আজকাল আপু খুব ব্যস্ত থাকে বলা যায়। স্কুল শেষে ফিরে দুপুরে,আবার প্রায় বিকেলেই কোন না কোন দাওয়াত-গেট টুগেদার থাকে বলে চলে যায়,ফিরে সন্ধ্যার পর,খেয়ে-দেয়ে আবার খাতা দেখায় লেগে যায়!
আমিও আজকাল ক্লাস,টিউশনী নিয়ে ব্যস্ত আছি,তাই খুব একটা আড্ডার সুযোগ তেমন পাই না,ছুটির দিন ছাড়া।
ক'দিন ধরে ভাবছি আপুর সাথে বসবো,কিন্তু বসবো বসবো করেও বসা হচ্ছে না! আজ বৃহঃস্পতিবার দেখে দেরি করে ঘুমাবো ঠিক করলাম,এশার নামায পড়ে রুমে এসে দেখি,আপু ল্যাপটপে কাজ করছে,আমি কিচেনে যেয়ে কফি আর পপ কর্ণ নিয়ে আসলাম।
মুপ্পু বলল,
-কিরে?কিছু বলবি?
-হুম,ক'দিন ধরেই বলবো ভাবছি!আজ একটু দেরি করে ঘুমালে তোমার সমস্যা হবে?
-না না,সমস্যা নেই,বল,কি বলবি?
আমি কফি তে চুমুক দিয়ে বললাম,
-সেদিন মারুফ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে ছিলো,আজিজ মার্কেটের সামনে।
আপু ল্যাপটপ থেকে একবার মুখ তুলে বলল,
-কে?মুহিনের ছোট ভাই মারুফ?ওহ,তো কি বলল?
-তেমন কিছু বলেনি!জিজ্ঞেস করলো তোমার কথা,কি করছো,কেমন আছো এই আর কি!
আপু স্ক্রিণের দিকে তাকিয়েই বলল,
-ওহ,আচ্ছা,তো কেমন আছে ওদের বাসার সবাই?ওর আম্মা?
-হুম,ভালো আছে সবাই। আরেকটা কথা বলেছে মারুফ ভাই!
-কি কথা?মুহিনের বিয়ে নিয়ে?
আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-ওরা মেয়ে ঠিক করেছে,মুহিন ভাই আসলেই বিয়ে হবে! বিয়ে করিয়ে তাদের মা হজ্বে যাবেন এবার।
মুপ্পু সাথে সাথে কিছু বললো না,আবার ল্যাপটপ থেকে মুখ তুললো না!আমি বুঝলাম,ও আসলে কোন রিএকশন দেখাতে চাচ্ছে না! একটু পর বলল,
-ভালোই তো!সময় তো আর কারো জন্য থেমে থাকে না। বিয়ে যখন আবার করতেই হবে,তো দেরি করে লাভ কি!আচ্ছা, বাদ দে,ওসব,আর কিছু বলবি?
আমি নড়েচড়ে বসে বললাম,
-নবনীর চাচা প্রফেশনালি কি করেন জানো তুমি?সে কি এখনো স্টুডেন্ট?
আপু একটু ভ্রু কুঁচকে বলল,
-কি জানি!মেবি এমবিএ পড়ুয়া হতে পারে,নট শিউর!কেন?
-লোকটা কে প্রায়ই আমার ভার্সিটি এরিয়াতে দেখি,কখনো চা খাচ্ছে আবার কখনো ফোনে কথা বলছে,তবে অফিসিয়াল গেটাপে না!তাই জিজ্ঞেস করলাম।
-ওহ!কথা হয়েছে তোর সাথে?
-নাহ।
মুপ্পু আর কিছু বললো না!। আমিও আর কিছু বলতে পারলাম না। কফির মগটা ধুতে ধুতে কিছুটা বিরক্তি লাগতে শুরু করলো!রাস্তায় কাউকে দেখলে সেটা কি এসে আবার বোনকে বলতে হয়?!এখন যদি মুপ্পু ঐ লোক কে জিজ্ঞেস করে,তাহলে লোকটা কি ভাববে?!ধুর...আর মুপ্পুকে তো বলাও হলো না,ওই লোক দুই বার কথা বলার চেষ্টা করেছিলো বাট আমি ইচ্ছে করেই কোনভাবে এড়িয়ে গেছি!অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কারো এমন গায়ে পড়ে কথা বলতে আসাটা আমার খুবই অপছন্দের তার উপর অপ্রয়োজনে!
