ভারতীয় টিভি নাটক বা মেগা সিরিয়াল নিয়ে অনেক সমালোচনা ও বিতর্ক চলে। বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যে মনে হয় এই নাটকগুলোর কোন ইতিবাচক দিক নেই। না, আমি ভারতীয় সিরিয়ালের সাফাই গাইছি না। বরং ভারতীয় সিরিয়ালের নানা দিক ও আমাদের দেশে তার জনপ্রিয়তার কারণ সম্পর্কে বলছি।
ভারতীয় সিরিয়ালগুলোতে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল নারীর অব্যাহত সংগ্রাম। প্রায় প্রতিটি সিরিয়ালেই দেখা যায় কোন না কোন নারী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘সুবর্নলতা’, ‘মা’, ‘রাশি’, ‘টাপুর-টুপুর’, ‘জল নুপুর’, ‘ইষ্টি কুটুম’, ‘আঁচল’, ‘তোমায় আমায় মিলে’ সহ বিভিন্ন সিরিয়ালে দেখা যায় কেন্দ্রিয় চরিত্রে থেকে কোন নারীকে জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে। যা নারীদেরকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এটাকে খারাপ চোখে দেখার সুযোগ নেই।
তবে সমালোচনা যেটা সেটা অন্যখানে। নাটকের গল্পগুলোর অহেতুক দীর্ঘসূত্রিতা বিরক্তি ধরিয়ে দেয়। অনেকেই বলে থাকেন- এই সিরিয়ালগুলো পারিবারিক অশান্তি তৈরি করছে। কিন্তু এটার জন্য একতরফাভাবে সিরিয়ালগুলোই দায়ি নাকি আমরা যারা নাটকের ভালটার পরিবর্তে খারাপটাই বেশি গ্রহন করছি তাদেরও ? আদতে নাটক দেখে ঠিক কতজন খারাপ পথে পা বাড়াচ্ছে তা বলা মুশকিল। কারণ দর্শকসারিতে বসে থাকা খারাপ লোকটাও নাটকের খলনায়ককে পছন্দ করছে না। তার মানে প্রবলেমটা অন্যখানে। সেটা হল আমাদের দেশের দর্শকেরা বিশেষ করে নারীরা সিরিয়ালের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে সেকারনেই পারিবারিক অশান্তি তৈরি হচ্ছে। এবং এসব তাদের ব্যক্তিগত আচরণগত সমস্যা। তাই দায়টা পুরোপুরি চ্যানেলকে দেয়া যায় না। যেমন- পাখি ড্রেস তৈরি করছে কোন এক পোষাক কোম্পানি যারা ব্যবসায়ে অধিক বিক্রির প্রত্যাশায় পাখি নামটা ব্যবহার করছে। এই দায় কি স্টার জলসা নাকি পোষাক কোম্পানির ? যদি কোন সু কোম্পানি মেসির নামে জুতা তৈরি করে বাজারজাত করে এবং বাংলাদেশের কোন ছেলে যদি সেটা কিনতে না পেরে আত্মহত্যা করে তাহলে কি আপনি মেসিকে দায়ি করে আর্জেন্টিনার খেলা দেখা বন্ধ করে দেবেন ? আসলে সঠিক পারিবারিক নিয়ন্ত্রনের অভাব প্রধানত দায়ি।
কিন্তু বাংলাদেশে ভারতীয় সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার কারণ কী ?
বাংলাদেশের টিভি নাটকের মান একসময় যথেষ্ট ভাল ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের নাটকের মান একদমই কমে গেছে। চঞ্চল বা মোশারফ করিম যারা খুবই ভাল অভিনেতা অথচ তারাও মানহীন নাটকে অভিনয় করছেন। নাটক দেখলে বোঝা মুশকিল- নাটক না কৌতুক দেখছি। পাশাপাশি আমাদের দেশের সব চ্যানেলই প্রায় নিউজ ভিত্তিক, বিনোদন ভিত্তিক নয়। তার উপর কোন অনুষ্ঠান বা নাটক বা সিনেমা দেখতে বসলে মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের আগ্রাসে পড়তে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এদেশিয় দর্শকেরা বেছে নিয়েছে ভারতীয় চ্যানেলগুলো। তাদেরকে আকৃষ্ট করছে ভারতীয় নাটকের পারিবারিক গল্প কিংবা রোমাঞ্চগুলো।
এটা পুঁজিবাদের যুগ। পুঁজিবাদ সবকিছুকেই পণ্য রূপে বিবেচনা করে। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে তাই সংস্কৃতিও পণ্য রূপে প্রবেশ করতে থাকে সবখানে। এখানে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। সেই প্রতিযোগিতায় আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল হেরে গেছে ভারতীয় চ্যানেলের কাছে। ভারতও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে সাংস্কৃতিক বাজার দখল করছে।
এর থেকে উত্তরনের উপায় হল-আমাদের নাটকের মান বৃদ্ধি করা, দর্শকের চাহিদার সাথে সংগতি রেখে অনুষ্ঠান নির্মান করা, বিজ্ঞাপনের মাত্রা কমিয়ে আনা।
তাই ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করে সমস্যা মিটলেও আমাদের ভেতরকার দৈন্যতা থেকে যাবে যদি না আমাদের ব্যর্থতাগুলো সমাধান না করি। বদলাতে হবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের মানসিকতা, পাশাপাশি বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন ঠেকাতে নিজের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক চেতনা দৃঢ় করার কোন বিকল্প নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৭