ইয়াজুজ ও মাজুজ হলো নূহে (আঃ) এর তৃতীয় পুত্র জ্যাপেথের সন্তান। এই দুই সন্তান মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রজাতির অদিপুরুষ। তারা তাদের প্রজাতির কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষদের অত্যাচার করত এমনকি সভ্যতা ধ্বংস করে দিতেও দ্বিধাবোধ করতো না। পবিত্র কুরআন, তাওরাত ও অন্যান্য ঐতিহাসিক গ্রন্থের আয়াত অনুযায়ী এইসব উপজাতিরা এশিয়ার উত্তর পূর্ব অংশে বাস করতেন এবং তারা এশিয়ার দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশে ধ্বংসলীলা চালাতো।
কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে তারা মস্কো এবং তবলস্ক এর কাছাকাছি বসবাস করত। অন্যদের বিশ্বাস যে এই উপজাতিরা চীন তুর্কিস্তান আর্কটিক মহাসাগরের পাশাপাশি তিব্বতের মধ্যবর্তী অধ্যুষিত স্থানে বসবাস করত। হযরত যুলকারনাইনের(আঃ) এর যুগে ইয়াজুজ ও মাজুজ উপজাতিরা অন্যান্য সভ্যতার উপর নির্দয়ভাবে হামলা চালায়। যুলকারনাইন তার লোকদের রক্ষা করার জন্য পর্বতমালার মধ্যস্থলে একটি অতি বৃহৎ প্রাচীর সৃষ্টি করেন। এই প্রাচীর সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সূরা আল-কাহাফ এ উল্লেখ আছে।
ইয়াজুজ মা’জুজ বনী আদমের অন্তর্ভুক্ত দু’টি জাতি। তারা বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ তাআ’লা যুল-কারনাইনের ঘটনায় বলেনঃ
)حَتَّى إِذَا بَلَغَ بَيْنَ السَّدَّيْنِ وَجَدَ مِنْ دُونِهِمَا قَوْمًا لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ قَوْلًا قَالُوا يَاذَا الْقَرْنَيْنِ إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ فَهَلْ نَجْعَلُ لَكَ خَرْجًا عَلَى أَنْ تَجْعَلَ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ سَدًّا قَالَ مَا مَكَّنَنِي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا آتُونِي زُبَرَ الْحَدِيدِ حَتَّى إِذَا سَاوَى بَيْنَ الصَّدَفَيْنِ قَالَ انفُخُوا حَتَّى إِذَا جَعَلَهُ نَارًا قَالَ آتُونِي أُفْرِغْ عَلَيْهِ قِطْرًا فَمَا اسْتَطَاعُوا أَنْ يَظْهَرُوهُ وَمَا اسْتَطَاعُوا لَهُ نَقْبًا قَالَ هَذَا رَحْمَةٌ مِنْ رَبِّي فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ رَبِّي جَعَلَهُ دَكَّاءَ وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا(
“অবশেষে যখন তিনি দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যস্তলে পৌঁছলেন, তখন তিনি সেখানে এক জাতিকে পেলেন, যারা তাঁর কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বলল, হে যুল-কারনাইন, ইয়াজুজ ও মা’জুজ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আপনি বললে আমরা আপনার জন্য কিছু কর ধার্য করব এই শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রচীর নির্মাণ করে দিবেন। তিনি বললেন, আমার পালনকর্তা আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। অতএব, তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দিব। তোমরা আমাকে লোহার পাত এনে দাও। অবশেষে যখন পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে গেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা হাঁপরে ফুঁক দিতে থাক। অবশেষে যখন তা আগুনে পরিণত হল , তখন তিনি বললেন, তোমরা গলিত তামা নিয়ে আস। আমি তা এর উপর ঢেলে দেই। অতঃপর ইয়াজুজ ও মাজুজের দল তার উপরে আরোহণ করতে পারলনা এবং তা ভেদ করতেও সক্ষম হলনা। যুল-কারনাইন বললেন, এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ। যখন আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত সময় আসবে, তখন