খন্দকার সাহেব বেশ আয়েশ করেই বসলেন এবার চেয়ার। উদ্দ্যেশ্য আজ ছুটির দিন,জুম'আর নামাজের আগ পর্যন্ত এক মনে বইটা পড়বেন,এক কাপ চা সাথে এখন আছে,মুনা কে বলে রেখেছেন ঘন্টাখানেক পর আরেক কাপ দিয়ে যাবে।
কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধালেন যথারীতি গৃহকত্রী! এক হাতে তরকারীর চামচ নিয়ে বেড রুমে ঢুকেই বলা শুরু করলেন,
-তোমার সংসারে আমার আসলে আর থাকা হবে না,বুঝলে? আমার পক্ষে আর সম্ভব না!
খন্দকার সাহেব ইচ্ছে করেই বই থেকে মুখ তুললেন না!কারণ,তিনি এখনো জানতে পারেননি রেহানা কেন সংসারে থাকতে পারবেন না!,
-তোমার মেয়ে কি বলছে জানো?একটু খোঁজ খবর কি রাখো সংসারের?
খন্দকার সাহেব,এবার বই পড়তে পড়তেই বললেন,
-কোন মেয়ে,আমার তো মেয়ে তিনজন,নাম উল্লেখ কর
-তোমার মেঝ মেয়ে,মুনা্র কথা বলছি!কি বলেছে শুনবে?পরশু যে ছেলে পক্ষ দেখে গেলো,ওর নাকি তাদেরকে পছন্দ হয়নি!ও এই বিয়ে করবে না!অথচ তুমিই তো দেখলে,গত কাল রাতে মিনু আপা ফোন করে জানালেন,ও পক্ষের মুনাকে পছন্দ হয়েছে,আর তোমার মেয়ে বলছে,তার পছন্দ হয়নি,সে এই বিয়ে করবে না!
খন্দকার সাহেব বই থেকে মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,
-কেন করবে না?ছেলে পছন্দ হয়নি ওর?
-তোমার কি মনে হয়?মুনার কি কোন ছেলে পছন্দ হয়েছে আজ পর্যন্ত?পছন্দ-টছন্দ কিছুই না,ওর তো উদ্দ্যেশ্য বিয়েই করবে না,জানো না তুমি?
খন্দকার সাহেব একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
-মুনা কে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও,আমি কথা বলছি,আর আপাতত তুমি এ নিয়ে মিনু'পা কিংবা অন্য কারো সাথে আলোচনা করো না।
-পাঠাচ্ছি,একটু বুঝাও মেয়েকে,অনার্স শেষ করছে,ক'দিন পর মাস্টার্সও শেষ করবে,এখন আর সেই দিন নাই,যে যতো প্রস্তাবই আসুক,যাচাই-বাছাই করে দিন পার করবে!অনেক হয়েছে ওর নখরা করা,আর না!
বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন রেহানা। খন্দকার সাহেব আরেকবার ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বইয়ের পাতায় চোখ ফেরালেন। কিন্তু চেষ্টা করেও মনোযোগ রাখতে পারছেন না!
খন্দকার সাহেব ছোটখাট চাকুরীজীবি মানুষ। বৃদ্ধ মা,স্ত্রী আর তিন মেয়ে,এক ছেলে নিয়ে আর সংসার। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে তিন বছর হতে চলল,ছেলে-সংসার নিয়ে একই পাড়ায় থাকে,বড় ছেলে বিয়ে করে রাজশাহীতে চাকরী সুবাদে সেটেল হয়েছে। বাকী আছে এখন দুই মেয়ে মুনা আর মীম।
মুনা কে ডেকে পাঠালেও,এই বিষয় নিয়ে খুব একটা আলোচনা করার ইচ্ছে নেই তার। কারণ,তিনি জানেন,মুনা কি বলবে! চার সন্তানদের মধ্যে তার এই মেয়েটা কিছুটা আলাদা,চাপা স্বভাবের হলেও যথেষ্ট ম্যাচিউরড,স্বনির্ভর,আর দায়িত্ববোধ মানুষিকতা সম্পন্ন। কখনো মুখ ফুঁটে কিছু চাওয়ার অভ্যাস নেই,বরং ছোট থেকেই সংসারের প্রয়োজন আর অবস্থান বুঝার চেষ্টা করে খুব! সংসারে কি নেই আর কতটুকু আছে তা কখনোই মুনাকে বলতে হয়নি,আর এই বুঝার চেষ্টাকেই এখন সব সমস্যার মূল মনে হয় খন্দকার সাহেবের!
