বাংলার মুখ Click This Link সাইটিটিতে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকজন সংগঠক ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছিলো ২০০৩ সালে। সাক্ষাতকারগুলো নিয়েছিলেন ড. সুকুমার বিশ্বাষ।
মুল সাক্ষাতকারটি এখানে পাবেন Click This Link
উনাদের অনুমতিক্রমে সাক্ষাতকারগুলো পর্বাকারে সামহোয়্যারইন ব্লগে পূনঃপ্রকাশ করছি।
সাক্ষাতকারগুলোর পূর্নসত্ব ও কৃতিত্ব বাংলার মুখের।
-------------------------------------------------------------------
নাম : বলরাম গুহঠাকুরতা
পিতা : সুরেশচন্দ্র গুহঠাকুরতা
পাড়া : আশ্রমপাড়া,
ডাক : ঠাকুরগাঁও টাউন
ইউনিয়ন : নিশ্চিন্তপুর,
থানা : ঠাকুরগাঁও
জেলা : ঠাকুরগাঁও ( ১৯৭১ সালে দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত মহকুমা)
শিক্ষাগত যোগ্যতা : বি.এ.,এল.এল.বি.
১৯৭১ সালে বয়স : ৩৫
১৯৭১ সালে পেশা : আইনজীবী,
বর্তমান পেশা : আইনজীবী
প্র: ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও তার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: ১৯৭০ সালে আমি ঠাকুরগাঁওয়ে আইন পেশার সাথে জড়িত ছিলাম এবং রাজনৈতিকভাবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি)-এর একজন সক্রিয় সদস্য ছিলাম। আমি ন্যাপ-এর ঠাকুরগাঁও মহকুমার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। স্বাধীনতার পর এটা মোজাফফর ন্যাপ নামে অভিহিত হয়। ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁও দিনাজপুর জেলার একটি মহকুমা ছিলো। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু তারপরও যখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো না, তখন গোটা দেশের সঙ্গে ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষও আন্দোলনে নেমে পড়ে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় সভা মিছিল করে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে লাগলাম। ঠাকুরগাঁও মহকুমায় প্রাদেশিক পরিষদের তিনটা সিট ছিলো। একটা সিট হচ্ছে ঠাকুরগাঁও সদর আর অন্য একটা থানার কিছুটা অংশ নিয়ে। এই সিটে বিজয়ী এম. পি. এ. ছিলেন আওয়ামী লীগের মোঃ ফজলুল করিম সাহেব। তাঁর সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছিলেন মুসলিম লীগের সম্ভবতঃ মীর্জা রুহুল আমিন। বর্তমান প্রতিমন্ত্রী ফখরুল ইসলাম আলমগীর-এর পিতা। আরেকটা সিট ছিলো বীরগঞ্জ আর রানীশংকৈল এলাকা নিয়ে। এখানে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের সম্ভবত: আকরাম। আরেকটা সিট ছিলো। সেটাও ছিলো আওয়ামী লীগের। এখানকার নির্বাচিত সদস্যের নামটা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। এ সময় মুসলিম লীগ থেকে মীর্জা রুহুল আমিন নির্বাচন করেছিলেন- যে কথা আমি বলেছি। আর অন্যান্য জায়গা থেকে এ দলের উল্লেখযোগ্যদের মধ্য থেকে কনটেস্ট করেছিলেন নূরুল হক চৌধুরী সাহেব। ন্যাপ ওয়ালি থেকে কনটেস্ট করেছিলেন এফ. এ. মোহাম্মদ হোসেন সাহেব। ঠাকুরগাঁওয়ে তিনি ন্যাপের সভাপতি ছিলেন। তিনি ঠাকুরগাঁও সিট থেকে কনটেস্ট করেছিলেন। নির্বাচনে তিনটা সিট-ই আওয়ামী লীগ পেলো। তারপর তো ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গোটা দেশে যখন আন্দোলন শুরু হলো তখন ঠাকুরগাঁওয়েও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ভাষণ দিলেন যে, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তারপরই আমরা ঠাকুরগাঁওয়ে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করি। সংগ্রাম পরিষদে আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি) এবং কমিউনিস্ট পার্টি-এই তিন দলের নেতৃবর্গকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।
প্র: সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত সদস্যদের নামগুলো বলবেন কি ? সংগ্রাম পরিষদের কাজই বা কি ছিলো ?
