আপনার মেয়ে পাড়ার বখাটে ছেলের পাল্লায় পড়েছে। বখাটের দাবি, মেয়েকে তার হাতে তুলে দিতে হবে। আপনার আদরের কন্যা, তিল তিল করে বড় করেছেন ওকে, আঁচড় লাগতে দেননি গায়ে, ওকে তুলে দিতে সেই হাতে -- যে হাতে ফুল কিংবা ভ্রমর নয়, বরং ইয়াবা, হেরোয়িন আর রিভলভার খেলা করে! আপনার কন্যা, যার মুখে আধো আধো বোলের শব্দ এখনো আপনার কান থেকে মুছে যায় নি, যার ডায়াপার বদলে দিতে গিয়ে আপনার শেষরাতের ঘুম পাতলা হয়ে গেছে কতদিন, যাকে আঙুলে ধরে স্কুলে নিয়ে গেছেন এই সেদিনও -- তাকে বৌ সাজিয়ে হাসিমুখে তুলে দিতে হবে কালো এক মোটর সাইকেলের পেছনে! ঝরাপাতার মত কাঁপছে আপনার কন্যা শোবার ঘরের দরজার আড়ালে লুকিয়ে, আর বসবার ঘরে ‘বরযাত্রী’ অপেক্ষমান মারণাস্ত্রসমেত, কী করবেন আপনি?
বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবক্ষয়, যেখানে জীবনের সামান্য নিরাপত্তাটুকু নেই, সেরকম একটি দেশের অসহায় পিতামাতা হিসেবে আপনারা তাই করলেন যা ন্যুনতম বিবেচনাবোধ থেকে করা যেতে পারত। পুলিশ ডাকলেন না (কারণ ডেকে লাভ নেই), বরং ঐ বখাটে যুগলের সাথে কথা বললেন। বুঝিয়ে দিতে চাইলেন যে এটা কেন অসম্ভব। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে ওরা পিস্তল বের করে গুলি করল, লুটিয়ে পড়লেন আপনারা। আর আমরা পত্রিকায় পড়লাম এই হত্যাকান্ডের ইতিবৃত্ত। পড়লাম, কন্যাকে তুলে না দেয়ার “অপরাধে” পিতামাতা খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ঙ্কর কাহিনী। আমরা এই হত্যাকান্ডের সাথে সমাজের অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে মিলিয়ে ব্যাখ্যা একটা দাঁড় করিয়ে তড়িঘড়ি দায়মুক্ত হয়ে গেলাম!
আর খুনীরা যখন ধরা পড়ল, আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম এরা কেউ মনস্টার নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র, মধ্যবিত্ত/উচ্চমধ্যবিত্ত পারিবারিক কাঠামোর মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছে! এদেরকে আশপাশের সবাই চেনে, তারা বাসে-রিকশায় চড়ে, ইন্টারনেট ব্রাউজ করে, ফেসবুকে একাউন্ট আছে। আমরা কেউ ভেবেই দেখলাম না তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? তাদের হাতে যখন পিস্তল, তারা তো কন্যাটিকে রাস্তা থেকেও কিডন্যাপ করতে পারত, বাসা থেকেও পিস্তলের মুখে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সেটা তারা করল না, এমনকি পিতামাতাকে খুন করার পরও। বরং বলে গেল, “তোর বাবামাকে মেরে ফেললাম, এখন একলা একলা থাক”! আপনার কন্যা যদি আসাযাওয়ার পথে কিডন্যাপ হয়ে যেত, কিংবা পিস্তলের মুখে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যেত ওরা তাতে আপনার বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ অন্তত জিম্মি হত না। কিন্তু এরা তা চায়নি। এরা চেয়েছিল আপনি এদের বখাটে জেনেও হাসিমুখে কন্যা সম্প্রদান করেন! হৃষ্টচিত্তে মোটরসাইকেলের পেছনে তুলে দেন আদরের কন্যাকে! সেই অর্থে, এরা শুধু আপনার কন্যাকে বলপূর্বক তুলে নিতে আসেনি, আপনার স্বাধীনতা, মূল্যবোধ আর বিশ্বাসকে ধর্ষণ করতেও এসেছিল। সেটা করতে দেননি বলেই খুন হতে হল আপনাকে।
