আনারকলি । না ! ভুল হোলো । শুধু আনারকলি না সেলিম আনারকলি । এঁদের প্রেম কাহিনী জনপ্রিয়তায় লায়লা মজনুর প্রেম কাহিনীকে পাল্লা দিতে পারে বললে বোধহয় , এমনকিছু বাড়িয়ে বলা হবে না । তো বহুশ্রুত গল্পটা সংক্ষেপে মনে করা যাক ।
শাহেনশা আকবরের খাস বাঁদী ছিলেন নাদিরা বেগম বা সরিফ-উন -নিসা বেগম । তাঁর নৃত্য আর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে আকবর নাম রাখেন
আনারকলি । ১৪ বছর বয়সে শাহজাদা সেলিম যেদিন যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফেরেন সেদিন শাহেনশা শাহজাদাকে অভ্যর্থনা করতে এক মেহেফিলের আয়োজন করেন । আর সেখানেই আনারকলিকে প্রথম দেখেন শাহজাদা সেলিম ।এটাই প্রেম কাহিনীর শুরু । তারপর নাকি শাহেনশা এই কথা জানতে পারেন ও ক্রুদ্ধ হন । সেলিম বাবার বিরূদ্ধাচারণ করেন । পরিশষে আকবর আনারকলিকে জীবিত কবর দেও্য়ার আদেশ দেন ও তা কার্যকর হয় । না কাহিনী এখানে শেষ হয়নি । এরপর আরেকটু প্রচলিত আছে । আসলে আকবর গুপ্ত রাস্তা দিয়ে আনারকলিকে প্রাসাদের বাইরে বের করে দেন ।
এই কাহিনীর জন্ম পাকিস্থান , লাহোর । কিন্তু কতটা সত্যতা আছে এই গল্পের ? এবারে একটু অনুসন্ধান চালানো যাক ।
উল্লেখিত গল্পটিকে লিখিত রূপ দেন উইলি্য়াম ফিন্চ (১৬১১ খ্রী ) তাঁর ভ্রমন বিষয়ক জার্নালে । ১৬০৮ খ্রী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে জাহাঙ্গীরের কাছে নীল বিক্রির বায়না দিতে আসেন । তিনি লেখেন আনারকলি হলেন আকবরের খাস বাঁদী এবং তাঁর ছেলে দানিয়েলের মা , এবং শাহজাদা সেলিমের প্রেমিকা । তিনি ( আনারকলি ) মারা যান ১৫৯৯ খ্রী ।সেলিম তাঁর জন্য একটি স্মৃতিসৌধ বানাচ্ছেন ।
এই কাহিনীটাই লাহোরে প্রচলিত আর বর্তমানে নেটেও বহুল প্রচলিত ।
এটাই সেই আনারকলির স্মৃতিসৌধ
এই তথাকথিত স্মৃতিসৌধে লেখা আছে এটি আনুমানিক (১৫৯৯ - ১৬০০) খ্রী - ( ১৬১৫ - ১৬১৬ ) খ্রী মধ্যে তৈরী ।
যদি এই গল্পটা সত্যি বলে মেনে নেই , তাহলে কয়েকটি প্রশ্ন মাথায় আসে --
১ । ১৫৮৫ - ১৫৯৯ খ্রী আকবরের রাজধানী ছিল লাহোর । ১৫৯৯ খ্রী আবার তিনি রাজধানী আগ্রায় নিয়ে আসেন এবং ১৬০৫ খ্রী মৃত্যুদিন পর্যন্ত রাজত্ব করেন । গল্পমতে সেলিম এটা তৈরী করেন । কিন্তু সেলিম তো ১৬০৫ খ্রী বাদশা হন ।
আবার এমতে এটি আনুমানিক (১৫৯৯ - ১৬০০) খ্রী - ( ১৬১৫ - ১৬১৬ ) খ্রী মধ্যে তৈরী । তাহলে আকবর যাকে জীবিত কবর দেও্য়ার আদেশ দেন , তারই আবার স্মৃতিসৌধ করেন ?
২ । এটি আনুমানিক (১৫৯৯ - ১৬০০) খ্রী - ( ১৬১৫ - ১৬১৬ ) খ্রী মধ্যে তৈরী । মানে এটা করতে সময় লাগে ১৬ বছর । তারপরে তৈরী পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য্য তাজমহলেরও তৈরী হতে সময় লাগে ঐ ১৬ বছর ( ১৬৩২ - ১৬৪৮ ) খ্রী ।
এটা কি নিছক কাকতালীয় নাকি কপি পেস্ট গল্পের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে ?
