যশোরের একজন স্কুল শিক্ষিকা তার কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে বর্তমানে জেলখানায় রয়েছেন। এটা কোন সংবাদ না। দেশের নানা পেশা ও বয়সের আরও অসংখ্য মানুষ সেখানে আছেন। জেলখানার চার দেওয়ালের ভেতরে চোর ডাকাত বদমায়েশ গুন্ডা ছাড়াও হাজার হাজার মানুষের খোঁজ মিলবে যারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শাসকদলের নিষ্ঠুরতা ভোগ করছেন। যেন অপরাধীর চেয়ে নিরপরাধী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে জেলখানাগুলোতে দিনে দিনে। পক্ষান্তরে প্রকৃত অপরাধীরা রয়েছে বহালতবিয়তে। মুক্ত বাতাসে। নিশ্চিন্তে।
যদিও এখানে আলোচনার বিষয় এটি নয়, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মা ও মেয়ে। মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকা এবং মেয়ে একটি স্বনামধন্য বিদ্যাপিঠের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। নাম সিথি। তার বাবা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যবসা করেন। এক কথায় ‘মেলার আয়োজন করেন। দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে, গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি ‘মেলা’করে বেড়ান। অজানা, অচেনা পরিবেশে, অপরিচিত মানুষের মনে আনন্দের খোরাক যোগান। সেই মেলা করা মানুষটির মন এখন বিষাদময়। নিরানন্দে ভরা। নেপথ্য কারণ কেবল একটি ভুল। ভুলের নাম ‘ধাতবমুদ্রা।’
গ্রামগঞ্জে বা মফস্বলের মেলাগুলোতে ধাতবমুদ্রা বা খুচরা পয়সার ব্যবহার বেশি দেখা যায়। সাধারণত জমানো কয়েন নিয়ে গ্রামের মানুষের মেলায় যাওয়ার ঘটনা আবহমান বাংলার একটি চিরায়ত দৃশ্য। লুঙ্গির গাঁটে করে একগাদা কয়েন নিয়ে হত দরিদ্র দর্শনার্থীরা মেলায় যান। সেখানে গিয়ে কেনাকাটা করেন, লটারীর টিকিট কাটেন এবং রাত জেগে যাত্রাপালা বা ভ্যারাইটি শো দেখে চোখ ডলতে ডলতে ভোর বেলা বাড়ি ফেরেন । আবারও শুরু হয় একটি বছরের অপেক্ষা। একটি রাতের আনন্দ ফূর্তির অপেক্ষায় এসব খেটে খাওয়া হত দরিদ্র মানুষ অল্প অল্প করে মাটির ব্যাংকে ধাতবমুদ্রা জমায়।
সিথির বাবা বিল্লাল হোসেনকে সারা দেশ ঘুরে ঘুরে ‘আনন্দ মেলা’করতে হয় বলে মাসের পর মাস তাকে থাকতে হয় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। যেকারণে উপার্জন করা অর্থকড়ি পুরোটাই জমতে থাকে নিজের কাছে। এভাবে জমতে জমতে পাহাড়সম ধাতবমুদ্রার স্তুপ নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন তিনি। সেগুলোর বিনিময়ে কাগজের নোট বানিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টায় ব্যাংকের দ্বারস্থ হন। সমাধান মেলে না। বাস্তবতা হলো দেশের কোন সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংক ধাতব মুদ্রা গ্রহন করে না। যদিও নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলো তা গ্রহন করতে বাধ্য। তাদের এই গ্রহন না করা নিয়ে অসংখ্যবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। টিভি চ্যানেলে। বিল্লাল হোসেন শেষ পর্যন্ত তার কাছে জমা হওয়া ধাতবমুদ্রাগুলো কুরিয়ার করে পাঠান যশোরে তার বাড়ির ঠিকানায়। সহধর্মিনী সুলতানা পারভীন তার মেয়ে সুমাইয়া সুলতানা সিথিকে সাথে নিয়ে চলে যান কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয়ে। আর বিপত্তি ঘটে তখনই। ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে উপশহর খাজুরা বাসষ্ট্যান্ড এলাকার ইউএস বাংলা কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ৪৯ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ানের একটি দল ওইসব ধাতবমুদ্রাসহ মা এবং মেয়েকে আটক করে। সেটির পরিমান ১৮৪ কেজি বলে মুদ্রা পাচারের অভিযোগে থানায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়।
এ সংক্রান্ত নিউজ লিংকগুলো থেকে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করতে পারেনঃ
School teacher, daughter held with 184kg with Bangladeshi coins
School teacher, daughter held with 184kg BD coins
