বীরাঙ্গনারা কেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেনা ?
(আমি আমার লেখনীর মাধ্যমে এই দাবী তুলেছিলাম বহু আগে। লেখাটি ০১-০৫-০৭ তারিখে দৈনিক জনকন্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল। ইদানীং এব্যাপারে সরকার এগিয়ে এসেছেন। বীরাঙ্গনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে সরকার। সেই প্রেক্ষাপটে লেখাটা এই ব্লগের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম।)
একাত্তরের মহাকাব্যিক অধ্যায় থেকে যে অনিবার্য অনুষংগগুলো আমরা পেয়েছি এবং যেগুলো আমাদের জাতিসত্তায় নিরন্তর বহমান সেগুলো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও একটি পতাকা। শুরু থেকেই একই মায়ের গর্ভজাত সন্তানের মতো কোন ভেদ-বিভেদের বালাই ছাড়াই এগুলোকে একাত্তরের পরম অর্জন হিসেবে দেখে আসছে বাঙালী জাতি। তবে এদের মধ্যে বিভেদ যে একটা ছিল না কিংবা নেই তা খুব একটা জোড় দিয়ে বলার মতো অবস্থানে এখনও আমরা পৌছুঁতে পারিনি। কথাটা বলার পেছনে যৌক্তিক যে কারণটা রয়েছে তা একাত্তরের আমাদের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সেটা হলো, একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দ্বারা নানাভাবে ধর্ষিত হয়েছিল যে সব নারী তাদেরকে বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছিলেন, হৃদয়ের সবটুকু ভাবাবেগ উজাড় করে দিয়ে পরম শ্রদ্ধায় তাদেরকে মায়ের আসনে বসিয়ে বুকে টেনে নিয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতাত্তোর বৈরী পরিবেশে নিজেদের সম্ভ্রমহানির জ্বালা ভুলতে অনেক ত্যাগী নারী সেটাকে খুশীমনে গ্রহণ করলেও কেউ কেউ সে সময় লোক সমাজের দৃশ্যপট থেকে নিজেদের আড়াল করতে বাধ্য হয়েছিল। যারা জাতির জনকের দেয়া উপাধি খুশীমনে গ্রহণ করেছিল তাদের মনে সে সময় জীবনের ধ্বংসস্তূপের উপর বেঁচে থাকার প্রত্যয় জেগে উঠেছিল। তাদের মনে এই প্রত্যয় জাগিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে। তার সেই দিনের উচ্চারণে এই বীরাঙ্গনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির কোন প্রশ্ন উঠেনি। যুদ্ধোত্তর স্পর্শকাতর আবহে তখন সাধারণের মনে এই সমস্ত নারীদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে আলাদা করে দেখার মনোভাবও কাজ করেনি। হতে পারে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত উচ্চারণ ও বলিষ্ট পদক্ষেপের কারণে এমনটি হয়ে উঠার সুযোগ পায়নি তখন। কিন্তু এই সময়টা দ্রুতই পাল্টে যায়। ১৯৭৫ সালের আগষ্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এদেশে সেটা বাঙালী জাতিসত্তার অনেক সত্যাশ্রিত ঘটনাকে গ্রাস করে এগোতে থাকে। আমরা শিকার হতে থাকি ইতিহাস বিকৃতির প্রতিযোগীতার। আর যারা প্রথম এবং প্রধানত এই ইতিহাস বিকৃতির বলির পাঠা হলো তাদের মধ্য থেকে এই সমস্ত বীরাঙ্গনা নারীদের কথা উঠে আসে সবার আগে।
সেই থেকে পাল্টে যেতে থাকে বীরাঙ্গনা নারীদের প্রতি আমাদের মানবিক বোধের প্রকাশগুলো। অত্যন্ত নিপুণভাবে মানুষের মনে গেঁথে দেয়া হলো বীরাঙ্গনাদেরকে ভিন্নরকম প্রেক্ষাপটে চিত্রায়নের কৌশলটা। সেই থেকে একটা গুঞ্জন ক্রমশ সরব হতে থাকে। সেটা হলো, কেন বীরাঙ্গনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এক করে দেখা হবে না ? একাত্তরের ত্যাগী নারীদের জন্য যে পরিচয়টা হওয়ার কথা ছিল গর্বের সেটা কেন তাদের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াবে ? অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বঙ্গবন্ধু যখন এই সমস্ত নারীদেরকে বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছিলেন তখন তার হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধার্ঘ্য উজাড় করেই দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা ক’জন আছি যারা বীরাঙ্গনা নামটি বঙ্গবন্ধুর মতো শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করছি ? প্রশ্নের উত্তরটা তো এখানেই খোঁজে পাওয়া যায়। তাই সময়ের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে একটি দাবী আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেটা হলো বীরাঙ্গনারা বঙ্গবন্ধুর দেয়া উপাধিতে পরিচিত হতে এই মুহূর্তে কতটা স্বস্তি বোধ করছে বা আদৌ করছে কি না সেই ব্যাপারটার একটা মীমাংসা খোঁজে বের করা। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই প্রসংগের অবতারণার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাকে খাটো করে দেখা হচ্ছে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। কারণ তখনকার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আজকের বৈরী পরিবেশের কথা বঙ্গবন্ধু কল্পনাও করতে পারেননি। তিনি এও কল্পনা করতে পারেননি যে, তার সোনার বাংলায় একদিন ইতিহাস পদদলিত হবে, বিকৃত হবে, তার বীরাঙ্গনা মায়েরা একদিন শুধুমাত্র এই খেতাবী আয়োজন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহৎ অংশ থেকে আলাদা হয়ে পড়বে। আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তাহলে বীরাঙ্গনা নারীদের জন্য প্রেক্ষাপট হতো ভিন্ন রকম। শুধু বঙ্গবন্ধুর বেঁচে থাকার প্রশ্নই নয়। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি যদি এদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে সমাজের সর্বত্র পাকাপোক্ত শেকড় গেড়ে বসার সুযোগ না পেত বা তাদেরকে এই সুযোগ দেয়া না হতো, তাহলেও একটা ভিন্নতর প্রেক্ষাপট আমরা আশা করতে পারতাম। অন্তত সভা-সমিতি করে বীরাঙ্গনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবী উত্থাপন করতে হতো না।
এমন একটা দাবী উঠার পেছনের কারণগুলো আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। আমরাই তো বলি স্বাধীনতার জন্য যে যে অবস্থান থেকে যতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে--সেটা যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক না কেন--তার জন্য তাকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিতে হবে। তাহলে একাত্তরের ত্যাগী নারীদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের জন্য দাবী উত্থাপন করতে হবে কেন ?
করতে হতো না যদি জাতির পিতার সময়কাল কিংবা তার প্রেক্ষাপট এখনও বজায় থাকত। আমরা যে যেভাবে পারছি দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থের ধান্ধায় মেতে সাময়িক যশের মোহে অহরহ আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করে চলছি। সত্যমিথ্যার মোহজাল সৃস্টি করে কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে কখনও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কখনও বা আশপাশ কেটে ইতিহাসকে আমরা তার অবিকৃত ধারা থেকে ভিন্ন প্রবাহে বইয়ে দিচ্ছি। কিন্তু ইতিহাসের জীবন্ত অনুপুস্পগুলো ইতিহাসের এই অঙ্গহানি নীরবে সইবে কেন ? এই অঙ্গহানির অন্য অর্থ হচ্ছে তাদেরকেই ছেটে ফেলা বা কেটে ফেলা। স্বাধীনতা বিরোধীদের নানা অপকৌশলের শিকার হয়ে এতদিনে তারা এটা হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে। তাই অন্তত নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার তাগিদে তাদের এই চেষ্টা, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের নীরব ইচ্ছেটাকে সরব গুঞ্জনে পরিণত করা-তার থেকে প্রকাশ্য দাবী উত্থাপন করা। না, এটা শুধু বীরাঙ্গনাদের দাবী নয়, দাবী আমাদের সকলের। আমরা চাই বীরাঙ্গনা শব্দের আড়ালে এই সমস্ত নারীদেরকে এক পাশে ঠেলে না দিয়ে অথবা খন্ডিত না করে মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহৎ অংশের সাথে এক করে দেখা হোক। আমরা যখন সম্মানের সাথে জীবিত বা মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম উচ্চারণ করি তখন এই সমস্ত ত্যাগী নারীদের নামও উঠে আসুক স্মরণের তালিকায়। তাদের পরিচয় হবে তারা বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা অথবা শুধুই মুক্তিযোদ্ধা।