তিনি একে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন এবং আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুতি সত্য।” (সূরা কাহাফঃ ৯৩-৯৮) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى يَا آدَمُ فَيَقُولُ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِي يَدَيْكَ فَيَقُولُ أَخْرِجْ بَعْثَ النَّارِ قَالَ وَمَا بَعْثُ النَّارِ قَالَ مِنْ كُلِّ أَلْفٍ تِسْعَ مِائَةٍ وَتِسْعَةً وَتِسْعِينَ فَعِنْدَهُ يَشِيبُ الصَّغِيرُ ( وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ ) قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَأَيُّنَا ذَلِكَ الْوَاحِدُ قَالَ أَبْشِرُوا فَإِنَّ مِنْكُمْ رَجُلًا وَمِنْ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ أَلْفًا
“আল্লাহ তাআ’লা কিয়ামতের দিন আদম (আঃ)কে ডাক দিবেন। আদম (আঃ) বলবেন হে আল্লাহ আমি আপনার দরবারে হাজির আছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার বংশধর থেকে জাহান্নামী দলকে পৃথক কর। আদম (আঃ) বলবেন, জাহান্নামের দল কারা? আল্লাহ বলবেন, প্রত্যেক এক হাজারের মধ্যে থেকে নয়শত নিরানব্বই জন। তখন কোলের শিশু বৃদ্ধ হয়ে যাবে। গর্ভবতী মহিলারা সন্তান প্রসব করে দেবে। মানুষদেরকে আপনি মাতাল অবস্থায় দেখবেন। অথচ তারা মাতাল নয়। আল্লাহর আযাব খুবই কঠিন। ছাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে থেকে কে হবে সেই এক ব্যক্তি? নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, সুসংবাদ গ্রহণ কর, তোমাদের মধ্যে থেকে হবে সেই এক ব্যক্তি। আর বাকীরা হবে ইয়াজুজ-মাজুজের দল।”
ইয়াজুজ-মাজুজের দল বের হয়ে আসা কিয়ামতের অন্যতম আলামত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর যুগেই ইয়াজুজ-মাজুজ বের হওয়ার লক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে। উম্মে হাবীবা (রাঃ) এর হাদীছে আছে, তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা পেরেশান ও রক্তিম চেহারা নিয়ে আমাদের কাছে উপস্থিত হলেন। তিনি বলছিলেনঃ
)لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مِثْلُ هَذِهِ وَحَلَّقَ بِإِصْبَعَيْهِ الْإِبْهَامِ وَالَّتِي تَلِيهَا(
“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আরবদের জন্য ধ্বংস অনিবার্য। অকল্যাণ নিকটবর্তী হয়ে গেছে। ইয়াজুজ-মাজুজের প্রাচীর এই পরিমাণ খুলে দেয়া হয়েছে। এই বলে তিনি হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনি আঙ্গুলি দিয়ে গোলাকৃতি করে দেখালেন।”
যুলকারনাইন(আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি কে ছিলেন? পণ্ডিত এবং দার্শনিকদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যুলকারনাইন সম্পর্কে অনেক মতভেদ আছে, অনেক পন্ডিত মনে করেন যে, যুলকারনাইন ছিলেন আসলে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। কেউ ধারণা করেন যে যুলকারনাইন আসলে বাদশাহ সোলেইমানের একটি উপাধি। এই মতের সাথে অনেকেই দ্বিমতপোষন করেন। আধুনিক যুগের দার্শনিকরা মনে করেন যুলকারনাইন পারস্য অধিপতি সাইরাস দ্য গ্রেটের নাম ছিলো। তবে এখনও যুলকারনাইন এর পরিচয় নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।