উ: আওয়ামী লীগের মো: ফজলুল করিম সাহেব এম. পি. এ. ছিলেন। ঠাকুরগাঁও আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি আবদুর রশিদ সাহেব ছিলেন। এ দিকে কমিউনিস্ট পার্টির কামরুল হোসেন, মেরাজুল হোসেন এবং ওয়ালি ন্যাপ-এর ছিলেন এফ. এ. মোঃ হোসেন, মোঃ নূরুল হক আর আমি বলরাম গুহঠাকুরতা। আরো কয়েকজন ছিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁদের নাম আমার মনে পড়ছে না। সংগ্রাম পরিষদ অনেক কাজই করেছিলো।
৭ মার্চের পরে আমরা কিছু লিফলেট ছাপিয়েছিলাম। পাকিস্তান সরকার যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছে না এবং এরই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু যে ৭ মার্চের ভাষণ দিলেন সেই প্রেক্ষিত মনে রেখেই আমরা কিছু লিফলেট ছেপেছিলাম এবং সেই লিফলেট ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যেকটি অংশে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিলো। সে সময় তো পঞ্চগড় ঠাকুরগাঁও মহকুমার অন্তর্ভুক্ত অন্তর্ভুক্ত ছিলো। অর্থাৎ পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া, আটোয়ারি, দেবীগঞ্জ-এ সব এলাকা আমাদের ঠাকুরগাঁওয়ের অধীনে ছিলো। আমরা অর্থাৎ নেতৃবর্গ যাঁরা ছিলাম তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে ঐ সমস্যা লিফলেট বিলি এবং সভা-সমিতি করতে লাগলাম। আমরা জনতাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, আমাদের এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম। সংগ্রাম পরিষদে আমাদের সঙ্গে আরো একজন ছিলেন এম. পি. এ. সিরাজুল ইসলাম- যিনি পঞ্চগড় আটোয়ারি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমরা সবাই ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন থানায় মিটিং করতে লাগলাম।
প্র: ৭ মার্চের পরে আপনার কি কোনো উল্লেখযোগ্য জনসভার কথা মনে পড়ে ?
উ: এমন কোনো থানা নেই যেখানে আমরা মিটিং করিনি। প্রত্যেকটি থানাতে এমন কি ইউনিয়নেও আমরা মিটিং করেছি। ২/১ দিন পর পর আমরা মিটিং করেছি আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ মিলে। এভাবে মিটিং মিছিল চলাকালে ২৫ মার্চ পাকিস্তান আর্মি হঠাৎ করেই ব্যাপকভাবে আক্রমণ শুরু করে। এ সংবাদ আমরা ২৫ মার্চ রাতেই পেয়ে যাই। পর দিন ২৬ মার্চ বেলা ১০টায় এর প্রতিবাদে আমরা বিশাল এক মিছিল বের করলাম ঠাকুরগাঁও শহরে। এই মিছিলে সর্বস্তরের জনগণ আমাদের সাথে ছিলো। সব রাজনৈতিক দলই এই মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলো। এ দিন বিকালে আওয়ামী লীগ দলীয় এম. পি. খাদেমুল ইসলামের ভাড়া বাড়ির মালিক রফিউল এহসান-এর বাড়ির ভিতর ছোট্ট একটি ঘরে আমরা অত্যন্ত গোপনে মিটিং করলাম। এই সভাতেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা বা নেতৃত্ব দেয়ার জন্য একটা সেল গঠন করা হয়। আমরা সভায় বসেছিলাম ২৬ মার্চ বিকাল পাঁচটায়।
প্র: কারা কারা এই মিটিংয়ে ছিলেন ?
