পরিবার ও ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ:
১. ঠাকুর পরিবারের আদি পদবি ছিল কুশারী। তাঁরা ছিলেন শাণ্ডিল্য গোত্রের ব্রাহ্মণ। আগেকার দিনে নিচু শ্রেণীর হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের অনেক সময় ঠাকুর বলতেন, এইভাবেই তাঁদের পদবি ঠাকুর হয়ে যায়।
২. বালক রবীন্দ্রনাথ বাড়িতে পড়াশোনা, গান ও আঁকা শেখা ছাড়াও প্রায় প্রতিদিন ভোরে উঠে তখনকার বিখ্যাত কুস্তিগির হিরা সিং-এর কাছে কুস্তি শিখতেন।
৩. রবীন্দ্রনাথের ঘুম ছিল খুব কম। গভীর রাতে শুতেন, উঠতেন শেষ রাতে। সাধারণত তাঁর দিন শুরু হত স্নানান্তে উপাসনায়। ঠিক ভোর ৪টায় চা। ভোর ৪টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত একটানা লিখতেন। সকাল ৭টায় প্রাতরাশ সেরে আবার লেখা। ফাঁকে ফাঁকে চা বা কফি। বেলা ১১টা পর্যন্ত লিখে যেতেন আবার স্নানে। স্নানের পরই খেতে বসতেন। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমোতেন না, বিশ্রামও না। ঘন্টা খানেক কোনো পত্রিকা বা বইয়ের পাতা উল্টে আবার লিখতে বসা। বিকেল ৪টায় চা, সঙ্গে কিছু নোনতা। রাতের খাওয়া সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে। রাতে পছন্দ করতেন ইংরেজি খাবার। দুপুরে বাঙালি। রাতে খেয়েদেয়ে আবার একটানা রাত ১২টা পর্যন্ত লেখা বা পড়া।
৪. তিনি বাড়িতে পরতেন গেরুয়া বা সাদা রঙের জোব্বা আর পায়জামা। উপাসনা বা সভা সমিতিতে যাওয়ার সময় জোব্বা ছাড়াও সাদা ধুতি, জামা ও চাদর ব্যবহার করতেন। ঋতু উৎসবে ঋতু অনুযায়ী নানা রঙের রেশমী উত্তরীয় ব্যবহার করতেন। যেমন বর্ষায় কালো বা লাল, শরতে সোনালি, বসন্তে বাসন্তি রঙের। কখনো কখনো জোব্বার রঙও হত উত্তরীয়র রঙের।
৫. বৃক্ষপ্রেমী রবীন্দ্রনাথের গানে কবিতায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য উদ্ভিদ আর ফুলের নাম। শুধু কাব্যেই উল্লেখ আছে ১০৮টি গাছ ও ফুলের নাম। এর মধ্যে বেশ কিছু বিদেশি ফুলের বাংলা নাম দিয়েছিলেন কবি স্বয়ং। তাঁর দেওয়া কয়েকটি ফুলের নাম হল : অগ্নিশিখা, তারাঝরা, নীলমণিলতা, বনপুলক, বাসন্তী।
৬. অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা শান্তিনিকেতনে এসে কবিকে `ডক্টর` উপাধি দিয়েছিলেন ১৯৪০ এর ৭ আগস্ট।
৭. রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রথম `বিশ্বকবি` কথাটি বলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। তাঁর নিজের সম্পাদনায় প্রকাশিত সোফিয়া পত্রিকায় ১৯০০ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এর নাম ছিল `দ্য ওয়ার্ল্ড পোয়েট অফ্ বেঙ্গল`।
৮. ভানুসিংহ ঠাকুর যে রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনাম ছিল সেটা অনেকেরই জানা। তাঁর আরো কয়েকটি ছদ্মনাম : দিক্শূন্য ভট্টাচার্য, অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর, আন্নাকালী, পাকড়াশি।
জমিদার রবীন্দ্রনাথ:
৯. ঠাকুরদের জমিদারির প্রতি গ্রামে জমিদার ও গ্রামবাসীদের টাকাতেই তৈরী হয়েছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়া তিনটি মাইনর স্কুল ও জমিদারির সদর কাছারিতে হাইস্কুলও তৈরী করা হয়। বানানো হয় ছাত্রাবাসও।
১০. রবীন্দ্রনাথ নিজেও হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতেন। হেলথ কো অপারেটিভ তৈরি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা ভারতে রবীন্দ্রনাথই প্রথম চালু করেন।
১১. রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধুপুত্র সন্তোষ মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন কৃষি ও পশুপালন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। তাঁরা ফিরে এসে শিলাইদহে ও পতিসরে বসানো হয় আদর্শ কৃষিক্ষেত্র - ৮০ বিঘা জমি জুড়ে। তাঁরা ১৯১০ সালে কৃষিক্ষেত্রে ট্রাক্টর আর পাম্পসেট চালান। বসানো হয় কৃষি ল্যাবরেটরি।