ফাল্গুন শুরু হয়ে গেছে,আর শীত যাই যাই করছে প্রায়,কিন্তু গরমও এসে ভালো মতো পৌছাতে পারিনি!ফলে এই গরম লাগে তো এই শীত।
এরই মধ্যে সর্দি লাগিয়েছি!ক্লাস শেষে লাইব্রেরি থেকে দুটো বই নিয়ে হাচ্চি দিতে দিতে আর নাক মুছতে মুছতে বের হলাম। আজ সাথে সোমা নেই,আদা চা খেতে খেতে দেরি করে ফেলেছি,তাই ওরা চলে গেছে আগেই।এদিকে আমি রিকশা ভালো মতো খুঁজতে পারছি না!অনেক ক্ষন হাঁচি দেয়ার ফলে শরীরটাও খুব উইক লাগছে,কি করবো ভাবছি!
এমন সময় পাশ থেকে কেউ বললো,
-অসূস্থ নাকি আজ?
আমি নাকে টিস্যু ধরা অবস্থাতেই তাকালাম!হায় আল্লাহ!!সেরেছে,নবনীর চাচা! এই লোক আবার এখানে কেন?আপু কি কিছু বলেছে নাকি!ছিঃ,গেছি তাহলে আমি...! বলতে বলতে আবার হাঁচি!হাঁচ্চুউউউউ...!
-জ্বী,কিছুটা!সর্দি লেগেছে আর কি!
-ওহ,আচ্ছা। তো কোথায় যাবেন এখন?বাসায়?
-বাসায় ঠিক না,তবে ওদিকেই যাবো,স্টুডেন্ট কে পড়াতে।
ভদ্রলোক কিছুক্ষন থেমে হঠাত বললেন,
-ওকেই,আমার গাড়ি আছে সাথে,চলুন ড্রপ করে দেই,এট লিস্ট সাইন্সল্যাব পর্যন্ত?
আমি আরেকটা হাঁচ্চি দিতে দিতে মাথা নেড়ে 'না' করলাম!মনে মনে বিরক্ত হলাম,
আরে কি?চিনে আমার আপুকে,লিফট দিতে চায় আমাকে?!আমি কি বলছি,রিকশা-গাড়ি কিচ্ছু পাচ্ছি না!নাকি বুঝালো,নিজের গাড়ি আছে?!হুহ
লোকটা মনে হয় বুঝতে পারলো,
-আচ্ছা,ঠিক আছে,তাহলে রিকশা ডেকে দেই একটা!
আমি না করতে করতেই বান্দা একটা রিকশাওয়ালাকে ডাক দিলো!এমন জোরে ডাকল,যে আমার মাথা মনে হয় একবার চক্কর দিলো!! আজীব লোক...!
আমি রিকশায় বসে বললাম,
-থ্যাংকস!হেল্প করার জন্য।
-ওয়েলকাম,তো কাল সন্ধ্যায় আসছেন তো?আমাদের বাসায়?
আমি ভ্রু কুঁচকালাম,
-কেন?কাল কি আপনাদের বাসায় যাওয়ার কথা?
-কেন?শারমিন ম্যাম কিছু বলেননি?কাল নবনীর আব্বু-আম্মুর এনিভার্সেরি,খুব সিম্পলি আয়োজন করা হয়েছে,আর শারমিন ম্যাম যেহেতু নবনী ফেভারিট মানুষ,তাই তাকেও বলা হয়েছে।
-ওহ,আচ্ছা!
-বাট আপনিও কিন্তু আসবেন।
আমি মনে মনে প্রমোদ গুণলাম!অনুষ্ঠান যাদের তারা আমাকে দাওয়াত করেনি,আর ইনি বলছেন!! আমি হু/হ্যাঁ কিছু একটা বলে রিকশাওয়ালাকে যাওয়ার তাড়া দিলাম।
বাসায় আসতে আসতে আমি রিকশায় বসে পুরো ঘটনাটা মনে করে একা একাই হাসতে লাগলাম! মাঝে মাঝে এমন মজার কিছু ঘটে যেমনটা ঘটার কোন সম্ভাবনা থাকে না,কিন্তু তবুও ঘটে!ক্যানভাসে নতুন রঙের ছোঁয়া দিতে হয়তো!
রাতে মুপ্পু মিট মিট করে হাসতে হাসতে আমার পাশে এসে বসলো। আমি টিভির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে একবার বললাম,
-ঘটনা কি?!
মুপ্পু কিছু না বলে মাথা নাড়লো। কিন্তু চোরের মন তো পুলিশ পুলিশ!!তাই আবারো জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হইছে?বলো না!