৩ । শাহজাদা দানিয়েল শাহজাদা সেলিমের থেকে মাত্র ৩ বছরের মতো ছোটো । তা আনারকলি যদি দানিয়েলের মা হন , তাহলে শাহজাদা সেলিম তাঁর থেকে মাত্র ৩ বছরের মতো ছোটো ভাইয়ের মায়ের প্রেমে পড়তে পারেন ? ফিন্চের কি কিং অদিওপাসের কথা মনে পরে গিয়েছিল ?
৪ । জাহাঙ্গীর তাঁর লেখা জাহাঙ্গীরনামায় শাহি বাগিচার ফুল থেকে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পর্যন্ত সবকিছুরই বিবরন দিয়েছেন । কিন্তু এই স্মৃতিসৌধের কোনো উল্লেখ নেই ।
৫ । আবুল ফজল আকবর নামায় তিন শাহজাদার জন্মের সবিস্তার বর্ণনা করেছেন । আকবরের অনেক সন্তান ক্ষণজন্মা ছিল ।বহু প্রার্থনার পর আকবর আর জোধা বেগমের প্রথম সন্তান হয় যিনি শাহজাদা সেলিম । এরপর ক্ষীবা বেগমের গর্ভে হন শাহজাদা মুরাদ মির্জা । তারপর আবার জোধা বেগমের ( মরিয়ম -উজ - জুমানি ) গর্ভে হন শাহজাদা দানিয়েল যিনি আমেরে জোধা বেগমের বাবা রাজা ভারমলের কাছে মানুষ হন । জোধা বেগমের বাবা রাজা ভারমল কোন যুক্তিতে এক দাসীপুত্রকে মানুষ করবেন ?
৬ । আবুল ফজল স্পষ্টতোই লিখেছেন যে শাহজাদা দানিয়েল মামার প্রাসাদে বড় হওয়ার দরুন স্বেচ্ছাচারী ও সুরাসক্ত হয়ে পড়েন ।
৭ । একই কথা জাহাঙ্গীরও লিখেছেন । তাঁর জীবনীতে মুরাদকে শাহজাদা মুরাদ বললেও দানিয়েলকে সবসময় আমার ভাই দানিয়েল বলেছেন ।
এবারে দেখি শাহজাদা সেলিম কি মজনুর মতো প্রেমিক হতে পারেন ?
জাহাঙ্গীর ও নূরজাহান
ছোটো থেকেই আকবরের অত্যন্ত আদরের ছিলেন সেখু বাবা অর্থাৎ শাহজাদা সেলিম । তিনি ( জাহাঙ্গীর )গর্বের সাথে লিখছেন যে আকবর তাঁকে সবসময় সেখু বাবা অথবা বাবা বলতেন ।
আবুল ফজলকে জাহাঙ্গীর কোনোদিনই পছন্দ করতেন না । শাহজাদা সেলিম নিজে পার্সীতে কবিতা লিখতেন । আর ভাই দানিয়েল পার্সীর সাথে হিন্দুস্থানী অর্থাৎ হিন্দিতেও অসাধারণ কবিতা লিখতে পারতেন । আবুল ফজল এই হিন্দুস্থানী কবিতাগুলো আইন - ই -আকবরীর অন্তর্গত না করায় সেলিম তাঁর সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন । আর এই হিন্দুস্থানী কবিতাগুলোকে তানসেনকে দিয়ে সঙ্কলিত করান । তারপর সেলিমের ধারনাই জন্মে যায় যে আবুল ফজল শাহজাদার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেন । আবুল ফজলের মৃত্যুর পর তিনি শিশুর মতো লিখছেন ' মনে হচ্ছে আবার আমি আমার বাবাকে ফিরে পেলাম ।' অথচ নিজে সম্রাট হওয়ার পর আবুল ফজলের সুযোগ্য পুত্রকে উচ্চপদ দেন । তাই তাঁর মধ্যে আবেগ থাকলেও তাঁকে বাস্তববাদীই বলা চলে ।
আর সেলিম ও মেহেরুন্নিসার প্রেমের সাক্ষী আছে ইতিহাস । এখানেও তিনি বাস্তববাদী প্রেমিক । মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করার জন্য তিনি নিজে সম্রাট হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন ।
তাছাড়া জাহাঙ্গীর তাঁর জীবনীতে আকবরের মৃত্যু দৃশ্য যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা পড়লে পাঠকের চোখে জল আসতে বাধ্য ! এছাড়া ছোট বড়ো সববিষয়েই তিনি আকবরকে স্মরন করেছেন । তাই এহেন পুত্র আনারকলির জন্য বাবার বিরুদ্ধে যাবেন , সেটা কল্পনা করা কষ্টকর ।
