somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাপুরুষ

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধীমান সিগারেট ছুঁড়ে ফেললেন । বললেন ‘আসলে কি জানো বিপাশা, বাঙালী বলে নয়, মিনিমাম কোয়ালিফিকেশনটুকু থাকলে আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করি যাতে করে কিছু একটা হিল্লে হয়ে যায়, তা সে পরিচিত,অপরিচিত যেই হোক না কেন । অন্ধকার হয়ে আসছে । নাগপুরে এবার শীত বেশ তীব্র । জিগীষার মাঙ্কিক্যাপটা ভালো করে টেনে দিলেন বিপাশা । মাঙ্কিক্যাপ জিগীষার একদম পছন্দ নয় । জোর করে পরিয়ে দিলেই টেনেটুনে এমন অবস্থা করবে, কান্ দুটো বেরিয়ে পড়বে ঠিক । ধীমান আজ বেশ মুডে আছে । অফিস থেকেও ফিরেছে তাড়াতাড়ি । ছোট্ট জিগীষাকে নিয়ে ওরা আজ অনেকদিন পর হাঁটতে বেরিয়েছে ।

টোটাল দুশো দশখানা ছোটো ছোটো বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি । এখনো সবাই এসে ওঠেনি । আধখেঁচড়া হয়ে পড়ে আছে বিশাল ক্যাম্পাসের ভেতর অনেক বাড়ি । তাদের কোনটাতে ঝোপজঙ্গল, কোনটার ন্যাংটো ছাদে অহংকারী ছাগলের মুখ, দরজা জানালাহীন কোনো কোনো অসম্পূর্ণ ঘরে ছন্নছাড়া মুর্গির পাল,আয়েশী গরুর ক্লান্তিহীন জাবরকাটা।অ্যাপ্রোচ রোডটাও এখনো তৈরি হয়ে ওঠে নি । এ জন্মে হবে কিনা কে জানে । যা ঢিলে কারবার সব বিল্ডারদের আজকাল ।স্বভাবতই বিভিন্ন মানুষের যথেচ্ছ ব্যবহারে নানা রকম পথচলা রাস্তা গড়ে উঠেছে কলোনির ভেতর ।বিপাশা বুঝতে পারলেন ধীমানের নিখুঁত কামানো মুখে ফুটে উঠেছে অসন্তুষ্টির এক মসৃন আভা,যা ধীমানকে অসম্ভব আকর্ষনীয় করে তোলে ।

জিগীষা হোচোঁট খেল পাথরে । ধীমান বললেন,‘চলো ওই পথে ফিরি,এ দিকটা বড়ো অন্ধকার’।বিপাশা বললেন,‘কি দরকার ।এটাই তো বেশ ফাঁকা ফাঁকা’। ধীমান মৃদু হাসলেন।বললেন, ‘কলোনির লোকজনদের তুমি এতো এ্যাভয়েড কোরে চলো কেন বুঝতে পারি না’। বিপাশা ক্ষুন্ন হলেন।এ নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক হয়েছে এর আগেও । বিপাশা আর এ প্রসঙ্গে যেতে চাইলেন না । নিঃশব্দে ধীমানের পেছনে হাঁটতে শুরু করলেন ।

পথটা আলোকিতকিন্তু অধিকাংশ ঘরেরই দরজা ভেজানো।পূজা ভাট আর তাঁর ‘চিত্রহার’ নিয়ে ব্যস্ত সবাই এসময়।এত মনোরম সন্ধ্যে।ধীমান হাসলেন । হায় অবসর।সবকিছু ফুঁড়ে সেই ইডিয়ট বক্সের মহিমা। হঠাৎ কোথার থেকে সিড়িঙ্গে এক যুবতী ছুটে এসে জিগীষাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। বিপাশা চীৎকার করতে গিয়ে থেমে গেলেন । যুবতীটি ততক্ষণে কলোনির চারদিক খোলা মস্ত কুঁয়ো্য ঝাপ দিয়েছে । ঝপ করে একটা শব্দ । ধীমান জিগীষাকে মাটি থেকে তুলে পেছনের অন্ধকারে চেয়ে দেখলেন । বিপাশা বললেন, ‘গেল, গেল’ । ধীমান শংকিত । বললেন, ‘কি গেল ?’
- মেয়েটা কুঁয়োয় ঝাঁপ দিয়েছে । দেখলে না ।
- তাই নাকি !
- দেখলে না । বিপাশার উত্তেজিত স্বরে অবিশ্বাস । তোমাকে আগেই বললাম ওই পথ দিয়ে যেতে । এসব আমি দেখতে পারি না মোটে ।
স্তম্ভিত ধীমান দাঁড়িয়ে পড়লেন । চারদিক ফাঁকা । সব দোর বন্ধ । টিভিতে ‘চল ছৈঁয়া ছৈঁয়া,।’বাতাসে তারই অনুরণন। এত বড়ো একটা কান্ড হয়ে গেল । কেউ টেরও পেল না ।

