নিজের মানচিত্রের বাইরে দেশে দেশে ঘুরে যেসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি আমি ।
আমার একটা বড় সৌভাগ্য এই যে বিভিন্ন সময় দেশের বাইরে একাধিক দেশে বেড়াবার সুযোগ হয়েছে আমার। সেই সুবাদে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা হয়েছে বিচিত্র সব মজার ঘটনা। সেসব ঘটনার কিছু কিছু তাৎক্ষণিকভাবে বিরক্তিকর ও অনভিপ্রেত মনে হলেও দিনান্তের পালবদলে সেগুলোই সুখের জাবরকাটার মতো মাঝেমধ্যে সামনে এসে দাঁড়ায়। ভালো লাগে সেসব ঘটনা নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে। তাছাড়া বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতার ধারক ও বাহক হিসেবে এই ঘটনাগুলোর গুরুত্ব নিতান্ত কম নয়। তাই স্মৃতি রোমন্থন করতে লিখেই ফেললাম সেসব ঘটনার চুম্বক অংশ নিয়ে এই লেখা।
এক)
২০০৮ সালের ঘটনা এটি। জাপানে গিয়েছিলাম ছোট ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে। তখন জাপানের ফুকুই সিটিতে ছিলাম দুই মাসের মতো। আমার ভাইয়ের প্রতিবেশী ছিল এক বৃদ্ধ মহিলা। স্বামী মারা গিয়েছে বেশ কিছুদিন আগে, ছেলেমেয়েরা অন্যত্র চাকুরি করে। বাসায় বুড়ি সম্পূর্ণ একা। সেখানে বাসার সামনের সবাই চাষাবাদ করত। কেউ ফুলের চাষ করত, কেউ বা শাক-সব্জির চাষ করত। সময় কাটানোর জন্য হোক কিংবা অন্য কোন কারণে, বুড়িও তাই করত। কিন্তু বয়সের ভারে সব কাজ সে একা একা করতে পারতনা। তাই আমার ছোট ভাই বুড়িকে মাঝে মাঝে বাগানের কাজে সাহায্য করত।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলে রাখি। আমরা অনেকেই জানি যে, জাপানীরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভদ্র ও সভ্য জাতি। সৌজন্যতাবোধেও কিন্তু ওরা কম যায়না। যেমন কেউ যদি কোনভাবে কোন জাপানীকে সাহায্য করে তবে এর প্রতিদানস্বরূপ তাৎক্ষণিকভাবে ওরা সেই ব্যক্তিকে কিছু না কিছু দিবেই। যদি দেয়ার মতো কিছু সেই মুহূর্তে হাতের কাছে না থাকে তাহলে একটা কাজ করে দিয়ে হলেও এর ঋণ শোধ করবে।
যাক, যে কথা বলছিলাম। একদিন আমার ছোটভাই বুড়ির বাগানে নিড়ানি দিয়ে এসেছে। এর কিছুক্ষণ পরই দেখি বুড়ি প্লেটে করে কি একটা নিয়ে এসে হাজির হয়েছে। আমরা ভাবলাম খাবার কিছু হবে। আমার ভাই জাপানী ভাষা বুঝে এবং বলতে পারে বলে সে এগিয়ে গেল। বুড়ি ওর হাতে প্লেটটা দিয়ে জাপানী ভাষায় বলল, তুমি বীচি দিয়েছিলে, আমার গাছে ধরেছে। নাও, এটার ফল তোমরা খেয়ো। আমরা সবাই একটু অবাক হলাম। আমার ভাই বলল, এমন কিছু ফলের বীচি তো তাকে দেয়া হয়নি ! প্লেটের ঢাকনা সরিয়ে দেখি প্লেটভর্তি গোল গোল করে কাটা করলা, তার উপর পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ কুচি দিয়ে লবণ ছিটানো। আমাদের তো আক্কেল গুড়–ম অবস্থা ! বুড়িকে বুঝানো হলো যে, আমরা এটা রান্না না করে খাইনা। তারপর সেই করলা ভাঁজি করে মহিলাকে খেতে দিয়েছিলাম আমরা। মহিলা খুব অবাক হয়েছিল করলার এমন রূপ পরিবর্তন দেখে।
দুই)