আমার এক শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রতিবেশী বড় আপার কথা এখনও মনে আছে। সেটা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন কথা। একই কলোনীতে আমরা এবং আমাদের ঐ আপারা থাকতেন। কলোনীতে মিলিটারীর আগমনে সবাই পালাতে পারলেও আমার ঐ আপাটা পালাতে পারেনি। মিলিটারীরা আমাদের কলোনীতে ক্যাম্প করে এবং ঐ আপাটি প্রতিদিন তাদের লালসার শিকার হতে থাকে। যুদ্ধশেষে মিলিটারীরা পালানোর সময় তাকে গুলি করে রেখে যায়। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী সে বীরাঙ্গনা, যদি সে বেঁচে থাকত। কিন্তু মরে গেছে বলে কি সে তার ত্যাগের স্বীকৃতি তিনি পাবেন না ? অবশ্যই তাকে তার ত্যাগের মূল্য দিতে হবে। তিনি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, একথা প্রাণ খুলে স্বীকার করে না নিতে পারলে আমরা ইতিহাসে ক্ষমার অযোগ্য এক অপরাধী জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকব।
আরও একটি ঘটনার কথা বলি। আমাদের কলোনীতে গেদি বুড়ি যে বাসায় কাজ করত সেই বাসার বড় ছেলেটি গিয়েছিল যুদ্ধে। কলোনীতে মিলিটারীরা ক্যাম্প করলে সবাই পালিয়ে গেলেও গেদি বুড়ি পালায় নি। বাসা আগলে পড়ে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি বাবা-মায়ের খোঁজ নিতে আসলে তাকে নিরাপদে চলে যেতে সাহায্য করে গেদি বুড়ি। গেদী বুড়ি না থাকলে হয়তো ছেলেটি মিলিটারীদের হাতে ধরা পড়ত। মিলিটারীরা পরে এটা জানতে পেরে গেদী বুড়িকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। ওকে নানাভাবে নির্যাতন করেও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কোন তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি। যুদ্ধশেষে গেদী বুড়িরও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। ইতিহাস গেদী বুড়িকে কোথায় স্থান দিবে আমি জানিনা। আমাদের কি কোন সাধ্য আছে শুধূ বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়ে এই বুড়ির ত্যাগকে একজন জীবিত বা মৃত মুক্তিযোদ্ধার ত্যাগ থেকে আলাদা করে দেখার ?
কোথায় তাহলে বাঁধা বীরাঙ্গনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ? একজন মুক্তিযোদ্ধা যদি সর্বকালে সর্ব অবস্থায় জাতির শ্রেষ্ট সন্তানের মর্যাদা লাভের স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে তাহলে একাত্তরের ত্যাগী নারীরা কেন শুধুমাত্র বীরাঙ্গনা খেতাবধারী হয়ে আত্মগ্লানী নিয়ে বেঁচে থকবে ? কেন জাতির শ্রেষ্ট সন্তানদের সাথে একই মর্যাদায় তাদের নাম উচ্চারিত হবে না ? একাত্তরে তো আমাদের প্রিয় জন্মভূমিটাই নানাভাবে ধর্ষিত হয়েছে দখলদার বাহিনী কর্তৃক ! কই ? আমরা তো আমাদের সত্তা থেকে, হৃদয়ের স্পন্দন থেকে কিংবা অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ্য থেকে এক মুহূর্তের জন্যও আলাদা করে দেখতে পারিনা আমাদের দেশটাকে ! আমাদের শিরায় শিরায় রক্তের প্রতি অণুতে দেশের জন্য এই হৃদয়াবেগ জ্বালিয়ে রাখার পেছনে রয়েছে যেসব নারীদের অপরিসীম ত্যাগ, তাহলে তাদেরকে কেন আমরা আলাদা করে দেখব ? আলাদা করে রেখে তাদেরকে একরাশ হাহাকার আর আত্মগ্লানীর মধ্যে ঠেলে দিয়ে প্রকারান্তরে আমাদের হৃদয়ের দৈন্যতাকেই বড় করে তুলছি আমরা। এই দৈন্যতাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে আমাদেরকে। সেজন্য একাত্তরের ত্যাগী নারীদেরকে টেনে আনতে হবে আমাদের ভাবনার মুক্ত আলোতে। এই সমস্ত ত্যাগী নারীদের যথাযথ সম্মান জানানোর প্রেক্ষাপট হতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের চির ভাস্বর প্রতিকৃতি, এটা যখন আমরা আমাদের চিন্তা-চেতনা ও কাজের মাধ্যমে প্রতিফলিত করতে পারব তখনই কেবল আমাদের পক্ষে এই দৈন্যতা ঘুচিয়ে উঠা সম্ভব হবে।
(আজ ৪৩ বছর পরে এই প্রথম আমাদের বীরাঙ্গনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। আমি মনে করি একাত্তরে দেশের জন্য ইজ্জত বিসর্জন দেয়া আমাদের দুই লক্ষ মা-বোনের বুকের তীব্র দহন এবার কিছুটা হলেও লাঘব হবে।)