জিগীষার হাত ধরে বড় বড় পা ফেলে বিপাশা ততক্ষণে মালপান্ডের বাড়ির কাছাকাছি । চীৎকার করে ধীমানকে ডাকলেন, ‘চলে এসো, তোমার কমমো নয়।‘

ধীমান বিভ্রান্ত বোধ করলেন ।একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর টপ একসিকিউটিভ তিনি । দিনের বারো থেকে চোদ্দ ঘন্টা এম ডির সাথে বসে থাকেন । কত জটিল, জটিলতর ক্রাইসিস অবলীলায় সামলে ওঠেন তাঁর করপোরেট এক্সপার্টাইজে । কিন্তু এখন । এখন তিনি কি করেন । এই অবিশ্বাস্য ক্রাইসিসে, তাঁর মাথা কাজ করছিল না ।

ধীমান কুঁয়োর পাড়ে এসে দাঁড়ালেন । গভীর অসংস্কৃত কুঁয়ো । ভাঙ্গা সিমেন্টের ঝুরঝুরে পাড়ে হাত রেখে একটু ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাতেই বুকপকেট থেকে তাঁর প্রিয় মিউজিক্যাল লাইটারটা টুক করে জলে পড়ে গেল । শব্দ হলো টুপ । ধীমানের মন খারাপ হয়ে গেল । গতবছর আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্কের লীনা এটা তাঁকে উপহার দিয়েছিল। ধীমান বুকপকেটে হাত রেখে উঠে দাঁড়ালেন । আর প্রায় উল্কার মত মাঠপারের অন্ধকার ভেদ করে এক যুবক এসে তাঁকে প্রায় জড়িয়ে ধরলো । শক্তপোক্ত চেহারা । গায়ে সড়কছাপ ঝ্যালঝ্যালে শার্ট । প্যান্টটা সম্ভবত শস্তা পলিয়েষ্টারের, মুখে ভুর ভুর করছে দেশী মদের গন্ধ । হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে টেকড়ি লাইনের গাঁওরানী মারাঠিতে ও বললো, ‘সায়েব, ও মরে যাবে, ওকে বাঁচান ।‘

ধীমান আতঙ্কিত বোধ করলেন । এ কি কান্ড ! বললেন, ‘ছাড়ো ছাড়ো । ব্যাপারটা কি আমাকে বলো আগে ।
‘অনেক দেরী হয়ে যাবে স্যার ।‘ যুবকটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো এবার । ‘আমি সাঁতার জানি না। ও বেচারা সারাদিন কিছু খায়নি । দয়া করুন স্যার ।
একটি দুটি করে দরজা খুলতে শুরু করলো অবশেষে ।নিষ্পন্দ জলের থেকে মুখ তুলে অসহায় ধীমান দেখলেন মালপান্ডে এসে দাড়িয়েছে। কলোনির খচ্চর আর চরিত্রহীন এই লোকটাকে ধীমান একদম সহ্য করতে পারেন না ।পারতপক্ষে এড়িয়ে চলেন।

