এক.
নভেম্বরের ৩ তারিখের সকাল। খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভেতরে ভেতরে দারুন উত্তেজনা, কিছুটা টেনশনও হচ্ছে। এত দূরের পথ, ঠিকভাবে যেতে পারব নাকি আবার কোন ঝামেলা হয়। যাচ্ছি আমেরিকা, অনেকের কাছে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মত। তবে আমেরিকা ঘিরে আমার স্বপ্নটা ছিল একটু অন্যরকম। আমাদের বাড়ির পাশের এক দাদা আমেরিকা থাকে, সুকমল দা, বুয়েট থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেছে পড়তে। এখন ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। ছোট থেকেই তাঁর কথা শুনে , আর তাঁর জন্য লোকের গর্ব করা দেখে আমারও ইচ্ছে করত আমিও একদিন পড়তে যাব ওখানে, দেখব ওখানকার মানুষের জীবনযাত্রা, দাপিয়ে বেরাব পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ।
যাচ্ছি একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে, একটু অন্যভাবে হলেও হচ্ছে তো আমেরিকা যাওয়া, মন্দ কি! তবে পুরাটাই আমার নিজের খরচে, ওরা শুধু হোটেলের থাকার পয়সা দেবে। যেহেতু থাকব সুকমলদার বাসায় তাই ওটা নেওয়ার আর প্রয়োজন পড়ছে না। একটা রিসার্চ পেপার লিখেছি দাদার সাথে, টেক্সটাইল কারখানার বর্জ্য পানি নিষ্কাশনের উপরে। দুই ধাপে যাচাই বাছাইয়ের পর ওরা কনফারেন্সের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন দিয়েছে, এখন আমাকে আমার পেপার নিয়ে যেতে হবে, ওখানে প্রেজেন্টেশান দিতে হবে। সেখানে প্রেজেন্টেশনে সিলেক্ট হলে ওটা জার্নালে যাবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি জার্নাল পেপার গুলো কিছু কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন কেউ যদি বাইরে ফান্ডিং সহ ভালো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে চায়, তাহলে তার রিসার্চের সাথে পরিচয় আছে, দুই একটা বিয়য়ে রিসার্চের অভিজ্ঞতা আছে এই ব্যাপারগুলো এডমিশন পেতে এবং সর্বোপরি ফান্ডিং পেতে খুব সাহায্য করে। কারণ প্রফেসর আপনাকে সিলেক্ট কেন করে, মূলত তাঁর গবেষণা কাজে সাহায্য করার জন্যই । এজন্য একটু অভিজ্ঞতা আছে এমন কাউকে প্রফেসর অবশ্যই অগ্রাধিকার দেবে। আর ভালো মানের রিসার্চ থাকলে তো আরও ভালো।
ভিসা পেতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি , কনফারেন্সের জন্য আলাদা ভিসা আছে। কনফারেন্স থেকে চিঠি ইস্যু করা ছিল অ্যাম্বাসিতে। ওরা শুধু মিলিয়ে দেখেছে আমার নাম আছে কিনা। শেভরণ বাংলাদেশ কোম্পানিতে চাকরি করার সুবাদে অনেকটাই সুবিধা হয়েছে। কারণ শেভরণ নামকরা আমেরিকান কোম্পানি। রেভেনিউ উপার্জনের দিক দিয়ে সারা পৃথিবীতে তৃতীয়। ওরা যখন কাউকে তাদের কোম্পানিতে চাকরিতে নেয় নানারকম সিকিউরিটি চেক করেই নেয়, এমনকি বাসাতে পর্যন্ত যায়। আমার বাসাতেও এসেছিল, আশপাশ থেকে আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছে। আমার বন্ধু বান্ধব কারা, তারা কে কি করে, সেটাও খোঁজ নিয়েছে, তাদের সাথে কথাও বলেছে। অ্যাম্বাসির কনসুলার কোথায় জব করি, আয় কেমন এইসব টুকটাক কিছু প্রশ্ন করে শেষে বলল দুইদিন পর ভিসা সহ পাসপোর্ট সংগ্রহ করার জন্য। সুকমল দাদা খুব উদ্বিগ্ন ছিল, সকালে সে অফিসে যাওয়ার আগে আমাকে ফোন করে বলে, ' অফিসে যাচ্ছি, ভালো খবর দাও, কি খবর বল।' আমি বললাম দাদা হয়ে গেছে। সে অভিনন্দন জানাল। আমেরিকা যাচ্ছি , দেশের বাইরেই প্রথম বারের মত। মনের ভেতরে চাপা উত্তেজনা আর শিহরন, সাথে একটু একটু ভয় সে এক অন্যরকম অনুভূতি।
