গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে ঈদ নিয়ে আনন্দের অভিজ্ঞতা বা বিশেষ স্মৃতি নিয়ে প্রথম আলো আয়োজন করে ‘আমার ঈদ’ নামের প্রতিযোগিতা। সেরা লেখকের জন্য ছিল ব্যাংকক, কলকাতা ও কক্সবাজার আসা-যাওয়ার এয়ার টিকিট। আমি পেয়েছিলাম ৩য় পুরস্কার কক্সবাজার আসা-যাওয়ার এয়ার টিকিট।[ আমার ইচ্ছে করলো গল্পটি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে। তাই এই প্রয়াস।
আমার কষ্টের ঈদ, আমার আনন্দের ঈদ
আমি জন্মেছি মফস্বলের খুবই দরিদ্র এক পরিবারে। দুটো খেয়ে পরে কোনোরকমে দিন চলে যেতো আমাদের। তো, সেবার আমি যখন ক্লাস ফোরে, তখন আমাদের সংসারের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। নুন আনতে পান্তা ফুরায়, এমন বলা চলে। রোজা ১৫টা পার হলে পাড়ার বন্ধুদের সবার ঈদের জামা কাপড় কেনাকাটা শুরু হয়ে যেত। খেলার মাঠে এসে সবাই সবার নতুন জামার ধরন আর দাম নিয়ে আলাপ আলোচনা করত। বিকেলে মাঠে খেলতে এসে এক বন্ধুর মুখে চার পকেটওয়ালা জামার কথা শুনলাম। আমি তো অবাক। ধুর! তাও হয় নাকি! আরও কয়েকজনের মুখে ওই জামার কথা শুনলাম। এবার আর বিশ্বাস না করে উপায় নেই।
আমার মনে আছে আমি কখনো কোনো কিছুর জন্য মা-বাবার কাছে জেদ করিনি। কী করে কী হলো জানি না, ওই চার পকেটওয়ালা জামাটা পেতে আমার খুব ইচ্ছে করল। সোজা মার কাছে গিয়ে জানান দিলাম, আব্বা যেন আমার জন্য ওই জামাটা কিনে আনেন। সন্ধ্যায় মা আব্বাকে আমার জামার বিষয়ে বললেন, ‘দেখো তো কিছু করা যায় কিনা।’ আব্বা নিশ্চুপ। আমার ছোট্ট মনটা বুঝত না, নতুন জামা কেনার সামর্থ্য তাঁর নেই। আমি প্রতিদিন একটু পরপর আব্বার কাছে গিয়ে জামার জন্য ঘ্যানঘ্যান করতাম। আব্বা প্রথমদিকে স্বাভাবিক থাকলেও শেষমেশ খুব বিরক্ত হলেন। ২৫ রোজার দিনে আব্বা আমাকে আচ্ছামতো মার দিলেন। ভাবলেন, মার খেয়ে আমি বুঝি জামার জন্য তাঁকে আর বিরক্ত করব না! আমি সেদিন খুব কেঁদেছি। আমার সঙ্গে মা-ও কেঁদেছেন। আমি আরও কেমন যেন হয়ে গেলাম। আমার এই জামা চাই, চাই, চাই।
রোজ আব্বাকে আগের মতোই বিরক্ত করি। ২৯ রোজার দিনে আব্বা বাজারে নিয়ে গেলেন। আমি তো মহাখুশি। আজকে আমাকে পায় কে! আমার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। চার পকেটওয়ালা জামা পরে ঈদের সারা দিন ঘুরে বেড়াব। সারা বিকেল এই দোকান, সেই দোকান করে সন্ধ্যা হয়ে এল প্রায়। আব্বা বললেন, ‘আজকে বরং থাক, কাল ঠিক তোর জামা কিনে দেব।’ আমি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। মাগরিবের নামাজের পর সারা পাড়া হই হই রব—চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠেছে।
সেবার রোজা ২৯টা হয়েছিল। আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। কাঁদলাম না, আব্বার কাছে জামার জন্য আবদার করলাম না। চাঁদ উঠেছে। কাল ঈদ। আজকে হাটও শেষ। আমি অসাড় হয়ে শুয়ে রইলাম। চোখের কোণ বেয়ে শুধু পানি গড়িয়ে পড়ছে। মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে গেলেন। রাতে কিছু খেলামও না। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি, জানি না।
সকালে ঘুম ভাঙল। আমার চোখ তো ছানাবড়া। আমার মাথার কাছে একটা নতুন জামা। হাতে নিয়ে দেখলাম, ওরে বাবা! সেটাতে আবার চারটা পকেট। উঁহু, আজকে না ঈদ! এই চার পকেটের জামা গায়ে দিয়ে সারাদিন ঘুরব, কত আনন্দ করব। আমার খুশি দেখে মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মাস কয়েক আগে বড় মামা মাকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। মা সেটা যত্ন করে তুলে রেখেছিলেন। কোথাও বেড়াতে গেলে তখন শুধু পরতেন। মায়ের সেই শাড়িটা কেটে সারা রাত জেগে আমার জন্য জামাটা সেলাই করেছেন। আমার পছন্দমতো চারটা পকেট বসিয়েছেন।
মায়ের কান্না দেখে আমার চোখেও পানি চলে আসে। আমি দুই চোখ ভরা পানি নিয়ে গাল ভরে হাসছি তো হাসছি।
পত্রিকায় প্রকাশিত আমার গল্পের লিংক