১২. ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ স্থাপন করেন `পতিসর কৃষি ব্যাংক` নোবেল প্রাইজের এক লক্ষাধিক টাকা তিনি ব্যাঙ্কে ঢালেন। এখান থেকে কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হত। ব্যাংক চলেছিল কুড়ি বছর।
গ্রন্থ ও সাহিত্য
১৩. রবীন্দ্রনাথের প্রথম বই ‘কবি কাহিনী’ প্রকাশিত হয় কবির অজান্তে ১৮৭৮ সালের ৫ নভেম্বর। কবি তখন বিলেতে। কবিবন্ধু প্রবোধচন্দ্র ঘোষ বইটি প্রকাশ করে কবির কাছে পাঠিয়েছিলেন।
১৪. ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে অর্থাৎ মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের মোট ৩১১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ থেকে প্রকাশিত হয় ৮৮টি গ্রন্থ।
১৫. প্রশান্ত মহলানবিশ একবার হিসাব করিয়ে দেখেছিলেন যে গল্পগুচ্ছসহ রবীন্দ্রনাথের ১৮টি গ্রন্থে মোট ৮,৬৩,৩১০টি শব্দ আছে। তার মধ্যে `আমি` আছে ৭৭৩৭ বার এবং `তুমি` আছে ৩,১৪৭ বার।
রবীন্দ্রসংগীত:
১৬. ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ গানের চর্চা করে এসেছেন। গবেষকদের মতে রবীন্দ্রনাথের গাওয়া প্রথম গান হচ্ছে তাঁর খুড়তুতো দাদা, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ` দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম আননে` গানটি। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাত।
১৭. এখন রবি ঠাকুরের গান বলতে বোঝায় তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গান, রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে রবি ঠাকুরের গান বলতে বোঝাত রবীন্দ্রনাথের গাওয়া গান।
১৮. রবীন্দ্রনাথের প্রথম গানের সংগ্রহ প্স্তুক রবিচ্ছায়া প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। গীতবিতান প্রকাশিত হয় ১৯৩১ এ।
১৯. ঠাকুর পরিবারের লোকজন ছাড়া বাইরের লোক, যিনি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে গান শিখে প্রকাশ্যে গাইতে আরম্ভ করেন এবং পরে রেকর্ড করেন তিনি হলেন চিত্তরঞ্জন দাশের ভগ্নী অমলা দাশ। যদিও রেকর্ডে নাম থাকত মিস দাশ, অ্যামেচার।
২০. রবীন্দ্রনাথের গাওয়া প্রথম ডিস্ক বেরোয় ১৯০৫ সালে। একপিঠে ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের `বন্দেমাতরম্` অন্যপিঠে স্বরচিত `সোনার তরী` কবিতার আবৃত্তি`।
২১. রেকর্ডে প্রথম `রবীন্দ্রসংগীত` শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল কনক দাশের গাওয়া ১৯৩৫ এ প্রকাশিত একটি রেকর্ডে। পূর্বে রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে লেখা হত `রবীন্দ্রগীতি`, কখনও `কথা ও সুর- রবীন্দ্রনাথ` কিংবা কেবলমাত্র বন্ধনীর মধ্যে `রবীন্দ্রনাথ` অথবা `আধুনিক`।
নাটক:
২২. রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেছিলেন ১৮৭৭ সালে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা `এমন কর্ম আর করব না` নাটকে রবীন্দ্রনাথ অলীকবাবুর ভূমিকায় মঞ্চে নেমেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর।
২৩. নিজের লেখা নাটকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেছিলেন `বাল্মিকী প্রতিভা`য় বাল্মীকির ভূমিকায়। নাটকটি মঞ্চস্থ হয় জোড়াসাঁকোয় ১৮৮১ সালের ২৬ ফেব্র"য়ারি।
২৪. অভিনয়ের জন্যে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং মঞ্চে অবতীর্ণ হন মোট ১০১ বার।
২৫. রবীন্দ্রনাথের অভিনয় দেখে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি বলেছিলেন, `রবীন্দ্রনাথই দেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা।`