আগের রাতেই আমার বন্ধু দীপনের স্ত্রী পূর্বা ফোন করে বলল, ' তুমি আমেরিকা যাচ্ছ, আমার দীপনের জন্য কিছু জিনিস দেব, যদি জায়গা থাকে একটু নিয়ে যেতে পারবে?'। আমার ব্যাগে খুব বেশি জিনিস নেইনি। কারণ সুকমল দা আগেই বলে রেখেছিল তাঁর কিছু জিনিস নিয়ে আস্তে হবে ফেরার সময়। তাই একটা ব্যাগ প্রায় ফাঁকাই ছিল। আর থাকব মাত্র ১৫ দিন। আমার চাকরির অন্যতম একটা সুবিধা হল ১৫ দিন অফিস আর ১৫ দিন ছুটি। ভাগ্যক্রমে কনফারেন্সটাও ছুটির মধেই পড়েছে। পূর্বাকে বললাম খুব সকালে এসে আমাকে জিনিস গুলো দিয়ে যেতে। কথামত খুব সকালে এসে কিছু নাড়ু, জামা কাপড়, জুতা দিয়ে গেল, আর বলে গেল নাড়ুর কথা না বলতে ওকে, এটা সারপ্রাইজ, সে নিজ হাতে বানিয়েছে। স্বামীর জন্য কত ভালোবাসা। আহারে ! এই ভালবাসা মায়া মমতা ছেড়ে আমার বন্ধু কিছুদিন আগেই পাড়ি জমিয়েছে আমেরিকায়। বেচারা পূর্বা একা হয়ে পড়েছে।
দুপুর ১২ টায় ফ্লাইট। যতটা সম্ভব কম খরচ আর মোটামুটি ভালো মানের জন্য টিকিট কাটলাম চায়না সাউদার্ন এয়ারওয়েজে। এক পরিচিত দাদার ট্রাভেল এজেন্সী আছে, উনি এগুলো ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে ৪ ঘণ্টার ফ্লাইটে চায়নার গুয়াংজু। সেখানে ১২ ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। এয়ারলাইন্স থেকেই হোটেল দেওয়ার কথা। তারপর একটানা ১৪ ঘণ্টার ফ্লাইটে সান ফ্রান্সিসকো। সকাল বেলায় আমাকে সি-অফ করতে পাবনা থেকে আমার কাকা কাকী বোনরা এসেছিল । আমার এক কলিগ, বুয়েটের বড় ভাই তাশফিক ভাইও এসেছিল । আমি আর তাশকিফ ভাই এক সিনজিতে আর কাকা কাকীরা অন্য একটায়। আমরা আগে পৌঁছে সিএনজি নিয়েই উপরে চলে গেছি সোজা ১ নম্বর টার্মিনালে। কাকু এসে ফোন দিয়ে বলে তাদের নাকি উপরে আসতে দিচ্ছে না, ভিসা দেখাতে বলছে। যাত্রী ছাড়া কেউ নাকি উপরে যেতে পারবে না। ওই সময় কয়েকজন বিদেশী নান জায়গায় মারা যাওয়ার কারণে বিমানবন্দরে বেশ কড়াকড়ি। উপায় না দেখে তাদের নিচে দাঁড়াতে বলে আমি একা একা হেঁটে নিচে আসলাম, তাশফিক ভাইকে উপরে রেখে কারণ আসার সময় তাকে যদি আবার আটকে দেয় এই ভয়ে। কাকু নিচে দাঁড়িয়ে ছিল, সে এক অন্যরকম আবেগ, মনে হচ্ছিল আমি বুঝি একেবারে চলে যাচ্ছি, আর হয়ত দেখা হবে না। কাকু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল সাবধানে যাস। আমিও কিছুটা আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লাম। খুব মিস করছিলাম আমার বাবা-মাকে। বাবা গতবছর আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন, মাও খুব অসুস্থ, তাঁর আসার মত অবস্থা নেই। কাকুর ভরসাতেই মাকে রেখে আমি চললাম আমেরিকা.বাবা-মা আসলে আরও কতই না ভালো লাগত। .............(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৫০