এটাও জাপানের ঘটনা। একদিন সকাল দশটা/এগারটার দিকে হাঁটতে বেড়িয়েছি আমি সাকুরা দরিতে (সাকুরা রোডে)। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি অসংখ্য গাছে সাকুরা ফুল ফোটে রয়েছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে ফুলের পাপড়ি গায়ে এসে পড়ছে। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই বললেই চলে। এক জাপানী মহিলা তার একটি কুকুরসহ হাঁটতে হাঁটতে আমার কাছে এসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে জানতে চাইল আমি ভারতীয় কি না। আমি জানালাম যে, আমি বাংলাদেশী। তারপর মহিলা আমার শাড়ির আঁচলের একটা অংশ তার হাতে তুলে নিয়ে জানাল, এরকম একটা ড্রেস তারও আছে। কিন্তু এর নাম সে ভুলে গেছে। আমি তাকে বললাম যে, এই ড্রেসটার নাম শাড়ি। তারপর জানতে চাইলাম যে, তুমি এই ড্রেস পেলে কোত্থেকে ? মহিলা জানাল, সে যখন ছোট তখন তার বাবা চাকুরির সুবাদে ভারতে থাকত। তখন তার মাকে এক ভারতীয় প্রতিবেশী বন্ধু একটা শাড়ি উপহার দিয়েছিল। তার মা সেটা তাকে দিয়ে গেছে। আমি কৌতুহলবশত জানতে চাইলাম, তুমি কি জানো এটা কি করে পরতে হয় ? মহিলা জানাল যে সে জানেনা এটা কি করে পরতে হয়। তবে আমাকে দেখে তার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে শাড়ি পরাটা দেখে নিতে।
কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ? রাস্তায় এই খোলা জায়গায় আমি তাকে শাড়ি পরা দেখাব, যদিও রাস্তায় লোকজন খুব একটা নেই। কিন্তু মহিলা আবারও আমাকে অনুরোধ করায় আমি তাকে বললাম যে, পুরোটা দেখানো যাবেনা। এটুকু দেখো। তারপর শাড়িতে কুচি তোলার প্রক্রিয়াটা শুধু তাকে দেখিয়ে দিলাম। খুব খুশী হলো মহিলা। বারবার আমার দিকে মাথা নত করে কৃতজ্ঞতা জানাল।
তিন)
২০১০ সালে গিয়েছিলাম চীনে বেইজিং এ একটি কনফারেন্সে অংশ নেয়ার জন্য। আমার সাথে ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের আরও ১২ জন কর্মকর্তা। আমরা সবাই একসাথে যাত্রা করেছিলাম এবং একই হোটেলে উঠেছিলাম। আমাদেরকে এয়ারপোর্ট থেকে নেয়া, বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখানো এবং সবশেষে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয়া- এসব কিছুর দায়িত্বে ছিল ইভা নামের ২০/২২ বছরের একটি মেয়ে, পেশায় সে একজন প্রাইভেট ট্যুরিষ্ট গাইড। যে কথা বলছিলাম। কনফারেন্স এর দুই দিন ছাড়া অন্য দিনগুলো ইভা আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল চীনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখাতে। প্রতিদিন দেখা গেছে ইভা আমাদেরকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যাবার সময় বলে গেছে আগামীকাল সকাল ন’টায় সে বাস নিয়ে হোটেলের গেটে অপেক্ষা করবে। আমরা যেন তার আগেই গেটে উপস্থিত থাকি। আমি প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে গেটে উপস্থিত থাকতাম, ইভাও আসত। কিন্তু প্রতিদিন আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হতো আধা ঘন্টারও বেশি সময়। একজন একজন করে লোকজন আসতে আসতে কখনও বাস ছাড়তে নির্দিষ্ট সময়ের পর এক ঘন্টা পর্যন্ত পার হয়ে যেত। এই অপেক্ষার সময়টাতে ইভাকে আমি মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতাম। সময় যতই গড়াত ইভার কপালে বিরকিক্তর বলিরেখা ততই ষ্পষ্টতর হতো। অবশেষে সবাই যখন বাসে এসে বসত তখন চরম বিরক্তির মুখেও ইভা মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলত, লেটস গো। বাট ইউ আর সো লেট। সাথে সাথে এও মনে করিয়ে দিত যে, কনফারেন্স এটা এলাউ করবেনা। ইভার মুখে একথা শুনে আমি মনে মনে লজ্জিত হতাম বটে, কিন্তু আমার সঙ্গীদের কারও মধ্যে এ নিয়ে কোন ভাবান্তর দেখতামনা। কারণ, একই ঘটনার পুণরাবৃত্তি তারা বারবার করত।
