নারী স্বাধীনতার যুগে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী লেখকরা কতটা সোচ্চার ?
প্রাগৈতিহাসিক সমাজ পত্তনের যুগ থেকে শুরু করে সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার দিনেও যে কলুষিত ব্যাধি সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে সেটা হলো নারী নির্যাতন। সমাজ বা স্থান-কাল-পাত্রভেদে এটাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হলেও এটা যেভাবে আমাদের শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে তা সব সমাজে এক। এরপর আমাদের নৈতিকতাবোধের চরম স্খলনকে তুলে ধরার জন্য আর কিছুর দরকার পড়েনা। দরকার পড়েনা নারীদের বিবেকের অসহায় তাড়নাবোধকে নতুন করে পরিচিত করিয়ে দেয়ার। তাই সমাজে নারীদের অবস্থান কোথায়?--এই প্রশ্নটা বার বার মাথা খুটে মরছে সভ্যতার দোরগোড়ায়।
একথা সত্য যে সমাজে নারীর সঠিক অবস্থান খোঁজে বের করতে হলে বর্তমান সভ্যতার উদ্ভাসিত আলোর ঝলকানি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদেরকে। তবে কতদূর পিছু হাঁটলে নারীর আজকের অবস্থানের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব আর এই অবস্থান নির্ধারণের ভিত্তিই বা কি হবে সেটারও মীমাংসা হওয়া দরকার। আমাদের দেশে নারী নির্যাতন তো কোন আইন বা শাসনের তোয়াক্কা না করেই ঘটে যাচ্ছে তার আপন আগ্রাসী ছন্দে। আর নির্যাতনের শিকার হয়ে ঝরে যাওয়া নারীর প্রাণ, সেটা যেন গাছের শুকনো পাতা ঝরার খেলা। কি সামাজিক, কি রাজনৈতিক, কি প্রথাগত কুসংস্কার--সব পটভূমিতেই নির্যাতনের আষ্টেপৃষ্ঠের বাঁধনে বাঁধা পড়ে আছে আমাদের দেশের নারীদের জীবনচক্র। নারীর অবস্থান বিবেচনায় এগুলোই হচ্ছে মূল্যায়নের ভিত্তি। নানামাত্রিক আঙ্গিকতায় আমাদের দেশের নারীদের জীবন পরিপূর্ণতার স্বাদ পেয়েছে--এই কথাটা জোড় দিয়ে বলার মতো পরিবেশ যেহেতু এখনও আসেনি, সেহেতু আমাদের দেশের নারীদের বর্তমান অবস্থানের মূল্যায়ন করার জন্য পেছনের কোন না কোন একটা সময়কালকে বেছে নিতে হবে।
খুব বেশী পেছনে যাবার দরকার নেই। আমাদের সাহিত্যে উঠে আসা সময়ের পথ ধরেই যদি এগোই তাহলে খুব সহজে চোখের সামনে ভেসে উঠবে বেগম রোকেয়ার শিক্ষার্জন থেকে শুরু করে সাহিত্য সাধনার সময়কালটা। নারী স্বাধীনতার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ স্রোতের মাঝে অবস্থান করে বেগম রোকেয়া যে অপরিসীম ধৈর্য, মনোবল আর সাহস নিয়ে তার লেখনীর মাধ্যমে নারীদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে টেনে আনার কঠিন ব্রত কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এখনকার নারীদের জন্য সেই পারিস্থিতির বহুলাংশে উত্তরণ ঘটেছে। এখনকার নারী লেখকরা ইচ্ছে করলেই তার মনের সমস্ত সৃষ্টিশীল শক্তিকে ভাষার সুদৃশ্য মোড়কে গেঁথে জনসমক্ষে উপস্থাপন করতে পারেন। তাদের এই সৃষ্টিশীল শক্তিতে প্রতিবাদ নামক অনুশঙ্কু সত্তাটা থাকলে সেটাকে সবার সামনে তুলে ধরার পথটাও অনেকটাই সুগম আগের চেয়ে। কাজেই বেগম রোকেয়ার সময়কালের চেয়ে আজকের নারীরা অনেকটাই স্বাধীন। তারা অনেক বেশী শিক্ষিত, অনেক বেশী মুক্ত চিন্তার অধিকারী, অনেক বেশী ভোগের চেতনায় বিশ্বাসী। অর্থাৎ তারা চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসে আগের চেয়ে অনেক বেশী স্বাধীন। এই প্রেক্ষাপটে এই সময়টাকে নারী স্বাধীনতার যুগ বলা হয়ে থাকে।
মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এর উল্টো পিঠের দৃশ্যপটকে তো আর রাতারাতি পাল্টে ফেলা যাবেনা! আমরা কি জোড় দিয়ে বলতে পারব যে স্বাধীনতা ভোগের আবহে এদেশের নারীদের বৃহৎ অংশ নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারছে ? পারছে না। পারছে না বলেই নারীদের একটা বৃহৎ অংশ এখনও নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রাগৈতিহাসিক সমাজের তুলনায় নারী নির্যাতন কতটা কমেছে তা কথার তোড়ে অত সহজে বলে দেয়া সম্ভব নয়। যতটা সহজে বলে দেয়া সম্ভব যে সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার এই যুগেও নারী নির্যাতনের আচরণগত ও প্রকৃতিগত বিস্তৃতি ঘটেছে বহুলাংশে। এটা কোন সভ্য সমাজের কাম্য হতে পারেনা যে নারী স্বাধীনতা ও নারী নির্যাতন সমান্তরাল ধারায় চলবে। অথচ অনাকাংখিত এই বাস্তবটা এখন আমাদের সমাজে ধ্রব সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশের নারীরা বিভিন্ন কারণে অহরহ নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। যৌতুক, এসিড সন্ত্রাস, ধর্ষন, শারিরীক নির্যাতন, হত্যা ইত্যাদি তো আছেই। ভাবতেও অবাক লাগে যে দেশে প্রচলিত প্রথাগত কুসংস্কার ও দারিদ্রতার সবচেয়ে বেশী বলি হয় নারীরা। শুধু লিঙ্গগত পার্থক্য এই ধরনের নানামুখী নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান গতিকে তরান্বিত করছে --এটা সত্য নয়। কারণ, নারী কর্তৃক নারী নির্যাতনের যে সব ঘটনা আমাদের দেশে ঘটছে সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে গেলে সেটা হবে সত্য উচ্চারণে আমাদের সাহসিকতার অভাব।
কিন্তু এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল? দেশে সার্বিক শিক্ষার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি নারী শিক্ষার হারও বেড়েছে। সেই অনুপাতে নারী নির্যাতনের হার কমার কথা থাকলেও তা কমেনি। তার কারণ অনেক শিক্ষিত নারীও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আমাদের দেশে। সব শিক্ষিত নারীর জন্য বাইরের পৃথিবী এখনও পুরোপুরি উন্মুক্ত নয়। এখনও অনেক শিক্ষিত নারীর জন্য আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগটা তার স্বামী-শ্বশুড়ের অনুমতির বেড়াজালে আটকে আছে। আবার যারা বেরিয়ে এসেছে তাদের কেউ কেউ যে কর্মক্ষেত্রে নানামুখী নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে তার নজিরও রয়েছে কম নয়। সত্যি বলতে কি ঘর-সংসার-গৃহস্থলীর আঙ্গিনা ছেড়ে উন্মুক্ত পৃথিবীর আলোতে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার নারীর ইচ্ছেগুলো এখনও প্রতিদিন মার খাচ্ছে সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসন নামক পরাধীনতার শৃংখলে আটকে। এখানেই প্রবন্ধের মূল স্রোত গতিবিচ্যূত হয়। শুধু নারী স্বাধীনতার যুগে নয়, আমাদেরকে খোঁজে বের করতে হবে যে নারী শিক্ষার অগ্রগতির যুগে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী লেখকরা কতটা সোচ্চার?
