বিতর্কিত তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে নানা সমালোচনা সেই শুরু থেকেই ছিল। সম্প্রতি সাংবাদিক প্রবীর শিকদার গ্রেফতার হওয়ায় আবারও বিষয়টি আলোচিত হয়ে উঠেছে। ৫৭ ধারা নিয়ে কেন এত বিতর্ক তা দেখা যাক তাহলে। মূলত ২০১৩ সালে সংশোধিত তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের অনুমোদন পায়। আইনের ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারায় অপরাধকে আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য করা হয়। ৫৪, ৫৬ ও ৬১ ধারা নিয়ে কোন কথা না উঠলেও ৫৭ ধারা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। বলা চলে সরকার হঠাৎ করেই আইনটি সংশোধন করে। এর আগে বিএনপি সরকার ২০০৬ সালের অক্টোবরে ৫৭ ধারা যুক্ত করে। পরে আওয়ামীলীগ সরকার এই আইন সংশোধনের নামে আরো ভয়াবহ করে তোলে।
৫৭ ধারায় বলা হয়েছে-
“ ইলেকট্রিক মাধ্যমে মিথ্যা, অশ্লীল বা মান হানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ এই ধারায় গণ্য হইবে। ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্যকোন ইলেকট্রিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে এবং তার কারণে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ব্যক্তির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে বা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়া হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে।”
হ্যা এটা ঠিক যেকোন মিথ্যা সংবাদ বা অশ্লীল কিছু প্রকাশ করা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। তার জন্য প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া যেত। কিন্তু এখানে সরাসরি মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আক্রমন করা হল। কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সবাই মানী ব্যক্তি, কিন্তু তাদের কোন বাজে আচরণ বা দুর্নীতির সমালোচনা আপনি করতে পারবেন না। ধর্মের নামে নানাবিধ কুসংস্কার- বিতর্কিত প্রথা বা ধর্মের চাপিয়ে দেয়া ভ্রান্ত নীতির সমালোচনা আপনি করতে পারবেন না। কোন সংগঠন যেমন- আই এস, জামায়াতে ইসলাম বা প্রতিদিন অনাচারে লিপ্ত ছাত্রলীগ মোদ্দা কথা কোনো সংগঠনেরই বিরুদ্ধে কিছু লিখতে বা বলতে পারবেন না। কথা হচ্ছে- আমরা স্বাধীন দেশে বাস করি অথচ ৫৭ ধারা দিয়ে আমাদের গলা টিপে রাখা হয়েছে। তাহলে আমরা কোথায় আমাদের মত প্রকাশ করবো ? আইনে ৫৭ ধারা রেখে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা বড় ধরনের স্ববিরোধীতা ছাড়া কিছুই নয়।
এবার জেনে নেয়া যাক- ৫৭ ধারায় অপরাধীর শাস্তি সম্পর্কে। বলা হয়েছে এটি আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য অপরাধ। অর্থাৎ অপরাধ আমলে নেয়া হবে এবং কোন প্রকার জামিনের সুযোগ নেই। পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে। অথচ কোন অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকে অপরাধী বলার সুযোগ নেই। কিন্তু এখানে আদালতকে ডিঙিয়ে পুলিশ সরাসরি গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। পুলিশের এই বাড়তি ক্ষমতা প্রদান পুলিশকে বেপরোয়া হবার সুযোগ দিয়েছে। এক্ষেত্রে শাস্তি সমূহ হল- সর্বনিম্ন ৭ বছরের জেল এবং অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানা। ব্যাপারটা কতটুকু যুক্তি সংগত ? যেমন ধরুন- আপনি যদি মদ খেয়ে মাতলামি করে কাউকে উত্যক্ত করেন তাহলে পেনাল কোডের ৫১০ বিধি অনুযায়ি আপনার শাস্তি হবে ২৪ ঘন্টার জেল বা ১০ টাকা জরিমানা। আবার কোন দাঙা বা সহিংসতায় সংশ্লিষ্ট হলে আপনার জেল হবে ২ বছর। তাহলে ৫৭ ধারায় অপরাধের শাস্তি লঘু পাপে গুরু দন্ড নয় কি ? মানে ব্যাপারটা এমন হয়ে গেল- কোন দোকান থেকে ১০ টাকার কলম চুরি করায় ১০০ টাকা জরিমানা করা।
ভারতেও এরকম একটি আইন ছিল। সেটি হল তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা। মুম্বাইতে শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরেকে নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনামূলক বক্তব্য দিয়েছিল দুই ভারতীয় তরুনী। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করলে শুরু হয় আইনের সমালোচনা ও প্রতিবাদ। আদালতে পিটিশন জমা হয় ৬৬এ ধারার বিরুদ্ধে। পরে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট এই আইনটি বাতিল করে এবং রায়ে জানিয়ে দেয় ৬৬এ ধারা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করে।
কিন্তু আমাদের দেশে ৫৭ ধারা প্রতিমুহুর্তে আতংকে রাখছে নিজের মত প্রকাশে। দেশের নোংরা রাজনীতি, কোন বিশেষ ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতা, কোন আগ্রাসী মতবাদের সমালোচনা করলেই ৫৭ ধারার খড়গ নেমে আসবে। আমরা দেখেছি এর আগেও ফেসবুক, টুইটার বন্ধ করার কথা উঠেছে। কিন্তু এই সাইটগুলোর বেশিরভাগ ব্যবহারকারী হল তরুন প্রজন্ম। ৫৭ ধারা তরুনদের মুক্তচিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক যা একটা দেশের জন্য কল্যানকর হতে পারে না। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে বিভিন্ন সাইট ব্যবহারকারীদের উপর স্বৈরাচারী নীতি প্রয়োগ কতটা ন্যায় সংগত ? নাকি সরকার ভিন্ন মত পোষণকারী ও তার অপকর্মের সমালোনাকারীদের দমন করতে চাইছে। কিন্তু এই চর্চা একটা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর তা যে কেউ বুঝবে।
৫৭ ধারার কবলে পড়ে, স্বাধীন মত প্রকাশ করে শহীদ পরিবারের সন্তান, নির্ভিক সাংবাদিক প্রবীর শিকদার ক্রাচে ভর দিয়ে কারাগারে ঢুকলো। এ যেন আমাদের বিবেক কারাগারে ঢুকলো, এ যেন আমাদের মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনা কারারুদ্ধ হল। এমনকি ৫৭ ধারা নিয়ে এই সমালোচনামূলক বক্তব্য দেবার জন্য আমাকেও কারাগারে ঢোকালে অবাক হবার কিছু থাকবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:১৬