উ: আমার যতদূর মনে পড়ে আওয়ামী লীগের এম. পি. এ. ফজলুল করিম সাহেব, আবদুর রশীদ সাহেব, ন্যাপের এফ. এ. মোঃ হোসেন সাহেব, ন্যাপের সেক্রেটারি মোঃ নূরুল হক সাহেব, ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমি ছিলাম, কমিউনিস্ট পার্টির কামরুল হোসেন এবং আলা বলে একটি ছেলে ছিলো। কমিউনিস্ট পার্টির সৈয়দ মেরাজুল হোসেন ছিলেন কিনা আমার ঠিক মনে পড়ছে না। ঐ সভায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, এখন যে সংগ্রামটা শুরু হলো সেটা পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংগ্রাম বা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আমরা আমাদের নেতা এবং নেতৃত্ব ভাগ করে নেই। একটা চার্ট আমরা তৈরি করলাম। সেই চার্টে আমরা প্রথম নেতৃত্বে রাখলাম এফ. এ. মোঃ হোসেন সাহেব এবং আওয়ামী লীগ দলীয় এম. পি. এ. জনাব ফজলুল করিম সাহেবকে। যদি এরা দু’জন মারা যান তাহলে পরবর্তীতে আবদুর রশীদ সাহেব ও কামরুল হোসেন সাহেব নেতৃত্ব দেবেন। এরা দু’জন মারা গেলে আমি বলরাম গুহঠাকুরতা ও নূরুল হক নেতৃত্ব দেবো। আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, এই রাতেই আমরা প্রতিটি থানা থেকে জনগণকে With Arms অর্থাৎ তাদের কাছে যে বন্দুক, গাদাবন্দুক, লাঠি সোটা- যা আছে তাই নিয়ে আমরা ঠাকুরগাঁও শহরে আসবো এবং তারপর আমরা ই.পি.আর ক্যাম্পে যাবো। এই শো ডাউনের কারণ ছিলো। ই.পি.আর. ক্যাম্পের কিছু বাঙালি জওয়ান ৭ মার্চের পর থেকেই আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখছিলো। তারা আমাদের এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলো যে, আমরা যদি ই.পি.আর.-বাহিনীর ৯ নম্বর উইং-এর গেটে বিশাল জনতার মিছিল নিয়ে যেতে পারি তাহলে বাঙালি ইপিআর-রা আমাদের সাথে যোগ দেবে। তাদের সেই আশ্বাসের ভিত্তিতেই আমরা সব থানাতেই ২৬ মার্চ সারা রাত জেগে অরগানাইজ করলাম। আমার দায়িত্ব পড়েছিলো আটোয়ারি থানা। আমি একটা মটর সাইকেলে সাথে একজনকে নিয়ে আটোয়ারি থানার চরেয়া, মীর্জাপুর, রসেয়াসহ পুরো আটোয়ারি থানার যে সব বয়স্ক রাজনীতিক ছিলেন তাঁদের সাথে যোগাযোগ করলাম। তাঁরা তাদের বন্দুক, লাঠিসোটা, চাল-ডাল নিয়ে প্রস্তুত হলো শহরে যাবার জন্য। চাল-ডাল নেয়ার কারণ হলো যারা শহরে থাকবে তাদের খাবার প্রয়োজন হবে। তাই তারা তাদের সামর্থ্য মতো যে যা পারলো তাই দিলো। আমি চাল-ডাল, জিনিসপত্র এবং লোকজন নিয়ে ট্রাকে করে ২৭ মার্চ সকাল ৯টায় ঠাকুরগাঁও শহরে এলাম। আমরা ঠাকুরগাঁও চৌরাস্তা থেকে মিছিল বের করলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিলো এই মিছিল নিয়ে আমরা ইপিআর ক্যাম্পে যাবো এবং তারা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। বড় আশা নিয়েই আমরা ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার গেটে গিয়েছিলাম। আমি যেমন আটোয়ারি থানা থেকে লোকজন নিয়ে এসেছিলাম। সে রকমভাবে বিভিন্ন থানা থেকেই লোকজন নিয়ে আসা হয়েছিলো। মোঃ নূরুল হক সাহেব পঞ্চগড় থেকে ব্যক্তিগতভাবে এসেছিলেন। কিন্তু পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া থেকে তার পক্ষে লোকজন আনা সম্ভব হয়নি দূরত্বের কারণে। তবে আশ পাশের যত থানা ছিলো- সকল থানা থেকেই লোকজন আসলো। সর্বস্তরের জনগণ মিলে এমন কি মুসলিম লীগ, যাদেরকে আমরা স্বাধীনতা বিরোধী বলে মনে করি তাদেরও অনেক সমর্থক ও কর্মী আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো। আমরা ঠাকুরগাঁও শহর থেকে মিছিল করে ইপিআর ক্যাম্পের গেটে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি ইপিআর বাহিনী