নারী হোক, পুরুষ হোক--লেখক মাত্রেরই তার পরিবার সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের প্রতি কিছু না কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। রাষ্ট্র ও সমাজের কলুষিত ব্যাধি নারী নির্যাতনকে এই দায়বদ্ধতার বাইরে রাখার উপায় নেই। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা ধর্মীয় সব দিক থেকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করবে এটা সহজাত দায়িত্ববোধ। আর একজন নারীর জন্য এই দায়িত্ব অস্বীকার করার অর্থ হলো নিজকে অস্বীকার করা। কাজেই যে সমস্ত নারীরা তাদের চারপাশের ঘটনার আবর্তনকে মনের ভাবাবেগে ঠাঁই দিয়ে ভাষার সুনিপুণ গাঁথুনিতে সাহিত্যের মোড়কে সমাজের সামনে তুলে ধরার ক্ষমতা রাখেন তাদের কাঁধে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ভার একটু বেশী করেই বর্তায়। কারণ সাহিত্য শুধু মনের ভাবাবেগের প্রকাশ নয়। সাহিত্যের ভিতর সমাজে চলমান নিপীড়ন, নির্যাতন, অনিয়ম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন থাকবে, দ্রোহ থাকবে, বিদ্রোহ থাকবে। কোমলে-কঠিনে রস-তরঙ্গের মিশ্রণেই তৈরী হয় সত্যিকারের সাহিত্য। মনের আবেগকে ভাষার সুকুমার বৈচিত্রে ফুটিয়ে তোলাকেই যারা সাহিত্য ভাবেন তারা সাহিত্যের একটা খন্ডিত অংশ নিয়ে নাড়াচাড়া করেন মাত্র। কাজেই লেখক মাত্রই সাহিত্যের সামগ্রিকতার আড়ালে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নিবেন।
কিন্তু সময়ের এই দাবী কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরটা একটু বিশে¬ষণের আঙ্গিকে না দিলেই নয় এই কারণে যে, আমাদের দেশে নারী লেখকদেরকে লেখক হিসেবে উঠে আসার পেছনে বহু কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। নারী লেখকদের মনে একটা ক্ষোভ প্রায়ই কাজ করে এই অভিযোগে যে প্রিন্ট মিডিয়াগুলো একজন পুরুষ লেখকের লেখা যতটা রুত্বের সাথে বিবেচনা করে নারী লেখকদের বেলায় ততটা নয়। সেই কারণে তাদের কথাগুলো অপ্রচারিত থেকে যায়। সেই অপ্রচারিত লেখার মধ্যে থাকতে পারে সমাজকে বদলে দেবার মতো সূচালো কিছু কথার মারণাস্ত্র। এভাবে অপ্রচারিত থাকতে থাকতে নারী লেখকদের কলমকণ্ঠগুলো এক সময় সোচ্চার হওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এই অভিযোগের সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করলে সেটাও হবে সত্যের অপলাপ। কারণ প্রিন্ট মিডিয়া নারী লেখকদের লেখাকে অবমূল্যায়ন করলে আমরা সুফিয়া কামাল, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন, নয়ন রহমান, জাহানারা ইমাম, রিজিয়া রহমান, মকবুলা মঞ্জুর প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত নারী লেখকদের পেতাম না। আসলে এটা একটা ঠুনকো ওজরমাত্র। সত্যিকার সাহিত্যনির্ভর লেখা যেমন প্রকাশককে টানবে তেমনি টানবে পাঠককে।
যে প্রশ্নটা এখানে যুক্তির টানে আপনিই এসে দাঁড়ায় সেটা হলো ইদানীং নারী লেখকদের মৌলিক সাহিত্যনির্ভর যে সব লেখা আসছে তার কয়টাতে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লেখনী বেরিয়ে আসছে? একেবারে আসছে না তা বলছি না। কিন্তু আমাদের দেশে বিদ্যমান নারী নির্যাতনের ভয়াবহ মাত্রার তুলনায় তা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। তার কারণও আছে। নারী লেখকদেরকে অত্যন্ত বিরুদ্ধ পরিবেশে তাদের লেখনী সচল রাখতে হয়। নারীদের পক্ষ হয়ে লিখলেই কথা উঠে যে অমুক লেখক নারীবাদী। অথচ নারীদের লেখা যখন পুরুষদের পক্ষ হয়ে কথা বলে তখন সেই লেখককে পুরুষবাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়না। কারণ যারা এই শব্দ দুটি ব্যবহার করতে পছন্দ করেন তারা শব্দ দুটির মধ্যে সূক্ষè পার্থক্য সৃষ্টি করে নিয়েছেন। তারা নারীবাদী শব্দটাকে তুলনামূলকভাবে তাচ্ছিল্য সহকারে উচ্চারণ করেন। তারা ধরেই নিয়েছেন যে নারীবাদী মানে পুরুষ বিরোধী এবং সাহিত্য সৃষ্টির আর কোন উপজীব্য বিষয় না পেয়ে এটাকে লেখার বিষয় হিসেবে বেছে নেয় নারী লেখকরা। কিন্তু এটা ঠিক নয়।
নারী নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে আমরা তো শুধু পুরুষদের দ্বারা নারী নির্যাতনের কথা বলছি না। নারীদের দ্বারাও আমাদের সমাজে নারী নির্যাতন সংগঠিত হচ্ছে--এটা মেনে নিয়েই আমরা সকল প্রকার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের লেখনীকে সোচ্চার করছি। সত্যিকার অর্থে যারা সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তারা কেউই চাননা নিজেদেরকে নারীবাদী বা পুরুষবিরোধী জাতীয় কোন বিভাজনে বিভাজিত দেখতে। একমাত্র সাহিত্যিক পরিচয়ে নিজকে পরিচিত করতেই তারা আগ্রহী। তাই এ জাতীয় বিভাজন টেনে কোন নারী লেখকের লেখাকে অবহেলা করলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের সোচ্চার হবার সুযোগটা সীমিত হয়ে পড়ে। এটা প্রকারান্তরে নারী স্বাধীনতাকে খর্ব করার সামিল। প্রসংগটা যেহেতু নারী নির্যাতন ও লেখকদের নিয়ে সেহেতু সত্যটাকে পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে না ধরলে সেটা আমাদের নৈতিকতাবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমাদের জরাগ্রস্থ মানবিক বোধগুলো সমাজের ক্ষরিত রক্তপ্রবাহে আকন্ঠ ডুবে গিয়েও শান্তির সরোবরে অবগাহন করতে চায় যখন দেখে যে অনেক পুরুষ লেখক নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে প্রতিবাদের আগুন ঝরাচ্ছে।
এমন অনেক পুরুষ লেখক আছেন যারা তাদের লেখায় সুযোগ পেলেই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লেখনীকে সচল রাখছেন। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী লেখকদের প্রতিবাদী লেখনীশক্তি এতে করে আরও গতিশীলতা পাচ্ছে, ক্ষুরধার আঙ্গিকে সমাজে প্রচলিত অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠার সাহস পাচ্ছে। আজকের সমাজ, সংস্কার, নৈতিকতা সব কিছুর সম্মিলিত দাবী হচ্ছে সাহিত্য হয়ে উঠবে লেখকদের সকল প্রকার চিন্তা-চেতনা আবেগ-অনুভূতির বাস্তবনির্ঝর প্রকাশ। এই দাবীর প্রতি লেখকদের শ্রদ্ধাশীল মনের অনুভূতিকে প্রবাহমান সময়ের চাহিদার সাথে সম্পৃক্ত করতে পারে একমাত্র সাহিত্যে। কাজেই নারী-পুরুষভেদে আমাদের লেখনীকে আমাদের চিন্তা-চেতনা আবেগ-অনুভূতির মাধ্যমে নারী নির্যাতনসহ সমাজের সকল প্রকার অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার করতে হবে। কারণ নারী নির্যাতন নামক সমাজের অবক্ষয়মান ইস্যুটা নারী-পুরুষভেদে সকল লেখকের কাছ থেকে প্রতিবাদী ও সাহসী উচ্চারণ দাবী করে।