মনের ক্ষত স্থানটিতে সময়ের প্রলেপ লাগিয়ে আমার বর্তমান চেতনা এখন উত্তেজনাহীন। নিরুত্তাপ থাকার সহস্র চেষ্টা করেও বুকের ভেতর হাপরের উঠানামা রোধ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। কাঠের দোতলা বাড়ীর কাঁচের দরজার পাশে সাদা নাম ফলকে কালো গোটা গোটা অক্ষরে জলজল করছে কাঙ্ক্ষিত সেই নাম। তারপরেও স্মার্ট ফোনে সেইভ করে রাখা ঠিকানার সাথে নেইম প্লেটের লেখা মিলিয়ে নিশ্চিত হয়ে যাই এই বাড়ীটিই ৫২ ম্যাপল ষ্ট্রীট চেরি হিল। কিছুটা ইতস্তত করে দরজার ডানপাশের ডোরবেলে হাত রাখি। এপ্রিল মাসের আরামদায়ক ঠাণ্ডাতেও আমার হাতের তালু ঘেমে ভিজে গেছে। চকচকে সাদা ডোরবেলে ঘামে ভেজা আঙ্গুলের ছাপ লেগে গেলো। কয়েক মিনিট পর আধবোজা দরজা ধরে এক কৃষ্ণ মহিলা উঁকি দিয়ে যথাসম্ভব মোটা গলায় জানতে চাইলেন
“কী চাই?”
মহিলাটির বয়স বেশী হলে চল্লিশের কোঠায়।
“এটাইতো ৫২ ম্যাপল ষ্ট্রীট, অনির্বাণ এখানেই থাকেন তো"? এতটুকু কথা বলতেই আমার পানির তৃষ্ণা পেয়ে গেলো !
মহিলাটি গম্ভীর আর ভীষণ শান্ত গলায় বলল "ইয়েস"
তাঁর বলা "ইয়েস" কথাটি আমার কর্ণ গহ্বরে প্রবেশ করে হৃদয়ের অলিন্দে ভীষণ আলোড়ন তুলে আমাকে চঞ্চল করে দিল। অনেকটা যেন সাহিত্যে যেমন করে বলা হয় "শান্ত দিঘিতে ঢিল ফেলা" ঠিক তেমন করে। তারপরেও আমি নির্বিকার থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। আমার মুখে কোন রকম ভাবান্তর সে যেন টের না পায় তাই যথেস্ট পরিমান শান্ত আর বিনয়ী গলায় বললাম
“আমি কি তাঁর সাথে দেখা করতে পারি?”
কৃষ্ণ মহিলাটি পূর্বের চেয়েও আরোও একটু বেশী গম্ভীর হয়ে বলল " তিনি এখন লাঞ্চ করে আরাম করছেন। বিকেল চারটায় তার কফি খাওয়ার সময়। তখন দেখা হতে পারে"।
আমি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে স্মার্ট ফোনে সময় দেখে নিলাম। এখন বাজে দুপুর দেড়টা। আরও আড়াই ঘন্টা সময় কি করে কাটানো যায়! আমার ভ্রু জোড়ায় ভাঁজ পড়লো। আমি তাকে কিছু বলতে চাইলাম। দরজার দিকে চেয়ে দেখি দরজা বন্ধ। মেয়েটি উধাও।
নিউইয়র্ক বাস টারমিনাল থেকে গ্রেহাউন্ড বাসে করে রওনা দিয়েছি সকাল নয়টায়। ফিলাডেলফিয়া আসতে চার ঘন্টা লাগলো। উবার কল করে ঠিকানা খুঁজে বাড়ি বের করতেই এত সময় ব্যয় হোল!