যেদিন গ্রেট ওয়াল দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনের ঘটনা একটু বলি। বরাবরের মতই বাঙালীর স্বভাবে আধঘন্টা দেরীতে যাত্রা শুরু করি আমরা। আরও একটা জায়গা সেদিন দেখার ছিল। সময়ও নির্দিষ্ট করা ছিল, কোথায় কতক্ষণ থাকব। গ্রেট ওয়ালের পাদদেশে যখন আমরা পৌঁছাই তখন এগারটার মতো বাজে। ইভা সময় নির্দিষ্ট করে দিল আমরা যেন একটার মধ্যে বাসের কাছে চলে আসি। একটায় বাস ছেড়ে আমরা যাব লাঞ্চ করতে, সেখান থেকে পরবর্তী দর্শনীয় স্থান। যার যার মতো আমরা গ্রেট ওয়াল দেখতে গেলাম, উপরে উঠলাম প্রথম পর্যবেক্ষণ টাওয়ার পর্যন্ত। তারপর সেখান থেকে ফিরে আসলাম বাসের কাছে। যখন বাস ছাড়ার সময় হলো তখন দেখা গেল দুই জন মিসিং। বলা বাহুল্য এই দুই জন আমার কলিগ। সবাই বলতে লাগল অমুক ব্যাংকের দুই জন আসেনি। আমি একটু বিব্রত বোধ করলাম।
যাই হোক। শুরু হলো অপেক্ষার পালা। দশ মিনিট/পনের মিনিট/আধঘন্টা। কিন্তু কারও দেখা নেই। আমি বারবার ইভার মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। বিরক্তির বলিরেখাগুলো যেন পড়া যাচ্ছে ইভার কপালে। অবশেষে দুটার দিকে নেমে এলো আমার দুই কলিগ। ভীষণ ক্লান্ত, ভীষণ পরিশ্রান্ত। সবার বিরক্তিকর জিজ্ঞাসা, কেন এমন হলো ? উত্তর পাওয়া গেল, তারা দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ টাওয়ার পর্যন্ত উঠেছিল। এতটা সময় লাগবে ভাবেনি। ইভা শুধু দু’জনের দিকে তাকিয়ে একবার বলল, ইউ মাস্ট বি পানচুয়াল। আদারওয়াইজ ইউ উইল বি লুজার। আমার তখন লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল।
চার)
একই বছর গিয়েছিলাম ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। সিঙ্গাপুর থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে আমরা যখন বালিতে গিয়ে নামলাম তখন রাত দশটার বেশি বাজে। আমরা ফ্লাই করেছিলাম এয়ার এশিয়ার বিমানে, যেখানে খাবার-দাবার-পানিয় সব কিছু কিনে খেতে হয় উচ্চমূল্যে। বিমান ল্যান্ড করার আগেই আমার পানি পিপাসা পেয়েছিল। যেহেতু কাছাকাছি পৌঁছে গেছিলাম আমরা সেহেতু ঠিক করলাম বিমান বন্দরে নেমেই পানি কিনব, সেখানে দাম নিশ্চয়ই এতবেশি হবেনা। করলামও তাই। বিমান বন্দরে নেমে সকল আনুষ্ঠানিকতা সেরে গেলাম এক্সচেঞ্জ বুথে। ১০০ ডলার ভাঙিয়ে পেলাম নয় লাখ রুপীরও বেশি। আমি তো খুশিতে আটকানা এত টাকা পাওয়ায়। বিমান বন্দরের বাইরে এসে প্রথমেই গেলাম পানি কিনতে। ২৫০ মিলি একটা পানির বোতল হাতে নিয়ে দাম জিজ্ঞেস করতেই দোকানী জানাল এর দাম পাঁচ হাজার রুপী। আমার তো আক্কেল গুড়–ম অবস্থা। পরক্ষণেই সেটা কেটে গেল। বুঝলাম একশ ডলারের বিনিময়ে লাখ লাখ রুপী পাওয়ার আসল মাজেজা এখানেই।