সীমান্তবর্তী জেলা শহর যশোরে এক সাথে এত বিশাল পরিমানের ধাতবমুদ্রার চালান পাওয়ার প্রেক্ষিতে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন ওঠে যে চালানটি ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে আনা হয়েছিল। যদিও সীমান্ত জেলা শহর থেকে অনেক দূরে। প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার। তবুও তা চোরাচালান পণ্য হিসাবে মনে করা হয়। অথচ খোঁজ নেয়া হলে যশোরের অনেক ব্যবসায়ীর গোডাউনে বা দোকানে কেজি কেজি ধাতবমুদ্রা মিলবে। শুধু যশোর নয়, দেশের সব এলাকাতে এমন পরিস্তিতি। ধাতবমুদ্রা নিয়ে চরম বিপাকে ব্যবসায়ীরা। কেননা দেশের কোন ব্যাংকে গিয়ে আপনি ধাতবমুদ্রা জমা দিতে চায়লে ক্যাশ কাউন্টার থেকে বিদায় করে দেয়া হবে।
যাইহোক যশোরে এই মা মেয়ের আটক হওয়ার বিষয়ে ৪৯ গার্ড ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে.ক. আরিফুল হক সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন, ভারতে কয়েন পাচার হচ্ছে এমন খবরের ভিত্তিতে আমরা দুজনকে আটক করি। তারা দায়ী কি না তা নির্ধারণ করবেন আদালত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই ১৮৪ কেজি পয়সা গননা করে এর মূল্য দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭৯,৭৮৪ টাকা। এখন প্রশ্ন হলো এই টাকার ধাতবমুদ্রা ভারতে পাচার করে কতটুকু লাভবান হতেন বিল্লালের পরিবার? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে ভারতের মেটলাইন ইন্ডাসট্রিজ এবং কৃষ্ণা ষ্টিল ট্রেডের ওয়েবসাইট ঘাটাঘাটি করে দেখা গেছে বিভিন্ন মানের ষ্টিল কেজি প্রতি ১০৯ থেকে ২৭৫ রুপির মধ্যে। সেহিসাবে বিল্লালের স্ত্রী ও মেয়ের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ধাতবমুদ্রার সর্বোচ্চ দাম ধরে যদি হিসাব করা হয় তাহলে ১৮৪ কেজির দাম পড়বে ৫০ হাজার ৬০০ ভারতীয় রুপি। সুতরাং এখানে ধাতবমুদ্রা পাচার করে লাভবান হওয়ার সুযোগতো নেই, উপরোন্ত সরকারি চাকরিজীবী স্ত্রী’র সামাজিক মর্যাদা, মান সম্মান এবং কলেজে পড়ুয়া মেয়ের ভবিষ্যতসহ অনেক কিছুর ঝুঁকি বিরাজমান। এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে বিল্লাল হোসেন আবেগ জড়িত কন্ঠে বলেন, “পাচারের উদ্দেশ্যে যদি পয়সাগুলো পাঠিয়ে থাকবো তাহলে অন্তত নিজের বউ ও মেয়েকে কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসে পাঠাতাম না।”
বিষয়টি নিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতয়ালী মডেল থানার ওসি (তদন্ত) সমির কুমার সরকারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে উদ্ধার হওয়া ১৮৪ কেজি কয়েন একটি আনন্দ মেলা থেকে সংগ্রহ করা। এ ঘটনায় আটক স্কুল শিক্ষিকার স্বামী বিল্লাল হোসেন বিভিন্ন মেলায় টিকিট বিক্রি করেন এবং মেলা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ধাতবমুদ্রাগুলো তিনি পেয়েছিলেন।
পুলিশের তদন্তে পাওয়া তথ্যের সাথে বিল্লাল হোসেনের বক্তব্যর মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন হলো মা, মেয়ে ও গোটা পরিবারের ওপর চলা এই অমানবিকতার জবাব কে দেবে? তাদের ক্ষুন্ন হওয়া মানসম্মান কি ফিরিয়ে দেয়া যাবে?
বিল্লাল হোসেন একজন সমাজ সচেতন মানুষ। সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত। রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত না হলেও তিনি আওয়ামী লীগের একজন কট্টর সমর্থক। অথচ এই মানুষটিও আক্ষেপের সাথে বলতে বাধ্য হলেন, “এ কোন দেশে বাস করছি আমরা! আমাদের বুদ্ধি, বিবেক, সাধারণ চিন্তা চেতনা, নৈতিকতা সব ধ্বংস হয়ে গেলো! ওরা কেউ আমার মেয়ের কথা ভাবলো না!” বিল্লাল হোসেন মেলা কর্তৃপক্ষের সাথে হওয়া লেনদেনের কাগজপত্র দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এসব কিছুই দেখেনি ৪৯ গার্ড ব্যাটালিয়ন। মামলা দিয়ে আমার বউ ও মেয়েকে চালান করে দেয়া হলো বলে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন বিল্লাল। সেই কান্না শুনে আরও একটা কান্নার কথা মনে পড়ে গেলো। একজন পিতার কান্না। টেকনাফের একরাম নামে এক নিরপরাধ মানুষের কান্না। একটি ভুল ক্রসফায়ার। মৃত্যুর কিছু সময় আগে মেয়ের সাথে পিতার কথোপকথনের সেই অডিও ক্লিপের কথা মনে পড়ে গেলো খুব।
আব্বু তুমি কান্না করতেছো যে!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:২৯