খোবরাগেড়ে কলোনির নাইটগার্ড। তার বাড়ি থেকে এলো একটা পেল্লাই সিকিউরিটি ল্যাম্প ।মালপান্ডে অন্ধকার কুঁয়োয় লাইট ফেলতে ফেলতে গাঁওরানী মারাঠিতে বললেন, ‘ধুশ ! কিছু নেই । ঠিক দেখেছেন তো মশাই ।‘
মিসেস মালপান্ডে বললো, ‘আপকো কসকে পকড লেনা চাহিয়ে থা ।‘
‘কি বলছেন ।‘ ধীমান ক্রমশঃ অসহিষ্ণু ।মনে মনে বললেন,শালা নিজের মরদকে পকড়কে রাখ নেহি সকতা । ভাদ্রবউ–এর সাথে খুলে আম ফস্টিনস্টি চালাচ্ছে । সারা কলোনি ছি ছি করছে, এদের এত চোপা হয় কি করে । পাটলে লুঙ্গিতে গিঁট দিতে দিতে বললো,‘সামনে বউটা মরতে যাচ্ছে, তখন না হয় একটু ধরলেনই বা তাতে......’
কানে, সহস্রবুদ্ধে, দীক্ষিত, মালপান্ডের বউ সব কটা এক সাথে হেসে উঠলো খিলখিল করে । যেন একটা মস্ত রগড়ের ব্যাপার হল ।

ধীমানের অসহ্য লাগছিলো।বললেন,‘আরে মশাই, বুঝবো কি করে মেয়েটা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে ।‘

ভরাডপান্ডে ব্যাজার মুখে বললেন, ‘যদি সত্যিই মরে গিয়ে থাকে তাহলে আমাদের খাবার জলের কি হবে । সত্যি বলিহারি সব কারবার মশাই ।‘
যুবকটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ‘দেরী হয়ে যাচ্ছে। জলের তলায় আকুলি বিকুলি করছে নিশ্চয় মেয়েটা । সকাল থেকে উপোস দিয়ে আছে । মদের নেশায় আজ ওকে পিটিয়েছিও খুব ।‘
মালপান্ডে ওকে দাবড়ে দিল। ‘চুপ কর, চুপ কর তেরা বিবি মরা নহি। ভোঁসড়ি কাঁহিকা, দেখ, দুসরা কঁহী গয়া হোগা।‘খবর পেয়ে কোথার থেকে যুবকটির বুড়িমাও এসে পৌঁছলো। পাড়ের কাছে পাতলা কাদার আস্তরণ থেকে একপাটি ছেঁড়াচটি বের করে বললো, মরেছে, মেয়েটা নিশ্চয় মরেছে।ভালোই হয়েছে।একটা মাতাল অপদার্থের সাথে ঘর করার চেয়ে কুঁয়োর ঠান্ডা জল অনেক ভালো।বেশহ য়েছে’, বলে ডুকরে কাঁদতে বসলো হাত পা ছড়িয়ে।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।ধীমান বাড়িতে এসময় ইনকামিং মেলস নিয়ে বসেন।বিদেশ থেকে আসা চিঠি গুলো থেকে যত্ন করে ছাড়িয়ে রাখেন স্ট্যাম্প।ওগুলো মউ-এর জন্য।
ভীমরাও এলো আরও অনেকপরে।ততক্ষণে তর্কবিতর্ক,বাকবিতন্ডা আর টেনশনে ধীমানের অবস্থা ত্রিশঙ্কুর মতো।কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।কেউ বুঝতে চাইছেনা ছুটন্ত ঘড়ির সাথে বাঁধা রয়েছে একটি দুর্বল ভীরু জীবন।অতল জলের নিচে সে বেচারা হয়তো হাত পা ছুঁড়ছে।শেষ হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়।সময় তো কম গেল না।

ভীমরাও তরুণ।কালো কোঁকড়ানো চুল একমাথা। এক একটি মানুষ থাকে যারা সামনে এসে দাড়ালেই বুকে বল।এই তল্লাটে তিনবছরের ওপর থাকতে থাকতে নানা কারণে ভীমরাও-এর ওপর আস্থা এসে গেছে ধীমানের । ছেলেটার সব চেয়ে বড়ো গুণ ও খুব তাড়াতাড়ি আর কনফিডেন্টলি ডিশিশান নিতে পারে । শুধু ডিশিশান নয় চটপট প্রায় ছবির মতো তার মেটিরিয়ালাইজেশনও । পড়াশোনা করলে ছেলেটা নির্ঘাৎ জি এম হয়ে যেত তিরিশ পেরোতেই।জিগীষার জন্মের সময় নার্সিংহোমে সারাদিন দৌড়ঝাপের পর ক্লান্ত শ্রান্ত ধীমান ভীমরাওকে বলেওছিলেন, ‘তুই না থাকলে আজ তো আমি মারা পড়তাম রে ।‘ ধীমানের মনে পড়ে গেল ।তো ভীমরাও এসেই লেগে পড়লো কাজে । ওটাই ওর স্বভাব। ও প্রথমেই মালপান্ডের ওপর একচোট নিল । যখন ইনি বলছেন বউটা ঝাঁপ দিয়েছে, তখন এত সন্দেহ কেন আর । ‘যত্তোসব’ । মালপান্ডে বললো, ‘তুই ঝাঁপাবি । যা না ব্যাটা ।‘

