শরৎ বাবু ,
শ্রীকান্ত উপন্যাসের ইন্দ্রনাথকে সেদিন আমার চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় নি । বরং তার মধ্যেই এক অভয় দেখেছিলাম । দেখেছিলাম একটা মানুষের ছায়া, চোখভরা মায়া , কষ্টের আধার আর রুদ্রতার সঙ্গীকে । ও ইন্দ্রনাথ বলেই পারে অভুক্ত অন্নদা দিদির মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে জীবন হাতে নিয়ে মাছ চুরি করতে । জাতভেদের উপরে উঠে অনাহারক্লিষ্ট মানুষের বাচ্চাদের , আমি আবার ও বলছি , মানুষের বাচ্চাদের নিজের স্বজাতি বলে পরিচয় দিতে ।
কিন্তু কষ্টের বিষয়টা কি জান শরৎবাবু , বাস্তবে ইন্দ্রনাথের চেহারাটা এখনও অদেখা থেকে গেল। ওর নিবাসটা যে কোথায় সেটা যে জিজ্ঞাসা করে নেব সে সুযোগও তুমি আমাকে দিলে না। কেননা ওকে তোমার উপন্যাসের খোরাক বানালে। কিন্তু ওকে যে আজ আমার ভীষন রকমের প্রয়োজন। আরও অনেক নাম না জানা অন্নদা দিদি যে আজ অনেক দিনের অনাহারী। চাল দাও বলে কাঁদছে। ওদের কঙ্কালসার শরীরগুলো থেকে পরিশিষ্ট পানিটুকুও বের করে নিচ্ছে চৈত্রের খরতাপ। ইন্দ্রনাথের অন্নদা দিদির মত ওরা নিঃসন্তান নয়। ওদের দুধের শিশু আছে যারা মায়ের সাথে অনাহারে রাত জাগে। অবুঝ কান্নায় আমার চারপাশ ভারি করে তোলে। আমি মাথা তুলে তাকাতে পারি না। ওদের দিকে একবার সাহসে চোখ তুলে দেখতে পারি না। তাই ওদের জন্য সাহসী ইন্দ্রনাথকে খুজছিলাম। ভাবছিলাম ওদের ক্ষুধার্ত মুখগুলোর চারপাশে ইন্দ্রকে খুজে পাব। অদম্য সাহস আর মায়ায় ও বুকে তুলে নেবে না খাওয়া মানুষগুলোকে। যারা ওর জ্ঞাতি , ওর আত্মীয়। ইন্দ্রকে পাব বলে তাই ওদের চারপাশে ঘুরঘূর করছিলাম। বিডিআরের চালের দোকানে , ও এম এসের বিশাল অথচ ব্যর্থ লাইনে কিংবা বস্তিগুলোতে যেখানে গেলে ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর অস্ফুট কান্না শোনা যায়। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে বুভুক্ষ মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাসে। ---- চাল দ্যান গো স্যার , আমারে দুই কেজি ধইরা দ্যান গো সার। আমার বাচ্চাডার ব্যাগডাতে এক কেজি দ্যান গো সার ---- ।
হাপানীর তান্ডবে বৃদ্ধা মহিলাটি ঠাই সাড়ে চার ঘন্টা চৈতী রোদে দাড়িয়ে থেকে অবশেষে হাসপাতালের করিডোরে ঠাই পেয়েছে। চাল পায় নি । তার পঙ্গু স্বামী ( অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে) সারাদিন ভাত খেতে পায় নি। শরৎবাবু , মনে পড়ে তোমার বিলাসীর কথা। তোমার সেই বিলাসীর মতই সেদিন ঐ বৃদ্ধাটি কেঁদেছে।-- “আমায় দুমুঠো চাল দাও গো বাবারা। রোগা স্বামীটা সারাদিন না খেতে পেয়ে মরে যাবে। ” ওদের জন্য ইন্দ্রকে চাইছিলাম। খুজছিলাম। কিন্তু পাই নি। শুনেছি ইন্দ্ররা নাকি আর এই বাংলার মাটিতে জন্ম নেয় না। নিলেও ওদের চেতনাকে মেরে ফেলা হয় অর্থ আর সমাজের দাপটে তৈরী নির্মম অন্ধকার কূয়াায় নিক্ষেপ করে। তাই ইন্দ্ররা আর এখানে আসে না। ধ্বংস হওয়া ধূসর বনপথে তাই ইন্দ্রর বাঁশের বাঁশি আর বাজে না। শরৎবাবু , তোমার সাথে যদি তার দেখা হয় তবে আমাদের কথা তাকে মমতা মিশিয়ে বলো। আমরা ওর আগমনের জন্য প্রার্থনা করি কায়মনবাক্যে ।
