সময়টা ২০০৭ এর মাঝামাঝি। এইচ এস সি পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। কিন্তু জীবনের আসল পরীক্ষা তখনো বাকি। অন্যান্যদের মত আমারো ছুটি নাই। কোচিং এর জন্য রওনা দিলাম আজব শহর ঢাকার অভিমুখে। শেল্টার নিলাম মনিপুরী পাড়ার ১নং গেটে মিলেনিয়াম ছাত্রাবাসের ৫০১ নম্বর রুমে। সঙ্গী অনেকদিনের চেনাজানা কলেজ ফ্রেন্ড এবং মেসমেট সোহেল। আজাইরা এক পাবলিক। তিন জনের রুমে আমাদের সাথে যোগ দিলো শরিফ নামের এক অপরিচিত ছেলে। ওর বাড়ী ছিল ময়মনসিংহ। চরম হাসিখুশি আর ইনোভেটিভ আইডিয়াতে মাথা ভরা। পড়াশোনা বা কোচিং এ আমাদের দু'জনের মত ওরও তেমন মনোযোগ নাই। একই গোয়ালের গরু হওয়াই অল্পদিনেই ও আমাদের খুব ক্লোজ হয়ে গেলো। সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে-ফিরে, সন্ধ্যায় জিয়া উদ্যানে আড্ডা দিয়ে, আর গভীর রাত পর্যন্ত ২৯ নাইন খেলে সময়গুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিল।
দিন আসে দিন যায়। আমাদের সোনার সময় গুলোও কেটে যায় একে একে। তার পর আসলো রমজান। ততদিনে আমরা গৎবাধা রুটিনে হাঁপিয়ে উঠেছি। চলার পথে নতুনত্ব দরকার। আমরা আমাদের দৈনন্দিন রুটিন পাল্টানোর প্লান করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম এই রমজানে দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানাবো। যেই ভাবনা সেই কাজ। আমাদের দিন শুরু হত ইফতারের ১৫ মিনিট আগে। ঘুম থেকে উঠে এক বয়কে দিয়ে ইফতার আনাতাম। এই ফাকে আমরা ব্রাশ করে একটু ফ্রেশ হয়ে নিতাম। তারপর পেট ভরে ইফতার। অত:পর গোসল দিয়ে গন্তব্য চন্দ্রিমা উদ্যান আর সংসদ ভবনের আশপাশ। ওখানে হালিম ফুচকা খেয়ে আর আড্ডা দিয়ে রাত দশটার দিকে রুমে ফিরতাম। তারপর রাতের খাবর খেয়ে বসে পড়তাম তাস নিয়ে। চলত সেহরী পর্যন্ত। তারপর সেহরী খেয়ে ঘুম সেই ইফতারের ১৫ মিনিট আগ পর্যন্ত। এইভাবেই চলছিল দিনগুলি।
কিন্তু আমাদের মত পুংটাদের কাছে এই রুটিনও আর বেশীদিন স্যুট করল না। চিন্তা করলাম নতুন কিছু করার। শরিফ প্রস্তাব করল একটা সংগঠন বানানোর। যে সংগঠনের কাজ হবে প্রতিদিন ১৫০ জন লোককে সেহরীর জন্য ডাকা। সংগঠনের জন্য নামও ঠিক করলাম। যুগান্তকারী নাম "মোবাইল কাফেলা"। আমাদের মিশন শুরু হত রাত আড়াইটা থেকে আর চলত রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। কাজ বেশী কঠিন না। আমাদের মোবাইল নম্বরের শেষ ডিজিটটা পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন করে একে একে ৫০ টি নম্বরে ফোন করতাম। ডায়লগ একটাই। একেবারে মুখস্থ "ভাইয়া আমি মোবাইল কাফেলা থেকে বলছি, সেহরীর সময় হয়েছে। সেহরী খেয়ে নিন।" ডিজুসে তখন ছিল ২০ সেকেন্ড পালস্ আর ২৫ পয়সা পার মিনিট। আমরা প্রতিজনের পিছে মাত্র ২০ সেকেন্ডই ব্যয় করতাম। ফলে ২৫ পয়সায়ই করা যেত তিনটা কল। শুধুমাত্র ঐ কথাটুকু বলেই কেটে দিতাম। এই আজব সংগঠনের নাম শুনে অনেই কলব্যাক করত। জানতে চাইতো কি এটা। উত্তরও ছিল গৎবাধা। নরমালি ভাই, আর ভারিক্কি গলার কেউ হলে আংকেল সম্বোধন করতাম। বলতাম, অনেকেই রমজানে সময়মত উঠতে পারেনা। সেহরী খেতে পারেনা। তাই আমরা কয়েক যুবক মিলে একটা সংগঠন খুলেছি আপনাদের সেবায়। যাতে অন্তত কিছু লোকের উপকার করতে পারি। বেশীরভাগ পাবলিকই বাহবা দিত। বলত দারুন কাজ। এভাবে অনেকদিন চালিয়েছি। কয়েকজন আংকেল আমাদের ফ্যান হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে প্রায় প্রতিদিন ডাকতাম। কোনদিন মিস হলে ফোন দিয়ে বলত কি ব্যাপার বাবারা? তোমরা কি আজ তোমাদের কাজ শুরু করোনি?
অনেকদিন পর আজ আবার মোবাইল কাফেলা করতে ইচ্ছা করছে। আননোন নম্বর থেকে ফোন দিয়ে শরিফ আর সোহেলকে চমকে দেব ভাবছি।
বি:দ্র: সংগঠনটা নিরহ টাইপ মনে হলেও এর একটা উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল। সেই উদ্দেশ্যটা কি হতে পারে সেটা পাঠকদের জন্য ধাধা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১২:২৩