দেশমুখ বললো, ’৭০ ফিট গভীর, আনকালচারড ফ্যাদম, আর একটা প্রাণ না যায়।‘
- সাপখোপ থাকাও বিচিত্র নয় ।
- কারেন্টও থাকতে পারে, গা বেয়ে ইলেকট্রিক পোল ।
- তার চেয়ে পুরো জলটা পাম্প করে বের করে নিলে কেমন হয় ।
- পাগল হয়েছো । কলোনি ভেসে যাবে । কম জল নাকি ।
- কাল থেকে আমাদের জলের কি হবে ?
- পুলিশে খবর দেওয়া জরুরী । পরে ঝামেলা টামেলা হলে সামলাবে কে ?
- ফায়ার বিগ্রেডে ফোন লাগাও ।লেট দেম হ্যান্ডেল।যত্তোসব উটকো ঝামেলা ।

নানান জনের নানা রকম প্রতিক্রিয়া । সব শুনেটুনে এবার ধীমানের ভয় করতে লাগলো । এতো শালা পাক্কা সুইসাইড কেস । থানা পুলিশ হাজারো ঝঞ্চাট । অফিসে যে কোন অস্বস্তিকর মুহুর্তে অথবা বেগতিক দেখলেই তাঁর প্রচ্ছন্ন বোধ তাঁকে এলার্ট করিয়ে দেয় টু কুইট দ্য সিন । মর গে সব, কি দরকার এত ঝামেলার। যা ভালো বুঝিস কর । আমি বাবা সাতেও নেই, পাঁচেও নেই ।
ভীম রাও ছুটলো দেশমুখকে সাথে নিয়ে । ওর বাড়িটাই সবচেয়ে কাছে। সেখানে ফোনও আছে।
ধীমানের আর ভালো লাগে না । অনেক সময় গেছে । এতক্ষণে মেয়েটা নির্ঘাত টেঁসে গেছে।নো ডাউট।ভীমরাও ফিরছে না কেন। পুলিশ এসে যা করার করুক । অথবা ফায়ার ব্রিগেড। ধীমানের অন্তরাত্মা পূণরায় এলার্ট করলো তাঁকে ইট ইজ হাই টাইম টু ক্যুইট দ্য সিন, ইফ পসিবল বিফোর পুলিশ টার্নড আপ । ধীমান জল থেকে চোখ তুলে দেখলেন কুঁয়োকে ঘিরে বেশ জটলা। ছাড়া ছাড়া ভাবে এক একটা গ্রুপ ফিসফিস করছে । আর থেকে থেকেই সবার নজর ধীমানের ওপর ।যেন ধীমান মেয়েটাকে ঝাঁপাতে দেখে বিরাট কোন অপরাধ করে ফেলেছে । আনকালচারড ব্রুট সব । মাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে মেয়েটার মরদ । ও আর কাউকে এ্যাপ্রোচ করেনি । ধীমানকেই বলেছিল, কাকুতি মিনতি করেছিল, হাতে পায়ে ধরেছিল । ধীমানের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল । তাঁর মনে পড়ে গেল তিনি তখন এইট অথবা নাইনে। অরেঞ্জ সিটির আন্ডার টুয়েন্টি স্যুইমিং কমপিটিশনে তিনি একটুর জন্য সেবার ফার্স্ট হতে পারেন নি । এত মন খারাপ হয়েছিল তাঁর । সব কটা ইভেন্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ফাঁকা পুলের ড্রেসিংরুমে একা একা বসে ছিলেন অনেকক্ষণ। কোচ ডরোথি এসে ওর ঠান্ডা পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘ডোন্ট গেট আপসেট মাই বয় । ধীমানের কান্না এসে গিয়েছিল, আশৈশব তিনি শিক্ষা পেয়েছেন প্রথম হওয়ার । কমপিটিটিভ এই নিষ্ঠুর সভ্যতায় শুধু জয়, জয়ী হওয়ার দীক্ষা তার রক্তে, ডরোথির বুকে মুখ গুঁজে হাওহাও করে কেঁদে ফেলেছিলেন সদ্য তরুণ ধীমান । আর পরম মমতায় ডরোথি তার লম্বা লম্বা আঙ্গুল বুলিয়ে দিয়েছিলেন ধীমানের প্রশস্ত পিঠে । বলেছিলেন, ‘দিস ইজ স্পোর্টস মাই ডিয়ার । টেক এভরিথিং স্পোর্টিংলি ইন লাইফ’। ডরোথির আধভেজা সর্পিল শরীরের মাদকতায় তাঁর এই মাত্র হেরে আসা নাছোড় তারুণ্য ডুবুরীর মতো মগ্ন ও একাত্ম হয়ে উঠেছিল । ড্রেসিংরুমের প্রায়ান্ধকার শূণ্যতায় ভয়ঙ্কর স্পোটিং হয়ে উঠেহিলেন ডরোথিও । ধীমানের এক মাথা চুল দু হাতে খামচে ধরে ফিসফিস করে হাস্কি গলায় অনেকক্ষণ পরে বলে উঠেছিলেন, ‘হাউ ওল্ড আর য়ু ধীমান’। যতটা বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল ধীমানের আপ্লুত শরীর ততটাই শান্ত ও স্থবির হয়ে উঠেছিল তাঁর মুখ । মৃদু উচ্ছ্বাসও হয়তো সম্ভব ছিলো না, কেন না সেখানে ইতিমধ্যেই ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছিল এক জোড়া ফ্যাট লিপস। অভিজ্ঞ ও অবচেতন। সেই শুরু। সেদিন থেকে ধীমান অত্যন্ত স্পোটিং, প্র্যাকটিক্যাল এবং আ টোটাল সাকসেসফুল গাই । অপারচুনিস্ট শব্দটিতে তাঁর ভয়ঙ্কর এ্যালার্জি, কেমন যেন গালের মত লাগে, কাওয়ার্ডিস । তিনি নিজেকে একজন সাকসেসফুল মানুষ হিসেবে দেখতেই ভালবাসেন এন্ড হি হ্যাড এস্টাবলিসড ঈট। এভরিবডি উইল অ্যাডমিট । কিন্তু আজকের এই ইনসিডেন্টটিকে কেন স্পোর্টিংলি নিতে পারছেন না ধীমান । কেন ক্ষণে ক্ষনে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তাঁর । মনে হচ্ছে......

