দু’চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে তার অনেক আগেই। সবকিছু পরিস্কার দেখতে পারে না। অনেক কষ্টে কেবল আলো-আঁধারির প্রার্থক্যটুকু বুঝতে পারে। দৃষ্টি ক্ষয়ে যাওয়া চোখ দু’টি বুজে বিলকিস বেগম তাই পুরানো অতীত হাতড়ায় সুযোগ পেলেই। অর্ন্তদৃষ্টিই এক্ষেত্রে তার প্রধান মাধ্যম। আর সেটাকে গল্পের রেশমি সূতোর জালে জড়িয়ে মেলে ধরে হালিমার কাছে।
হালিমা তার সার্বক্ষণিক পরিচর্যাকারী। বয়স আনুমানিক চল্লিশ এর কাছাকাছি। এই বৃদ্ধ নিবাসে পা রাখার সাথে সাথে বিলকিস বেগমের সবকিছু অন্তরীণ হয়ে গেছে হালিমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের মাঝে। বেশ লাগে বুড়ির। হয়তো হালিমাও নিজের আত্মজের কাছে তারই মতো অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠা পুরানো আসবাবপত্র মাত্র। নিজেদের অত্যাবশ্যকীয় ভোগবাদী বিলাসী জীবন সংস্কৃতির সাথে বেমানান বলে তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে অবলীলায়। জন্মধাত্রী বলে অস্বীকার করতে না পারার কারণেই কি-না কে জানে? একেবারে ভেসে যেতে না দিয়ে দয়া পরবশ হয়ে রেখে গেছে এখানে!
নিজের জীবনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে হালিমার এখানে আসার কারণ এর বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করতে পারে না বিলকিস বেগম। কিন্তু যখন জানতে পারে যে হালিমা নিঃসন্তান, স্বামীর মৃত্যুর পর সে নিজেই চলে এসেছে এই বৃদ্ধ নিবাসে, তখন কেন জানি হালিমাকে নিজের চেয়ে ভাগ্যবতী মনে হয় বিলকিস বেগমের।
বিয়ের পর প্রায় দশ বছরের চেষ্টায় পাওয়া একমাত্র পুত্রকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে স্বামী-স্ত্রী দুজনই। স্বামী আকবর মিয়া মফস্বল শহরে থেকে তার স্বল্প আয়ে যথাযোগ্যভাবে ছেলেকে মানুষ করে তোলার চেষ্টা করত। একদিন সফলও হয় সে। আরিফ ইঞ্জিনীয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে চাকুরী নেয় একটা বিদেশী কোম্পানীতে। ভাল বেতন, মাঝে-মধ্যে বিদেশে যাওয়া-আসা। মন্দ কি? সেই সুবাদে নজড় কাড়ে এক কোটিপতির মেয়ের, যারা টাকার জোড়ে বিয়ের বাজার থেকে সবচেয়ে বড় রুইটা তুলে আনতে পারে। ততদিনে আকবর মিয়া চলে গেছে পরপাড়ে। ছেলের সাফল্য সে দেখে যেতে পারেনি। আরিফ আজ সস্ত্রীক আমেরিকাবাসী।
এও ভাল হয়েছে এক দিক থেকে।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে বিলকিস বেগম। আরিফের সাফল্য দেখতে গিয়ে এক বুক কষ্টের সাগর মন্থন করতে হয়নি আকবর মিয়াকে। এজন্য তো সে আছে!
আরিফ বিয়ে করে সংসার পাতে ঢাকায়। অভিজাত এলাকায় বিরাট বিলাস-বহুল ফ্ল্যাট। শহরের মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে তোলা যাবেনা। কাজেই বিলকিস বেগমকেই স্বামীর ভিটা ছেড়ে আসতে হয় ছেলের সংসার গুছিয়ে দিতে।
বিরাট সাজানো বাড়িতে সবই আছে। শুধু নেই আরিফের বাবার নাম-নিশানা। নেই বুক ভরে তৃপ্তির শ্বাস নেয়ার মতো মাটির সেই সুধাগন্ধ। হাঁফিয়ে উঠে বিলকিস বেগম। গাছ-পালার ছায়াঘেরা স্বামীর পৈত্রিক ভিটার শীতল হাতছানি তাকে টানতে থাকে ক্রমাগত। মন চায় সেখানে ফিরে যেতে। কিন্তু নানা টালবাহানা করে ছেলে-বৌ। মনটা আরও বিষিয়ে উঠে যখন বিলকিস বেগমের কাছে এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে, এ বাড়িতে তার আর কাজের লোকদের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। খাওয়ার টেবিলে ছেলে-বৌ এর পাশে বসার সুযোগ হয়না তার। তাকে থাকতে দেয়া হয়েছে নীচ তলায় সার্ভেন্টস রুমের পাশে। বৌ সুযোগ পেলেই এই বাড়িটা তার বাবার দেয়া বলে বুলি আওড়ায়। বাড়ির শো-পিসগুলো অত্যন্ত দামী। অসাবধানতায় যেন ভেঙে না যায় সেজন্য সে শ্বাশুড়িকে সাবধানে হাঁটাচলা করার পরামর্শ দেয়। বিলকিস বেগম কখনও হিসেব করে দেখেনা যে তার ছেলের আয়ে ঢাকা শহরে এতবড় একটা বাড়ি বানানো সম্ভব কিনা। শুধু পুত্রবধূর কথায় তার সাবধানী হাঁটাচলা আরও সীমিত হয়ে আসে।
মনটা তাই ছটফট করে বিলকিস বেগমের। ছেলেকে অনুরোধ করে একটিবার বৌমাকে নিয়ে গিয়ে তার বাবার বাড়িটা দেখিয়ে আনতে। বার বার অনুরোধে এক সময় সত্য কথাটা বলে ফেলে আরিফ। গ্রামের ভিটেবাড়ি সমেত সমস্ত সম্পত্তি সে বিক্রি করে দিয়েছে। স্ত্রী শিউলীকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যাবে সে। সেজন্য অনেক টাকা দরকার তাদের। তাছাড়া কে ভোগ করে এসব! কোন ভাই-বোন তো নেই তার। তাছাড়া মায়ের দিন তো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে!
শেষের কথাটা অবশ্য আরিফ বলে স্বগোক্তি করে চক্ষুলজ্জার সর্বশেষ রেশটুকু ধরে রেখে।
নিজের সন্তানের কাছ থেকে এতবড় প্রতিদান আশা করেনি বিলকিস বেগম! নিজকে নিয়ে কোন রকম চিন্তা করার আগেই আরিফ মীমাংসা করে দেয় সবকিছুর।
মা, তুমি তো আমাদের সাথে বিদেশে গিয়ে থাকতে পারবে না। তাই তোমার জন্য বৃদ্ধ নিবাসে থাকার ব্যবস্থা করেছি। ওখানে ভালই থাকবে তুমি। তোমার মতো অনেকেই আছে ওখানে।
ছেলের কথাগুলো বিলকিস বেগমের কাছে মনে হয় দূর কোন সমুদ্দুর থেকে ভেসে আসা অচেনা কন্ঠের নিষ্ঠুর বাক্যবান। উত্তরে ছেলেকে কিছু বলেনা বিলকিস বেগম। শুধু মনে মনে বলে
আমি তো আমার স্বামীর ভিটা ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনি। এখানেও আসতে চাইনি। ইট-পাথরে গাঁথা তোদের এই শান-সওকতের মাঝে প্রাণের স্পন্দন নেই।
বিলকিস বেগম আরও ভাবে।
আত্মজের কাছ থেকে এ তার কেমন প্রাপ্তি! তাকে ভিটাছাড়া করে কি কৌশলে সবকিছু হজম করে ফেলেছে তার সন্তান! মায়ের প্রাণহীন দেহটাকে চিরশায়িত করার জন্য এক মুঠো মাটিও রাখেনি। শেকড় থেকে উপড়ে ফেলে টবে বাঁচিয়ে রাখার কি হাস্যকর চেষ্টা!
সেই থেকে বিলকিস বেগমের ভিটামাটি, আত্মীয়-স্বজন বলতে এই বৃদ্ধ নিবাস। তাও প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে। পেরিয়ে আসা সত্তর বছরের জীবনে শত বিড়ম্বনা সয়েও বিলকিস বেগম আজও স্বপ্ন দেখে। মৃত্যুর আগে একবার ছেলেকে দেখতে পাবে সে। আরিফ এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলবে
তুমি কেমন আছো মা? তোমাকে দেখার জন্যেই চলে এলাম।
হয়তো তারও পরে আসবে আরিফ। বিলকিস বেগমের নিস্প্রাণ দেহটাকে কাঁধে করে নিয়ে শুইয়ে দিবে তার বাবার কবরের পাশে শীতল সেই মাটির কোলে।
আহ্ কি শান্তি ! কোঠরাগত দুটি চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে বিলকিস বেগমের।