সর্বোপরী জাহাঙ্গীরনামায় আনারকলি বা নাদিরা বেগম বলে কোনো শব্দ নেই ।
আনারকলির সন্ধান করতে গিয়ে জীবন্ত কবর নিয়ে একটি করুন কাহিনীর সন্ধান পেলাম । তবে সেটার কেন্দ্রবিন্দু শাহজাদা দানিয়েল ।
শাহজাদা দানিয়েল
আগেই বলেছি যে শাহজাদা দানিয়েল ছিলেন সুরাসক্ত । তাঁর নেশা এমন পর্যায় পৌঁছায় যে , আকবর আদেশ দেন যে তাঁকে সুরা এনে দেবে সেই ব্যক্তিকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হবে । এরপর কিছুদিন তাঁর নেশা বন্ধ থাকে । কিন্তু শাহজাদা দানিয়েল তা সহ্য করতে পারেন না । তিনি তাঁর এক অনুচরকে বলেন যে তাঁর প্রিয় বন্দুকের ( জেন্বৌজা ) নলের মধ্যে করে সুরা নিয়ে আসতে । সে তাই করে । আর শাহজাদা সেই সুরা পান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও মাত্র ৩২ বছর বয়সে মারা যান ।
জাহাঙ্গীর তাঁর জীবনীতে ভাইয়ের এই বন্দুকের জেন্বৌজা নামকরনকে অত্যন্ত অশুভ বলে ব্যাখ্যা করেছেন । আর দানিয়েল নিজে যে শায়েরীটি লিখে বন্দুকে খোদাই করেছিলেন সেটাও তুলে ধরেছেন । আমি সেটা নিজের মতো করে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি -
মৃগয়াতে যদি তুমি রাখো অঙ্গীকার
আমার নিঃশ্বাস হয় আনন্দের অংশীদার ।
কিন্তু তোমার স্পর্শ যে পায়
অনন্ত নিদ্রার কোলে সে যায় !
তো এই শাহজাদা দানিয়েলের বাগদত্তা ছিলেন খাঁ খানের কন্যা জানান বেগম । কিন্তু দানিয়েলের সাথে বিবাহ হয়ে ওঠেনা । আবুল ফজল লিখছেন এই জানান বেগম শাহজাদা দানিয়েলের মৃত্যুর পর সহমরনে জীবন্ত কবরে যেতে চান । কিন্তু এমন কোনো রীতি ধর্মত না থাকায় তাঁকে বিরত করা হয় । এরপর তিনি অনেক বছর বাঁচেন দানিয়েলের বিধবা হিসাবে । আবুল ফজল বলেছেন যে বহু বছর পরও তাঁকে দেখে এমন মনে হত যেন তিনি সদ্য বিধবা হয়েছেন । এমনভাবে তিনি শোক বহন করেছিলেন ।
আমি ইতিহাসবিদ নই । তবু পরিশেষে আমার মনে প্রশ্ন আসে আনারকলির গল্প কি সব কাহিনীর সংমিশ্রন ?
যাঁরা আনারকলির গল্প বিশ্বাস করেন তাঁদের কাছে অনুরোধ রাখবো একবার যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখার জন্য ।
কারন এই কাহিনী মহান সম্রাট আকবরকে কালিমালিপ্ত করার প্রচেষ্টা নয় কি ?
বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই রূপক বিধৌত সাধুকে ( Click This Link ) । কারন উনি আমার লেখা শাহেজাদীর শায়েরানা ( Click This Link ) পড়ে আনারকলিকে নিয়ে কিছু লেখার অনুরোধ করেছিলেন । আমার এই লেখাটা পড়ার যোগ্য হয়েছে নাকি জানিনা । কিন্তু ওনার জন্য আমার কিছু ইতিহাস পড়া হোলো । তাই ওনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
তথ্যঋণ -- আকবরনামা - আবুল ফজল
জাহাঙ্গীরনামা - সম্রাট জাহাঙ্গীর
দ্য কল অফ ব্লাড - রবার্ট হিকেন্স
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৬