আহত মনে ছোট ছোট পা ফেলে বাড়ির আঙ্গিনা থেকে রাস্তায় এসে দাড়ালাম। কাঙ্ক্ষিত তাঁর সাথে সাক্ষাৎ না হওয়াতে বুকের ভেতর কেমন যেন ভারি ভারি লাগতে লাগলো। চোখ দুটো জালা করে ঝাপ্সা দেখতে লাগলাম। দীর্ঘ বছরের জমানো অনুভবগুলো এখন দুচোখ গড়িয়ে আমার সুয়েটার ভিজিয়ে দিচ্ছে। উল্টো হাতে চোখ মুছে কাছেই এক কফি শপের দিকে হাঁটতে লাগলাম। কফি শপের দিকে হাঁটতে যেয়ে টের পেলাম আমার পা দুটি বেশ ক্লান্ত। চোখের সামনে দিয়ে অতীতকে হেঁটে যেতে দেখে বুঝতে পারলাম ভালোবাসা রূপকথার মতোই এক অলীক ব্যাপার!
জুলাই মাসের সেদিন সকালে বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। রাস্তা পার হতে গিয়ে পা পিছলে অনি একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারায়। পথচারী ৯১১ কল করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। জ্ঞাণ ফিরে আসার পর অনি চোখ কচলাতে কচলাতে আমাকে খুঁজতে থাকে। খবর পেয়ে আমি পড়িমরি করে ছুটে আসি তাঁর পাশে। কি গভীর আকুলতায় সে তখন আমার হাত ধরে বলেছিল " বিশ্বাস করো জ্ঞাণ হারানোর মুহূর্ত আগে তোমার মুখটাই দেখতে চেয়েছিলাম শুধু"! তার কথার সারল্য আমাকে বিশ্বাস করতে হয়েছিল। হ্যা আমি তাকে বিশ্বাস করেছিলাম।
আজ এতোগুলো বছর পর বুকের পাঁজর সংকোচন করে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কফিশপের পাশ দিয়ে কালো পীচ মোড়ানো রাস্তাটি চলে গেছে বাফেলোর দিকে। রাস্তার উপর ছুটন্ত গাড়ীর চাকার প্রতি দৃষ্টি রেখে আপন মনে বলতে থাকি "অনির্বাণ তোমার জন্য ভালোবাসা" ৷ তুমি কেবলমাত্র আমার একটি স্পর্শকাতর অনুভবের নাম ৷সম্পর্কের মাপাজোঁকায় এ অনুভবের কোন প্রতিচ্ছবি নেই অনির্বাণ! নেই কোন ইতিহাস, নেই ভবিষ্যতও। শূন্যতার বেড়াজালে আবদ্ধ আমি বুঝতে পারি তোমার প্রতি এ আমার শুদ্ধ প্রেম। কোথায় তুমি অনির্বাণ ?
কফি শপের স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে বাহিরে দেখতে পাই শুভ্র চেরীফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
ওয়েটার বিল দিয়ে গেলো। কফির সাথে কিছু স্ন্যাক্সস মিলে বিল হয়েছে ছ'ডলার। ক্যাশকাউন্টারে বিল পরিশোধ করার সময় টিপস্ এড করতে যেয়ে মনে পড়লো অনির্বাণ সবসময় দুই ডলার বেশী টিপস এড করত। তার কথা মনে হওয়াতে বিলের সাথে আরও দুই ডলার এড করে দিলাম।
কফি শপ থেকে অনির্বাণের বাড়ী যেতে প্রায় দশ মিনিটের হাঁটা পথ। হঠাত মেঘ কালো অন্ধকার হয়ে ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু হোল। এপ্রিল মাসের শেষে এমন বৃষ্টি প্রত্যাশিত নয়। আবহাওয়ার সংবাদ দেখার কথা মনে ছিল না। নিশ্চয় আবহাওয়া রিপোর্টে আজকে বৃষ্টির কথা বলা ছিল। আমি প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও। হঠাত আসা বৃষ্টিতে একেবারে কাক ভেজা হয়ে গেলাম।