রাজপথে আগুনে পোড়া মনিরের মায়ের সামনে একজন মহানায়ককে দরকার যে তার সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে যেখানে দেশ জাতি রাষ্ট্র স্বাধীনতা তা পারে না ।
বিশ্বজিতের রক্তের বদলা নিতে দাড়িয়ে যেতে পারে রাস্তায় , ডেকে নিয়ে আসতে পারে ভীরু কাপুরুষগুলোকে মেসবাড়ির অন্ধকার থেকে । ক্যাম্পাসের দখল হয়ে যাওয়া ছাত্রাবাস থেকে । পচে গলে যাওয়া রঙচঙা শিক্ষকদের মুখোস খুলে রাস্তায় নামিয়ে দিতে পারে । ধর্মকে সম্বল করে মানুষকে পুড়িয়ে মারতে বাধা দিতে পারে । অগ্নিমূর্তি হয়ে দাড়িয়ে যেতে পারে ।
ইন্দ্রনাথ নেতা হতে পারে । ইন্দ্রনাথ নেতা তৈরী করতে পারে । স্বাধীনতাবিরোধীদের সমস্ত চক্রান্ত সূর্যসেনের মত বুক চিতিয়ে লড়ে ধ্বংস করে দিতে পারে ।
নষ্ট নেতার নষ্ট পকেট চিরে মানুষের তাজা কলিজার লোলুপ জিভটা উপড়ে দিতে পারে ।
ওকে বলো , কাশিপুর গ্রামের যে পথের ধারে গফুরের ক্ষুধার্ত মহেশ বাঁধা থাকত - না খেতে পেয়ে অবুঝ ভাষায় কাঁদত , সেই মহেশ মরে গেছে। কিন্তু সেই স্থানটি ফাকা হয়নি। মহেশের বদলে আজ সেখানে কয়েকটা মানুষের বাচ্চা বাধা। মহেশের মত পাজরার হাড় ওদের ও গোনা যায়। পিটালি গাছের ছায়ায় দাড়িয়ে থাকা তর্করতœদের হাতের ফলমূল - ভেজা চালের পুটুলি দেখে ওদেরও চোখ স্বভাবজাত লোভে চকচক করে ওঠে। ওরা সত্যিই বড় বুভুক্ষ শরৎবাবু। মহেশের ভাগ্যে না হয় ভাতের ফ্যান জুটত কিন্তু এদের ভাগে যে আজ তাও জোটে না। ভাতের ফ্যান ও অনেক টাকা দিয়ে কিনে খেতে হয়। অথচ ওদের দগদগে তাজা ঘায়ের মত ক্ষুধায় জড়ানো আবেগের উপর দিয়ে নতুন কেনা চামড়ার হাল ফ্যাশনের জুতো পরে তর্করতœরা হেটে যায় দামি ডাইনিং এর দিকে। যুগযুগ ধরে চলে আসা নিয়মের মতই ওরা থরে থরে সাজানো দামি খাবারগুলোর দিকে হাতদুটো প্রসারিত করে নিবিঢ় শান্তিতে।
ওকি শরৎবাবু তুমিও কাঁদছ নাকি ! কাঁদ , বুকে যত কান্না জমেছে কেঁদে নাও। কিন্তু একটিবার ইন্দ্রকে ডেকে দাও। যে মানুষের ক্ষুধা সয়না। অন্যায়ের সাম্রাজ্যকে ভয় পায় না। যে তর্করতœদের ধনাগার থেকে উদ্ধার করে দেবে মানবতার বীজ। নায্য পাওনা। অধিকার আদায়ের বজ্র শপথ। ক্ষুধায় খাদ্য। আর অজানা ত্রাস থেকে , মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্তি এনে দেবে ঐ সব ক্ষুধার্ত অসহায় মানুষগুলোকে। ওদের এবার একটু হাসতে শেখাবে। নির্মলতার হাসি। শিশুগুলোও হাসতে শিখবে-নিষ্পাপ হাসি। বলবে , পৃথিবীকে ভালবাসি।
ইন্দ্রর মত ওরাও তো জাতিতে বাঙ্গাল , ধর্মে মানুষ ॥ ॥ ॥
সেদিন হয়তো এই বাংলায় আবার নজরুল লিখবেন , জয়নুল আঁকবেন , আব্বাস গাইবেন ! সুকান্ত বলবেন স্বার্থক জীবনের গল্প -
ইতি
রবীন্দ্রনাথের সজ্ঞায়িত এক ঘরকুনো বাঙালি