অজিত রায়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী
অজিত রায় জন্মেছিল কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ২৯ জুন, ১৯৩৮ সালে। রংপুরের অনেকের কাছেই তিনি তাঁর ডাক নাম রথুতেই বেশি পরিচিত। দুই ভাই ছিলেন তাঁরা। অজিত রায় (রথু) ও অশোক রায় (সথু) যিনিও ভারতের একজন উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী। তাঁর বাবা স্বর্গীয় মুকুন্দ রায় রংপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চাকুরী করতেন, সেই সূত্র ধরেই রংপুরে চলে আসা। তারপর ওখানকার জল হাওয়াতেই তাঁর বেড়ে ওঠা-তাঁর লেখাপড়া তাঁর সংগীত শিক্ষা সব। অজিত রায় এর শিক্ষাজীবন শুরু রংপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে রংপুর কারমাইকেল কলেজ। এরপর জীবিকার সন্ধানে ঢাকায়, গানকে পুঁজি করে প্রথিতযশা এই শিল্পীর প্রথমটা শুরু হয়েছিল তবলা দিয়ে, ছোট বেলায় পা ভেঙ্গে ঘরে বসেছিলেন সে সময়েই হয়ে ওঠেন একজন দক্ষ তবলা বাদক। আর তাঁর প্রথম মঞ্চে ওঠাও তবলা নিয়েই। খ্যাতিমান সেতার বাদক নবদ্বীপ লাহিড়ীর সেতার বাদনে তাঁকে সঙ্গত করতেই রংপুর জেলা পরিষদ মিলনায়তনের মঞ্চে ওঠা তার। দারুন বাজিয়েছিলেন। আর তাই মঞ্চ থেকে নামার পরপরই তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়েছিল দর্শকরা।
অজিত রায়ের মা স্বর্গীয় কণিকা রায়। যিনি ছিলেন রংপুর বেতারের নিয়মিত শিল্পী আর অন্যদিকে সালেমা বহুমুখী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। জলপাইগুড়ি জমিদার পরিবারের মেয়ে ছিলেন তিনি। আর তাঁর গান শেখাও হয়েছিল সে সময়ের শান্তি নিকেতনের দিদিমনিদের কাছে। খুব ভাল গাইতেন রবীন্দ্র সংগীত, অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত আর ডিএল রায়ের গান। এই মায়ের কাছ থেকেই তাঁর সঙ্গীত জীবনের শিক্ষা শুরু। তাঁর শিল্পী সত্তা সংগীতকে মনে-প্রাণে-দেহমনে এক করে পাওয়া, আর সঙ্গীতের মুল প্রভাব তাঁর মায়ের কাছ থেকেই। ছাত্র জীবন থেকেই উদার প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী মানসিকতা লালন করতেন। ১৯৫৭ সাল কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন পক্ষ থেকে সামাজিক ও আপ্যায়ন সম্পাদক পদে জয়লাভ করেন। ১৯৬২ সালে তাঁর প্রথম ঢাকা যাওয়া। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বেতারের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্তি। ফিরে অসেন ১৯৬৪ সালে তারপর আবার ১৯৬৬ সালের শেষ দিকে ঢাকায় গিয়ে পুরোপুরি থিতু হয়ে বসা। সে সময় উত্তাল ঢাকা। স্বাধীকারের জন্য ও স্বাধীনতার জন্য। শিল্পী জাহিদুর রহিম আর তিনি সে সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছুটে বেড়িয়েছেন গান গেয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য। জনপ্রিয় করে তুলেছেন “আমার সোনার বাংলা” গানটি যা পরে জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। ’৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের সময়টায় ডাকসুতে নিয়মিত যেতেন গণ-সংগীতের রির্হাসেল করাতেন। প্রতিটি অনুষ্ঠানে ছিল তাঁর সাহসী উপস্থিতি। গণ-সংগীত গেয়ে ছাত্র-জনতাকে উজ্জীবিত করতেন। দরাজ গলায় গাইতেন বলেই বঙ্গবন্ধু তাঁকে ডাকতেন রায় বাহাদুর বলে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁকে খুঁজে বেড়িয়েছেন পাকিস্তনি শাসক গোষ্ঠী। পাকিস্তানিদের ভয়ে ঢাকাতেই আত্মগোপন করেন। পরিবার বাবা মার খবর জেনে ঘুর পথে জুন মাসে কোলকাতায় গিয়ে পৌঁছান। যুক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১ জুলাই যোগ দেন বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে এবং ১৯৯৫ সালে তিনি বেতারের মুখ্য সংগীত প্রযোজক হিসেবে অবসর গ্রহন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই নিয়মিত তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। জীবনের প্রথম দিকে গণসংগীত গাইলেও পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের গানেই তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাাঁড়ায়। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ছাড়াও শিল্পকলা একাডেমী ও দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজিত বিভিন্ন সংগীত কর্মশালার প্রশিক্ষক হিসেবে অংশ নিয়েছেন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ছায়ানটসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা ও উদীচীর সাথে ছিল নিবিড় সম্পর্ক। ১৯৭২ ও ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। ১৯৮৭ সালে কবিগুরুর ১২৫তম জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বিশ্বভারতীর আমন্ত্রণে ২ দিন ব্যাপী একক সংগীতানুষ্ঠানে শান্তি নিকেতনের উত্তরায়নে সংগীত পরিবেশন করেন। কবি নজরুলের ‘ধুমকেতু’ সুকান্তের ‘বোধন’, ‘প্রিয়তমাষু’, ‘হে সূর্য’, শামসুর রহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’, জীবনানন্দ দাসের ‘বাংলার মুখ’, ‘আবার আসিব ফিরে’, মধুসূদন দত্তের ‘কপোতাক্ষ নদ’, ‘বঙ্গভাষা’, রবিঠাকুরের ‘১৪০০ সাল’, কবি কায়কোবাদ, সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহাসহ অনেক জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কবির কবিতায় সুর করে বাংলা গানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সিকান্দার আবু জাফর, ডঃ মোঃ মনিরুজ্জামান, কবি আজিজুর রহমান, মুন্সী আঃ ওয়াদুদসহ অনেক গুনী গীতিকারের গানে বৈচিত্র্যময় সুরারোপ করেছেন তিনি। ‘ একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’, ‘সুখ তুমি কি’, এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সুর তিনি করেছেন। সম্ভাবনাময় প্রতিভা বিকাশ ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার জন্য ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় তাঁর তৈরী প্রতিষ্ঠান “অভ্যূদয়”। স্বাধীনতা পদক (২০০০) রবীন্দ্র পদক (২০১১) আজীবন সম্মাননাসহ বহু পদক ও সম্মানে ভুষিত হয়েছেন তিনি। তা মধ্যে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী, শহিদুল ইসলাম স্মৃতি পরিষদের শব্দ সৈনিক পুরস্কার, আলমগীর কবির স্মৃতি পরিষদের ‘এওয়ার্ড অব অনার’, সোল্স এর সম্মাননাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে। রংপুরবাসীর পক্ষ থেকে রংপুর পৌরসভা ও মোঃ আফজালের নেতৃত্বাধীন রংপুর নাগরিক কমিটি তাঁকে সম্মানিত করেন। সদা বন্ধুবৎসল, সদালাপী, অভিযোগহীন এই মানুষটির ¯েœহে অনেকেই সিক্ত হয়েছেন। তাঁর সাহচর্যে, তাঁর কাছে প্রশিক্ষন নিয়ে অনেকেই আজ এ দেশে সু-প্রতিষ্ঠিত শিল্পী।
মানুষের সীমিত জীবনে ছুটে চলার দিন শেষ হয়, দুরারোগ্য ফুসফুস ক্যান্সার ব্যাধি আক্রমনে তিনি মৃত্যুর কাছে নিজেকে সর্মপণ করেন। ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১ বেলা ১.০৫ মিনিটে তাকে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষনা করেন। লাল-সবুজের বিজয় পতাকা কফিনে জড়িয়ে, তাঁকে শেষ বিদায় জানাল দেশবাসী গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে একজন মুক্তিযোদ্ধার বিরল সম্মাননা রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এরপর ঢাকা রামকৃঞ্চ মিশনে অন্তিম প্রার্থনা শেষে পোস্তগোলা মহাশ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রীসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতের বরেন্য ব্যক্তিবর্গসহ সকল স্তরের মানুষ অজিত রায়ের অন্তিম যাত্রাপথে তাঁকে বিন¤্র শ্রদ্ধা জানান। বিদেশ থেকেও শুভানুধ্যায়ীরা তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
ক্ষতি হয়ে গেল দেশের, তাঁর মতো গুনি মানুষকে হারিয়ে। সংরক্ষন করা হোক তাঁর সমস্ত সৃষ্টি আগামী প্রজন্মের জন্য- এটাই একমাত্র দাবী, যার মধ্য দিয়ে তিনি যুগ যুগ বেচেঁ থাকবেন।
আরো বিস্তারিত-------CLICK HERE