এক বুড়ার কাহিনী বলি, বোবা হয়ে গিয়েছে সে, অবসাদে-ভরা একটা মুখ, হাসবার কিংবা রাগ করবার জন্য যথেষ্ট কান্ত। ছোট একটা শহরে থাকে, গলির শেষ মাথায় বা সদর রাস্তার কাছাকাছি। তার চেহারার বর্ণনা দেয়া আদতে নিরর্থক, কারণ পাঁচজন থেকে তাকে আলাদা করার মত খুব সামান্য কিছুই হয়ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তার মাথার টুপি ছিল ছাইরঙা, ট্রাউজার ছাইরঙা, পরনের জ্যাকেট ছাইরঙা, শীতকালে লম্বা যে ওভারকোটটা পরত সেটাও ছাইরঙা। তার গলা ছিল চিকন এবং ঘাড়ের চামড়া ছিল শুকনা ও কোঁচকানো, ফলে শাদা শার্টের কলার তার গলায় অনেকখানিই ঢলঢলে লাগত।
বাড়িটার সবচে উপরের তলার চিলেকোঠায় থাকে সে, হয়ত একসময় বিয়েশাদী করেছিল আর বাচ্চাকাচ্চাও ছিল, হয়ত আগে অন্য কোনো শহরে থাকত। একসময় সেও নিজেও নিশ্চয়ই শিশু ছিল, তবে সে সময়টায় বাচ্চারা বড়দের পোশাক পরত মনে হয়। দাদীর ছবির অ্যালবামে এইরকম জিনিস পাওয়া যাবে। বুড়ার ঘরে দুইটা চেয়ার, একটা টেবিল, একটা কার্পেট, একটা খাট আর একটা ওয়ার্ডরোব। ছোট্ট একটা টেবিলের ওপর একটা এলার্ম ঘড়ি, তার পাশে পুরান সংবাদপত্রের স্তূপ আর একটা ছবির অ্যালবাম, তার পাশে একটা আয়না আর দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবি।
সকালে হাঁটতে বের হত সেই বুড়া, আবার বিকালেও হাঁটত, পাড়াপড়শির সাথে টুকটাক দুয়েকটা কথা বলত, এবং সন্ধ্যায় আবার টেবিলে এসে বসত।
এর কোনো ব্যতিক্রম হত না, এমনকি রোববারেও একই রুটিন। টেবিলের সামনে বসেই লোকটা এলার্ম ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে পেত, সবসময় সে এলার্ম ঘড়ির শব্দ শুনতে পেত।
তারপর একদিন সেই বিশেষ দিন এল, রোদেভরা একটি দিন, খুব গরমও না, আবার খুব ঠান্ডাও না, পাখপাখালির কিচিরমিচিরে ভরা একটা দিন, বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়ার মত একটি দিন, বাচ্চাদের খেলাধুলা দেখার মত - এবং সবচে বিশেষ যে ঘটনাটি ঘটল সেটা হল ঐ দিনটি আমাদের বুড়ার মনে প্রভূত সন্তোষ বয়ে আনল।
হাসল সে।
“এখন সবকিছু বদলে যাচ্ছে দেখছি”, ভাবল সে। শার্টের উপরের বোতামটা খুলে দিল, টুপি হাতে নিল, আর হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। অনেকদূর হেঁটে এল সে, যতক্ষণ না হাঁটুতে আরাম লাগতে শুরু করে, খুব খুশি দেখাচ্ছিল তাকে। তারপর নিজের গলিতে ফিরে এল, বাচ্চাদের দেখে মাথা নোয়াল, বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে গেল, সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠল, পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলল।
কিন্তু তার ঘরের সবকিছু আগের মতই ছিল, একটা টেবিল, দুইটা চেয়ার, একটা খাট। আর যখনি সে বসল, বরাবরের মতই ঘড়ির টিকটিক শব্দও কানে এল তার, নিমেষে সব আনন্দ যেন উধাও হয়ে গেল তার মন থেকে, কোনো কিছুই বদলাল না বলে।
ভীষণ রাগে গা জ্বলতে লাগল বুড়ার।
আয়নায় খুটিয়ে খুটিয়ে সে তার নিজের লাল হয়ে-ওঠা মুখটা দেখল, তারপর হাত নামিয়ে আনল টেবিলের ওপরে, প্রথমে একটা টোকা দিল, তারপর আরেকটা, তারপর সে পাগলের মত টেবিল বাজাতে আরম্ভ করল আর চেঁচাতে লাগল বারবার:
“বদলানো দরকার। অবশ্যই বদলানো দরকার!”