ধীমান যুবকটির কাঁধে হাত রাখলেন । বললেন, ওরা এখনো ফিরছে না কেন । যাই দেখি । অফিস থেকে ফিরে এই ঝামেলা । হি ইজ ড্যাম টায়ার্ড । ধীমান বুঝতে পারছিলেন তাঁর কন্ঠস্বরে সেই কনফিডেন্স আর নেই। তবু আর নয়, আর পারা যায় না । তাঁর আজন্ম বিকশিত আই কিউ বললো আর নয় ধীমান, এনাফ ইজ এনাফ, এবার কেটে পড়ো । হারি আপ মাই বয় ! হারি আপ ! এবার ফায়ার বিগ্রেড আসবে, পুলিশ আসবে। শুরু হবে জেরা, জিজ্ঞাসাবাদ । ও সব কচকচিতে না যাওয়াই ভালো । লিগেল প্রসিডিংসের জট খুলতে অনেক হ্যাপা । যা হবার হয়ে গিয়েছে । নিজেকে এর পর সরিয়ে নেওয়া সব চেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ । সকলের ইঙ্গিতময় মুখগুলির দিকে ফিরেও তাকালেন না তিনি । লম্বা লম্বা পা ফেলে দেশমুখের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন এক সময় । ভাবলেন ভেতরে যাবেন নাকি কেটে পড়বেন । সিড়ির পাশের সরু গলিটা গিয়ে পৌঁচেছে সর্দারজীর বাড়ি । ওখান থেকে ধীমানের বাড়ি খুব দুর নয় । শেষমেষ কি ভেবে ঢুকেই পড়লেন । দেশমুখ বিগলিত হাসলেন । ওদের দু জনের হাতে ধুমায়িত কাপ । ‘আসুন, চা বলি । অফিস থেকে ফিরে চাও খান নি নিশ্চয় ।‘
- ‘নো থ্যাঙ্কস, আই রিকোয়ার এ সাওয়ার নাউ । কি হলো লাইন পেয়েছেন ?’
দেশমুখ ভীমরাও-এর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন । ‘চেষ্টা চলছে, কিন্তু বারবার ইস রুট কি সবহী লাইন ব্যস্ত হ্যয়...’
- ঠিক আছে । চেষ্টা চালিয়ে যান । আমি একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।‘ বলে তিনি আর দাঁড়ালেন না । পাশের সরু গলিটাই ধরলেন । এদিকে তো ভীড়ভাড় । ওদিকটাই ফাঁকা, শুনশান ।

