বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমার এক কলিগ কাম বন্ধু হঠাত অসুস্থতায় পড়লো। ও আর আমি একই বিল্ডিঙের কাছাকাছি দু’টি আলাদা রুমে থাকতাম। দু’জনেরই ছিল বি শিফট ডিউটি। অর্থাৎ বিকেল ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। বি শিফট বলে সকালে ওঠার তাড়া নেই। তাই রাত করে ঘুমিয়েছি আগের দিন। সকাল সাড়ে ৯ টায় ঘুম ভাঙলো। ঊঠে দেখি ওর অনেকগুলো কল মিসড হয়ে আছে। ভাইব্রেশান দিয়ে রেখেছিলাম রাতে ঘুমানোর আগে। তাই টের পাইনি। আমি কলব্যাক করলাম তখনি। ও তখন বলল, দোস্ত একটু রুমে আসো। আমি একটু ঝামেলাই পড়েছি। আমি বললাম ঝামেলা কিসের? ও বলল, আসো আগে তারপর বলছি। আমি ভাবলাম ওর হয়ত নিচে নামতে মন চাচ্ছে না। আমাকে দিয়ে নাস্তা আনার বাহানা। ব্যাপারটাকে অত গুরুত্ব না দিয়ে ধীরে-সুস্থে ব্রাশ করে, ফ্রেশ হয়ে, রেডি হয়ে ওর রুমে গেলাম।
গিয়ে দেখি আসলেই সাংঘাতিক অবস্থা। ও মোটেই হাটতে পারছে না। ডান পা ভাঙতেই পারছে না। ওকে বললাম ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নেওয়া ঠিক হবেনা। তুমি রেডি হও। আমি অফিসের এম্বুলেন্সে ফোন করি। রেডি হওয়ার পর ওকে অনেক কষ্টে চারতলা থেকে নামিয়ে গেটের গার্ডরুমে নিয়ে আসলাম। পুরোটা পথ ও আমার ঘাড়ে ভর দিয়ে প্রায় এক-পায়ে হেটে আসলো। এম্বুলেন্স আসতে একটু দেরি হচ্ছিল। ওকে মোটেও চিন্তিত বা সিরিয়াস মনে হচ্ছে না। এই অপেক্ষার সময়টুকুতে সে তার অসুস্থতার ব্যাপারটাকে পুরোপুরি ফাজলামির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর এম্বুলেন্স আসলো। এম্বুলেন্সের ড্রাইভার আমাদেরকে ফ্যাক্টরীর ক্লিনিকে যাওয়ার পরামর্শ দিল।
সেখানে গিয়ে দেখি এমবিবিএস ডাক্তার এখনো এসে পৌছাননি। যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি হালকা কিছু পথ্য দিয়ে দুপুরের পর আসতে বললেন। বললেন ঐ সময় ডাক্তার আসবেন। আপনি ঐ সময় ঊনার সাথে এসে দেখা করেন। আর এই ওষুধগুলো আপাতত খেয়ে নিন। রগে টান পড়েছে। এটা তেমন সিরিয়াস কিছু না। দু’দিন রেষ্ট নিলেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ও কানে কানে আমাকে বলল, দোস্ত এই সুযোগ। হাসপাতাল যাওয়ার নাম করে চলো এম্বুলেন্সে করে শহরের দিকে যায়। সকাল থেকে নাস্তা করা হয়নি। অনেক ক্ষুধা লাগছে। তাছাড়া অনেকদিন ভাল-মন্দ খাওয়া হয়না। শহরের ভাল একটা হোটেলে নাস্তা করা যাবে। পরে না হয় হাসপাতালেও যাবো। রথ দেখাও হল, কলা বেচাও হল। আমি মনে মনে বললাম, শালা বলে কি? তারপর কি ভেবে রাজী হয়ে গেলাম।
ও ক্লিনিকের ঐ ডাক্তারের এসিস্টেন্টকে বলল, দেখুন আমার কাছে ব্যাপারটাকে নরমাল মনে হচ্ছে না। এতক্ষন ওয়েট করা মনে হয় ঠিক হবেনা। আপনি ড্রাইভারকে বলুন আমাদের শহরের কোন হাসপাতালে পৌছে দিতে। ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আমরা এম্বুলেন্স নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ড্রাইভার দেখলাম কার সাথে ফোনে কথা বলা শুরু করলো ফ্যাক্টরী ছাড়ার পর। একটু পরে পিছনে ফিরে ড্রাইভার ওর নাম জিজ্ঞাসা করল। ও নাম বলল। তারপর ড্রাইভার অপরপ্রান্তে বলল, আমি একজন রোগী পাঠাচ্ছি। এই এই নাম। একটু ব্যবস্থা করবা। পরে আমাদেরকে বলল, ওখানে আমার এক আত্বীয় আছে। রিসিপশানে গিয়ে আপনি আপনার নাম বলবেন। ওরা আপনাকে একটু সাশ্রয়ে চিকিতসার ব্যবস্থা করবে। বন্ধু কানে কানে বলল, দোস্ত খেয়াল করছো? সব কমিশনের খেলা। আমিও পাখনা মাল। দেখবো ক্যামনে কমিশন খাই। আমি হাসলাম।
