দেশবাসী হেফাজতের নাম তেমনভাবে জানত না, যখন আমি হাটহাজারিস্তানে যাই। আপনারা কথায় কথায় আল্লামা শফী, জুনায়েদ বাবু নগরীকে নিয়ে হাসাহাসি করেন, আমার গল্পটা সেজন্য। আমি বাবা-মার ভয়ঙ্কর অবাধ্য সন্তান। মেডিকেল কলেজে ওঠার পর আমার অবাধ্যতা সীমা অতিক্রম করে। অচীরেই চরম বিশৃঙ্খল জীবনে আমাকে পেয়ে বসে। আমার পিতা অবাধ্য সন্তান বশীকরণে আমাকে নিয়ে হাট হাজারিস্তানে যাওয়ার বুদ্ধি করেন। আব্বা প্রচন্ড ধর্ম পরায়ন একজন মানুষ। একটা উদাহরণ দিই। আমি আর বাবা বর্তমান সময়ের তুলনায় অনেক বেশী বন্ধুভাবাপন্ন। আমরা একিসাথে প্রচুর কাজ করেছি বন্ধুর মত, সে ডাক্তারী হোক, হজ্জ্ব করা হোক। আব্বার সাথে চড়িনি খালি নাসার রকেটে আর মটর সাইকেলে। আমি আর বাবা একি সাথে আরব দেশে যাই। আব্বার সাথে যাওয়ার মেইন সমস্যা হল বিড়ি খাওয়া যায় না আর দ্বিতীয়ত হল খাওয়া ছাড়া আব্বার যাবতীয় ব্যাপারে মিতব্যয়িতা। এটাকে আব্বার মুখের উপরই বলি আপনি এত কিপটা ক্যান? জবাবে আব্বা বলছিল, দুই টাকা বাচাইলে ইন ফিউচারে কে খাবে, আমি না তুই? অবশ্য কস্ট করার ব্যাপারে আব্বার সাথে সামান্য মিল থাকায় আমার তেমন কিছু হয় না।
আব্বার সাথে যখন আরব দেশে ফ্লাই করি, সেদিন খুব সম্ভব দ্বিতীয় রমজান। রোজা রাখার ব্যাপারে হুজুর বেশ গোপনীয়তা অবলম্বন করেন, এবিষয়ে হুজুরের বক্তব্য হল-হুজুরের এলেম নিয়া সন্দেহ? যাইহোক, বলা বাহুল্য, আব্বা রমজানে অসুস্থতাকেও ন্যুণতম পাত্তা দেন না। আব্বার বয়স আপনাদের অনেকের নানাভাই এর কাছাকাছি। বরাবরের মত প্লেনে এটা সেটা খেয়েই যাচ্ছি, তাবত লোকের মাঝে আমরা কয়েকজন রোজা রাখিনি, ধাই-ধাই করে খেয়ে যাচ্ছি, পয়সা দিয়ে প্লেনে উঠসি, খাব না ক্যান? সেবার শুরুর দিকে রোজা ছিল প্রায় ষোল সতেরো ঘন্টা। বাংলাদেশ থেকে ৪টার সময় ফ্লাই শুরু হয়, ইফতারি ছিল ছয়টা পঞ্চাশ এর দিকে। উল্লেখ্য বাঙ্গলাদেশের সাথে আরব দেশের সময়ের পার্থক্য ছয় ঘন্টা। প্লেনে সবাই টাইম মিলায়ে ইফতারী করে ঈদ লাগায়ে ফেলল, আমি আরো একদফা খাইলাম, আব্বা নীরব, আমি বললাম, আব্বা খাবেন না? আব্বা হাসেন! আব্বা এজমার পেশেন্ট, টয়লেটে গেলেও তিনি ইনিহেলার নিয়ে যান, দুটো ইনহেলার অস্ত্রের মত তিনি লুঙ্গিতে নিয়ে মার্সেনারি বনে যান! আব্বা খেলেন না। আব্বা ইফতারী করলেন রিয়াদ এয়ারপোর্টে নেমে। ছয় ঘন্টার পার্থক্য ডুড!!! আরব দেশে সন্ধ্যা ৭টা বাজে, বাংলাদেশ সময় রাত একটার সময়, এবার বুঝে নেন পপ্স কি জিনিস! তিনি আল্লাহ কে তার ঈমানের প্রতি আনুগত্য দেখাতে পছন্দ করলেন! কারণ সুর্যাস্ত প্লেনে বসে কি দেখা যায়? সাওম তো সূর্যোদ্যে শুরু, সূর্যাস্তে শেষ!