মুপ্পু ভ্রু নাচিয়ে বলল,
-বাপরে!এত্ত শোনার আগ্রহ!নাকি আগে থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিস,কোনটা?হুম!
আমার রাগ লাগলো!
-ধুর,লাগবে না বলা যা তুই!
মুপ্পু জোরে হেসে ফেলল!
-শোন,নবনীর আম্মু ফোন দিয়েছিলো,ক'দিন আগে একবার আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলো,আজ ফোন করে স্পেশালি তোকে দাওয়াত করলো!হুমম!
বলেই আবার হাসা শুরু করলো!আমি ঠিক সাথে সাথে বুঝতে পারলাম না,আমার কি রিএকশন দেখানো উচিত!আমি একবার খুব অবাক হওয়ার ভান করে বলার চেষ্টা করলাম,
কেন?আমাকে কেন দাওয়াত দিয়েছে?!!
কিন্তু বলতে পারলাম না। বরং বললাম,
-আমি কোথাও যেতে পারবো না!আমার ওসব ফাংশন ভালো লাগে না!আর আমি কাউকে চিনিও না,যেয়ে বোরড হবো!
-সমস্যা কোথায়?নবনীর মা কে চিনিস,নবনীকে চিনিস আর...ওর সেই লাল চুল ওয়ালা চাচাকেও চিনিস!কত্ত মানুষ!
বলতে বলতে আবারো হেসে গড়িয়ে পড়লো আপু! আর ওদিকে আমার রাগ আরো বেড়ে গেলো!সোফার কুশনটা মুপ্পুর দিকে ছুঁড়ে আমি রুমে চলে আসলাম। ভাল মজা পেয়েছে যেনো!
পরদিন আমাকে অনেক জোরাজুরি করেও মুপ্পু ওর সাথে নিতে পারলো না,কিন্তু কি মনে করে যেনো মা কে সঙ্গে নিয়ে গেলো!আর মা ও কোন রকম জোর করা ছাড়াই বিনা বাক্যে রাজী হয়ে গেলো!অদ্ভুদ!
একা বাসায় কোন কাজ নেই দেখে,আপুর ল্যাপটপ টা নিয়ে বসলাম। আপুর মেইল বক্সটা ওপেনই ছিলো,হঠাত তাকিয়ে দেখি,নতুন একটা মেইল এসেছে,স্ক্রীণে মুহিন ভাইয়ের আইডিটা জ্বল জ্বল করছে!!
ওপেন করার লোভটা সামলাতে পারলাম না!ক্লিক করেই ফেললাম,
''কেমন আছো?গত ছয় বছরে দেশে আসার জন্য কতোই না ওয়েট করতাম,কিন্তু এবার যখন সত্যি সত্যি আসছি তখন কেন জানি মন ভালো থাকছে না! সব কিছুই অনেক বদলে গেছে তাই না?তুমিও বদলে গেছো!শুনলাম,বাচ্চাদের স্কুলে চাকরী নিয়েছো!তারমানে তোমার ফিরে আসার আর কোন ইচ্ছে নেই? মিতু,আমার কেন জানি মনে হয়,তুমি আমাকে অনেক ভালো বুঝ আর তাই,আমার রাগ-ক্ষোভের কথা গুলোকে,ভুল গুলোকে ক্ষমা তুমি করতে পারবে।
এক কাজ করি?আমি দেশে আসার টিকেট টা ক্যান্সেল করে ফেলি!তুমি বরং ফিরে আসো,তারপর যা হয় হোক!''
এই মেইল পড়ার পর আমি কি খুশী হবো না কি অবাক হবো?বুঝলাম না! বুকের ভেতর কেমন জানি আনন্দ আর বিস্ময় মিশ্রিত অস্থিরতা কাজ করছিলো! এই মেইলটা পড়ার পর আমি জানি আপুর মুখে হাসি ফুঁটবেই!
সিদ্ধান্ত হয়তো বদলাবে না,কিন্তু মুহিন ভাইয়ের প্রতি যে ক্ষোভ-অভিমান জন্মেছিলো তা নিশ্চয়ই কমবে।
ইশশ...ভালোবাসার গল্প গুলো যদি সত্যি সত্যি এভাবে বদলে যেতো,তাহলে কতোই না ভালো হতো!
[আগামী পর্বে সমাপ্ত ]
১ম পর্ব- Click This Link
২য় পর্ব- Click This Link
৩য় পর্ব- Click This Link