মা হিসেবে রেহানার চিন্তাকেও তিনি উড়িয়ে দিতে পারেন না,অন্যদিকে মুনার যুক্তির কাছেও হার না মেনে পারেন না,এমন উভয় সংকট অবস্থায় নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়!কখনো কখনো খুব অক্ষমও মনে হয়!
মুনা চুপচাপ বাবার সামনে এসে বসে। বাবার চিন্তামগ্ন মুখ দেখে,আরেকবার চায়ের কাপের দিকে তাকালো।
-বাবা,আরেক কাপ চা দিবো?
মাথা নাড়ালেন বাবা,শান্ত কন্ঠে বললেন,
-তোর মা বললেন,এই ছেলে নাকি তোর পছন্দ হয়নি?
-হুম।
-আমি যতটুকু জেনেছি,ছেলে এবং ফ্যামিলি বেশ ভালোই খুব একটা আপত্তির তো কিছু দেখছি না!
মুনা দৃষ্টি নত করেই বলল,
-বাবা,আমার অনার্স শেষ হয়ে যাচ্ছে বাট ভালো একটা চাকরী এখনো হয়নি,আর ভালো একটা চাকরী আমার জন্য অনেক জরুরী,আপনি সেটা জানেন,আমার এমবিএ টা আর করা হবে না,যদি ভালো একটা চাকরী না পাই,আর
ঐ ফ্যামিলি অবশ্যই ভালো,বাট ওরা চাকুরীজীবি মেয়ে চায় না,মুখে ক্লিয়ার না করলেও ছেলে আমাকে বলেছে!খুব বড়জোর কোন কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে চাকরীর পারমিশন হয়তো দিবে,কিন্তু সে টাকায় তো এমবিএ কমপপ্লিট করতে পারবো না,ছেলেটা বলেছে,মাস্টার্স করতে এমবিএ না,এতে খরচ কম!তার মানে তিনি বিয়ের পর আমার পড়াশুনার খরচ দিতে পারবেন না,অন্যদিকে চাকরীরও সাপোর্ট দিতে পারবেন না,তো আমি এই অবস্থায় কিভাবে রাজী হই বলেন? ''
সাথে সাথে কোন কথা বলতে পারলেন না খন্দকার সাহেব! ভেতরে ভেতরে আবারো অস্বস্তি কাজ করতে লাগল!
চাকরী জীবনের শেষের দিকে এসে সঞ্চয় যা ছিলো তা দিয়ে এই মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকু গড়েছেন,তবুও সাথে ব্যাংক লোন লেগেছে। গত একত্রিশটা বছর ধরে,বলতে গেলে একদম শুরু থেকেই টানাটানি করতে করতে কোন রকম জোড়াতালি লাগিয়ে সংসারটাকে এই পর্যন্ত এনে দাঁড় করিয়েছেন। অন্যদের মতো এক্সট্রা সেভিংস বা এসেট তৈরীর সুযোগ তো কখনো আসেইনি! যেখানে ছেলে-মেয়েদের অত্যাবশকীয় প্রয়োজন গুলো পূরণ করতেই হিমশিম খেয়েছেন সেখানে ওদের জন্য বাড়তি কিছু গড়ার চিন্তা কিভাবে করবেন? আল্লাহর রহমতে সন্তানরা নিজেরদের প্রয়োজন পূরন তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে,কিন্তু তাই বলে এখন...!ভাবতে পারেন না আর কিছু! তবে এই বিষয় গুলো মুনা খুব ভালো করেই বুঝে!সে জন্যই বাঁধছে এতো সমস্যা।