হাট হাজারিস্তানের গল্পে ফেরত যাই। আমি কিভাবে কিভাবে গেসি আমার মনে নাই। আমরা চিটাগং এর গভীর ভেতরে প্রবেশ করি। বেশ কয়েকবার বাস, সিএনজি ইত্যাদি পাল্টায়ে হাটা পথে গহীন থেকে গহীন গ্রামে অপূর্ব সুন্দর এক ইসলামী স্থাপত্য, মাদ্রাসা আর এতীম খানায় ঢুকি। আজ থেকে ৮ বছর আগের কথা বলছি...আব্বারা মসজিদে ঢুকে দাখালাল মসজিদের নামায আদায় করেন, আমি চিকনে যাই একটা বিড়ি খেতে। বিড়ি টিড়ি খেয়ে আশ পাশের সাজ সজ্জা, রান্নার বহর দেখে বুঝলাম আজ মাদ্রাসার বার্ষিক কোন মাহফিল। নামাজের পর খাওয়ার পালা। আরব দেশের স্টাইলে খাওয়ার ব্যবস্থা। একের পর এক খাবারের আয়োজন, আমার চোখ কপালে উঠে গেল, দরিদ্র মাদ্রাসায় এত খাবার! আমি একজন বুযুর্গকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি এতিম খানায় ও খাওয়ানো হবে? উনি সুন্দর একটা জবাব দিলেন, বাবা এটা শুধুই নিমন্ত্রিত অতিথিদের সম্মানে। কোন স্কুল কলেজের বার্ষিক দিনে যেরকম খাওয়া হয়, শিক্ষকেরা যেভাবে খান, ছাত্ররা কি সেভাবে পায়? আমি ঢাকার অনেক নামী-দামী স্কুলে পরেছি, আমি সত্য জবাব দিলাম, না! উনি বললেন তাহলে? অথচ তুমি আশা করছ ছাত্রদের খাওয়ানোর জন্য! আমি বললাম ওরা মেহমানদারি করছে যে? আল্লাহর রাসূলের অতিথিপরায়নতার কথা তুমি জান, নতুন করে কি কিছু বলার আছে?
মজার ব্যাপার হল, আমার সাথে শফি হুজুর, বাবু-নগরী সবার সাথেই দেখা হয়। আন্তরিকভাবে, বিনয়ের সাথে, আদব-কায়দাভরে তারা আমাদের আতিথেয়তা করেন। আব্বা আমার জন্য বিশেষভাবে দোয়া চান হুজুরদের কাছে। সত্যি কথা বলতে আমি একজন লোকের বাড়িতেও যাই, বাঙ্গলাদেশে পর্দার এত কঠিন রূপ আমি সেখানে দেখি। যাবতীয় আপ্যায়ন করেন বুযুর্গ আলেম ব্যক্তি নিজেই। আমি কোন মহিলা সে তার স্ত্রী কিংবা কণ্যা হোক, আমি শব্দ ও পাইনি, অথচ আমি পুরো একটি দিন সেই বাড়িতেই ছিলাম!
তারা কি পরিমান জ্ঞাণী, তাদের আন্তরিকতা কতটুকু এ বিষয়ে আপনাদের প্রশ্ন থাকলে আমি বলব আপনি নিজে যেয়ে মিশে দেখুন, এবসলুট জেন্টলম্যান এবং একি সাথে প্রচন্ড জ্ঞাণী কিভাবে থাকেন। তাদের পরিচ্ছদ বহু ব্যবহারে মলিন, কিন্তু তাদের নূরে, তাদের প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল। মানুষ ইসলামের চর্চা করছে সর্বত্র। শফী হুজুর কিভাবে থাকেন, কি খান ইত্যাদি দেখলে আপনারা লজ্জা পাবেন। তাদের কোন সমস্যা নাই, যাই হোকনা কেন, হাসি মাখা মুখে আলহামদুলিল্লাহ বলতে তারা অভ্যস্ত! আল্লামা শফী নারিদের কে তেতুল বলেছেন, আপনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন সুন্দরী নারী আপনাকে আকর্ষণ করে না? আপনারা কত বড় আলেম কে অবহেলাভরে ডাকেন আপনাদের নিজেদের ও জানা নেই। তাদের মত আলেম, ইসলামের সেবক কে নিয়ে আপনারা মজা করেন! তাদের জ্ঞানের ধারে কাছেও আপনারা নাই, এটলিস্ট আমি একজন এম বি বি এস পাশ করা, শহরে জন্মানো, উচ্চ শিক্ষিত একজন ছেলে, আমি সার্টিফাই করছি, আপনারা তাদের দেখলে লজ্জা পাবেন! তাদের নাম নিয়ে মজা করানোর জন্য পা ধরে ক্ষমা চাইবেন!
একটা জিনিস ই খারাপ লেগেছিল, হুজুর কতকের মাঝে কয়েকজনের পান খাওয়া! আমি নিজে সিগারেট খাই, কিন্তু পান জিনিসটা কিভাবে খায় আমার মাথায় আসে না।
আমরা আলেমদের সম্মান করতে পারছিনা বলেই আমাদের ক্লাস সিক্সের বইয়ের এই অবস্থা, আপনারা বুঝতে পারছেন, কোর আন শরীফের আয়াত নিয়ে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা মাধ্যমে এতবড় ভুল, তাও আল্লাহর পাক কালাম নিয়ে কি ভয়াবহ অপরাধ? এই অপরাধদের দায় কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের একার নয়, পুরোজাতির উপর বর্তাবে। আল্লাহ আমাদের শাস্তি দিবেন কিনা আল্লহ ভালো জানেন, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। একটা বড়সর ভূমিকম্প হলে কত মানুষ মরবে, ধুলোয় মুছে যাবে কত শহর বুঝতে পারছেন? কারণ আল্লাহ নিজেই কুরআনের রক্ষক। সমগ্র আসমানী কিতাবের মাঝে একমাত্র কোর আন ই সম্পূর্ণ অবিকৃত আছে, এটা কি আপনি জানেন? হাজার বছর ধরে একটা কিতাব মানুষ হুবহু একই রকম রাখতে পারে কি যদি না এর পেছনে অলৌকিক ক্ষমতার প্রশ্রয় না থাকে? ক্ষমা চান আল্লাহর কাছে! এটা অপরাধ নয়, এটা ভয়ঙ্কর নাফরমানী, আমি-আপনি-সবাই এর জন্য দায়ী!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ২:০৬