৫/৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার পর আমরা শহরে এসে পৌছালাম। আর মাত্র এক কিলোমিটার পথ বাকি হাসপাতালের। আর যেখানে আছি এখানেই সেই হোটেলটি যেখানে আমাদের নাস্তা করার প্ল্যান। ও বলল, দোস্ত একটা ব্যবস্থা করো। হোটেলের কাছে তো চলেই এসেছি। আমি একটু ভাবলাম। তারপর ড্রাইভারকে বললাম, আমাদের এখানেই নামিয়ে দিন। আমরা তো নাস্তা করিনি। ডাক্তারের এপয়েন্ট পেতেও হয়ত লাইন দিতে হবে। কিছু না খেয়ে এতক্ষন থাকা কষ্টকর হবে। ড্রাইভার আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু হাসপাতাল তো এখনো এক কিলোমিটার দূরে। আমি বললাম, এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমরা রিক্সা নিয়ে চলে যাবো। ড্রাইভারকে কেমন দ্বিধান্বিত মনে হল। শেষমেষ আমাদেরকে হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে রোগীর নাম রিসিপশানকে বলার কথা মনে করিয়ে দিল। ব্যাটা হয়ত ভাবছে তার কমিশন মিস হয়ে যাচ্ছে।
এম্বুলেন্স থেকে হোটেলের সামনে নামতে দেখে কিছু পথচারী উতসুক চোখে আমাদের দিকে তাকাল। তারা হয়ত ভেবে পাচ্ছে না, রোগী এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে না গিয়ে হোটেলে নামছে কেন? আমরা হোটেলে একটা টেবিল দখল করে বসলাম। হোটেলের বয়গুলোরও দেখলাম পথচারীদের মত অবস্থা। তারা ভাবছে, এ কেমন কাস্টমার রে বাবা! এম্বুলেন্সে করে নাস্তা করতে আসে! যাইহোক দু’জন আধা ঘন্টা ধরে পেট পুরে খেলাম। তারপর রিক্সা নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
হাসপাতালে নেমে ওকে নিয়ে রিসিপশানের দিকে এগিয়ে গেলাম। রিসিপশানিস্ট নাম জানতে চাইল। ও চালাকি করে আমার নাম বলল। রিসিপশানিস্ট একটা কাগজে নাম লিখে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ডাক পড়া পর্যন্ত ওয়েট করতে বললেন। এক সময় আমাদের সিরিয়াল আসলো। আমরা ডাক্তারের রুমে গেলাম। ডাক্তার ওর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার নাম সুমন? ও একটু ইতস্তত হয়ে বলল জ্বী। এরপর ডাক্তার ওকে কিছু প্রশ্ন করে কয়েকটা ওষুধের নাম লিখে প্রেসক্রিপশানটা ধরিয়ে দিলেন। বললেন সিরিয়াস কিছু নয়। এই ওষুধগুলো খাবেন আর ২ দিন বেডরেষ্ট নেবেন। আমরা ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।
কিন্তু একটা ঝামেলা হয়ে গেল। ২ দিন বেডরেষ্ট নিতে হলে অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে। কিন্তু প্রেসক্রিপশানে তো আমার নাম লেখা। কি করা যায়! নামটা তো বদলাতে হবে। ওকে রিসিপশানে বসিয়ে রেখে আবার ডাক্তারের সাথে দেখা করলাম। আমি বললাম একটু তো মিসটেক হয়ে গেল ডাক্তার সাহেব। রোগীর ডাকনাম হচ্ছে সুমন। পুরো নাম হচ্ছে বেলাল হোসেন সুমন। ছুটি নেওয়ার জন্য তো অফিসিয়াল নামটাই লাগবে। এটা কেটে একটু যদি লিখে দিতেন। ডাক্তার অতি বিনয়ের সাথে বললেন, ওহ শিউর শিউর। এরপর সুমন কেটে বেলাল হোসেন লিখে যেই না আবার সুমন লিখতে যাবেন, আমি বললাম ওটা আর লেখার দরকার নেই। সারটিফিকেটে ডাকনামটা নেই। এরপর ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে কাদের মোল্লা স্টাইলে ভি সাইন (মানে কাম সারছি) দেখিয়ে বন্ধুর দিকে ছুটে গেলাম।