বিয়ে নিয়ে কোন কালেই তার মাথা ব্যাথা ছিলো না!যেখানে তার সহপাঠি-কাজিনরা একে একে বিয়ের পিঁড়ীতে বসেছে,যখন চারপাশে সবাই নিজের বিয়ে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করেছে,মুনা তখন বসে বসে লিস্ট তৈরী করেছে,চাকরীর বেতন পেলে কোন মাসে কি কি করবে!! মুনার ইচ্ছে পড়াশুনা শেষ করে,চাকরী করবে,সংসারের জন্য,নিজের জন্য একটা পজিশন তৈরী করবে। মাসের শেষে বাবা যেমন বেতনটা এনে মায়ের হাতে দিতেন,আর মা সেটাতে বরকতের দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন,ঠিক তেমনি সেও তার বেতন এনে মায়ের হাতে তুলে দিবে,খানিকটা স্বচ্ছলতা আসবে সংসারে,সেই খুশীতে মায়ের চোখ চিকচিক করে উঠবে! ছোট বোনটা ভালো একটা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবে,দাদী আজন্ম সাধ হ্বজ্জ করবেন,তাকে নিয়ে বাবা-মা দু'জনেই হ্বজ্জে যাবেন,বাবার ব্যাংক লোনটা শোধ হবে,বড় বোনের সংসারটাও স্বচ্ছল না,তাই চাইলেও বোনটার জন্য,ভাগ্নেটার জন্য কিছু করতে পারে না,খুব ইচ্ছে ভাগ্নেটার যত আবদার হবে খালামনি সেটা পূরণ করবে। এমন আরো হাজারো স্বপ্ন মুনার নিজের পরিবারকে নিয়ে!
মুনা জানে,এসব নিয়ে সে যতোটা ভাবে ভাই ততোটা ভাবতে পারে না!আসলে সংসারের টানাটানির সাথে সে নিজেও কম লড়াই করেনি,আর আজ তাই দূরে যেয়ে এসব থেকেও দূরেই থাকতে চায়,তাছাড়া নিজের বউ-বাচ্চারও তো হক আছে। মুনা এসব নিয়ে ভাইকে দোষারপ করতে চায় না,ভাই তো চেষ্টা কম করে না,বাট একা তার পক্ষে এতগুলো দায়িত্ব পালন করা সম্ভব না,তাই সে চায়,ভাইয়ের দায়িত্বের কিছু ভাগ নিতে। সন্তান হিসেবে তার নিজেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে।
রেহানা বেগম প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে প্রশ্ন করলেন,
-কথা হয়েছে মুনার সাথে?
খন্দকার সাহেব কিছু বললেন না। রেহানা আবারো বললেন,
-মিনু আপাকে কিন্তু আজকের মধ্যেই জানাতে হবে,কি জানাবে?
খন্দকার সাহেব অস্থির কন্ঠে বললেন,
-জানিনা! মিতুর মা,আমার আসলে এখন নিজেকে অনেক ব্যার্থ একটা মানুষ মনে হচ্ছে!পুরো জীবনটাই আসলে ব্যার্থ!
