তিনি কবিতা লেখেন। মনের আকুতি প্রকাশ করেন শব্দ-ছন্দ-ভাবে। কবিতার পাশাপাশি লেখেন ভাষার নিয়ম-কানুন সংক্রান্ত গ্রন্থ। এই কবি পারস্যের বাসিন্দা। বর্তমান ইরানের। একবার তাঁর ইচ্ছে হলো হজ্জ করার। শুরু হলো হজের প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতিতে তিনি একটি কাজ করেন। সেই কাজের কারণে তাঁর জন্য মদীনা প্রবেশের দরোজা বন্ধ হয়ে যায়। কার নির্দেশে? হ্যাঁ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে। কীভাবে? আল্লহর রাসুল (স.) তখনকার বাদশাহকে নির্দেশ দেন এই কবিকে মদীনায় প্রবেশ করে রওজা পাকে আসতে দেওয়া যাবেনা।
তিনি কী এমন কাজ করেছিলে! যে তাঁকে মদীনায় প্রবেশ করতে বারণ করা হলো? তার কাজটি আর কিছুই নয়। তিনি মনের আকুল আকুতি মিশিয়ে কিছু পংক্তি রচনা করেছিলেন। সেই পংক্তির আবেগ-আবেদন এতই তীব্র যে এসবের আবৃত্তি শ্রবন করে কারো পক্ষে নীরব থাকা সম্ভব নয়। সম্ভব ছিলনা রাসুলে আরাবী (স.)-এর জন্যও। তাই রাসূল নিজে স্বপ্নযোগে বাদশাহর কাছে বলেন- যদি এই কবি আমার রওজার পাশে এই কবিতাগুলো পাঠ করে তাহলে আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে যাবে তার সাথে মোসাফাহা করা।
আর কবি নিজেও কবিতাগুলো লিখেন- হৃদয়ের অতল হতে ভালবাসা এনে, আবগের সীমান্ত হতে ভাব এনে, চেতনার দিগন্ত হতে কামনা এনে, বিশ্বাসের চূড়ান্ত অনুভব দিয়ে, প্রেমের সুনির্মল আহ্বানে, শব্দের অবাক কারুকার্যে, বাক্যের অনিন্দ্য নির্মাণে, মিনতির শেষ প্রান্তে এসে বুকভরা বিশ্বাসের আশ্বাসে। হৃদয়ের আকুল অনুরাগ তিনি রাসুল সমীপে পেশ করবেন কাব্যের ছন্দ আর ভাবের অপূর্ব মিশেলে। রাওজার পাশে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করবেন নিজের কবিতা। আর রওজার অতল হতে শুনবেন স্বয়ং রাসুলে আরাবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
সুতরাং বাদশাহ এই অভূতপূর্ব ঘটনার বিবরণ স্বপ্নে রাসুলের (স.) কাছে পেয়ে। ভীষণ চিন্তায় মগ্ন হয়ে যান। তিনি তল্লাশি চালাতে থাকেন প্রতিটি হজ্জ কাফেলায়। যারা আসছে পারস্য হতে। একসময় কবিকে পেয়েও যান। তাকে অনেক খুঁজে পাওয়া যায় উটের পেটের যেখানে খাবারের পুটলা রাখা হয় সেখানে। তিনি পুটলার মত হয়ে লুকিয়ে প্রবেশ করতে চান মদীনায়। আসতে চান রওজায়ে আতহারে। রাসুলকে জানাতে হৃদয়ের আকুল অনুরাগ। অতপর তাকে বন্দী করে কয়েদ করা হয়। কিন্তু রাসুলের এমন প্রেমিককে কয়েদখানায় আটকে রাখাটা কি শোভা পায়? আবারও রাসুলের নির্দেশ আসে স্বপ্ন যোগে। বাদশাহ্ কবিকে সম্মান ও তাজিমের সাথে ছেড়ে দেন।
কিন্তু না! যার মনে আছে ভালবাসা আর অনুরাগের আবেগী দহন; তাকে কি সহজেই বারণ করে ফেরানো যায়। তিনি আবার রওয়ানা করেন মদীনার পথে। ল্য রওজায়ে আতহার। আচ্ছা তিনি কী রওজা পাকে যেতে পেরেছিলেন? বলছি একটু পরই। তার আগে জেনে নিই তার পরিচয়।