এর ফলে আর সে এলার্ম ঘড়ির শব্দ শুনতে পেল না। কিন্তু একটু পর হাতে ব্যথা অনুভব করতে লাগল সে, গলাও ধরে এল, এবং তারপর আবার সে এলার্ম ঘড়ির শব্দ শুনতে শুরু করল এবং কোনকিছুই বদলাল বলে মনে হল না।
“প্রতিদিনই সেই একই টেবিল”, বলল বুড়া লোকটা, “একই চেয়ার, বিছানা আর ছবি। এবং টেবিলকে আমি টেবিলই বলছি, ছবিকে ছবি, আর চেয়ারকে চেয়ার। কেন, কোনোদিন ভেবেছি কি সেটা? ফ্রেঞ্চরা বিছানাকে বলে ‘লি’, টেবিলকে বলে ‘তাহবল’, ছবিকে বলে ‘তাহব্লো’ আর চেয়ারকে ‘শেজ’, এবং তারা একজন অন্যজনকে ঠিক বুঝতে পারে। চীনারাও তো একে অন্যকে ঠিক বুঝতে পারে।”
“খাটকে ছবি ডাকলে কি সমস্যা?” ভাবল লোকটা আর হাসল নিজের মনে, এবং হাসতেই থাকল, যতক্ষণ না ওর পাশের ঘরের প্রতিবেশী দেয়ালে ঘা মেরে ওকে থামতে বলল।
“এখন তাহলে সব বদলাতে শুরু করছে”, সে চেঁচিয়ে বলল এবং তখন থেকেই সে খাটকে “ছবি” বলে ডাকতে আরম্ভ করল।
“কাহিল লাগছে, ছবিতে যেতে চাই”, বলল সে, এবং প্রায় সকালেই সে বহুক্ষণ ছবিতে শুয়ে থাকল এরপর থেকে, ভাবতে লাগল চেয়ারকে কী বলে ডাকা যায়, এবং এভাবেই চেয়ারকে সে “এলার্ম ঘড়ি” বলে ডাকতে শুরু করল।
কাজেই সে বিছানা ছেড়ে, কাপড় পরে, এলার্ম ঘড়ির ওপর বসল, এবং টেবিলের ওপর হাত বিছিয়ে দিল। কিন্তু টেবিলের নাম তো আর টেবিল নাই, ততক্ষণে সে “কার্পেট” নাম পেয়ে গেছে। সুতরাং সকালবেলায় আমাদের বুড়া ছবি ত্যাগ করে, কাপড় পরে, তারপর কার্পেটের পাশে এলার্ম ঘড়ির ওপরে এসে বসে, আর ভাবে কোনটাকে কী ডাকা যায়।
বিছানাকে সে ছবি ডাকতে শুরু করল।
টেবিলকে সে কার্পেট ডাকতে শুরু করল।
চেয়ারকে সে এলার্ম ঘড়ি বলতে শুরু করল।
খবরের কাগজকে সে বিছানা বলতে আরম্ভ করল।
আয়নাকে সে চেয়ার বলে ডাকতে শুরু করল।
এলার্ম ঘড়িকে সে ছবির অ্যালবাম বলে ডাকতে শুরু করল।
ওয়ার্ডরোবকে সে খবরের কাগজ ডাকতে শুরু করল।
কার্পেটকে সে ওয়ার্ডরোব বলে ডাকতে শুরু করল।
ছবিকে সে টেবিল নামে ডাকতে শুরু করল।
ছবির অ্যালবাকে সে আয়না ডাকতে শুরু করল।
কাজেই:
সকালবেলা আমাদের বুড়া অনেকক্ষণ তার ছবির মধ্যে শুয়ে থাকে, নয়টায় ছবির অ্যালবাম বাজতে শুরু করে, তখন সে উঠে দাঁড়ায় ওয়ার্ডরোবের ওপরে, যাতে তার পায়ে ঠান্ডা না-লাগে, তখন সে খবরের কাগজের ভেতর থেকে কাপড়চোপড় বের করে পরে, দেয়ালে ঝোলানো চেয়ারের দিকে তাকায়, তারপর কার্পেটের পাশে এলার্ম ঘড়ির ওপর বসে বুড়া আয়নার পাতা উল্টাতে থাকে যতক্ষণ না সে তার মায়ের টেবিলটা খুঁজে পায়।
এই খেলায় খুবই মজা পেল বুড়া, সারাদিন ধরে খেলতে লাগল, তার স্মৃতিভান্ডারে যত শব্দ আছে সব নিয়ে। প্রতিটি জিনিসকেই সে নতুন নাম দিল। এখন সে আর কোনো মানুষ না, একটা পা মাত্র, আর পা হচ্ছে সকাল, আর সকাল হচ্ছে মানুষ।
এবার তুমি তোমার নিজের জন্য এই কাহিনী এগিয়ে নিতে পার। আর এভাবে, ঐ বুড়ার মত, তুমিও অপরাপর শব্দগুলোকে বদলে দিতে পার।