কড়াইল বস্তিতে একটা গান শুনতাম প্রায়ই: “কোনো অস্ত্রধারীর হাতে আমার বোনকে দেবো তুলে/সে সন্ত্রাসী হোক কিংবা ক্যাডার, কার কি যায় আসে?/ আমার বোনটি নিরাপত্তা পাবে থাকলে যে তার পাশে”। মনির খানের সেই গানের শ্রোতা তো আপনি নন। এই গান বলছে শহরের সেই জনগোষ্ঠীর কথা যারা বস্তিতে থাকে শহরের আবর্জনা হিসেবে, যাদের পক্ষে কোনো থানাপুলিশ কোর্টকাচারি নেই, যারা ঘুমায় কিংবা জেগে থাকে আগুন আর বুলডোজারের দুঃস্বপ্নের মধ্যে প্রতিদিন। সেই বস্তিতে বড় হয়ে ওঠা একটি বোনের জন্য উদ্বিগ্ন ভাই এরচে বেশি কি নিরাপত্তা চাইতে পারে? কারণ সে জানে তার হাত আইনের দরজা পর্যন্ত কোনোদিন পৌঁছাবে না। তো, আপনি কেন সেভাবে ভাববেন? সমাজে আপনার প্রতিষ্ঠা আছে, সাংগঠনিক পরিচয়ও আছে খানিকটা, ছেলেমেয়েরা দেশেবিদেশে ভাল করছে, আপনি তো মনির খানের সেই গানের শ্রোতা হবেন না! আপনি আইনের শাসনে বিশ্বাস করেন, ভোট দেন, ট্যাক্স দেন, এমনকি সমাজের ভালমন্দ নিয়ে বন্ধুমহলে মতামতও দিয়ে থাকেন। এভাবে নিজের ক্ষমতায়ন সম্পর্কে আপনার একটি বায়বীয় ধারণা জন্মায়। আপনি ভাবেন যে, সমাজের সার্বিক পচন থেকে আপনার বিত্ত, সক্রিয়তা, বিশ্বাস আর মূল্যবোধ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আর নিরাপত্তার যে ব্যুহ আপনি নিজের চারপাশে অনুভব করছিলেন, আপনি খুন হয়ে যাওয়ার পর আমরা বুঝলাম এটা ছিল নেহাত কাচের দেয়াল!
খুন হওয়ার আগের মুহূর্তে যাই, যেখানে দেখবো যে দুই বখাটে আপনার বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে কোমরে রিভলভার গুঁজে, আপনার কন্যাটিকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, বরং আপনারা হাসিমুখে কন্যাকে “সুপাত্রে” সম্প্রদান করবেন সেই আবদার নিয়ে! এবার অন্য পৃষ্ঠায় যাই, দেখবো আপনার কন্যার দীর্ঘদিনের “বন্ধু” তার অন্যত্র প্রেমের দেনা শোধ করতে গিয়ে ছুরি কিনছে আপনাকে রক্তাক্ত করে দেবে বলে। কারণ তার বিশ লাখ টাকা লাগবে এবং সেই টাকা কোনো কার্যকারণ ছাড়াই আপনাকে দিতে হবে! কন্যার এই বন্ধুটিকে নেহাত বখাটে ভাববার কোনো সুযোগ ছিল না আপনার, আপনি তো একে সুশীল ছাত্র এবং কন্যার বন্ধু হিসেবেই চেনেন। এবার আরেক পৃষ্ঠায় যাই, যেখানে আপনার ছাত্রীর প্রেমিক আপনারই বাড়ির সামনে ছুরি নিয়ে অপেক্ষা করছে আপনাকে খুন করবার জন্য। আপনার চোখের আড়ালে আপনার চেনাপরিচিত মানুষজন কী ভয়ঙ্করভাবে বদলে যাচ্ছে সেই হিসাব আপনি কিভাবে রাখবেন? কিন্তু হিসাব না রাখতে পারলেও দায় আপনাকেই নিতে হবে! খড়গ আপনার ওপরেই উঠানো, পচন যেখানেই থাকুক।