আগেই বলা হয়েছে। তিনি পারস্যের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি হলেন- কবি আব্দুর রহমান ইবনে আহমদ মোল্লা জামী। মোল্লা জামী নামে অধুনাকালে অধিক পরিচিত। তিনি নূরুদ্দীন ও আবুল বারাকাত নামেও পরিচিত চিলেন। ৮১৭ সালে জন্ম গ্রহণ করে ৯১৬ হিজরী সালে এই কবি পরম প্রিয়ের সান্নিধ্যে চলে যান। সমকালীন পারসিক কবিদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানেই ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত এই প্রেমিক কবি মদীনায় প্রবেশ করতে পারেননি। পূরণ হয়নি তার রওজার পাশে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তির আজন্ম লালিত স্বপ্ন। ব্যর্থ হয়েই তিনি ফিরে যান পারস্যে।
[তারঁ লেখা কবিতাগুলো থেকে একত্রিশটি কবিতা আমাদের হাতে এসেছে। কারো মতে কবিতা এই একত্রিশটিই। আবার কেউ বলেন আরো আছে। আমাদের প্রাপ্ত কবিতাগুলোকে। ভাবানুবাদ করেছি কাব্যে। তার ভষা আর ভাবের যে গভীরতা তার যথার্থ অনুবাদ আমার মত অধমের পে অসম্ভব। তাও আবার কাব্যে। তাই ভাটাকেই নিয়েছি। নবী প্রেমের নজরানা স্বরূপ। যদি মিলে যায় দিদার কখনো! সেই আমায় শত সীমাবদ্ধতা সত্বেও কবিতাগুলো অনুবাদের দুঃসাহস দেখলাম। প্রিয় পাঠক আমার দীনতা মা সুন্দর চোখে দেখবেন। এই আশায়...]
এই অনুবাদের সকল কৃতিত্ব ব্লগার জামিনদারের । তিনি গদ্যানুবাদ না করলে আমি এটার কথা ভাবতামই না। দীর্ঘকাল আগে তার ভাষা বিষয়ক গ্রন্থের কাসে এই ঘটনাটা শুনেছিলাম। বাট সময়ের আবর্তনে তার হারিয়ে গিয়েছিল বিস্মৃতির অতলে। ধন্যবাদ জামিনদার! অন্যভাবে বলা যেতে পারে এই অনুবাদটি একটি যৌথ প্রয়াস।
ব্যক্তি আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ ব্লগার নস্টালজিকের কাছে। রানা ভাইয়ের বিশেষ আগ্রহের কারনেই কাজটা দ্রুত শেষ করতে পারি। জামনিদারের পোস্টে একটা কবিতার কাব্যে অনুবাদ করার পর রানা ভাই এফবিতে আমাকে নক করেন। বলেন সুপান্থ যদি পুরো কবিতাগুলো ছন্দোবদ্ধ করতে পারো তাহলে সুন্দর একটি কাজ হবে।
“এমনিতেই নাচনি বুড়ি আরো পাইছে ঢোলের তুড়ি।” আমার হলো সেই অবস্থা। শুরু করলাম বিসমিল্লাহ বলে...
প্রেমার্ত কবির কাব্য গাথার ভাবানুবাদ প্রচেষ্টা
০১.
প্রিয় রাসূল দয়ার সাগর দাও বুলিয়ে
পূত তোমার দয়ালু হাত খানা
এই জগতের খণ্ডিত প্রাণ যায় বেড়িয়ে
দৃশ্যে এসে একটু করো মানা।
০২.
তুমিই রহম এই ধরণীর সন্দেহ নেই হৃদয় পুরে
কিন্তু কেন তোমার দয়ার ছায়া হতে বঞ্চিত হই
কেমন করে আনমনা হও জগৎ ছেড়ে দু'হাত দূরে
ঘুমে আছো নাইবা দেখো তবু তোমার উম্মতই রই।
০৩.
মুক্তোঝলক আমার নবী! বরফ-সাদা আলোর কিরণ
সেই কিরণে দাও করে দাও এই অবনীর সুখ উপকার
নারগিসেরই ফুলেল ঘুমে আর না থেকে আলোয় ভরো
মন আমাদের। চাই হেদায়াত; হেদায়াতের হও রূপকার।
০৪.
মোবারক শির হতে সরাও তোমার
ইয়ামানের চাদর-ঢাকা কাফন
তুমি এলে চোখের আগে আমার
হয় জীবনের সকাল আসার কারণ।
০৫.
ওগো নবী তোমার বিরহের যাতনায় দিনগুলো যেই
রাত হয়ে যায়। তখন তোমার রূপের ছোঁয়া নিতে এসে
দিবাকর ঠিক অস্ত যাবার আগেই আসে দৃষ্টি সীমায়
হৃদাকাশে লাগাতার সে উদয় হতে থাকে হেসে হেসে।
০৬.
