বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে ভারতের মাটিতে মুসলমানদের রক্তাক্ত ছবি দেখে প্রতিটি মানবিক হৃদয় কেঁদে উঠে। অথচ ইসলাম ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। একসময় মুসলিম শাসকদের কেন্দ্রীয় শাসন পরিচালিত হত ভারতের দিল্লী হতে। মুসলিম শাসন দেশটিকে করেছিল সমৃদ্ধ । ভারতে সভ্যতার প্রতিটি দিকে ইসলাম ও মুসলমানের অবদান অনিস্বীকার্য। যে দিল্লি এক সময় একত্ববাদের মহত্ত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল সে দিল্লিতে পৌত্তলিকতা ও বহুত্ববাদের গেরুয়া সন্ত্রাসী আক্রমণের বলি হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। একত্ববাদের অনুসারীরা আজ ভারতে তাদের বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার অগ্নি পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অথচ হাজার বছর ধরে হিন্দু মসলিম সৌহার্দ , সম্প্রীতি বজায় রেখে চলার নীতি নিয়ে ভারতীয় মুসলমানেরা গর্বিত। সারা যাহা ছে আচ্ছা – হিন্দুস্তান হামারা এ গান মুসলমান ই লিখেছে। আল্লামা ইকবাল রচিত এটি একটি দেশাত্মবোধক উর্দু কবিতা। সারে জহাঁ সে অচ্ছা গানটি একশত বছরেরও বেশি সময় ধরে সারা ভারতে সমান ভাবে জনপ্রিয়। এই গানটি এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। ভারত প্রায় ৭৬৬ বছর মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল।
ভারতে ইসলাম --
সুদূর অতীত- থেকেই আরবের সাথে -ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। হজরত মুহাম্মদ ( স: ) এর জীবদ্দশাতেই সাহাবী মালিক ইবনে দিনার ২০ জন সঙ্গী নিয়ে ইসলাম প্রচারে ভারত আসেন। ৬২৯- সনে ভারতের কেরালাতে চেরামান জুম্মা মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় সমসাময়িক কালে গুজরাট এবং বাংলার মুসলিমেরাও মসজিদ প্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন।
ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে – সাহাবী , ওলী আল্লাহ ,গাউস , কুতুব , আউলিয়া, ছুফি, পীর, মাশায়েখ , মৌলানা , মৌলবী , তানজিম , তাবলীগ এর সৎ , নিষ্ঠাবান , জ্ঞানী,গুণী ত্যাগী ইসলাম প্রচারক দের ভূমিকা সব সময়ই মূল ও প্রধান। তবে এটাও সত্য – পরবর্তীতে ভারতে মুসলিম শাসন ইসলাম ধর্ম প্রচারে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে । ইসলামের প্রাথমিক যুগেই মুসলিম ধর্ম প্রচারকেরা সারা বিশ্বে ইসলাম প্রচারে ছড়িয়ে পড়েন।
৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয় থেকে শুরু করে আজ অবধি অসংখ্য ইসলামের বীর মুজাহিদ ইসলামের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন উপমহাদেশে।
দিল্লিতে সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিসের কবর।
সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিস--
শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ দিল্লির মামলুক সালতানাতের একজন সুলতান ছিলেন। তিনি ১১৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি ধর্মপ্রান ছিলেন এবং দরবেশদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি তার সময়ের একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন। তিনি দিল্লির বিখ্যাত কুতুবমিনারের নির্মাণকার্য সম্পন্ন করেন। বিশ্বের ইতিহাসে কয়েকজন আলোচিত নারীশাসকদের অন্যতম ও ভারতে প্রথম মহিলা শাসক রাজিয়া সুলতানের পিতা ছিলেন ইলতুতমিশ ।
কুতুব মিনার