মেশিনগান, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্র হাতে পজিশন নিয়ে বসে আছে। ওখান থেকেই কয়েকজন বাঙালি ইপিআর সদস্য আমাদেরকে ইশারা করলো চলে যাবার জন্যে। চলে যাবার ইশারাটা আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তারা আমাদের চলে যেতে বলছে না আসতে বলছে সেটা বুঝতে পারিনি। সেই মুহূর্তে একজন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন একটি রাইফেল নিয়ে ফায়ার শুরু করে ইপিআরদের আমাদের দিকে তাক করে পজিশন নিতে বললো। ওরা যখন পজিশন নিতে আরম্ভ করলো আমরা তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম। কথা ছিলো, বাঙালি ইপিআর-রা আমাদের সাথে যোগ দেবে। কিন্তু যোগ না দিয়ে যখন গুলি চালাতে আরম্ভ করলো তখন আমরা ওখান থেকে ব্যাক করে শহরে ঢুকলাম। কিন্তু শহরে ঢুকেই দেখতে পেলাম যে, অন্য রাস্তা দিয়ে ইপিআর বাহিনী ঠাকুরগাঁও শহরে এসে বিভিন্ন রাস্তার কোণে অবস্থান নিয়েছে মেশিনগান, রাইফেল ইত্যাদি নিয়ে। প্রতিটি গ্রুপের সাথেই দু’জন করে পাঞ্জাবি জেসিও ছিলো। তাদের কাছে পিস্তল ছিলো, এস. এল. আর-ও থাকতে পারে। ইপিআর-এর যারা বাঙালি জোয়ান ছিলো তারা সামনে ছিলো এবং তারা পজিশন নিয়ে ছিলো।
তখন বেলা বারোটা কিংবা একটা হবে। আমরা যখন মিছিল নিয়ে ফিরছিলাম তখন মোহাম্মদ আলী নামে একজন রিক্সাওয়ালা এবং তার সাথে আরো কয়েকজন মিছিলে সামিল হতে যাচ্ছিলো। তারা মিছিলের শেষভাগে ছিলো। এ সময় তাদেরকে ইপিআর-রা চেজ করলো। ওদের তারা বললো, ‘রুখ যাও, কেয়া মাংতা, ? তখন তারা বললো, ‘জয় বাংলা’। হাত তুলে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করতে শুরু করলো। তখন ইপিআররা মোঃ আলীকে লক্ষ্য করে গুলি করে। ফলে, সে সেখানেই মারা যায়। যেখানে সে মারা যায় পরবর্তীতে সেখানেই তার কবর হয়েছে। যাহোক, গুলি হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমরা খবর পেলাম যে, নরেশ চৌহান নামে অপর একটা ছেলেও গুলিতে নিহত হয়েছে। যদিও ছেলেটা ঘরের মধ্যে ছিলো। গুলিটা বেড়ার ভিতর দিয়ে ঢুকে তাকে বিদ্ধ করায় সে মৃত্যুবরণ করে। স্বাধীনতার পর তার স্মরণেও একটা স্মৃতি সৌধ হয়েছে। এই দু’টো মৃত্যুর পর ঠাকুরগাঁও-য়ের লোকজন পালাতে শুরু করে। তখন থেকেই ঠাকুরগাঁওয়ে কার্ফু শুরু হলো। এ সময় আমার বাড়িতে কিছু আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং এফ. এ. মোহাম্মদ হোসেন সাহেব সহ আরো কয়েকজন ছিলেন। আমরা বাড়ি থেকে বের হবার কোনো রাস্তা পাচ্ছিলাম না। কারণ আমার বাড়ির চারদিকেই ইপিআরদের মেশিনগান ফিট করা ছিলো। আমরা তখন চিন্তা করছি কিভাবে কোথায় থাকবো। এভাবে যখন ভাবছি তখন রাত্রি বারোটার দিকে আমরা গুলির আওয়াজ পেলাম ইপিআর ক্যাম্প থেকে। ইপিআর ক্যাম্পের এই আওয়াজ আস্তে আস্তে প্রচন্ড আকার ধারণ করলো। এদিকে ইপিআর যারা শহরে অবস্থান নিয়েছিলো তারা উইথড্র করে চলে গেলো। ইপিআর-রা চলে যাবার পর আমরা যারা ইয়াং ছিলাম তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম এবং ইপিআর ক্যাম্পের দিকে গেলাম।
তখন রাত দু’টো আড়াইটে হবে। দূর থেকে আমরা দেখছি গোলাগুলি হচ্ছে। কিন্তু সাহস করে এগুতে পারছি না। যুদ্ধটা যে কাদের মধ্যে হচ্ছে, কে করছে এ সব কিছুই জানা যাচ্ছে না। এর মধ্যে হঠাৎ করে আমরা ইপিআর-এর চারজনকে দেখতে পেলাম যারা রীতিমতো যুদ্ধের পোষাক পড়ে অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসছে। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না, এরা পাকিস্তানের সমর্থক না আমাদের সমর্থক। আমরা গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। কিছদূর এগিয়ে এসে তারা ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে উঠলো। ‘জয় বাংলা’ চিৎকার শুনে আমরা দৌঁড়ে তাদের কাছে গেলাম এবং তাদের সাথে হাত মেলালাম। তারা বললো, ‘আমরা অনেক দুশমনকে খতম করেছি এবং এখনও খতম করা হচ্ছে। আপনারা শহরের দুশমনদের মারেন।’ শহরের দুশমন কথাটার অর্থ হচ্ছে যখন অসহযোগ আন্দোলন চলছিলো তখন আমাদের কাছে খবর আসে যে, ইপিআর ক্যাম্প থেকে কিছু অস্ত্র শহরের অবাঙালিদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। এটা আমরা কেউ কেউ দেখেছি এবং এটা আমাদের নলেজে ছিলো। এরা আমাদের ইঙ্গিত করলো ঐ সমস্যা লোকজনদের মেরে ফেলার জন্য। দু’টো কারণে তারা আমাদের এ কথা বলেছিলো। একটা হলো অবাঙালিরা আমাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয়ত এই আন্দোলনটা কোথায় যাবে কেউ তা বলতে পারে না। যদি এটা ফেল করে তাহলে ঐ সমস্যা অবাঙালিরাই আমাদের চিনিয়ে দিতে পারে। তখন আমি তাদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, আপনারা যদি এখন এ কাজে এগিয়ে যান তাহলে এ সংগ্রাম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আপনারা আপনাদের জায়গায় যান। সেখানে আমি সবার সিনিয়র ছিলাম বলে তারা আমার কথা শুনলো এবং ফিরে গেলো। ২৭ মার্চ রাত থেকে ২৮ মার্চ দিনভর গোলাগুলি চলতে থাকে। এই সংঘর্ষে ইপিআরদের অবাঙালি কমান্ডিং অফিসারও প্রাণ হারায়। একজন পাঞ্জাবি মেজর ছিলো ইপিআর উইংয়ে, মোঃ হোসেন তার নাম, তিনি শেষ পর্যন্ত বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রাণ হারান। তার ছেলে নিহত হয়। তার সঙ্গীও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার ছোট একটা ছেলে বেঁচে যায়। তাকে কেউ হয়তো ক্যাম্প থেকে নিয়ে আসে। শামসুজ্জোহা কাদের বক্স, যিনি মীর্জা রুহুল আমিনের চাচাত ভাই তার কাছে তাকে দেওয়া হয়েছিলো। পরে পাকিস্তানি ফোর্স যখন এই এলাকা দখল করে নেয় তখন তারা ঐ বাচ্চাটাকে পাকিস্তানিফোর্সের কাছে হস্তান্তর করে। যাহোক, ইপিআর-জনতা ঠাকুরগাঁও মুক্ত করলো। এরপর আমরা চিন্তা করলাম যে, চারিদিক থেকে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢোকার যে রাস্তাগুলো, সেগুলোতে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
প্র: তখন কি আপনাদের কোনো কন্ট্রোল রুম ছিলো ?
উ: হ্যাঁ, ছিলো। সংগ্রাম পরিষদের প্রথম কন্ট্রোল রুম ছিলো ফজলুল করিম সাহেবের কাছারি ঘরে। এটা ঠাকুরগাঁও চৌরাস্তার দক্ষিণ দিকে। সেটাকে এখন মোহাম্মদ আলী সড়ক বলা হয়। কিন্তুপরবর্তীকালে যখন স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়ে যায় এবং যুদ্ধবস্থানে সৃষ্টি হয় অর্থাৎ ২৬ মার্চের পর আমরা ঠাকুরগাঁও এস. ডি. ও. কোর্টের একটা রুম তাদের কাছ থেকে নিয়েছিলাম কন্ট্রোল রুমের জন্যে। সেখানে সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের লোক ডেপুটেড করা ছিলো। তখন আমাদের কাজ ছিলো চারিদিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা। এ সময় ঠাকুরগাঁওয়ের এস. ডি. ও. ছিলেন তসলিম উদ্দীন সাহেব। প্রথম দিকে আমাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিলো না। কিন্তু এস. ডি. ও. সাহেবের অফিস সংলগ্ন ট্রেজারি বিল্ডিংয়ের মধ্যে কিছু রাইফেল ছিলো। এ সব অস্ত্র আমরা জোর করে বের করে নিলাম এবং আমাদের ছেলেদের মধ্যে বিলি করলাম। তখন ঠাকুরগাঁওয়ে কোনো বৈদ্যুতিক আলো ছিলো না।