পবিত্র সেই শরীর তোমার
আচ্ছাদিত মেষ্কাম্বরের আভরণে
মোবারক শির আবৃত যেনো
শুভ্র পাগড়ির দৃষ্টিকাড়া আবরণে।
০৭.
সুরভি মাখা পাগড়ি খানা
একটু ঝুলাও তোমার পূত শির ছেড়ে
বরকতি সেই ছায়া থেকে
হেদায়াতের আলোক মালা নেই কেড়ে।
০৮.
বিছিয়েছেন সারা জগৎ
তোমার মনের চাদর করে
সেই কারণে সকল জমিন
তোমার দেয়া চাদর ধরে
কদমবুচির অভিলাসে
এবং হাসে গৌরবে সে।
০৯.
তায়েফেরই প্রসিদ্ধ সেই রক্তমাখা
দু'টি জুতা আবার পায়ে দিয়ে
নতুন করে ডাকো এসে দ্বীনের পথে
তোমার কাছের স্বজন করে নিয়ে।
১০.
যেমন করে বাইরে যেতেন সবুজ গম্বুজ হতে
তেমন করেই আবার আসুন কাবা ঘরের পথে
বারান্দাতে তোমার আশিক তোমার পথে চলে
সেই সড়কে রাখুন কদম একটু সময় হলে
নাদান আমি পাক কদমের ধুলোয় চুমু খেতে
চাই আবেগে তোমার দিদার ভালোবাসায় পেতে।
১১.
অক্ষম আমার বিনয় ভরা এই আবেদন
বিবেচনা ছাড়াই তুমি একটু কবুল করো
দাও অনুরাগ ঘুচাই আমার মনের জ্বালা
আমি আছি খাঁটি প্রেমিক বিবেচনায় ধরো।
১২.
অপরাধের সাগর তলে ডুবে আছে
যদিও আমার মাথা-দেহ-প্রাণটা
তোমার পথে পিপাসার্ত শুষ্ক দু'ঠোঁট
নিয়ে তবুও লেপ্টে আছে জানটা।
১৩.
তুমি রহমত বারিধারা মুক্ত হাতের
খোলা দাতা (এই পৃথিবীর অবস্থানে)
পিপাসার্ত শুকনো দুটি চাতক ঠোঁটে
করুণাজল দাও না ঢেলে প্রেমের টানে।
১৪.
অনেক ভালো হতো মোদের হতাম সবাই ধন্য
যেতাম যদি তোমার কাছে খাদেম হবার জন্য
যেভাবে হোক পৌঁছুতে চাই দূর মদীনার দেশে
রওজা পাকের মাটি হতে সুরমা দিবো হেসে।
১৫.
আমার নবীর মসজিদেতে শোকর জানাই হেসে
কৃতজ্ঞতায় সিজদা করি নেই তুমি তাও এসে;
রওজা হতে আলোর কিরণ, সিজদাগুলো যতো
আমার প্রাণের দু:খবোধের পালক যদি হতো-
প্রেমের টানে যেতাম আমি হয়ে ব্যাকুল পাখি
রওজা পাকে থাকতো চেয়ে অবুঝ দুটি আঁখি।
১৬.
প্রিয় নবী ওগো আমার পবিত্র সেই রওজা তোমার
এবং আরো সবুজ গম্বুজ আমায় এতো দগ্ধ করে
কলজে যেন চালনি এখন প্রেম-বিরহীর ছিদ্র আধার
প্রিয় নবীর দিদার-আশা আমার ভেতর গোমরে মরে
অঝর ধারায় বৃষ্টি ঝরায় ভাগ্যলিপির চোখের মেঘ
রওজা পাকে মাতম করে বাড়াই মনে প্রেমের বেগ
১৭.
হেরেম শরীফ বারান্দাতে দিচ্ছি ঝাড়ু
স্বপ্ন আশা ভাগ্যে আমার অর্জিত হোক
কখনোবা চারিপাশে ঘাস কেটে যাই
দেখুক চেয়ে ফেরেশতা বা হাজারো লোক।
১৮.
তোমার প্রেমে অশ্রু ছেড়ে দুচোখ আমার দৃষ্টি হারা
নেই কামনা হৃদয় পুরে তোমার নূরের আলো ছাড়া
অন্ধ থাকাই; দিদার আশায় অশ্রু ফেলে করছি বরণ
বিরহী মন তোমায় পেয়ে করবে সুখের স্মৃতি বহন।
১৯.
কদম তোমার যেথায় ছিল ইচ্ছে করে
সেই মিম্বরে ভালোবাসায় ছুটে চলি
প্রেম ক্ষুধার্ত চোয়াল দুটি সেথায় ডলে
পিয়াস মিটাই এবং শান্ত হতে বলি।
২০.
যে মেহরাব আর মুসল্লাতে সালাত আদায় করতে তুমি
সেই ভূমিতেই তৃপ্তি ভরে নামাজ আদায় করবো চুমি
দুটি রাকাত সালাত আমার হোক না তোমার মুসল্লাতে
জায়নামাজে পা মুবারক থাকতো তোমার যেখানটাতে
সেই জাগাটা ভালবাসার রক্ত দিয়ে চাই ধুয়ে দেই
বিনিময়ে অনুরাগের নজরানাটা দেই তোমাকেই।
২১.
নবী তোমার মসজিদেরই মিম্বরেতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে
দরখাস্ত পেশ করছি আমি সত্যবাদি সাক্ষি দু’জন পাশে লয়ে।
২২.
নবী তোমায় ভালবেসে বাড়ছে যখম
মনের ক্ষত; করছে ধারণ চুড়ান্ত রূপ
উদ্ভাসিত হচ্ছে মনের গোপন আশা
দু:খরা আজ জবাব-হারা অনন্ত চুপ।
২৩.
আমার দেহ নেই তা জানি ‘আল্লাহ তোমার ঘরে’
শুকরিয়া তাও করছি আমি জগৎ খোদার তরে;
কিন্তু জেনো দগ্ধ আমার আত্মা খানা ঠিকই
আছে তোমার ঠিকানাতে রওজা পাকের ঘরে।
২৪.
আমিত্ব আর দুরাত্মাদের জালে আমি
আটকে গেছি কঠিনভাবে
অক্ষম হয়ে আশায় আছি আমার দিকে
তোমার দয়ার দৃষ্টি যাবে।
২৫.
তোমার দয়ার দৃষ্টি যদি
না পাই আমি নিরবধি
কিংবা তোমার সাহায্যটা
আমায় ছেড়ে লাগায় হাটা
অক্ষমতা আসবে কাজে
পঙ্গু হয়ে মরবো লাজে।
২৬.
প্রতিদিনই নাশুকরিয়া অহংকারে
বঞ্চিত রই সরল পথের অলংকারে
দয়া করুন প্রভুর কাছে দুয়া করে
ক্ষমা দিতে আমাদেরে মরার পরে।
২৭.
প্রথম দুয়া করো নবী আল্লাহ যেন
নিখাঁদ ঈমান দেন সবারই অন্তরে
আকাঈদের প্রকাশ যেন করতে পারি
সারম্বরে এই জীবনের বন্দরে।
শিশাঢালা প্রচীর হয়ে অটল থাকার
দাওগো দুয়া খোদার অধম বান্দারে
দ্বীনের পথে পূর্ণরূপে থাকার সাহস
আমার যেন না যায় কভু আন্ধারে।
২৮.
যখন হবে কিয়ামতের বিভিষিকার পরিস্থিতি
রাসুল আমার করো দুয়া দুহাত তুলে
বিচার দিনের মালিক যেনো দোযখ না দেন
ইজ্জত আমার রক্ষা করেন গুনাহ ভুলে।
২৯.
দৃষ্টি মোদের অন্ধ হলো দেখিনা তো অপরাধ আর পাপগুলোকে
অদেখা সব পাপের বোঝা মার্জনা হোক করছি যতো এই ভূলোকে
ক্ষমার পরে আল্লাহ যেনো শাফায়াতের অনুমতি তোমাকে দেন
কারণ সেদিন সুপারিশের ক্ষমতাটা জানি কেবল তিনিই দেবেন।
৩০.
আমাদেরই অপরাধে নবী তোমার লজ্জাতে শির না হোক নত
নত মাথার কারো মতো( নিজের বাঁচার) কামনাতে না হও রত
তোমার কাছে করছি দাবী হাশর দিনে সহায় হারা মোদের জন্য
রবের কাছে ইয়া উম্মাতি বলে তুমি আরজু জানাও শত শত।
৩১.
রাসুল তোমার দুয়া পেলে আশা আছে
পাপীর মনে; আগলে থেকে দয়ার ডানায়
মুক্তি মিলে যেতেও পারে বান্দা নেকের
সাথে আমার গুনা’য় ডুবা জামি’র খাতায়।
উৎসর্গ:
ব্লগার নস্টালজিক