খিদেয় পেট জলে যাচ্ছিল ধীমানের । দশটার হুইশল ভেসে এলো এমাইডিসি থেকে । জিগীষা ঘুমিয়ে পড়েছে । ডাইনিং টেবিলের ওপর তার টুকটুকে লাল জুতোজোড়া । বিপাশার মুখ ভার, শূণ্য দৃষ্টি, বললেন, ‘রান্নাবান্না করিনি আজ, মুড নেই । হুট করে মাথা গরম হয়ে গেল ধীমানের । অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে তিনি ডাইনিং টেবলের ফলের ঝুড়ি থেকে একটা বড়সড় আপেল তুলে নিলেন । চীৎকার করে বললেন, ‘দরজা জানালা সব হাট করে খুলে রেখেছো কেন ? বন্ধ করো, বন্ধ করো ।‘
বিপাশা পাশ ফিরে শুলেন । ‘ডু ঈট ইয়োরসেলফ ডিয়ার । আমাকে বিরক্ত করো না প্লিজ । আমার আজ কিছু ভালো লাগছে না ।‘
-‘তোমার কি এতটুকু সিমপ্যাথী হয় না আমার জন্য । সারা দিন অফিস করে এসে এই ঝুটঝামেলা, খাওয়া নেই, নাওয়া নেই । এখনি পুলিশ আসবে । আর এক হুজ্জোৎ।শেষে আমাকে নিয়ে না টানাটানি করে ?
বিপাশা শব্দ করে হেসে উঠলেন, ‘কেন ভয় পাচ্ছো !‘
ধীমানের আর সহ্য হলো না । বললেন, ‘শাট আপ এ্যান্ড টক সেন্স ।‘
তারপর সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে আলোগুলো নিবিয়ে ফ্রিজ থেকে দুটো ফ্রস্টার বিয়ার বের করে টেবিলে নিয়ে বসলেন ।
এরপর পুলিশ আসবে । লাশটা না পাওয়া গেলে ওরা কি কুঁয়োর সমস্ত জল পাম্প করে বের করে দেবে । তাঁর মিউজিক্যল লাইটারটা পেয়ে গেলে পুলিশ অন্য কিছু সন্দেহ করবে না তো । না, ধীমানের মাথা খারাপ হয়ে গেছে । আর চিন্তা করতে পারছেন না তিনি । আচ্ছা, পুলিশ এলে কি দলবল নিয়ে সবাই ফের ধীমান কে নিয়ে পড়বে ফের । আই উইটনেস, জিজ্ঞাসাবাদ, থানা, কোর্ট । উঃ কার মুখ দেখে যে আজ উঠেছিলেন ধীমান । এমন একটা বিতিকিচ্ছিরি দিন । বাথরুমে ধুকে জামাপ্যান্ট শুদ্ধ সাওয়ারের নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন ধীমান। দু দুটো বিয়ারেও শরীর ঠা্ডা হলো না আজ ।