আপনার বেঘোরে খুন হয়ে যাওয়ার জন্য এসব উছিলাই যথেষ্ঠ। আপনি শুধু বেশুমার নৌ কিংবা সড়ক দুর্ঘটনায় পটল তুলবেন, লাগাতার ভূমিকম্পে থরহরিকম্প থাকবেন তাতো হবে না! আপনাকে শুধু ক্রসফায়ার, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বুলেট, ছিনতাইকারীর ছুরি বা অজ্ঞানপাটির্র ধুতরাবিষ খুঁজে বেড়াচ্ছে ভাবলে ভুল হবে। আপনি খুন হতে পারেন নিজকন্যার বখাটে প্রণয়প্রার্থীর হাতে স্রেফ তার আবদার ফিরিয়ে দেয়ার অপরাধে। আরো তুচ্ছ অজুহাতে আপনাকে খুন করতে পারে আপনার সন্তানের বহুদিনের চেনা কোনো বন্ধু, কিংবা আপনার ছাত্রীর প্রেমিক, কিংবা আপনাকে খুন করার জন্য বিদেশে বসেও খুনী ভাড়া করতে পারে কোনো অনলাইন ফ্যানাটিক। আপনি খুন হতে পারেন নিজগৃহে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পথে, মসজিদে, সভায়, মিছিলে, জানাজায়, কর্মস্থলে, এমনকি পুলিশী হেফাজতে। আপনার রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে পারে আপনার বসার ঘরের সোফার ওপরে, কোনো আবাসিক প্রকল্পের ছাপড়াঘরের পাশে, ব্রিজের পিলারে, কিংবা তাকে পুঁতে রাখা হতে পারে কোনো দোকানের ভেতর, টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেয়া হতে পারে সারা শহরের ডাস্টবিনে!
এখন নিশ্চয়ই হেসে উঠবেন আপনি। বলবেন, আরে ধূর, এসব ঘটনা তো হরহামেশা ঘটে না, সরলীকরণ করছো তুমি! ঠিক। এসব ঘটনা কালেভদ্রেই ঘটে। তাই বলে কি এর ভয় থেকে আপনি মুক্ত থাকতে পারছেন? জমাট-বাঁধা ভয় হয়ত আপনার দম বন্ধ করে দিচ্ছে না, আপনি দিব্যি খাচ্ছেন-দাচ্ছেন ঘুরেও বেড়াচ্ছেন। কিন্তু শিরার ভেতর, রক্তপ্রবাহের সাথে অবয়বহীন তরল একটা ভয় ঠিকই বয়ে চলেছে। এই “তারল্য” পাতলা অর্থে মোটেও নয়, বরং এর অবয়বহীনতা একে সর্বগামী করে তুলছে, যেন সর্বভূতে বিরাজিত সে! কিন্তু এই ভয়কে বহন করে বেঁচে থাকার সামর্থ আপনাকে দিচ্ছে আমাদের “তরল আধুনিক” সমাজব্যবস্থা, সমাজতাত্ত্বিক জিগম্যান্ট বম্যান যেমন বলেন। আপনি পালিয়ে যাবেন না, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠবেন না, ঘরে খিল লাগিয়ে কাঁপতে থাকবেন না, কিন্তু অবশ্যম্ভাবী ভয়ের স্রোত আপনাকে একটু একটু করে গিলে ফেলবে। নীরবে টহল দিয়ে বেড়াবে আপনার শিরায় উপশিরায়। এভাবে ভেতরে ভেতরে আপনি অন্য মানুষ হয়ে উঠবেন ধীরে ধীরে।
