Mashuq Rahman ভাইয়ের মাস্টারপিস একটা লেখা। রাহিমাহুল্লাহু রাহমাতান ওয়াসি'আন। মহান রব তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস প্রদান করুন।
| যে কারণে হানাফিই রয়ে গেলাম |
ছোট বেলা থেকে না জেনেই হানাফী মাজহাব পালন করে বড় হয়েছি। নামাজ শিক্ষার যে বই গুলি বাসায় ছিল সব ছিল নিউজপ্রিন্টের। ভিতরে খালি মাসআলা ছিল। কুরআন হাদিসের কোন রেফারেন্স ছিলোনা। ছিল ব্র্যাকেটে ফতোয়ায়ে আলমগিরির রেফারেন্স। যা কি জিনিস জানতাম না।
বড় হলে আহলে হাদীস ও সালাফিদের বই পড়লাম। কুরআন ও হাদিসের প্রচুর রেফারেন্স দেয়াতে খুব ভালো লাগলো। তারা বললো- তুমি এসব মাজহাব ছাড়। সহীহ হাদিস মেনে ইবাদত করো। অন্ধ তাকলীদ করো না।
হানাফীরা ইমাম আবু হানিফা ও অন্যান্য মুকাল্লিদরা অন্যান্য ইমামদের ফিকহ মানে, এর চেয়ে সহীহ হাদিস মানো। একটু এক্সট্রিম কেউ কেউ তাকলীদকে শিরক বললো, বললো বুদ্ধি থাকলে তাকলীদ করতে হবে কেনো। এরকমই আরো কিছু কথা সুন্দর সুন্দর কথা।
আমার কথা গুলো বেশ মনে ধরলো। হানাফী থেকে আহলে হাদীস ইচ্ছা জাগলো। মাজহাবের তাকলীদ বাদ দিয়ে সহীহ হাদিসের উপর আমল করার ইচ্ছা জাগলো। হাতে টাকা ছিল জোগাড় করলাম সিহাহ সিত্তাহ, বাংলা-আরবী। আরবী স্কিপ করে বাংলায় সহীহ হাদিস পড়া শুরু করলাম।
কিন্তু ওযু ও গোসল অধ্যায়ই শেষ করতে পারলাম না। নামাজ তো আরো পরে।
রাসূলুল্লাহ (দঃ) এর ওযুর বিভিন্ন ধরণের বর্ণনা আছে। কোনটা মেনে ওযু করবো? ছোট একটা জিনিসই ধরি। কিছু জায়গায় অঙ্গ দুবার করে ধোয়ার কথা বলা আছে, কিছু জায়গায় তিনবার, কিছু জায়গায় একবার। আমি যদি দুবার করে ধৌত করি তাহলে একটা সহীহ হাদিস আমি মান্য করছিনা, তিন বার ধুলে অন্য আরেকটি সহীহ হাদিস মান্য করছিনা।
☞ প্রশ্ন ১: আমি এই যে কিছু সহীহ হাদিস মানতে যেয়ে অন্য সহীহ হাদিস মান্য করছিনা, সেগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে রেফারেন্স দিয়ে কেউ যদি বলে আমি সহীহ হাদিস মানিনা সেটা কি ঠিক হবে? এর মানে কি আমি সহীহ হাদিস অমান্যকারী?
এখন আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। আমি পড়ালেখা করেছি, বই পড়ার উৎসাহ আছে, ইসলামের প্রতি ঝোক আছে। এদের কথা ধরেন- আমাদের বাসার বুয়া বা বিল্ডিং এর কেয়ারটেকার পড়াশোনা করতে পারেনা। আমার বন্ধু কয়েকজন যারা পড়ালেখা জানলেও ইসলামী বই অধ্যায়ন করেনা কারণ ইসলামের প্রতি আগ্রহ নেই। আমার ছেলে যার বয়স যখন ৭ হয়েছে। এদের কেউ ওযু পারেনা।
☞ প্রশ্ন ২: তাদের কে শিখানোর জন্য যদি আমি যদি বুখারীর ও অন্যন্য হাদিস গ্রন্হের ওযু অধ্যায়ের সহীহ হাদিস গুলি সিরিয়ালি তাদের কাছে শুধু বাংলায় রিডিং পড়া শুরু করি, তারা কি সেগুলি বুঝে ঠিক মতো আমল করতে পারবে?
☞ প্রশ্ন ৩: যদি তারা না বুঝে তাহলে তো আমাকে তাদের দেখিয়ে দিতে হবে কিভাবে ওযু করতে হয়। তখন আমি বুখারীর ও অন্যন্য হাদিস গ্রন্হের ওযু অধ্যায়ে উল্লেখিত বাংলা সহীহ হাদিস গুলি সমন্বয় করে বা সেখান থেকে বেছে নিয়ে আমার বুঝ অনুযায়ী তাদের শিখাবো। এতে কি তারা সহীহ হাদিস মানলো নাকি আমার বুঝ ও ব্যাখ্যা মানলো? এই ব্যাখ্যাই কি ফিকহ না?
☞ প্রশ্ন ৪: যখন আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি, তখন আমার হাদিসের টেক্সট ও রেফারেন্স দেয়া কি আমার জন্য জরুরি হবে? বাস্তবেই কি তারা প্রত্যেকটির শিক্ষার পিছনের হাদিসের রেফারেন্স চাবে? নাকি বলবে শুধু ওযু শিখিয়ে দাও? এটি কি আমার উপর বিশ্বাস করে অন্ধ তাকলীদ করা নয় কি? যদি রেফারেন্স দিয়েও দি তাও কি তারা সহীহ থেকে জাল হাদিস পার্থক্য করতে পারবে?
☞ প্রশ্ন ৫: একটি হাদিস যে আমি সহীহ হাদিস কিভাবে বুঝছি? ব্র্যাকেটে লেখা আছে বলে। আমার সামর্থ্য নাই হাদিস শাস্ত্র অধ্যয়ন করে সহীহ যঈফ আলাদা করার। কেউ তাহকীক করে লিখে দিয়েছে। সেটাই চোখ বন্ধ করে মেনে নিচ্ছি। কেউ বুখারী অনুবাদ করে দিয়েছে, আমিও মেনে নিচ্ছি সেটা সঠিক অনুবাদ, কারণ আমার পক্ষে আরবি বুঝে অনুবাদের ত্রুটি ধরা সম্ভব না। এই তাহকীক ও অনুবাদ যে সঠিক মেনে নেয়া হচ্ছে সেটা কি অন্ধ তাকলীদ নয়?
☞ প্রশ্ন ৬: ওযুর মতো অতি সহজ ব্যাপারে আমার যদি এই অবস্থা হয়, নামাজের মতো অতি জটিল ব্যাপারে কি আমার পক্ষে সহীহ হাদিস পড়ে নামাজ শিক্ষা করা কিভাবে সম্ভব? যদি আমার পক্ষেই সম্ভব না হয় আমার ৭ বছরের ছেলে কিংবা পড়ালেখা না জানা বুয়ার পক্ষে কিভাবে সম্ভব?
☞ প্রশ্ন ৭: যদি সম্ভব না হয় তাহলে আমাকে এমন একজনের আলিমের দারস্ত হতে হবে যিনি সব হাদিস পড়ে বুঝে আমাকে নামাজের নিয়ম কানুন বুঝিয়ে দিবেন, তাইনা? হাদিস গুলির সমন্বয় করে যদি উনি ব্যাখ্যাই করেন তাহলে ফিকহ তো ফিকহই হয়ে গেলো। এই ক্ষেত্রে আমি কি সহীহ হাদিস মানছি নাকি ফিকহ? এই ফিকহ মানার মাধ্যমে আমি কি বাস্তবে সমন্বয়কৃত সহীহ হাদিসই মানছি না?
☞ প্রশ্ন ৮: আমি যদি আরেকজন আলিমের কাছে যাই এবং একই অনুরোধ করি হাদিস ঘেটে নিয়ম কানুন বানিয়ে দেয়ার জন্য। উনিও সব হাদিস ঘেটে আমাকে নিয়ম বানিয়ে দিলেন। প্রথম আলিমের নিয়ম গুলি আর দ্বিতীয় আলিমের নিয়ম গুলি কি হুবুহু একই হবে? নাকি তাদের দুজনের সমন্বয় পদ্ধতি আলাদা হতে পারে?
একজনের কাছে এক হাদিস বেশি সহীহ অন্য জনের কাছে কম সহীহ লাগতে পারে না? দুজন একই হাদিসের অর্থ কে দুই ভাবে নিতে পারে না? তারা কি আরবি ইবারত ভিন্ন ভাবে পড়তে পারে না? হাদিসের শত শত কিতাবের উনি হয়তো কিছু পড়েছেন অন্যজন কিছু? রাবী দুর্বল কিনা এই নিয়ে ইখতেলাফ আছে না? কারো কারো মতে বুখারী সব চেয়ে সহীহ, কারো মতে মুয়াত্তা ইমাম মালিক, এরকম আছে না?
আরো কত কারণ আছে, হাদিস শাস্ত্র কি অংকের মতো যে রেজাল্ট একটাই হবে? তাহলে দুজনেরই সহীহ হাদিস মানা সত্ত্বেও দুজনের নামাজের নিয়ম দুই ধরণের হতে পারে না? আমার কি সেই যোগ্যতা আছে যে আমি বলতে পারবো প্রথম জন বেশি ঠিক না দ্বিতীয় জন?
☞ প্রশ্ন ৯: ধরেন আমি প্রথম আলিমের কাছে যাওয়ার পর উনি আমার অনুরোধে সকল হাদিস ঘেটে আমার জন্য নামাজের নিয়ম বানিয়ে দিয়েছেন। এখন আমার ভাই যদি তার কাছে যেয়ে একই অনুরোধ করে তাহলে কি তিনি এই কাজটি হাদিস ঘাটার কাজটি কি আবার করবেন? নাকি আমাকে যে নিয়ম গুলি উনি দিয়েছেন সেগুলিই আমার ভাইকেও দিয়ে দিবেন? আমার ভাই আজ থেকে ১০ বছর পর গেলে একই নিয়মই তো পাবেন ওই আলিম থেকে তাইনা (কারণ যে হাদিস দেখে নিয়ম তৈরী করেছেন সেই হাদিস তো আর ১০ বছরে পরিবর্তন হয়নি)? ৫০ বছর পর কেউ গেলে? এখানে কি নামাজের নিয়ম পরিবর্তন হওয়ার খুব বেশি সুযোগ আছে? ১৩০০ বছর পর? নাকি প্রত্যেকবার শুরু থেকে হাদিস ঘাটতে হবে?
যদি পরে আমরা প্রথম আলিমের বের করা নিয়ম কে মাজহাব বা ফিকহে X এবং দ্বিতীয় আলিমের বের করা নিয়ম কে মাজহাব বা ফিকহে Y নাম দিই , তাহলে X ও Y ফলো করা কি ১৩০০ বছর পর হারাম হয়ে যাবে, যেখানে এটি ১৩০০ বছর আগে সহীহ ছিল!?
☞ প্রশ্ন ১০: নামাজ তো আর নতুন জিনিস না। এটি ইসলামের শুরু থেকে চলছে। তাহলে এই হাদিস ঘাটাঘাটি করে নামাজের নিয়ম বের করার কাজও তখন থেকেই হওয়ার কথা। তখন থেকেই যদি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বা ইমাম মালিক (রহঃ) বা ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বা ইমাম আহমদ (রহঃ) যদি এই হাদিস ঘাটাঘাটি করে নামাজের নিয়ম বের করার কাজটি করে গিয়ে থাকেন, নামাজের নিয়ম তো আর পরিবর্তন হয়নি, তাহলে এখন সেগুলি মানতে সমস্যা কোথায়?
ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেব এই যুগে এসে হাদিস ঘাটাঘাটি করে যে নিয়ম বের করেছেন তা ওগুলোর উপর প্রাধান্য পাবে কেন? ওই চার ইমামের কারো যোগ্যতা কি ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেবের চেয়ে কম ছিল?
☞ প্রশ্ন ১১: এখন যদি কেউ বলেন যে সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ (দঃ) এর ওফাতের পর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় হতে পারে।
হয়তো প্রধান সাহাবীরা যেসব এলাকায় গিয়েছিলেন বা ছিলেন সেসব জায়গায় নামাজ সম্পর্কিত সব হাদিস ছিল। এই ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার কাছে কুফায় বা ইমাম মালিকের কাছে মদিনায় নামাজ সংক্রান্ত সব হাদিস ছিল। এই ক্ষেত্রে তারা এসব বেছেই নামাজের নিয়ম বানিয়েছেন। ওই নিয়ম ফলো করতে আপত্তি কোথায়?
অথবা, সাহাবীরা যেসব এলাকায় গিয়েছিলেন সেখানে নামাজ সম্পর্কিত সব হাদিস ছিলোনা, কিছু হাদিস ছিল। তাই কোনো এক এলাকায় যেমন ইমাম আবু হানিফার কুফায় কিংবা ইমাম মালিকের মদিনায় সব হাদিস ছিলোনা। পরে সব হাদিস একত্রিত হয়েছে। তাই সব হাদিস বাছাই করে বানানো ল্যাটেস্ট ইমাম আলবানী সাহেবের নামাজের নিয়ম বেশি শুদ্ধ।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে ওই সব এলাকায় আংশিক হাদিস থেকে বানানো আংশিক নামাজের নিয়ম পালন করে যদি সালাফ তথা তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈনরা শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম হয় তাহলে ওই আংশিক নিয়ম পালন করলে আমরা কেন ধরা খাব কিংবা সাওয়াব কম পাবো?
☞ প্রশ্ন ১২: সুন্নাহর বিস্তার এর একমাত্র মাধ্যম কি হাদিস? এছাড়া কোন মাধ্যম নেই? ওযুর কথাই ধরুন না। যখন সাহাবীরা তাদের সন্তান বা তাবেঈদের ওযু শিক্ষা দিতেন তখন কি শুধু হাদিস বর্ণনা করতেন?
নাকি হাতে কলমে নবীজির (দঃ) এর কাছ থেকে শেখা ওযুর মতো করে ওযু করে অন্যদের শিক্ষা দিতেন?
তাহলে তাবেঈ বা তাবেঈ-তাবেঈনদের সংস্পর্শে এসে প্র্যাকটিকাল নামাজ শিক্ষার পদ্ধতি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) কিংবা ইমাম মালিকের (রহঃ) বেশি জানার কথা নাকি ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেবের?
ইমাম আলবানীর কাছে তো শুধু হাদিস আছে, কিন্তু ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিকের কাছে হাদিসের সাথে সাথে প্র্যাকটিকাল শিক্ষাও তো ছিল। কার নামাজের নিয়ম বেশি শুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?
☞ প্রশ্ন ১৩: ইমাম চতুষ্টয়ের বানানো নামাজের নিয়ম প্রায় ১৩০০ বছর ধরে মুসলিম উম্মাহ ফলো করে আসছে। উম্মাহর ইতিহাসের বাঘা বাঘা আলিম এগুলি মেনে নামাজ পড়েছেন। এমন সময় যখন ইসলাম দুনিয়াতে বিজয়ী ছিল, যখন মুসলিমদের ঈমান আমল ও ইখলাস বর্তমান মুসলিমদের চেয়ে বেশি ছিল। আর ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানীর তৈরী নামাজের নিয়ম অপেক্ষাকৃত অনেক কম মানুষ অনেক কম দিনের জন্য ফলো করছে, যখন মুসলিমদের ঈমান, আমল ও আখলাক সবচেয়ে নিচে। প্রথমোক্ত গ্রূপের বহু মুসলিমদের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি নাকি দ্বিতীয় গ্রূপের কম মুসলিমদের?
☞ প্রশ্ন ১৪: কুরআনে বলা আছে শুধু মাত্র বাপ-দাদারা করতো বলে কোন কিছু করা উচিত না। কিন্তু তা কি মুশরিক বাপ-দাদাদের ব্যাপারে বলা হয়নি? বাপ-দাদা যদি মুসলিম হয় তাহলে তো তাদের মান্য করতে কোনো দোষ আছে?
যেমন নবী ইয়াকুব (আঃ) মৃত্যুর সময় তার পুত্রদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন তারা তার পরে কার ইবাদত করবে। তার ছেলেরা উত্তর দিয়েছিলেন তাদের বাপ-দাদাদের উপাস্যের। বাপ-দাদা সঠিক রাস্তায় থাকলে সেই রাস্তা দিয়ে হাটা যাবেনা এমন কথা কি বলা আছে? নূহ (আঃ) এর ছেলে যদি এই যুক্তি দিত যে বাপ-দাদা মেনে আসছে বলে আমরা মানবোনা এটা কি সঠিক হতো?
এসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে সালাফী হতে দিলোনা।
আমি হানাফীই থাকলাম। এবং মন ভরে দুআ করলাম সেই সব আলিমদের যারা আমাদের জন্য নিজেদের সারা জীবন বিলিয়ে দিয়ে সহজ ফিকহের কিতাব লিখে গিয়েছেন, যা মাত্র ১০০/২০০ টাকা দিয়ে কিনে কিংবা আলিমের সোহবতে শিখে আমল করে আমরা অমূল্য অফুরন্ত অনিঃশেষ জান্নাতের জন্য কাজ করতে পারি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ইমামে আজম আবু হানীফা রহ. একজন তাবে'ঈ ছিলেন।
[পোস্টটি Mashuq Rahman ভাইয়ের আরো দু'বছর আগের লেখা]