এই রাতেরই আর একটা মজার ঘটনা। বিমান বন্দর থেকে হোটেলে পৌঁছে সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রুমে পৌঁছে দেখি ঘড়ির কাঁটা রাত বারটার ঘর পার হয়ে গেছে। তখন পর্যন্ত রাতের খাবার খাওয়া হয়নি আমাদের কারও। যে হোটেলটিতে উঠেছি সেখানে শুধু সকালের নাস্তা খেতে পারব আমরা। আর সব খাবারের ব্যবস্থা বাইরে করে নিতে হবে। তো এত রাতে খাবার পাব কোথায় ? কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এই হোটেলের গেট পেরোলেই অনেকগুলো খাবার হোটেল। ওগুলো প্রায় সারারাত খোলা থাকে। আমরা পাঁচজন বেরিয়ে পড়লাম এবং কাছেই একটা হোটেল খোলা পেলাম। ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম ভাত হবে কি না। জানাল, হবে। সাথে সাথে একটি মেনু বুক এগিয়ে দিল। কিন্তু কি দিয়ে ভাত খাওয়া যায় ? বালি হচ্ছে একশত ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত জায়গা। কাজেই হালাল খাবার পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব। তাই আমরা পছন্দ করলাম ডিম ভাজা আর ভাত। সাথে একটা করে কোল্ড ড্রিংকস। আমরা পাঁচ জনের জন্য অর্ডার দিলাম পাঁচটি ডিমভাজা আর ভাত। অর্ডার পাওয়ার সাথে সাথে ছেলেটি হোন্ডা নিয়ে বেরিয়ে গেল। সময় যায় ছেলেটা আর ফেরত আসেনা, খাবারও আসেনা। জিজ্ঞেস করব কিছু এমন কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। আমাদের খিদে ততক্ষণে অসহ্য হয়ে উঠেছে।
আর কোন খদ্দেরও নেই হোটেলে। আমরা পাঁচজন ঘর-বার করতে লাগলাম। এমন সময় প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ছেলেটা ফিরে আসে এক ঝুড়ি ডিম নিয়ে। যাক, এবার খাবার মিলবে। আশ্বস্ত হলাম আমরা। টেবিলে গিয়ে বসলাম। প্রথমে পাঁচ জনের জন্য আসল গরম ভাত উঠা ভাতের প্লেট। দেখে খিদে আরও চনমনিয়ে উঠল পেটের ভিতর। যার যার প্লেট টেনে কাছে নিতেই আমার রুমার সামনে আসল ইয়া বড় প্লেটে তদ্রুপ বড় একটা ডিমভাজা। আপরা পাঁচজন সেই ডিমভাজা ভাগ করে নিয়ে খেতে শুরু করলাম। কিন্তু প্রথম লোকমা গিলতে গিয়েই গলায় আটকে গেল। ডিম ভাজায় না আছে লবণ, না আছে কাঁচা মরিচ, মাশরুম কুচি কুচি করে দিয়ে ভাজা হয়েছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভাজা বলতে যা বুঝায় তার ধারেকাছেও যায়নি। বলতে গেলে মাশরুম পুরা কাঁচাই রয়ে গেছে। আমরা একজন আর একজনের দিকে তাকাচ্ছি এমন সময় আগের সাইজের আরও একটা ডিমভাজা আমাদের সামনে রাখা হলো। তারপর আরও একটা। অবাক হলাম আমরা, আর কেন ? ছেলেটা বলল, আপনার পাঁচটা ডিম ভাজার অর্ডার করেছেন। তার মানে প্রথম যেটা দিয়েছিল সেটা একটা ডিমের ভাজা ! একটা ডিমভাজা এতবড় হয় কি করে ! আমি বললাম, এ কিসের ডিম আল্লাহই জানে। রুমা তাড়াতাড়ি উঠে কিচেনে গেল দেখতে। একটা মেয়ে সেখানে ডিম ভাজছে। রুমার সামনে সে চারটা ডিম ভেঙ্গে একসাথে ভাজল। মূল রহস্য তাহলে এখানেই। একটা ডিমভাজা মানে একসাথে চারটা ডিমভাজা। সে হিসেবে আমাদের পাঁচজনের জন্য সে কুড়িটা ডিম ভেজেছে। হায় আল্লাহ ! আমরা খাব কি ! হতভম্ব হয়ে গেলাম এই ঘটনায়।