বম্যান তিন ধরনের ভয়ের কথা বলছেন তার লিকুইড ফিয়ার(২০০৬) নামক বইতে। কিছু ভয় আছে আদিম বা প্রাকৃতিক। এর প্রতিক্রিয়ায় মানুষ আর জানোয়ারের পার্থক্য বিশেষ নেই: পারলে রূখে দেয়া নয়তো পালানো। কিছু “ডেরাইভেটিভ” অর্থাৎ সামাজিক-সাংস্কৃতিক: যেমন চাকরি হারানোর ভয়, স্ট্যাটাস নেমে যাওয়ার ভয়। আর কিছু ভয় আছে যা পুরো প্রাকৃতিকও নয় আবার পুরো সাংস্কৃতিকও নয়। এদের কোনো নাম নেই, এরা থাকে মাঝখানে ধূসর এলাকায়। এরা প্রাকৃতিক হলেও পুরোপুরি নয়, আবার মানবসৃষ্ট হলেও পুরোপুরি নয়। এই জোনে আপনার বিবেকবুদ্ধির বিশেষ ভূমিকা নেই, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রও এখানে কখনো বধির কখনো বা অকেজো, নৈতিকতা কিংবা রামসুন্দর বসাকের আদর্শ দিয়ে এর সামান্যই মোকাবেলা করা সম্ভব। একেই “তরল ভয়” নাম দিচ্ছেন বম্যান। এরা হল সেই ধরনের ভয়, যাদের অসংখ্য চোখ আছে এবং এরা মাটির নিচেও দেখতে পায় বলে সারভান্তেস লিখেছিলেন ডন কুইকজোট গ্রন্থে। আপনি ভ্রমণ করছেন ট্রেনে বোমা হামলা হতে পারে, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন স্টক এক্সচেঞ্জে ধস নামতে পারে, ঘুমিয়ে পড়েছেন ভূমিকম্পে চিরকালের মত আটকে যেতে পারেন বিধ্বস্ত ভবনের ভেতর, মেয়ে বড় হয়েছে তার প্রণয়প্রার্থীর হাতে খুন হয়ে যেতে পারেন, ছেলে স্কুলে গেছে কিডন্যাপ হতে পারে, পাড়ার বখাটেদের উৎপাতে মেয়ে বিষ খেয়ে মরে যেতে পারে, স্কুটারে বাড়ি ফিরছেন চোখে মলম লাগিয়ে আপনাকে ট্রাকের নিচে ফেলে দেয়া হতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ভয় তরল, শ্রেণী-লিঙ্গ-বর্ণভেদে আগের মত জমাট বাঁধছে না। নাগরিক মধ্যবিত্ত, দেখুন না আপনার সম্ভাব্য খুনী শুধু নিম্নবর্গ থেকেই আসছে না, সে বেড়ে উঠছে আপনারই ড্রয়িংরুমে, তাকে আপনি চেনেন, রাস্তায় সালাম নিয়েছেন বহুবার, পালাপার্বণে হয়ত বাড়িতে ডেকে খাইয়েছেনও। তাকে এখন আর শ্রেণী দিয়ে বর্ণ দিয়ে ধর্ম দিয়ে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না, যাবেও না।
তো, আপনি যখন আপনার কন্যার প্রণয়প্রার্থীর গুলিতে খুন হয়ে যাবেন তাকে আমরা কি নাম দেব? সমাজের অবক্ষয় বা সহিংসতার বিস্তার যাই বলি, হাতের মুঠোয় যেন পুরোটা আসে না। যতই আমরা বিস্মিত না-হবার ভান করি, যতই হাজির করি রেডিমেড ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, এই খুন যেন সেসবের উর্ধ্বে উঠে থাকে! “সহিংসতা” কিংবা “অবক্ষয়”জাতীয় শব্দগুলোকেই খুব ক্লিশে লাগে, এদের সংজ্ঞাগুলো যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে! এই যে ভয়াবহ গতিশীলতা, যার জন্য অশুভ কোনো নাম আমরা ঠিক করতে পারছি না, তার সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে দিনে দিনে আরো অক্ষম হয়ে উঠছে আমাদের রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা, বিবেচনা, মূল্যবোধ এবং শুভবুদ্ধি। ফলে ভয় অবয়ব হারাচ্ছে আরো, পরিপুষ্ট হয়ে ওঠছে আমাদের তরল ভয়ের স্বরলিপি!