নিরাপত্তার কথা ভেবে এ সময় বিবাহিত ও বয়স্কদের অধিকাংশকেই ঠাকুরগাঁও টাউন থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তারা গ্রামে গঞ্জে নিরাপদ দূরত্বে আশ্রয় নিয়েছিলো। আমরা ইয়াংরা শুধু ঠাকুরগাঁও শহরে ছিলাম। ইয়াংদের মধ্যে আবার আমি সিনিয়র ছিলাম। এইভাবে আমরা যখন চারিদিকে ব্যারিকেড দিচ্ছি সে সময় একদিন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আশরাফ-এর নেতৃত্বে কিছুসংখ্যক বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ান ঠাকুরগাঁও শহরে আসে। তারিখটা ঠিক মনে নেই। বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঘ মার্কা মনোগ্রাম দেখে ওদেরকে আমরা শহরে স্বাগত জানালাম। জনতা উল্লসিত হলো। কিন্তু তারা আমাদের সাথে তেমন কোনো কথাবার্তা না বলে আবার শহর ছেড়ে চলে গেলো। তাদের মূল ক্যান্টনমেন্ট ছিলো সৈয়দপুরে। পাকিস্তানি আর্মি সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলো। সৈয়দপুর থেকে তারা আস্তে আস্তে ঠাকুরগাঁও শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছিলো। আমরা চারিদিকে রাস্তাঘাট কেটে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে ২৭ মার্চ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত চম্পাতলী থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এই গোটা এলাকা মুক্ত ছিলো। ঠাকুরগাঁওয়ে বস্তুত: তখন কোনো প্রশাসন ছিলো না। বাংলাদেশের যে মূল ভূ-খন্ড তা থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম। মূল নেতৃত্ব থেকেও আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম। আমরা তখন জানতাম না যে, আমাদের কেন্দ্রীয় নেতারা কোথায়, বঙ্গবন্ধু কোথায় ? তাঁরা কে কোথায়, কি করছেন, এ সবের আমরা কিছুই জানতাম না। আমরা কিছু মানুষ সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যেই লোকালি এই সংগ্রামটা চালাতে লাগলাম।
এপ্রিল মাসের ৪/৫ তারিখের দিকে আমাদের মনে হলো যে, আমরা এটা আর ধরে রাখতে পারবো না। পাকিস্তানিরা ক্রমশ: এগিয়ে আসছে হেভি আর্টিলারি নিয়ে। যখন আমরা ইপিআর ক্যাম্প টাকে পুরোপুরি দখলে আনলাম তখন বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে সুবেদার কাজিমদ্দীন নামে একজন ছিলেন। ঠাকুরগাঁওয়ে ইপিআর বাহিনীর মধ্যে তিনি তখন সিনিয়র সুবেদার ছিলেন। তার কাছ থেকে আমরা শুনলাম যে, তাদের কাছে কেবল থ্রি নট্ থ্রি রাইফেল, কিছু এস. এল. আর, এস.এম.জি. আর চারটা নাকি ফোর অথবা সিক্স পাউন্ডার গান আছে। আমরা এই ‘গান’ সম্পর্কে আগে জানতাম না। দেখলাম, একটা পাইপ তার মধ্য দিয়ে কোয়ার্টার মাইল পর্যন্ত গোলা ছোঁড়া যায়। হেভি হাতিয়ার বলতে অন্য কোনো গান ছিলো না। যখন পাকিস্তানিবাহিনী এগিয়ে আসতে লাগলো এবং দর থেকে গোলা ছুঁড়তে থাকলো তখন আমি, ইপিআর সুবেদার কাজিমদ্দীন সাহেব, এস. ডি. ও. বা মহকুমা প্রশাসক তসলিমউদ্দীন সাহেব এবং সংগ্রাম পরিষদে যারা ছিলাম তারা মিটিং করে বললাম, এভাবে তো আমরা বাঁচবো না। পাকিস্তানিরা এক পর্যায়ে আমাদের মেরে ফেলবে। এস. ডি. ও. তসলিমউদ্দীন সাহেব প্রথম দিকে আমাদের সাথে ছিলেন। কিন্তুপরে অর্থাৎ ঠাকুরগাঁও ফল করার পর পাকিস্তানিআর্মির সাথে যোগ দিয়েছিলেন, যদিও তিনি বাঙালি ছিলেন। যাহোক, যে কথা বলছিলাম- ঠাকুরগাঁও থেকে ইন্ডিয়ান বর্ডার ছিলো কাছে। তাই আমরা ঐ সভাতেই ঠিক করলাম ইন্ডিয়াতে লোক পাঠানো হবে। উদ্দেশ্য, সেখান থেকে হেভি আর্মস ও অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী আনা যায় কিনা। এটা এপ্রিল মাসের ৪ কি ৫ তারিখের কথা। তখন ওই সভাতেই সিদ্ধান্ত হলো যে, আওয়ামী লীগের যে সেক্রেটারি ছিলেন রশীদ মোক্তার সাহেব তিনি এবং আমি ভারতে যাবো। আমি যেহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, অ্যাডভোকেট, রাজনীতি