একদিন বিকেলে পড়াতে যাচ্ছিলাম। শীতের বিকেল। রিকশা ঠিক করতে গিয়ে দেখি পিচ্চি এক ছেলে। শুকনা মত, বয়স ১৫/১৬ হবে। গায়ে কোন গরম কাপড় নাই। দেখে মনে হল এতো নিজেকেই টানতে পারবেনা রিকশা টানবে কি? জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে, চালাতে পারবি?”। পিচ্চি বলে, “হ্যাঁ, পারব”। দেখে খুব মায়া হচ্ছিল। উঠবো কি উঠবোনা ভাবতে ভাবতে উঠেই গেলাম। দেখে শুকনা মনে হলে কি হবে, সে ঝড়ের বেগে চালানো শুরু করল। যদিও আমার তাড়া ছিল তাও বাধ্য হয়ে আমিই আস্তে ধীরে যেতে বললাম। যেতে যেতে তার কাহিনী জানতে চাইলাম। রিকশাটা তার বাবার। বাবা অসুস্থ, ঘরে খাবার নাই। সে রিকশা চালিয়ে যা রোজগার করবে দিন শেষে তাই দিয়ে চাল-ডাল,তরিতরকারি কিনে নিয়ে যাবে। তারপর খাওয়া হবে সবার। সকালেও কিছু খায়নি ছেলেটা। শুনে আরও খারাপ লাগল। শীতের কাপড় নাই কেন জিজ্ঞেস করাতে বলল, “খাওয়ার টাকাই নাই, শীতের কাপড় কিনব কেমনে?”। গন্তব্যে পোঁছে আমি ভাড়া বাদে আরও কিছু টাকা দিয়ে বললাম, “এটা দিয়ে আজকেই সোয়েটার কিনে ফেলবি”। ব্যাগে কিছু শুকনা খাবার ছিল। সেটা খাওয়ার জন্যে দিয়ে আমি ওপরে উঠে গেলাম।
মাসখানিক পরের কথা। বাসা থেকে এসেছি মাত্র। হোস্টেল গেইটে সিএনজি থামল। বিশাল জার্নির পর ক্লান্ত, অবসন্য শরীর। ব্যাগটা রুমে দিয়ে আসার জন্যে দারোয়ানকে খুঁজছি। আশেপাশে কোথাও তার দেখা পেলাম না। তখনি একটা পিচ্চিকে দেখে ডেকে বললাম, “বাবু, আমার ব্যাগটা একটু উপরে নিয়ে আয় তো”। আরে তাকিয়ে দেখি সেই রিকশাওয়ালা পিচ্চি ছেলেটা। গায়ে সোয়েটার নেই।জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে, তোর সোয়েটার কই? কিনিস নাই?”। বলে, “হ্যাঁ আপা, কিনসি। শীত লাগেনা তাই পরি নাই”। একটু অবাক হলাম। রুমে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম তার বাসার খবর, বাবার শরীর কেমন এসব। এসবের মাঝে হঠাৎ সে নিজেই বলে, “আপা, আজকেও কিছু খাই নাই”। তো আজও আমি তাকে অতিরিক্ত কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করলাম।
তারও কিছুদিন পরের কথা। কাজ সেরে আমি আর অনন্যা ফিরছি হোস্টেল এ। এদিন আর আমি খেয়াল করিনি। গেইট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে অনন্যা বলল, “এখানে একটা রিকশাওয়ালা ছেলে দাড়িয়ে থাকে আর সবাইকে বলে তার বাবা অসুস্থ, ঘরে খাবার নাই। সে আমাকে একদিন বলেছে, ফারজানাকে একদিন বলেছে”। তার কথা শেষ হবার আগেই আমি বললাম, “আমাকে দুইদিন বলেছে”। পুরো ব্যাপারটা এক ধরনের ধাপ্পাবাজি বুঝতে পেরে মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেলো। অনন্যা বলল, “সেকি বুঝেনা আমরা একি জায়গায় থাকি? সবাইকে এক কথা বলে। কি জানি, বয়স কম তো তাই এখনো ভালো করে চাপাবাজি শিখে উঠতে পারে নাই হয়ত”। আমারও মনে হল মানুষের আবেগ নিয়ে খেলতে শিখে গেছে এতো অল্প বয়সেই। এদের কারনে তো যারা সত্যিই অসহায় তাদেরও ধাপ্পাবাজ মনে হবে এরপর থেকে। অবশ্য এর আর কি দোষ দেব সারা দুনিয়াটাই তো চলছে এভাবে!! কদিন পর মানুষের হয়ত আবেগ বলে কিছু থাকবেই না।