ঘন্টা বাজানো মানে হল দাঁড়ানো।
শীত লাগা মানে হল তাকানো।
মিথ্যা বলা মানে হল ঘন্টা বাজানো।
জেগে ওঠা মানে হল শীত লাগা।
দাঁড়ানো মানে হল পৃষ্ঠা উল্টানো।
কাজেই আমরা এমনটা পেতেই পারি:
মানুষবেলা বুড়া একটা পা ছবির মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে ঘন্টা বাজাল, নয়টায় ছবির অ্যালবামটা দাঁড়িয়ে গেল, বেচারা পা ঠান্ডা অনুভব করতে লাগল, আর তাই ওয়ার্ডরোবের পাতা উল্টাতে লাগল যাতে করে তার সকালটাকে ঢেকে ফেলা যায়।
বুড়া একটা নীল রঙের খাতা কিনে আনল এবং নতুন নতুন সব শব্দ বানিয়ে সেসব লিখে লিখে খাতা ভরিয়ে ফেলল, ফলে সে আগের চেয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ল, এবং এখন রাস্তায় তাকে খুবই কম দেখা যায়।
এভাবে সে চারপাশের সব জিনিসের নতুন নাম শিখে ফেলল এবং পুরনোগুলো একটা একটা করে ভুলে যেতে লাগল। এভাবে একটা নতুন ভাষা তৈরি হয়ে গেল যেটা একান্ত তার।
এভাবে সে তার নতুন ভাষায় স্বপ্ন পর্যন্ত দেখতে শুরু করল, স্কুলে যেসব গান গাইত সে, ওগুলোকে এখন এই নতুন ভাষায় অনুবাদ করে করে আপন মনে একা একা গাইতে শুরু করল।
কিন্তু দেখা গেল ঐ অনুবাদের কাজই কঠিন হয়ে পড়েছে তার জন্য, কারণ সে পুরনো ভাষাটা প্রায়-একদমই ভুলে গেছিল, এবং পুরনো শব্দের অর্থ বের করার জন্য তাকে প্রায়ই নীলরঙা খাতাটা ঘাঁটতে হত। লোকজনের সাথে কথা বলতে ভয় পেতে লাগল সে, কারণ কোনো জিনিসকে লোকেরা কী নামে ডাকে সেটা মনে করার জন্য তাকে বহুক্ষণ স্মৃতি হাতড়াতে হয়।
তার ছবিকে লোকেরা ডাকে বিছানা।
তার কার্পেটকে লোকেরা ডাকে টেবিল।
তার এলার্ম ঘড়িকে লোকে বলে চেয়ার।
তার বিছানাকে লোকে বলে খবরের কাগজ।
তার চেয়ারকে লোকে বলে আয়না।
তার ছবির অ্যালবামকে লোকে বলে এলার্ম ঘড়ি।
তার খবরের কাগজকে লোকে বলে ওয়ার্ডরোব।
তার ওয়ার্ডরোবকে লোকে বলে কার্পেট।
তার টেবিলকে লোকে বলে ছবি।
তার আয়নাকে লোকে বলে ছবির অ্যালবাম।
আর বিষয়টা এমন দাঁড়াল যে, লোকের কথাবার্তা কানে গেলেই বেদম হাসতে শুরু করত সে।
“কাল কি তুমি ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাচ্ছ?” অথবা কেউ যদি বলল, “দুই মাস ধরে বৃষ্টি হচ্ছে” বা বলল, “আমেরিকায় আমার এক চাচা থাকে”।
বুড়া হেসে হেসে লুটোপুটি খায় কারণ এসব বাক্যের একবর্ণও বুঝতে পারে না সে।
কিন্তু এটা কোনো হাসির গল্প নয়। এর শুরু হয়েছিল বিষাদ থেকে আর শেষটাও বেদনার।
ছাইরঙা কোট-পরা আমাদের বুড়া এখন আর কারো কথা বুঝতে পারত না, কিন্তু সেটা বড় সমস্যা ছিল না।
সমস্যা যেটা হল, লোকেও তার কথার একবর্ণ বুঝতে পারত না।
আর এ কারণেই সে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। বোবা হয়ে গেছিল।
চুপচাপ থাকত সে।
আর নিজে নিজেই কথা বলত।
লোকজন তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে আগের মত আর মাথাও নোয়াত না সে।
[মূল: পিটার বিকসেল]