কুরআনের আয়াত অনুযায়ী, যুলকারনাইন আল্লাহর রহমতে অসাধারন সম্পদশালি ছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিমের দেশগুলো দখল করার পর তিনি ইয়াজুজ আর মাজুজ প্রজাতির আবাসস্থলের কাছাকাছি এক পর্বতশ্রেণীর সীমারেখায় অবস্থান করেন। সূরা আল-কাহাফের আয়াত অনুযায়ী, যুলকারনাইন উত্তর দিকে তার অভিযানের সময় একটি পাহাড়ী অঞ্চলে আসেন। এখানে তিনি একটি অস্বাভাবিক প্রজাতি যারা সম্পূর্ণ এক অপরিচিত ভাষায় কথা বলে তাদের দেখা পান। তিনি অনুবাদক এর মাধ্যমে তাদের সাথে কথোপকথন শুরু করার পর তিনি জানতে পারেন যে এই মানুষগুলো ইয়াজুজ ও মাজুজ দ্বারা অত্যাচারের কারণে বিধ্বস্ত হয়ে আছে। তারা তাঁকে তাদের এবং ইয়াজুজ ও মাজুজ প্রজাতির মানুষের মাঝখানে একটি দেয়াল নির্মাণের জন্য বলে।
অতএব, যুলকারনাইন (আঃ) তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর নির্মাণ করলেন। আর এ প্রাচীর রূপক অর্থে নয়, বাস্তবিকেই ছিল। এটি গলিত ব্রোঞ্জ ও ইস্পাত থেকে তৈরি করা হয়। এটি নির্মাণ করে সাময়িকভাবে ইয়াজুজ ও মাজুজ প্রজাতির ধ্বংসলীলা বন্ধ করা হয়। যুলকারনাইন (আ) মানুষ রক্ষার এই ঐশ্বরিক সাহায্যের জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। তবে, তিনি তাঁর লোকদের বলেছিলেন যে, এই প্রাচীর অমর নয় এবং আল্লাহর অঙ্গীকার অনুযায়ী তা একসময় ভূপাতিত হবে। এবং আল্লাহ কখনও তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। এখন প্রশ্ন রয়ে যায় যেখানে এই প্রাচীর কোথায় অবস্থিত।
এর অবস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। তাদের মতানুযায়ী মানবতার বিভিন্ন যুগে এর মত পাঁচটি আলাদা দেয়াল রয়েছে, গ্রেট ওয়াল অফ চায়না যার মধ্যে একটি। তবে এটি মাটির ইট নয়, বরং গলিত ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি হয়। কিছু ঐতিহাসিক মনে এই মহাপ্রাচীর আসলে ইয়েমেনে অবস্তিত ওয়াল অফ মারিব। যাইহোক, এই প্রাচীর একটি বাঁধ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। pakistantv.tv দ্বারা সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, এই প্রাচীর ব্রোঞ্জ ও লোহার তৈরি নয়। একইভাবে, ধর্মীয় বিশারদদের মতানুযায়ী, এটি কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী অবস্থিত ককেশাস পর্বতশ্রেণী। এই পর্বতশ্রেণীর একটি অংশ বিশুদ্ধ লোহা দ্বারা তৈরি যা খালি চোখে দেখা যায়।
যদিও এই প্রাচীর এতটাই শক্তিশালী যে ইয়াজুজ ও মাজুজের মত এমন শক্তিশালী প্রজাতির পক্ষেও এটি ভাঙা সম্ভব নয়। যাই হোক, আল্লাহ তা'আলা তার অঙ্গীকারকৃত সময়ানুযায়ী একে টুকরো টুকরো করে দেবেন। আর এই অঙ্গীকার রয়েছে ইয়াজুজ ও মাজুজ প্রজাতির কাছে, শেষ বিচারের দিনের পূর্বে।
নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর হাদীস অনুযায়ী, যেমন - সহীহ বুখারি অনুযায়ী জানা যায়, ইয়াজুজ ও মাজুজ প্রতিদিন গর্ত তৈরি করে কিন্তু তারা তা শেষ করতে পারে না। এবং যখন তারা পরের দিন ঘুম থেকে উঠে, গর্ত ভরাট হয়ে যায় এবং তারা আবারও নতুন করে গর্ত করা শুরু করে। তবে, কেয়ামতের দিন যত কাছাকাছি আসবে, একদিন তারা বলবে যে, আমরা 'ইনশাল্লাহ " গহ্বরটি আগামীকাল শেষ করব। সেদিন হবে ঐদিন, যেদিন ইয়াজুজ ও মাজুজ প্রজাতির পুনরত্থান হবে এবং তাদের অন্যায় কাজ আবার চালু হবে।
ইয়াজুজ ও মাজুজ প্রজাতির অত্যাচার থেকে মানুষকে রক্ষা করতে আল্লাহ ঈসা (আ) কে ভালো মানুষদের রক্ষা করার আদেশ দিবেন। ঈসা (আ) আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবেন এবং ইয়াজুজ ও মাজুজ সম্প্রদায় এক মহামারি ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হবে। বিশ্বের প্রতিটি ইঞ্চি ইয়াজুজ ও মাজুজ সম্প্রদায়ের মানুষের লাশে ভরে যাবে। অতঃপর আল্লাহ বিশালাকার পাখি পাঠাবেন এবং তারা সরিয়ে নেবে। তারপর একটি বৃষ্টি দিয়ে সমগ্র বিশ্ব ধোয়া হবে এবং এটি আবার উর্বর হয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:৫৪