তবু পেটে খিদে বলে কথা। কিছু তো খেতেই হবে। একটু লবণ হলে তাও যদি কিছু খাওয়া যায়। ছেলেটার কাছে লবণ চাইলাম। কিন্তু সে কিছুই বুঝলনা। লবণের ইংরেজী সল্ট, সেটাও বুঝেনা। ওকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমাদের একটু লবণ দরকার। কিন্তু সে কিছুই বুঝেনা। আমার মনে পড়ে গেল আমাদের গ্রামাঞ্চলে লবণক নেমক বলে। যদি লাইগা যায় মনে করে সেটাও বললাম। কিন্তু তাতেও কাজ হলনা। শেষে লবণ-মরিচবীহিন আধাভাজা ডিম দিয়ে কোনমতে একটু করে ভাত গিলে একলাখ রুপী দিয়ে উঠে গেলাম আমরা। টের পেলাম পেটের ভিতর ক্ষুধার নিবৃত্তি তো হয়ইনি, বরং সেটা আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পরের দিন ট্যাক্সি ড্রাইভারের নিকট থেকে জেনেছিলাম ইন্দোনেশিয়ায় লবণকে গরমা বলে।
পাঁচ)
আরও একটি ঘটনা। সেটাও বালিতে, একই ট্রিপে। আমরা পাঁচজন মিলে গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়েছি দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরতে। আমাদের সঙ্গী একজন পথিমধ্যে একটি মার্কেটে নামার আগ্রহ প্রকাশ করল একটি মোবাইল সেট দেখবে বলে। ড্রাইভার রাজী হলো এবং একটি মার্কেটের সামনে আমাদেরকে নামিয়ে দিল। আমরা শপিংমলে ঢুকলাম। কিন্তু পছন্দসই সেট না পেয়ে প্রায় সাথে সাথে বেরিয়ে এলাম। সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী একটি স্লিপ ড্রাইভারের হাতে ধরিয়ে দিল। দুই হাজার রুপী দিতে হবে গাড়ি দাঁড় করানোর চার্জ হিসেবে। কি আর করা ? একেই বলে ধরা !
টাকা পরিশোধ করে গেলাম বীচে ঘুরতে। ঘুরাঘুরিশেষে গাড়িতে উঠার আগে আমাদের সঙ্গী একজন ওয়াশরুমে ঢুকল। কাজ সেরে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে ওর হাতে একটা পাঁচ হাজার রুপীর স্লিপ ধরিয়ে দেয়া হলো। সেটা পরিশোধ করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আমরা বললাম, আগেরটা তবু ভালো ছিল। এ তো দেখছি দিনে-দুপুরে ডাকাতি।
ছয়) মালয়েশিয়ার লংকাউই গিয়েছিলাম ২০১০ সালে একই ট্রিপে। হোটেল বুকিং দিয়েছিলাম অনলাইনে মালয়েশিয়ায় বসে। নিরিবিলি পরিবেশে ছিমছাম হোটেলের প্রতিটি রুম। অর্থাৎ আমাদের সাধ্যের মধ্যে বেশ ভালো। আমরা যখন হোটেলে গিয়ে পৌঁছলাম দুপুর বারটার মতো বাজে। যার যার রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে খেতে যাব আমরা। কিন্তু কারও রুমে কোন বাথরুম নেই। বাইরে করিডোড়ে এক সারিতে পর পর তিনটি বাথরুম। যাক, তবু কাজ সারা যাবে। কোন হোটেলে রুম বুকিং করার আগে এটাচড বাথরুম আছে কি-না দেখে নেয়া দরকার, এটা এই প্রথম বুঝলাম। আমি আর রুমা তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হলাম দুই জন দুই বাথরুমে ঢুকব বলে। প্রথম বাথরুমে গিয়ে দেখি সেটার দরজা নেই, ভিতরে সংস্কারের কাজ চলছে। গেলাম অন্যটাতে। সেটার অবস্থা আরও নাজুক। পানিতে সয়লাব হয়ে আছে পুরো বাথরুম অর্থাৎ পানি সরছেনা ভিতর থেকে। বাদ রইল আর একটি বাথরুম। রুমাকে বলে আমি আগে ঢুকলাম সেটাতে। কিন্তু ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে অবাক হলাম, ভিতর দিকে কোন সিটকিনি নেই। অগত্যা রুমাকে ডেকে এনে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি কাজ সারলাম। রুমাও একইভাবে আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজের কাজ সারল। আমার সঙ্গী দু’জন পরের দিনই এই হোটেল ছেড়ে অন্যটাতে চলে গেলেও আমি আর রুমা লাগেজ টানাটানির ভয়ে সিফট করলাম না।