এপার বাংলা ওপার বাংলা কথাটা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের হাতে গোনা কতিপয় ব্যক্তির মুখে উচ্চারিত হতে দেখা যায়। সুশীল সমাজের এই মানুষগুলো প্রধানত সাংস্কৃতিক অঙ্গনের। তাদের ভেতর গরিষ্ঠ অংশ আবার রবীন্দ্রানুরাগী। রবীন্দ্রনাথের গান হল তাদের এক মঞ্চে দাঁড়াবার ঐক্যসূত্র। সেই সূত্র ধরে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশে আমন্ত্রিত হয়ে এসে বাঙালির অভিন্ন চেতনা ও জীবনবোধের নানা পরিচয় তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশের অস্ট্রিক ভেডিড জনতা থেকে উত্থিত সংগ্রামী জনমানুষের রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষা ও বঙ্গ সংস্কৃতি রক্ষায় তাদের অবদানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানান। অতিথির পক্ষে এটাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। মেহমানদারির নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশে তারা যত দিন থাকেন তাদের তত দিন আপনজনের মতোই যত্ন নেওয়া হয়। তারা যে ভিন দেশের মানুষ তা বুঝতে দেওয়া হয় না।
একইভাবে বাংলাদেশের শিল্পী-সাহিত্যিক সুধীজন যারা পশ্চিমবঙ্গে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনিমন্ত্রিত হয়ে) যান তাদের সঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গের সুধীসমাজ ভালো ব্যবহার করেন। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে তাদের বক্তব্য শোনেন এবং শিল্পী হলে গান পরিবেশনের সুযোগ দেন।
হালে বাংলাদেশের শিল্পীদের তাদের টিভি চ্যানেলগুলোতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। সুযোগ দেওয়ায় তারা বিগলিত হয়ে এপার বাংলা ওপার বাংলা বলে কিছু নেই বলে উল্লেখ না করে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও ভারতীয় রক্ষী কর্তৃক বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ নির্যাতন করে এবং গুলি করে হত্যা ও চেকপোস্টে ভারতীয় শুল্ক কর্মচারীদের হয়রানির উল্লেখ করলে তারা বলেন, ওসব কোনো বাধাই নয়, এপার বাংলা ওপার বাংলার মানুষ সব অভিন্ন সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ। কাঁটাতারের বেড়া এ বন্ধন ছিন্ন করতে পারে না।
উভয় দেশের এমন কতক গুণীজন ও শিল্পীর এ-দেশে ও-দেশে আনাগোনা আপামর জনগণের কাছে কোনো তাত্পর্য বহন করে না। জনগণের স্তরে বিষয়টি একেবারে ভিন্ন, বলা যায় সম্পূর্ণ উল্টো। সেখানে কেবল কাঁটাতারের বেড়ার বাধা এবং গুলি ও পিটুনি খেয়ে অক্কা পাওয়ার ভয় নয়, রয়েছে সমাজপতি আরোপিত বর্ণ ও শ্রেণী বিভেদের সুউচ্চ দেয়াল। সমাজপতি সৃষ্ট এ দেয়াল বাংলাকে এপার ওপার দুপারে করেছে বিভক্ত। এ ভাগ রাতারাতি দূর হওয়ার নয়।
প্রজাতি হিসেবে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও তার অসম বণ্টন প্রথমাবধি বুদ্ধি যার বেশি তাকে অন্যদের ওপর প্রভাব খাটাবার সুযোগ করে দেয়। মানুষ কয়েকটি নৃগোষ্ঠীতে বিভক্ত। প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীর মধ্যে কিছুসংখ্যক বেশি বুদ্ধিমান থাকে। বুদ্ধিমান মানুষের বৈশিষ্ট হল পুরো নৃগোষ্ঠীর সুবিধা হয় এমন সব যন্ত্র ও হাতিয়ার উদ্ভাবন। জীবনযাত্রা সহজ করতে সামাজিক আইন অনুশাসন প্রণয়ন ও প্রবর্তন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে, উদাহরণস্বরূপ, দা, কুড়াল, কোদাল, কাঁচি, বঁটি, হাতুড়ি বাটাল, ছুরি, ঝাঁকা-টুকরি, দোয়ার, জাল, বানা, তাঁত প্রভৃতি হাতিয়ার দ্বারা উত্পাদন ও আহরণ এবং পিতামাতা ও গ্রামের সব মুরব্বির প্রতি, উপাসনা পরিচালনাকারী যাজকের প্রতি ও শিক্ষক, শিল্পী ও গায়কের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং কম বয়সীদের