শাড়ি পরে কখনো বিছানায় আসে না বিপাশা। আজ শাড়িও ছাড়ে নি । ফ্যানের হাওয়ায় আঁচল সরে গেছে । কালো শাড়ি ও ব্লাউজের নীচে রজনীগন্ধা রঙের শরীর । ছিপছিপে । সুঠাম । ফর্সা পায়ের গোছ । লালাভ গোড়ালি । চশমা না পরলে বিপাশাকে ঠিক কলেজ বালিকার মতো লাগে । মনেই হয় না ও রীতিমত গিন্নিবান্নী মানুষ, একটি সন্তানের মা । তিনি কি ভাববাদী হয়ে পড়লেন । তার মনে হলো তিনি যেন এক অন্য রমনীকে চেয়ে দেখছেন । তাঁর কুটোহীন শরীরে জল । স্নান সেরে তিনি কখনো গা মোছেন না । ধীমান তাঁর ঠান্ডা হাত বিপাশার উন্মুক্ত কোমরে রাখলেন । তিনি হয়তো বিস্মরণ চাইছিলেন ।সারাদিনের ক্লান্তি, হতাশা, ঝুটঝামেলা, টেনশন থেকে মুক্তি চাইছিলেন । বিপাশা উঠে বসলেন । বললেন, ‘মনে হয় না আমাকে আর ডিস্টার্ব করা হবে । তবু কলোনির যা সব পাবলিক, জাগিয়েও দিতে পারে আমাকে, পুলিশ এলে।‘
বিপাশা দু হাটুর নাঝে মুখ রেখে বললেন, ‘তো’। তাঁর গলার স্বর থমথমে।
‘না, ইফ দে আস্ক ইউ, তুমিই তো প্রথম উইটনেশ, যে কিনা দেখেছে বউটা কুঁয়োয় ঝাঁপ দিল । তুমি কিন্তু সাফ বলে দেবে ইউ নো নাথিং এবাউট দ্য কেস । বুঝেচ !”
‘সেটাই তো সত্যি । তুমি ভয় পাচ্ছো ধীমান । আমি আর কি জানি ।‘
‘ও কে বাবা, আমি সেটাই তোমাকে রিমাইন্ড করিয়ে দিচ্ছি । আনতাবড়ি কিছু বলেটলে তুমি আমাদের ইনভলমেন্ট বাড়িয়ে তোলো না যেন ।‘ বেড স্যুইচ টিপে লাইট নিবিয়ে দিলেন ধীমান । ঘরের মধ্যে থিকথিকে অন্ধকার । আর এই অন্ধকারের ভেতর একটা অদ্ভুত নিশ্চিন্তি আছে। ধীমান ভাবলেন । নিজেকে অনেক নির্ভার ও নিরাপদ লাগলো তাঁর । সব কিছু কেমন দৃষ্টিসহ, অস্পষ্ট । হাত না দিলে নিজের নাকটাও টের পাওয়া যায় না । ধীমান টানলেন । একটু জোরেই ।
‘আমার ভালো লাগছে না প্লিজ’।
‘তুমি মাঝে মাঝে এমন করো না’ – ধীমানের মাথা গরম হয়ে গেল ফের । ‘আয়াম ডগ টায়ার্ড টু ডে, টোটালি এগজস্টেড আর তুমি কিনা _____’
তাঁর কথা শেষ হলো না । বিপাশা চীৎকার করে উঠলেন, ‘সাট আপ’ তার পর ভেঙ্গে পড়লেন প্রবল কান্নায় ।
- ডোন্ট টাচ মি । ইউ আর এ বিস্ট, আ ডগ ইন ডিড, আই হেট য়ু, আই হেট য়ু’।
গোঙানীর মতো ধাতব করুণ তাঁর শব্দগুলি সাজানো বেড রুমের আনাচে কানাচে ঘুরতে লাগলো । ক্রিয়াশীল ঘুনপোকার মতো ।ফুলে ফুলে কাঁদছেন বিপাশা । আর সব কিছু চিরে আচমকা একটা তীব্র হুইশেলের শব্দ । ধীমান একটা চাদর টেনে নিলেন আপাদ মস্তক ।
-------
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×