করি, তাই তারা আমাকে বললেন যে, আপনি ইন্ডিয়াতে এই গ্রুপের অন্যতম প্রতিনিধি হিসাবে যাবেন এবং তাহলেই হয়তো একটা স্কোপ পাওয়া যেতে পারে। সেভাবেই সেখানে তারা রেজুলেশন নিয়ে আমাকে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি হিসাবে দেখানো হলো। এর কারণ ছিলো- ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা জনগণ ন্যাপ কিংবা অন্য রাজনৈতিক দলকে তেমন চিনতো না। ’৭০-এর নির্বাচনের কারণে, আন্দোলনের কারণে তারা তখন চেনে আওয়ামী লীগকে। এখন যেহেতু যুদ্ধাবস্থানে তাই আমরা কে কি দল করি- এ সব চিন্তা ভাবনা না করে লিখিত সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, বলরাম গুহঠাকুরতা ঠাকুরগাঁও আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি এবং আবদুর রশীদ প্রেসিডেন্ট- এদের দু’জনকে ভারতে পাঠানো হলো। এরা ভারত সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে হেভি আর্মস ও অন্যান্য সামগ্রী আনা যায় কিনা তার ব্যবস্থানে করবে।
এই সিদ্ধান্তের পর আমাকে এবং আবদুর রশীদ সাহেবকে টাকা পয়সা দিয়ে একজন ইপিআর-এর জওয়ানসহ আমাদেরকে মরাগতি নামক একটা জায়গা দিয়ে ইন্ডিয়ার বর্ডারে পৌঁছে দিলো। ওপাশে বি. এস. এফ.-এর একজন ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে জানতে পারি তাঁর নাম ক্যাপ্টেন ধীলন। আমি এ পাশ থেকে তাঁকে ইংরেজিতে জোরে জোরে বললাম,We are in problem, we are detached from the main land. But we are not able to keep our position this way. We want to talk your government. আমার কথা শুনে তিনি একটা ছোট নদীর ওপার থেকে আমাদের ইশারা করলেন ওপারে যাওয়ার জন্য। তখন আমি আর রশীদ মোক্তার সাহেব ওপারে গেলাম। সেখানে যাবার পর আমি তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, আমাদের বর্তমান অবস্থা এবং ইলেকশনের পর থেকে গোটা বাংলাদেশের অবস্থা। আমি বললাম, চম্পাতলী থেকে তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, আটোয়ারি এবং বীরগঞ্জ পর্যন্ত আমাদের যে এলাকা, সেটা যদিও মুক্ত আছে কিন্তুআমাদের সেখানে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধে হেভি আর্মস নেই। আমরা main land থেকে সম্পূর্ন detached. Main land-এ আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কে কোথায় কিভাবে আছেন তাও আমরা জানি না। আমাদের কাছে তেমন উল্লেখযোগ্য অস্ত্র ও নেই যে, আমরা পাকিস্তানি আর্মিকে প্রতিহত করতে পারবো। পাকিস্তানিরা কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তখন তিনি বললেন যে,We can not do anything, but one thing I can do. I can arrange for you, if you go to kolkata. আপনি কলকাতা গিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারো সাথে কথা বলেন। তার প্রস্তাবে আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলাম। তখন তিনি আমাদেরকে বি. এস. এফ.-এর একটা গাড়ি দিয়ে কিষণগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন এবং সেখান থেকে তারা কলকাতাগামী একটা বাসে তুলে দিলেন।