চিত্রকলা:
২৬. অনেক আগে আঁকা শুরু করলেও রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত ছবি আঁকতে শুরু করেন ১৯২৮ সালে, যখন তাঁর বয়স ৬৭।
২৭. ১৯০১ থেকে ১৯৪০ এই চল্লিশ বছরে সাদা কালো ও গাঢ় রঙে ছোট বড়ো মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছিলেন প্রায় তিন হাজার।
২৮. শান্তিনিকেতনের বাইরে তাঁর ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয় ফ্রান্সের প্যারিস শহরে ১৯৩০ এ। প্রদর্শনীটির ব্যবস্থা করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো।
২৯. দেশ বিদেশের বহু শিল্পী রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছবি আঁকেন তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ১৮৮১ সালে।
নৃত্য:
৩০. রবীন্দ্রনাথ খুব ভালো `বলডান্স্` করতে পারতেন। তাঁকে নাচ শিখিয়েছিলেন খুড়তুতো দিদি সত্যেন্দ্রবালা ঠাকুর।
৩১. রবীন্দ্রনৃত্য বলতে এখন যা বোঝায়, রবীন্দ্রনাথ নিজে এই নৃত্যশৈলীকে বলতেন `ভাবনৃত্য`। জাভা দেশের নৃত্যের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগ থেকে এই শৈলীর জন্ম। মণিপুরি, কথাকলি, ভরতনাট্টম, শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিনাচ, জাভার নৃত্যভঙ্গি- নানা দেশের নানা ধরনের নৃত্যশৈলী দেখে অনুপ্রেরণায় তাঁর নিজস্ব নৃত্যশৈলীর জন্ম দিয়েছিলেন। তবে সবসময় বলতেন, নাচের টেকনিক যেন গানের ভাবকে ছাড়িয়ে না যায়।
চলচ্চিত্র:
৩২. ১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজের পরিচালনায় ও অভিনয়ে মঞ্চস্থ করেন `নটীর পূজা`। নিউ থিয়েটার্স সেই অভিনয়ের সবাক চিত্র তুলে রাখে। `নটীর পূজা` প্রথম মুক্তি পায় চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে ১৯৩২ সালের ২২ মার্চ।
৩৩. নরেশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের কাহিনীচিত্র প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্ররূপ `মানভঞ্জন` মুক্তিলাভ করে ১৯২৩ সালে।
৩৪. রবীন্দ্র-কাহিনী ভিত্তিক প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের নাম `চিরকুমার সভা`। নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় ছবিটি পরিচালনা করেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। ছবিটি ২৮ মে ১৯৩২ সালে চিত্রায় মুক্তি পায়।
৩৫. রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নয় এমন চলচ্চিত্রে প্রথম রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হয় প্রমথেশ বড়–য়ার `মুক্তি` ছবিতে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। পঙ্কজকুমার মল্লিকের সংগীত পরিচালনায় ছবিটিতে কাননদেবীর কন্ঠে দুটি এবং পঙ্কজ মল্লিকের কন্ঠে দুটি মোট চারটি রবীন্দ্রসংগীত স্থান পেয়েছিল।
জন্মোৎসব:
৩৬. আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন প্রথম পালন করা হয়েছিল ১৮৮৭ সালে, পার্ক স্ট্রিটে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে। গুরুদেবের সেই প্রথম জন্মোৎসব পালনের কৃতিত্ব দাবি করেছেন রবীন্দ্রনাথের ভাগনি, সরলা দেবী চৌধুরানি।
৩৭. কবির পঞ্চাশ বছর পূর্তি জন্মোৎসবে টাউন হলের এক সভায় অজিতকুমার চক্রবর্তী `রবীন্দ্রনাথ` নামে প্রবন্ধ পাঠ করেন। পরে এটি বই হয়ে বেরোয়। এই বইটিই রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক প্রথম বাংলা বই।
৩৮. ১৯২৮ অর্থাৎ ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথের দেহের ওজনের সমপরিমাণ ওজনের বই বিশ্বভারতী থেকে অন্যান্য সাধারণ গ্রন্থাগার ও প্রতিষ্ঠানকে দান করা হয়।
তথ্য সংগ্রহ : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর।