হতভাগ্য মা ও অনাগত এক শিশু
প্রথম আলোর এই খবরটি আমার ব্লগে কপি করে রাখলাম শ্রেফ অনেকটা নিজের ডাইরীতে কোন ঘটনা লিখে রাখার মত করে... ইনশাল্লাহ একদিন এরা সঠিক পথে ফিরে আসবে... আমিন।
হাসপাতালে মাতৃত্বের গর্ব আর তৃপ্তি নিয়ে শুয়ে থাকার কথা ছিল তাঁর। পাশে থাকত সদ্যজাত স্বাস্থ্যবান একটি শিশু। পরম নির্ভরতায় মায়ের পাশে ঘুমিয়ে থাকার কথা ছিল শিশুটির। আর মাও তাঁর সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে শিশুটিকে আগলে রাখতেন। কিন্তু এসবের কোনোটিই হয়নি—হতে দেওয়া হয়নি। যা ঘটেছে তা ভয়ংকর। হাসপাতালেই শুয়ে ছিল চীনের সেই মা। জীবিত তবু যেন মৃত। এলোমেলো চুল ছড়িয়ে ছিল মুখে। পাশে তাঁর অচেতন কন্যাসন্তান। শিশুটি বেঁচে নেই। তাকে বেঁচে থাকতে দেওয়া হয়নি। বেঁচে আছেন মা। তবে অচেতন, অনেকটা জড় পদার্থের মতো।
চীনের হতভাগ্য এই মায়ের নাম ফেনজ জিয়ানমেই। চীনা সরকারের এক সন্তাননীতির শিকার তিনি। দ্য ইকনোমিস্টে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, চীনের স্থানীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা একটি ইনজেকশনের মাধ্যমে গর্ভে থাকতেই হত্যা করেছে শিশুটিকে। সাত মাসের সন্তানসম্ভবা ফেনজ জিয়ানমেইকে ইনজেকশন দিয়ে মৃত সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য করেছে চীনের সরকার।
ফেনজ চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সাংহাই প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে থাকেন। তিন বছর আগে হলেও তাঁর এই দুর্ভোগের কথা অজানাই থেকে যেত। কিন্তু এখন যুগটা তথ্যপ্রযুক্তির। ইন্টারনেট এখন সারা বিশ্বকেই আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। আর তাই ফেনজের স্বজনেরা তাঁর ছবি তুলে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়। আর সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট, ব্লগের মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে দেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যায় সেই ছবি। এই ঘটনা দেখে চীনের অধিবাসীরাও ইন্টারনেটে তাদের উদ্বেগের কথা জানায়। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এটি ফেনজের একার দুর্দশা নয়। চীনের সরকারের এক সন্তাননীতির কারণে এমন দুর্দশার শিকার ফেনজের মতো আরও অনেক মা-বাবা।
সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট টুইটারের চীনা সংস্করণ সিনা উইবোতে লিয়াং জিয়ানঝাং বলেন, শুধু সাংহাইয়ে নয়, শুধু ফেনজের সঙ্গে নয়, অনেককেই এ ধরনের ভয়ংকর ঘটনার শিকার হতে হয়েছে। গর্ভপাতে বাধ্য করা হয়েছে অনেক মাকে।
চীনা সরকারের এক সন্তাননীতির আরেক সমালোচক হি ইয়াফু বলেন, এটি কেবল একজনের ঘটনা নয়। ১৯৮৩ সালে পরিবার পরিকল্পনা কমিটি চীনের এক কোটি ৪০ লাখ মাকে গর্ভপাতে বাধ্য করে। ২০০৯ সালে জোর করে ৬০ লাখ মায়ের গর্ভপাত করানো হয়। তবে সম্প্রতি পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা এই সংখ্যা প্রকাশে আপত্তি জানান।
চীনে একের বেশি সন্তান থাকলে সরকারকে জরিমানা দিতে হয়। এই জরিমানার সরকারি নাম হলো ‘সামাজিক ভরণপোষণের ব্যয়’। হি ইয়াফুর মতে, ১৯৮০ সাল থেকে সরকার ৩১ হাজার ৪০০ কোটি ইউয়ান জরিমানা আদায় করেছে। এই টাকা না দিলে সরকার দ্বিতীয় বা অতিরিক্ত সন্তানটির জন্য বাসস্থান বা শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করে না। সাংহাইয়ে স্বামী ও স্ত্রীকে দ্বিতীয় সন্তানের জন্য ১৭ হাজার ৩০০ ডলার জরিমানা দিতে হয়। আয় বাড়লে জরিমানাও বাড়ে।
প্রত্যন্ত গ্রামের অধিবাসী ফেনজের জন্য জরিমানার পরিমাণ কিছুটা কম ছিল। তাঁর জরিমানা ছিল ৪০ হাজার ইউয়ান। শর্ত ছিল, সরকারকে এই জরিমানা দিলেই দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিতে পারবে ফেনজে। কিন্তু দরিদ্র মা ফেনজের পক্ষে তা ছিল একেবারে অসম্ভব। ফেনজের স্বামী দেং জিউয়ান স্থানীয় জল বিদ্যুেকন্দ্রের স্বল্প-বেতনের একজন কর্মচারী। মাসে তাঁর আয় চার হাজার ইউয়ান। জরিমানা দিতে হলে আয় করতে হবে আরও বেশি। তাই ৩০ মে জিউয়ান মঙ্গোলিয়ার কয়লা খনিতে কাজ নেন। লক্ষ্য একটিই। যদি আরও কিছু অর্থ পাওয়া যায়। যদি বাঁচানো যায় শিশুটিকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। অনাগত শিশুকে বাঁচাতে সন্তানসম্ভবা ফেনজ লুকিয়ে ছিলেন তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে হানা দেন পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা। তাঁরা দরজা ভেঙে বাড়িটিতে ঢোকেন। ফেনজ কাছের এক পাহাড়ে পালান। সেখানে এক বন্ধুর বাড়ির খাটের নিচে লুকান ফেনজ। কিন্তু শিশুকে বাঁচানোর এই চেষ্টাটিও ব্যর্থ হলো। ফেনজের স্বামী দেং জানান, সে সময় পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা ফেনজকে দেখে হাসতে থাকেন। একজন জোর করে ফেনজকে একটি ফর্মে সই করান। এরপর ফেনজের তলপেটে জোর করে ইনজেকশন দেওয়া হয়। এর ৩০ ঘণ্টা পর ফেনজ মৃত শিশুর জন্ম দেয়। অনাগত সন্তানকে নিয়ে দেখা সব স্বপ্ন ভেঙে যায় তাঁর। কোনো আইনি সংস্থা হতভাগ্য এই মায়ের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। ১৪ জুন প্রাদেশিক সরকার ফেনজের কাছে ক্ষমা চায়। বলা হয়, ঘটনার জন্য দায়ী পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। তবে কোনোটিই হয়নি। যে শিশুটিকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া হয়নি, তার বাবা ও ফেনজের হতভাগ্য স্বামী দেং জানতে চেয়েছেন, ‘অতিরিক্ত সন্তানের জন্য জরিমানা দেওয়ার মতো অর্থ আমার কাছে ছিল না। আর তাই সারা জীবন সন্তান হারানোর দুঃখ বয়ে বেড়াব আমরা? সরকারের কাছে এটাই কি আমাদের প্রাপ্য?’