কুতুব মিনার ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত একটি স্তম্ভ বা মিনার । ভারতীয়-মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে কুতুব মিনার গুরত্বপূর্ণ। ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশে কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। কুতুব উদ্দিন আইবেক বাগদাদের সুফিসাধক কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকির নামানুসারে এই মিনারকে ‘কুতুব মিনার’ নাম দেন। ইংরেজ আমলে ‘কুতুব মিনার’ নামটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। মিনারের শুধু প্রথম তলাটি কুতুব-উদ্দিন দ্বারা সমাপ্ত হয়েছিল, বাকি তলাগুলি তার উত্তরাধিকারী জামাতা সুলতান ইলতুৎমিস শেষ করেছিলেন। (1211-36 খ্রীষ্টাব্দ)।
দিল্লিতে হযরত খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর মাজার শরিফ
কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী
হযরত খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। দুই বছর বয়সে পিতাকে হারানোর পর, মা’র যত্নে পালিত হন, এবং পাঁচ বছর বয়স হতে তিনি শরিয়তের জাহেরি শিক্ষার তা’লিম নেন। তিনি খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর শিষ্য এবং খলিফা ছিলেন। তার নামেই দিল্লীর বিখ্যাত কুতুব মিনার উৎসর্গ করা হয়। তিনি হোসাইন ইবনে আলী মাধ্যম হয়ে হজরত মুহাম্মাদ (দঃ) এর বংশের সাথে মিলিত হয়েছেন। মঈনুদ্দিন চিশতি তার ভ্রমণের সময় যখন আউশ দিয়ে যাচ্ছিলেন,খাজা বখতিয়ার তার হাতে বায়াত দান করেন এবং তার থেকে খেলাফত গ্রহণ করেন। এভাবেই তিনি মঈনুদ্দিন চিশতির প্রথম খলিফা হিসেবে নিযুক্ত হন।
পরবর্তিতে তিনি গরীবনওয়াজ (র) ‘র ভারত অভিযানের সাথী হন এবং লাহোর, মুলতান হয়ে দিল্লীতে আসেন। খাজা বাবা তাঁকে দিল্লীর কুতবের দায়িত্বে রেখে চলে যান আজমির অভিযানে।
আজমির বিজয়ের পর, তিনি নিজের পীরের কাছে আজমির শরিফ থাকতে চেয়েও দিল্লী বাসীর ভালবাসার বাধার কারণে পারেননি। দিল্লীর মানুষেরা তাঁকে দিল্লী ছেড়ে যেতে দেখে কান্নার রোল তুলেছিল। তাকে অনুসরন করে হাজার হাজার মানুষেরা সাথে আসতে থাকে। তারা তাঁর পা রাখার ছাপ থেকে মাটি নিয়ে চোখে মুখে বুকে মাখতে থাকে। সাথে থাকা পীর খাজা বাবা, তাঁর প্রতি দিল্লীবাসীর এমন বিরল ভালবাসা দেখে অভিভূত হন, এবং বলেন —বাবা বখতিয়ার তুমি এখানেই থাক, তুমি এ শহর ছেড়ে গেলে দিল্লীবাসীর দিল জ্বলে পুড়ে কাবাব হয়ে যাবে। তাই, শেষ পর্যন্ত তাঁকে দিল্লীতেই থেকে যেতে হয়েছিল।
চিশতিয়া তরিকার অন্যান্য সাধকদের মত খাজা বখতেয়ার কাকি কোন আনুণ্ঠানিক মতবাদ প্রণয়ন করেননি। সূফি সধক হিসেবে খাজা বখতেয়ার কাকি মানুষের উপর প্রচন্ডভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। তিনি সবসময় মজলিসের আয়োজন করতেন যেখানে তিনি তরিকতের গোপন রহস্য তত্ত্ব নিজ শিষ্যদের কাছে উন্মোচিত করতেন। জনসাধারণের মধ্যে পরিচালিত এই মজলিসে যেসব বিষয়ের উপর জোর দেয়া হতে সেগেুলো হল- আত্ম-ত্যাগ ও বাসনা শূণ্য প্রেম, আল্লাহর উপর সম্পূর্ বিশ্বাস, সকল মানুষকে একইরূপ আচরণ করা এবং যথাসাধ্য তাদের সাহায্য করা। ফলাফলের বা প্রতিদানের আশা না করে অভাবগ্রস্থদের সাহায্য করার মতাদর্কের বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।
কাকি নাম পাওয়ার ঘটনা --
কাকি নামটি দিল্লীর একটি ঘটনার পর তার উপাধি হিসেবে যুক্ত হয়। তার চরম দরিদ্রতা সত্ত্বেও স্থানীয় রুটিওয়ালা থেকে ঋণ না নিতে তিনি স্ত্রীকে নিষেদ করেন। তিনি স্ত্রীকে বলেন, যখনই প্রয়োজন হবে তখন ঘরের এক কোণা থেকে যেন কাক (এক ধরনের রুটি) নেন। এরপর, যখনই প্রয়োজন হত আশ্চর্জনকভাবে তারঁ স্ত্রী ঘরের কোণা থেকে কাক পেয়ে যেত।