সারাটা জীবন শুধু খেঁটেই গেলাম,কিছু করতে আর পারলাম না! বড় মেয়ের বিয়ে দিলাম,বছর ঘুরতেই জামাই ব্যাবসায় লস খেলো,সেই যে সংসারে অভাব নামলো,আজো গেলো না,কত কষ্ট করে টাকা-পয়সা যোগাড় করে কতো আশা নিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলাম,আর আজ?মেয়ের ক্লান্তি আর দুঃশ্চিন্তা ভরা মুখের দিকে তাকাতেও সাহস পাই না! ছেলে টা সব সময় নিজের মতো থেকেছে,আজ নিজের সময় মতো বিয়ে করে,নিজের মতো সংসার করছে,মাস শেষ ফিক্সড ৮হাজার টাকা পাঠিয়ে সব দায় চুকাচ্ছে! অন্য দিকে এই মুনা... একাই সব দায়ভার মাথায় নিয়ে বসে আছে! কোন দিক থেকে অযোগ্য না মেয়েটা,শুধু গায়ের রংটা একটু চাপা তবুও ভালো একটা বিয়ে দিতে পারছি না,যাও কিছু ভালো প্রস্তাব আসে,তারাও লেনদেন না হলে চাকরী-পড়াশুনা নিয়ে এমন কিছু শর্ত দিয়ে বসে,যে সব জেনে শুনে মেয়েকে জোর করতেও পারি না!আল্লাহ যে কি এক পরীক্ষায় ফেলেছেন বুঝিনা! ''
বলতে বলতে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে আসে খন্দকার সাহেবের! খাওয়ার প্লেট ওভাবেই পরে থাকে। রেহানা বেগমের ভেতরেও ভাঙ্গন শুরু হয়ে গেছে,তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
-তুমি এতো ভেঙ্গে পড়ো দেখেই কিছু আগাচ্ছে না!এই অবস্থায় কি আমরা একা আছি?এমন বহু পরিবার আছে,তো তাদের মেয়েরা কি কেউ বিয়ে করছে না?সব কি মুনার মতো আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে? যে অবস্থায় আছি,আল্লাহর শুকরিয়া,মানুষ তো এরচেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে,নাকি?মিতুর সংসারও এক সময় ঠিক হবে,কিন্তু মুনা?ওর কি বয়স বসে থাকবে?এখন যাও কিছু প্রস্তাব আসছে,ক'দিন পর তো সেগুলোও আসবে না,তখন কি করবে?মেয়ের ইনকামের আশায়,বিয়ে বন্ধ করে রাখবো? ছেলে-মেয়ের ইনকাম খাওয়ার জন্য রাত-দিন খেঁটে এই সংসার গড়ে তুলিনি,এমন মা হতে পারবো না!আমরা চাই,ওরা ভালো থাকুক,সুখে থাকুক এ জন্য যত কষ্ট করতে হয় করবো।
-কিন্তু মেয়েটা তো রাজি না,কি করে জোর করি? সবই তো বুঝলাম!
-ওকে রাজি করাতে হবে,অনেক শোনা হয়েছে ওর যুক্তি,আর না!আমি মিনু আপাকে বলবো,আমরাও রাজি,ব্যাস কথা যেনো আগায়। দেখবে আল্লাহই সাহায্য করবেন।
-না না,আগে মুনাকে বুঝাও,পরে কিন্তু খারাপ অবস্থা হবে!মেয়ে রেগে যেতে পারে।
রেহানা বেগম হালছাড়ার ভঙ্গিমায় উঠে চলে গেলেন। রান্নাঘরে এসে ধপ করে বসে পড়লেন,চোখের পানি কে এবার আর আটকালেন না! তার খুব মনে পড়ে,ক্লাস নাইনে থাকতে মুনা একবার আবদার করেছিলো,এক জোড়া রূপার পায়েল পড়ার। একবারই বলেছিলো,তিনি বহু কষ্টে টাকা জমিয়ে,তার সাথে মুনার ঈদি যোগ করে বছর খানেক পর কিনে দিয়েছিলেন,পায়েল পেয়ে সে কি খুশী মেয়েটার! কিন্তু সে মাসেই,ওর দাদা অসূস্থ হয়ে যাওয়ায়,মুনার রেজিষ্ট্রেশনের টাকা
যোগাড় করতে পারছিলেন না,মুনা হাসিমুখে সেই পায়েল জোড়া ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে স্কুলে জমা দিয়েছিলো। রেহানা বুঝেন,তার মেয়েটা খুব সৌখিন,চূড়ি-পায়েল-আংটি এসবের প্রতি খুব ঝোঁক,কিন্তু পারেন নি কখনো খুব সুন্দর দেখে তেমন কিছু কিনে দিতে,আর মেয়েটাও...কোন চাওয়া নেই,শুধু স্বপ্ন দেখে,একদিন নিজে টাকা ইনকাম করবে,তারপর সবার শখ পূরণ করবে,সংসারের এই টানপোড়ন কেটে যাবে!