আমরা কলকাতা এলাম সম্ভবত: ৬ এপ্রিল। কলকাতা বিরাট শহর। এখানে কার সাথে কোথায় যোগাযোগ করতে হবে আমরা জানি না। আমাদের তো ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আগে থেকে কোনো যোগাযোগ ছিলো না। আর আমরা গেলেই যে, ওখানকার উচ্চ পর্যায়ের কেউ যে আমাদের সাথে কথা বলবেন- এমন গ্যারান্টি কে দেবেন ? তখন আমাদের একটা সুযোগ হলো। ঠাকুরগাঁওয়ের একজন আইনজীবী ছিলেন, তার নাম শরৎ দত্ত। ভারতে তাঁর এক জামাতা ছিলেন হেনলী কেবলস নামে একটা ইলেকট্রিক ওয়্যার কোম্পানির চীফ একাউন্টস অফিসার, তাঁকে আমরা চিনতাম। তাঁর কাছে আমরা গেলাম এবং তাঁকে সব কথা বলে তার সাহায্য চাইলাম। তখন তিনি বললেন, আমাদের কোম্পানির যিনি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, তিনি শেরিফ অব কলকাতা, তাঁর নাম ডি. এন. ঘোষ, তিনি রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরির ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে। তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারো সাথে আপনাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থানে করতে পারবেন। শরৎ দত্ত বাবুর জামাতা বললেন, আমি এটুকু করতে পারি যে, আপনাদের দু’জনকে আমি ডি. এন. ঘোষের কাছে নিয়ে যেতে পারি। তখন তার মাধ্যমে একটা সময় ঠিক করে আমরা দু’জন ডি. এন. ঘোষের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আমাদের সমস্যার কথা বললাম। তিনি প্রথমেই বললেন, Have you heard any revolution that without making cell in the neighbouring country ? Any revolution could be possible? আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতেই তিনি আমাকে বসতে বললেন। তারপরই বললেন, Where are your leaders ? শেখ মুজিব কোথায় ? অন্যান্য বড় বড় নেতারা কোথায় ? আমি তখন আমাদের পজিশনটা তাঁর কাছে আবার তুলে ধরলাম। তাঁকে বললাম, সৈয়দপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে চম্পাতলী। এরপর থেকে দিনাজপুর জেলার যে অংশটা সেটা যদিও মুক্ত আছে কিন্তু main land থেকে আমরা সম্পূর্ন detached। যদি পাকিস্তানিরা আমাদের দিকে অগ্রসর হয় তাহলে আমরা তাদেরকে রুখতে পারবো না। কারণ আমাদের কাছে কোনো ভারী অস্ত্র নাই। তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে, আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি। তবে, আমি মনে করি না যে, আপনারা কোনো অস্ত্র পেতে পারেন। কারণ আপনাদের কি identity আছে ? কি কারণে একটা সরকার আপনাদের মুখের কথার ওপর নির্ভর করে অস্ত্র দেবে ? মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ডি. এন. ঘোষ কথা বললে তিনি বলেন, এটা সম্ভবই না। এটা তো কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপার। এটা রাজ্য সরকারের কোনো ব্যাপার নয়। এটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী করতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী তাকে একথা জানিয়েছেন। ডি. এন. ঘোষ আরো বললেন, আর এটা করতে হলেও আপনাদের দেশের জনগণের যারা প্রতিনিধি তাঁদেরকে আসতে হবে। একটা অ্যাগরিমেন্ট হবে। তারপরে অস্ত্র দেয়ার প্রশ্ন। আমিও তখন দেখলাম, আসলে এটাই ঠিক। আমাদের কথা মতো তারা কেন অস্ত্র দেবে ? সে দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, ন্যাপ বা অন্য কোনো পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কলকাতায় এসেছেন কিনা সেটা জানাও আমাদের পক্ষে সম্ভব হলো না। এরপর ডি. এন. ঘোষ আমাদের বললেন, আপনাদেরকে দিয়ে আমি একটা সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করতে পারি, আপনারা যদি রাজি থাকেন। আমরা তার এই প্রস্তাবে রাজি হলাম। ডি. এন. ঘোষ দ্রুতই সেই প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলেন। ঐ প্রেস কনফারেন্সের অভিজ্ঞতা বা সৌভাগ্য জীবনে আমার আর হবে না। কারণ প্রেস ট্রাস্টের চীফ এডিটর বোধহয় তখন সুধীর মুখার্জী ছিলেন, তিনি এবং আনন্দবাজার পত্রিকার চীফ এডিটরসহ প্রায় প্রত্যেকটি পত্রিকার চীফ এডিটররা সেই প্রেস কনফারেন্সে উপস্হিত ছিলেন।
চলবে...