ইতিমধ্যে রুটিওয়ালা এটা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল যে, কেন খাজা ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিল। তিনি চিন্তা করলেন হয়ত তিনি প্রায়শ খাজার সাথে রাগারাগি করতেন, সেজন্য খাজা ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে, রুটিওয়ালার স্ত্রী কুতুবউদ্দিনের স্ত্রীর কাছ থেকে এর কারণ জানতে চাইলেন। তিনি তাকে কাক এর আশ্চর্ জনক ঘটনাটি বর্ণা করলেন। এই গোপন রহস্যটি উন্মোচিত হওয়ার পর যদিও কাক আসা বন্ধ হয়ে যায়, ঐ দিন থেকে মানুষ কুতুবউদ্দিনকে "কাকি" নামে সম্বোধিত করতে থাকে।
কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর মাজার শরিফের ভেতরের অংশ
গোনাহ মুক্ত জীবনের একটি নমুনা ফুটে ওঠেছে তার জীবনীতে। ‘ওলামায়ে হিন্দকা শানদার মাজি’ কিতাবে একটি ওয়াকেয়া লিখিত হয়েছে। ওয়াকেয়াটি হলো- আল্লামা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী মৃত্যুর আগে তার সন্তান ও খলিফাদের ওসিয়ত করলেন যে, আমার মৃত্যুর পর যাকে-তাকে দিয়ে আমার জানাযা পড়াবে না। আমার জানাযা যে ব্যক্তি পড়াবে; তার মধ্যে ৪টি গুণ থাকতে হবে। যদি এ ৪টি গুণ কোনো ব্যক্তির জীবনে পাওয়া না যায়; তবে বিনা জানাযায় আমার লাশ দাফন করবে। খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শর্তগুলো হলো
১) যে ব্যক্তি জীবনে কোনো দিন তাকবিরে উলা ব্যতিত নামাজ পড়েনি; এমন ব্যক্তি।
২) যার জীবনে একদিনও তাহাজ্জুদ কাজা হয়নি; এমন ব্যক্তি।
৩) যে ব্যক্তি তার চোখের দ্বারা পরনারী দেখে কখনো গোনাহের কল্পনা করেনি ।
৪) যে ব্যক্তি জীবনে কোনো দিন আছরের সুন্নাতও কাজা করেনি।
খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী ইন্তেকাল করলেন। ইন্তেকালের পর তাকে জানাযার জন্য প্রস্তুত করে মাঠে নেয়া হলো। সেখানে উল্লেখিত ৪টি শর্ত উল্লেখ করে ঘোষণা করা হলো- যিনি বা যারা এ গুণগুলোর অধিকারী; তিনি খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর জানাযা পড়ানোর জন্য সামনে আসুন।
মাঠ ভর্তি মানুষ। কোনো সাড়া শব্দ নেই। এতো অনেক বড় গুণের কথা। এ গুণ অর্জন করা সহজ ব্যাপার নয়। সারা মাঠের লোকগুলো মাথা নিচু করে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। নিজেদেরকে অপরাধী মনে করে নিরবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। মাঠ থেকে কোনো প্রতি উত্তর না আসায় খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী’র ছেলে, খলিফা, ছাত্রসহ শুভাকাঙ্ক্ষীরা বিনা জানাজায় তাকে দাফনের সিদ্ধান গ্রহণ করলেন।
এমন সময় ভীড় ঠেলে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন একজন। সবার দৃষ্টি তাঁর দিকে। ধীরে ধীরে জানাযার দিকে এগিয়ে এলেন। লাশের মুখ থেকে চাদর সরিয়ে বললেন, কুতুবুদ্দীন ! তুমি নিজে তো চলে গেলে কিন্তু আমাকে অপদস্ত করে গেলে।"
তারপর তিনি জনসম্মুখে আল্লাহ তা‘য়ালাকে সাক্ষী রেখে কসম খেয়ে বললেন, আমার মাঝে এই চারটি গুণ আছে। জনতা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। আরে !! ইনি কে?? তিনি আর কেউ নয়। তিনি হলেন তৎকালীন বাদশাহ শামসুদ্দীন ইলতুৎমিস (র.)।
সুফিজমের উপর আমার আগ্রহ সবসময়ের। ইতিপূর্বে সুফিজমের উপর আমি বেশ কয়েকটি পর্ব এই ব্লগেই লিখেছি। সাম্প্রতিক দিল্লির ঘটনায় ভীষণ আহত হয়েছি। তাই পর্যায় ক্রমে আবার লিখতে শুরু করবো ।
আগের পর্বগুলো
সুফিবাদ বা সুফী দর্শন একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন (চতুর্থ পর্ব)
সুফিবাদ বা সুফী দর্শন একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন (দ্বিতীয় পর্ব)
সুফিবাদ বা সুফী দর্শন একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন ( ১ম পর্ব)
ফরিদ উদ্দিন আত্তার ও তাঁর লেখা ‘মানতিকে তাইয়ার’
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৫১