শাহরিক রূপকথা তৈরি হচ্ছে ঢাকার, গত শতকের য়ুরোপ-স্টাইলে। আমরা এবার পেয়ে গেলাম আমাদের "জ্যাক দ্য রিপার" রসু খাঁকে। সেই আমাদের প্রথম "সিরিয়াল কিলার", এতোই হতচকিত আমরা যে, ভুলে চক্করে কোনো কোনো পত্রিকা তাকে অভিহিত করছে "লেডি কিলার" বলে! সত্য বটে, রসু খাঁ ১১ জন মেয়েমানুষকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেছে। মওকা পেয়েছে পুলিশ। তারা সশব্দে অনুমান করছে, কমপক্ষে ৫০ জনকে হত্যা করে থাকতে পারে এই সিরিয়াল কিলার। অর্থাৎ যেসব হত্যাকাণ্ডের সুরাহা ইতোপূর্বে হয় নি, তার অনেকগুলোর দায় হয়ত নিতে হবে খাঁ সাহেবকে। আরো ভয়ানকভাবে ফোলানো-ফাঁপানো হতে পারে তাকে। আরো আরো রক্তহিম করা কাহিনী শুনতে হতে পারে আমাদের। ভয়ের বিনোদন কিন্তু ব্যাপক!
রসু খাঁর অতিদানবীয়করনের প্রকল্প মিডিয়া নিয়েছে, কাগজগুলো ঘাঁটলে এটা মনেই হয়। এমন এমন কাহিনী শোনাচ্ছে তারা, যেন একজন রশিদের খুনী রসু খাঁ হয়ে ওঠার কার্যকারণ আবিষ্কার করার দায় তাদেরই পড়ে গেছে। রসু-র বিকৃত যৌনরূচির গোড়া সন্ধানে এটাও আবিষ্কার করেছে তারা যে এই খুনী আপন দুই বোনকে বিয়ে পর্যন্ত করেছে! অথচ স্ত্রী-র মৃত্যুর পর শ্যালিকাকে বিয়ে করার একটা প্রায়-বৈধ চল বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কিন্তু আছে। সেসব এখন চলবে না। আমাদের একটা ফ্রাংকেনস্টাইন লাগবে। আমাদের একটা জ্যাক দ্য রিপার লাগবে। আমাদের শহর আমাদের চোখে আরো রহস্যময় হয়ে উঠুক। আমাদের আদর্শিক বিবেচনাবোধের পালে তেজী হাওয়া লাগুক, আমরা থুথু ছিটাব সেইসব খুনীদের মুখে।
আরো হাস্যকর লাগল মনোবিজ্ঞানীদের তোড়জোড়। সমাজে সহিংসতা বাড়ার ফলাফল এই রসু খাঁ, বেশ ঝেড়ে দিলেন তারা। একবারও ভাবলেন না, যে হারে সহিংসতা বেড়েছে তাতে বাংলাদেশের অর্ধেক লোকের রসু খাঁ হয়ে যাওয়ার কথা। আর রসু খাঁ-প্রতি ১১ টি লাশ গুনতে হলে গোটা দক্ষিণ এশিয়া নারীশূন্য হয়ে যাওয়ার কথা! এইটাকেই বোধ হয় ভালগার জেনারালাইজেশন বলে। যাক, পুলিশ, মিডিয়া এবং অপরাধ মনোবিজ্ঞান যুগপৎভাবে রসু খাঁর চরিত্র উদঘাটনের দায়িত্ব নিয়েছে। এতে করে পুলিশের খাতায় অমীমাংসিত লাশগুলোর হিল্লা হবে, পত্রিকার বাড়বে কাটতি, আর অপরাধ মনোবিজ্ঞান পাবে মনোহর কেস স্টাডি।
কেন এই ক্রনিক হত্যার নেশা রসু খাঁকে পেয়ে বসেছিল, এ নিয়ে প্রকল্পনার কি কোনোদিন শেষ হবে? নির্যাতন কিংবা ক্রসফায়ারের ভয়ে রসু তাইই বলবে, যা তাকে নিয়ে বলানো হবে। ফলে, রসু শুধু অমীমাংসিত হত্যাকাণ্ডের দায় নেবে না, অপ্রমাণিত কোনো তত্ত্বের দায়ও নিতে পারে। বিনা আয়াসে নিশ্চয়ই পার পাবে না এই মানসিক বিকৃতি, তার পেছনে কোন-না-কোন যুক্তি খাড়া করাতেই হবে!
তবু ভিলেন হিসাবে রসু খাঁ নানা কারণেই আরামের। এই নিম্নবর্গীয় খুনীর দৌড় গার্মেন্টস বালিকা থেকে ভিখারিনী পর্যন্ত। ফলে মিডিয়াভোগী শাহরিক মধ্যবিত্ত কাচের দেয়ালের ওপাশ থেকে কাহিনীটা উপভোগ করতে পারছে। ক্ষমতাবানের জানমাল রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে কয়েদ থাকার সুবাদে রসু আরো উপাদেয় হয়ে উঠেছে, সন্দেহ নাই। অজানা আতংকে কেউ শিউরে উঠছে না এখন। ফলে আদর্শের চাপ বাড়ছে। রসুর গডফাদার নাই, রাজনীতিও নাই। ফলে সামাজিক ন্যায়বিচার ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনাও শূন্যের কোঠায়। এত এত খুন জড়িত থাকার পরেও এমন নিরাপদ বিনোদন!
রসুর গলা যতটুকু শোনা গেছে, তাতে তার নিজেকে রাজনীতিকরনের চেষ্টাটা চিন্তার খোরাক জোগায়। "ক্রসফায়ার"এ মরতে চায় না সে। বিচারে তার ফাঁসি হবে, একথা নিশ্চিত জানার পরেও। কর্নেল ওয়েস্ট যেমন বলেন, মানুষের আইডেন্টিটি তৈরি হয় তার প্রত্যাশা এবং মৃত্যুভাবনা দিয়ে। রসুর এহেন মৃত্যুভাবনা তার আইডেন্টিটি তৈরি করে বৈকি। এরশাদ শিকদারের মৃত্যুভাবনাটির কথাও মনে হয় এই প্রেক্ষিতে। এমন ক্রুশিয়াল মুহূর্তগুলোতে তারা তাদের পরিচয়সংকটের সুরাহা করতে চাইল, ভেবে অবাক লাগে। এরশাদ শিকদার যেখানে জীবনের অনিত্যতার ব্যাপারে একটা দার্শনিক অবস্থান নিল, রসু সেখানে অনামা লাশ এবং বিচারবিহীন মৃত্যুকে নিজের নারকীয় কীর্তির চেয়ে আরো নারকীয় হিসেবে দেখল।
সেই অর্থে, রসু কি বলতে চাইল যে, রসু খাঁ নয় বরং ক্রসফায়ারই আমাদের সবচে নারকীয় সিরিয়াল কিলার?