বোকা মেয়েটা বুঝে না,এসব স্বপ্ন দেখা সহজ,বাস্তবায়ন করা না। মধ্যবিত্তদের সংসার চিরকাল এমনই থাকে,ঠিক নদীর কূলের মতো,এক পাশ ভাঙ্গে তো আরেক পাশ গড়ে!তবে এ জন্য জীবনটাকে থামিয়ে রাখতে নেই!আল্লাহর উপর ভরসা করে সময়ের সাথে তাল মিলিয়েই এগিয়ে চলতে হয়,আর চলার পথেই যা কিছু হারাবার হারায় আর যা পাওয়ার তা পাওয়া যায়। কোন কিছুর জন্য বসে থাকার সুযোগ নেই। সুখ সব সময় সব কিছু পাওয়ার মাঝেই মিলে না,না পাওয়ার মাঝেও মিলে।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মুনা চেঁচিয়ে উঠলো!
-কিরে তুই কিছু বলিস না কেন?!কি করবো বল না?
আমি চিন্তা করা ভঙ্গিতে বললাম,
-বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে আসলে লেট করা ঠিক না,করে ফেল!চারপাশে যা দেখি,তাতে মনে হয়,একমাত্র আমরাই বিয়ে টা কে লিস্টের লাস্ট পয়েন্টে রেখে বসে আছি,বাকী সবাই রাখে টপ লেভেলে!তুইইই বরং বিয়ে করেই ফেল!
মুনা রেগে যেয়ে বলল,
-তুই আসলে সেলফিশ বুঝলি?!নিজের বেলার ষোল আনা বুঝিস,আর আমার বেলায় বলে ফেললি,করে ফেল!বাহ!শোন,আমার সামনে ভাব না ধরে বাস্তবে এসে কথা বল,কল্পনার দুনিয়ার যুক্তি কল্পনাতেই রাখ।
-দোস্ত,তোর যে অবস্থা দু'দিন পর আমারো দেখিস একই অবস্থা হবে!সো,ষোল আনা কি আর বারো আনা,যেদিক দিয়েই ভাববি ধাক্কা খেয়ে আবার এখানেই আসতে হবে,সো যদি উপায় না ই থাকে তো বলে ফেল,কবুল!যা হয় হবে!
মুনার আমার হাত থেকে কমিকসের বইটা টান দিয়ে নিয়ে বলল,
-করে ফেলবো না?যেই ছেলে আম্মা নিয়ে আসছে,সে তার বাড়ির ছোট ছেলে,আমাদের চাইতেও ভালো স্বচ্ছল অবস্থা তাদের,তারা যথেষ্ট ধুমধামের প্রস্তুতি নিয়ে আছে,আর আমার বাসার অবস্থা?লাখ টাকা খরচ করাটাও আব্বুর জন্য পুরাই জুলুম!কিন্তু আব্বু তো তা ঠিকই করবেন,আর তোর কি মনে হয়?কম পক্ষে দু'ভরি স্বর্ণ ছাড়া শ্বশুড়বাড়ি আম্মু আমাকে পাঠাবে?অথচ,আজ ৩২বছরেও আম্মু পারে নাই একটা চেইন গলায় পড়তে!আর আমি তার মেয়ে হয়ে,স্বর্ণের দোকান সাজবো?!ইম্পসিবল!
আমি গালে হাত দিয়ে নির্বিকার গলায় বললাম,
-দুই ভরি স্বর্ণ পড়লে দোকান সাজা যায় না,আগে খোঁজ নে,ঐ বাড়ির ছোট ছেলে কয় ভরি দিবে!সে যদি কমপক্ষে পাঁচভরির কম স্বর্ণ দেয়,তাহলে তুই আন্টিকে এক ভরিও দিতে দিবি না!!
মুনা এবার দুই হাত বাড়ালো আমার গলা চেপে ধরার জন্য!আমি দ্রুত দুই হাত তুলে বললাম,
-শান্তি শান্তি!শোন,তুই এক কাজ কর,আরেকবার ইস্তেখারা নামায পড়,আল্লাহর কাছে আরেকবার খুব আন্তরিকতার সাথে দোয়া করে,এই ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত চেয়ে দেখ,যদি এর পরেও দেখিস বিয়েটা আগাচ্ছে,তাহলে বুঝতে হবে,সিদ্ধান্ত এবার আল্লাহ দিয়ে দিয়েছেন,তুই আর সেটা বদলানোর ট্রাই করিস না,লাভও হবে না।
-বাট ঐ বাড়ির লোকজনও জানি কেমন!তার মামী আমাকে বলে,'মুখে ভালো কিছু ইউজ করো না নাকি?ব্রণের দাগ বসে আছে যে!আর স্কীনে কেমন পোড়া ভাব হয়ে আছে,নিয়মিত চন্দন লাগাও না?!''চিন্তা করতে পারিস?এসব কথা মেয়ে দেখতে এসে সবার সামনে বলে!