স্নেহ-ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখা ও তাদের অন্যায় ও ভুল আচরণ করতে দেখলে শাসন করা বাঙালি সমাজের বুদ্ধিমান চিন্তকদের আবিষ্কার উদ্ভাবন। তাদের এসব আবিষ্কার বাঙালি জাতিকে একটি পৃথক পরিচয় এনে দিয়েছে। বাংলাদেশে উদ্ভাবিত যন্ত্র ও হাতিয়ার এবং শাসন-অনুশাসন নিয়ে বাঙালি জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী কাটিয়ে দিয়েছে। তাদের মধ্যে দুঃখের বিষয়, হাতিয়ার কিংবা অনুশাসন উন্নয়নের কোনো প্রয়াস একেবারে আধুনিক আমল বা ব্রিটিশপরবর্তী আমল পর্যন্ত দেখা যায় না।
উত্পাদনের উন্নততর কোনো উপায় ও যন্ত্র নিয়ে না এলেও মধ্যযুগের আদিতে উত্তর ভারতের আর্য বৈদিক শাস্ত্র বাঙালির ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। বৈদিক আর্য ভারতে অনুপ্রবেশের পর তাদের শাস্ত্র বেদপুরাণ উপনিষদ এবং তাদের রচিত দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত এবং কাব্য ও মঞ্চনাটকের চরিত্রাবলি তাদের সাহিত্য রসের গুণে আর্য অনার্য নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয় হূদয় জয় করার রোল মডেল হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে আর্য সাহিত্য সংস্কৃতি জনমনে শিকড় গেড়ে দশম শতকের সেন আমলে। সেন রাজারা বাংলা দখলের পর আর্য সমাজের বর্ণপ্রথা, বিশেষ করে উচ্চবর্ণের শ্রেষ্ঠত্বজ্ঞাপক কৌলীন্য প্রথা কঠোরভাবে প্রবর্তন করে। এ প্রথা প্রবর্তন দ্বারা বাংলাদেশের প্রধান উত্পাদক গোষ্ঠী অস্ট্রিক ডেভিড কৃষিজীবী সম্প্রদায় স্থায়ীভাবে আর্য উচ্চবর্ণের সেবাদাসে পরিণত হয়। বাঙালি সমাজ, ইতঃপূর্বে ছিল নির্ধন; তাদের মধ্যে উঁচু-নিচু বলে কিছু ছিল না। সেন যুগে পৌঁছে বাঙালির মধ্যে দেখা দিল স্পষ্ট দুই বর্ণ-কুলীন ও ইতর। উত্পাদক শ্রমজীবী হল ইতর এবং শ্রমজীবীর উত্পাদন আত্মসাত্কারী হল উচ্চবর্ণ কুলীন। বর্ণ হিসেবে কুলীনের জন্য বরাদ্দ থাকল অধ্যয়ন ও লেখাপড়াভিত্তিক সব পেশা আর নিম্নবর্ণ বা নিচুজাতের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল কৃষি ও অন্যান্য শ্রমনির্ভর পেশা। শুধু তাই নয়, অধ্যয়ন ও লেখাপড়া তাদের জন্য করা হল নিষিদ্ধ। কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন দ্বারা বাঙালি সমাজ স্পষ্ট দুদলে ভাগ হয়ে গেল।
নিম্নবর্ণের বাঙালি তাদের মানবেতর অবস্থা অতিক্রম করতে সামাজিক সাম্যের বর্ণহীন মতবাদ বৌদ্ধ ধর্ম দল ধরে প্রথম সুযোগে গ্রহণ করে। যতদিন বৌদ্ধ রাজশক্তি বাংলাদেশের শাসক হিসেবে ছিল ততদিন উচ্চবর্ণের লোকেরা তাদের উত্পাদন আত্মসাত্ করে গেলেও তাদের ওপর নিম্নবর্ণের প্রতি যে ঘৃণা ও অবজ্ঞা সেটা প্রকাশ্যে দেখানো থেকে বিরত ছিল। বৌদ্ধরা ধর্মীয় কারণে মাথা মুণ্ডন করত বলে তাদের তারা নিজেদের মধ্যে উল্লেখ করত নেড়ে বলে। বৌদ্ধ রাজশক্তির অবসানের পর পুনরায় ব্রাহ্মণ্য শাসন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলে উচ্চবর্ণ আদেশ জারি করে সবাইকে বর্ণপ্রথায় ফিরে আসতে। কেউ না এলে তাকে হত্যা করার এবং যে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানাবে তাকেও হত্যা করার ফরমান জারি হল। বাংলাদেশে এরপর আবার উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হল। বৌদ্ধদের কেউ কেউ প্রাণ ও ধর্ম রক্ষায পালিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেল। এ কারণে আজ বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ও চট্টগ্রামে কিছুসংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সাক্ষাত্ মেলে।
বর্ণপ্রথার অমানবিকতা থেকে মুক্ত হতে শ্রমজীবী বাঙালি ইসলাম ধর্মে সব মানুষ সমান মর্যাদাবান জেনে পঞ্চদশ শতক থেকে দলে দলে মুসলমান হয়ে যায়। রাজশক্তি তখন মুসলিম থাকায় বাংলার উচ্চবর্ণ তাদের আর ঘাঁটায় না। ব্রিটিশের দখল নেওয়া পর্যন্ত তারা ইসলাম ধর্মাবলম্বীই থেকে যায়। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তারা মক্তব-মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। বহু শতাব্দী পর এই প্রথম তারা পুস্তক, শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের নাগাল পায়।
ইংরেজ কর্তৃক বাংলাদেশ দখলের পর বাংলাদেশের উচ্চবর্ণ আবার স্বরূপে আবির্ভূত হলেও শ্রমজীবী বা নেতাকে ফের বর্ণপ্রথার আওতায় নিয়ে আসতে পারে না। মুসলমান কৃষক মাথা ন্যাড়া না করলেও বাংলার উচ্চবর্ণ বৌদ্ধ যুগের মতো তাদের ঘৃণাসূচক নেড়ে বলেই অভিহিত করতে থাকে। ইংরেজ থাকায় তারা কৃষককে মাদ্রাসায় যাওয়া থেকে, এমনকি উচ্চবর্ণ প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ থেকে দূরে রাখতে পারে না। ইংরেজ তার প্রয়োজনে ভারতের রাজনীতি ধর্মভিত্তিক করে দিলে বাংলাদেশের কৃষিজীবী নেড়ে তার সুযোগ গ্রহণ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে সরকারি-অসরকারি সব পদ ও পেশায় তার হিস্যা দাবি করে। তারা সম্প্রদায়ের স্বার্থসচেতন ও রাজনীতিসচেতন হয়ে ওঠে। সংসদীয় গণতন্ত্র বাংলাদেশে কায়েমের প্রথম সুযোগে ১৯৩৭ সালের বঙ্গীয় বিধান সভার নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের নেতা আবুল কাসেম ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিকে জিতিয়ে হক সাহেবকে মন্ত্রিসভা গঠনের সুযোগ করে দেয়। ফজলুল হক হন নবাব সিরাজের পর বঙ্গদেশের প্রথম বাঙালি শাসক। তাদের নেতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় বাংলাদেশের কৃষক জনতার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তারা এরপর থেকে উচ্চবর্ণের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন সাহিত্য, সংগীত, অঙ্কন, নৃত্য, খেলাধুলা প্রতিটিতে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করে। তারা তাদের প্রতিভার দীপ্তি ছড়াতে থাকে লেখাপড়া ও গবেষণায়ও। এতে বাংলার উচ্চবর্ণ প্রমাদ গোনে। তাদের ভাবতেও এসময় কষ্ট হয় যে নেড়ে তাদের দিকে এতটা তেড়ে আসতে পারবে।
বাংলাদেশের উচ্চবর্ণের এ ভয় থেকে তারা ভারত ভাগের সময় (১৯৪৭) বঙ্গভঙ্গেরও প্রবল দাবি জানায়। ভারত ভাগ ও বঙ্গভঙ্গের প্রতি ইংরেজেরও ছিল পূর্ণ সায়। বঙ্গভঙ্গ হয়ে গেলে বঙ্গদেশের সমুদয় উচ্চবর্ণ পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে তাদের মান-ইজ্জত বাঁচানোর সুযোগ পায়। অভঙ্গ-বঙ্গে তাদের হাজার বছরের একচেটিয়া ভোগ ও কৌলীন্য থাকবে না তা আঁচ করেই তারা বাঙালিত্ব চিরতরে বিসর্জন দিয়ে ভারতীয় বনে যায়। আজ তারা বাঙালি নয়, ভারতীয় হয়েই থাকতে চায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকালে বিপুলসংখ্যক বাঙালি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব রাজ্যের বাংলাভাষী ভারতীয় তাদের এককালের স্বদেশের মানুষদের বিপদে সাড়া দিয়ে তাদের সব প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা দেয়। ভারত সরকারের কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে বাংলাভাষী অনেক ভারতীয় বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো হয়ে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গকে যুক্ত করে অখণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে মত প্রকাশ করতে থাকে। এতে ভারত সরকার প্রমাদ গোনে। ভারতে তখন এই মত (যা বিভাগপূর্বকালে প্রবল ছিল) প্রকাশ ও জোর প্রচার হতে থাকে যে, বাংলাদেশ যারা স্বাধীন করেছে তারাও নিম্নবর্ণের অস্ট্রিক-ভেডিড গোষ্ঠীর মানুষ এবং তারা প্রধানত বিধর্মী এবং নিম্ন