আমি ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা নেড়ে বললাম,
-এসব নিয়ে বলতে বলতে মুখ ব্যাথা হয়ে গেছেরে!কিন্তু কয়লা ধুলে কি আর ময়লা যায়?এসব মানুষিকতা হলো,কয়লার চেয়েও খারাপ,ভিনেগার দিয়ে ঘষেও লাভ নাই!এসব ধরিস না,এক কান দিয়ে ঢুকাবি,আরেক কান দিয়ে বের করবি!
-কিন্তু ঐ লোকের সাথে তো আমার প্ল্যান মিলে না!
এবার আমি দুই গালে হাত রেখে বললাম,
-হায়রে জটিলতা!তাহলে এক কাজ করিস,ডিসিশন ফাইনাল হয়ে যাবার আগে আরেকবার তুই ঐ কুট্টি মিয়ার সাথে মিটিং এ বসিস। এর আগের বার তো সে এক তরফা তার লেকচার দিয়েছে,মানে,সে কেমন বউ চায়,তার বউ এর দায়িত্ব কর্তব্য কি কি হবে ইত্যাদি নিয়ে বলে গেছেন,এবার তুই তোর লেকচার তাকে শোনা,পজেটিভলি তার কাছে তোর অবস্থান ক্লিয়ার কর,তার পজেটিভ রায় হলে নেগোশিয়েট করবি,না হলে বাটনা পজিশনে যাবি,বাট যেভাবেই হোক,দু'জনে একটা পজেটিভ ডিসিশনে আসবি,দ্যান,আলহামদুলিল্লাহ বলে কবুল বলবি!!
বাহ,আমি কি দেখি সুন্দর সমাধান দিচ্ছি দেখেছিস?!!মাশাআল্লাহ বল জলদি!
-চুপ থাক!
আমি ভেংচি কেটে আবারো কমিকসের বইটা হাতে নিয়ে বললাম,
-বিনে পয়সায় বহুত মিটিং করছো,এবার বিদায় হও,দ্রুত বাসায় যেয়ে আন্টিকে সিদ্ধান্ত জানা,না হলে কিন্তু তুই কিছু করার আগে তারাই ফাইনাল করে ফেলবে সব! তখন আবার আফসোস করিস না।
মুনা চিন্তিত মুখ নিয়ে চলে গেলো। আর আমি শুধু মনে মনে আল্লাহকে বললাম,'এই মেয়েটা অসম্ভব ভালো একটা মেয়ে,হে আল্লাহ আপনি তাকে একজন উপযুক্ত জীবন সঙ্গী দিন,না হলে অনেক কষ্ট পাবে মেয়েটা।'
সপ্তাহ দু'য়েক পর মুনার দাদী অসূস্থ হয়ে পড়ায়,আর ওপক্ষেরও কোন এক মুরুব্বী মারা যাবার কারণে,আল্লাহর অশেষ রহমতে বেশ সিম্পল ভাবেই হুট করে বিয়ে হয়ে যায় মুনার। মাস খানেক আগে জানলাম,ওর বরের দেশের বাইরে চাকরী হয়েছে খুব শীঘ্রই ওরা ওখানে সেটেল হবে। আল্লাহ ইচ্ছেয় মুনার স্বপ্ন গুলোও ইনশাআল্লাহ পূরণ হবে,হয়তো ঠিক যেভাবে সে চেয়েছে সে ভাবে না,বাট যত দূরেই থাকুক,যেখানেই থাকুক মুনা,সবার আনন্দ ওকে অবশ্যই ছুঁয়ে যাবে সেখানেও।
[উৎসর্গঃ মুনা-টুনা কে। ]