সংস্কৃতির। ওদের সঙ্গে বনিবনা হবে না বলেই ১৯৪৭ সালে বঙ্গদেশ ভাগ করে উচ্চবর্ণের সসম্মানে বাঁচার সুবিধার জন্য পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্নদাশংকর রায়ও এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বৃহত্ ভারতের সুবিধা ছেড়ে ক্ষুদ্র বাংলাদেশের সঙ্গে কখনও জোড়া লাগতে যাবে না। তারা বাংলাদেশি বা বাঙালি নয়, ভারতীয়ই রবে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অস্ট্রিক ভেডিড জনতা যারা ব্রিটিশসৃষ্ট চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার দ্বারা নিঃস্ব ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়, তাদের চল্লিশ শতাংশ আজও (২০১১) দারিদ্র্যরেখার (১৮০০ ক্যালরি খাদ্যগ্রহণ মাত্রার) নিচে অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে কোটিপতি অধিকোটিপতির সংখ্যা কয়েক লাখে গিয়ে পৌঁছেছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত, উচ্চ সংস্কৃতির ও রুচির মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। শিল্পকলার সব শাখায় তারা পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণ শিল্পীদের ধরে ফেলেছে ও অনেক জায়গায় গেছে ছাড়িয়ে। এর দরুন পশ্চিমবঙ্গে তাদের সমাদর বেড়েছে এবং তাদের নানা প্রযোজনায় বেড়েছে তাদের চাহিদা। বাংলাদেশের শিল্পীদের তারা করুণার বদলে এখন সমীহ করে। তবু তাদের নাক উঁচু-ভাব বা দাদাগিরি এখনও পুরোপুরি কাটেনি। বাংলাদেশের লোক দিয়ে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, গ্রিস-পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কথা বাদই দেওয়া গেল-ভরে গেলেও এবং বাঙালি বলতে কেবল তাদেরই বোঝালেও পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণের বাংলাভাষী ভারতীয়রা ওই সব দেশে তাদের সঙ্গে নিম্ন সংস্কৃতির অল্পশিক্ষিত ধরে নিয়ে না মিশে তাদের সজ্ঞানে এড়িয়ে চলে। এখানে উল্লেখ্য যে, পশ্চিমবঙ্গের অস্ট্রিক ভেডিড কৃষিজীবী জনতা যারা ১৯৪৭-এর পর দাঙ্গা-ভীতি অগ্রাহ্য করে মাটি কামড়ে স্বভূমি আঁকড়ে থাকে স্বাধীনতার সাড়ে ছয় দশক পরও, ৩৫ বছর বাম বাবুদের শাসন সত্ত্বেও, প্রাক-৪৭ স্তরে রয়ে গেছে। এতো লম্বা সময়েও তাদের মধ্য থেকে গায়ক, অভিনেতা, চারু ও কারুশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, খেলোয়ার, শিক্ষক, অধ্যাপক, আমলা বের হয়েছে বলে চোখে পড়ে না। বিদ্যমান এই অবস্থার পৃষ্ঠপটে এপার বাংলা ওপার বাংলা বলে কিছু নেই, আছে শুধু বাংলাদেশ এবং তার কতিপয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিয়ে বাঙালি জনতা। কাঁটাতারের বেড়া, সীমান্ত রক্ষা এবং পাসপোর্ট ভিসা যত দিন আছে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
বিদ্যমান এই অবস্থার পৃষ্ঠপটে এপার বাংলা ওপার বাংলা বলে কিছু নেই। এটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে মমতা ব্যানার্জী কর্তৃক হাসিনা-মনমোহন বৈঠক পণ্ড করা হয়েছে। তিস্তা তো নয়ই ফারাক্কা দিয়ে যে সামান্য জল চুইয়ে বাংলাদেশে আসে সেটুকু দিতেও তার অনিচ্ছার কথা মুখ্যমন্ত্রী হয়েই তিনি বলে ফেলেছেন।
আজ পৃথিবীর মানুষ এপার ওপার নয় বাংলাদেশকে শুধু চেনে। এই দেশে বসবাস করে কতিপয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ বাঙালি জনতা। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এ জনতা ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে রক্তস্নাত স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শুচিতা লাভ করে এক অখণ্ড সেক্যুলার জাতিসত্তায় পরিণত হয়েছে। এ জাতির সবাই একে অপরের পরমাত্মীয় এবং তারা বাঁচে ও মরেও সেভাবে।
সূত্রঃ Click This Link