ভেজা হাত জামায় মুছে কলিং বেল টিপে ধরলাম। কলবেলটা কয়েকবার বাজার পর বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে উচ্চস্বর ভেসে আসে, "কেউ একজন দরজাটা খুলবে প্লিজ, কতোক্ষণ ধরে বেল বাজছে"! সেই অতি পরিচিত চেনাস্বর বলে উঠে "কামিং"।
আমার কণ্ঠতালু শুকিয়ে আসছে। বুক উঠানামা করতে লাগলো হাঁপরের মতো। বহুদিন বহুদিন পর দেখা হবে আজ তার সাথে। থমথমে জীবনের বাঁকে জমে থাকা স্মৃতির পায়রাগুলোর পাখনা মেলে উড়ে যাওয়ার ক্ষণ অনুভব করছি এখন।
আচমকা কাঁচের দরজা খুলে সকালের সেই কৃষ্ণ মহিলা শান্ত হয়ে বললেন “কাম ইন, উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি অবোধ বালিকা হয়ে গেলাম যেন। সেই মহিলার পিছু পিছু বাড়ীর ভেতরে চলে গেলাম।
বাড়ীর ভেতরে ঠান্ডা হাওয়া দিয়ে ঝিরঝির বাতাস বইছে। বৃষ্টিভেজা জামাকাপড়ের উপর ঠান্ডা হাওয়ায় আমার বেশ শীত লাগতে লাগলো। সেই সাথে হাঁচি। মনে হয় হাঁচির শব্দ বেশ জোরেই হয়েছিল।
“ একেবারেই ভিজে গেছো। মাথা মুছে কাপড় বদলে নাও। নইলে অসুখ করবে"।
এমন আদর মাখা কথায় আমি ঘুরে দাঁড়াই। ঘরের যে জায়গাটিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকেই সিঁড়ি উপরে দোতলায় উঠে গেছে। সিড়ির মাথায় সাদা রঙের হাউস কোট গায়ে জড়িয়ে কাংখিত "সে" দাঁড়িয়ে। মাথাভর্তি সাদাকালো চুল এতোগুলো বছরে আরও একটু সাদা হয়েছে। অতি চেনা মিটিমিটি হাসিতে কি সারল্য মাখা মুখ ! আশ্চর্য !! দীর্ঘ ছ'বছর পরেও এতোটুকু বদলায়নি সে।
নরম মায়া আর মিষ্টি কিছু অনুভব নিয়ে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে সে বলতে থাকে
-‘কখন এলে ?’
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে উত্তর করলাম ‘অনেকক্ষণ হল।’
-‘ও আচ্ছা, ওপরে উঠে এসো।’ এই বলে আমার দিকে চেয়ে রিনরিনে ব্যাথার বুক বিদীর্ণ দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ছড়িয়ে দিলো । সিঁড়ি বেয়ে উপরে তাঁর কাছাকাছি যেতে গরম শ্বাস অনুভব করে আমি শিহরিত হলাম।
ঘরে ঢুকে আমার দিকে তোয়ালে বাড়িয়ে ধরে লাইটগুলো জেলে দিলো অনির্বাণ। ঘরের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম এটা তার রিডিং কাম বসার ঘর। বাইরে তখন সন্ধ্যা নামছে। রুমের সাথে লাগানো বাথরুম দেখিয়ে একটি কাউচে বসে কিছু একটা পড়ায় মনযোগী হয়ে গেলো সে।
আমি ভেজা চুল মুছে শুকনো কাপড় পরে নিলাম। ঘরে ঢুকে তার উল্টো দিকের একটি কাউচে বসে জানালা দিয়ে বাইরে বাড়ির পেছনে খোলা জায়গাটিতে লাগানো উঁচু সিলভার বার্চ গাছের উপর ছোট ছোট গাছের ডালপালা দিয়ে বানানো পাখির বাসা দেখায় মনযোগী হয়ে গেলাম। এই মুহূর্তে আমাকে দেখলে মনে হবে এতদূর আবেগের বোঝা বয়ে অনির্বাণের বাড়ী এসেছি গাছে বানানো পাখির বাসা দেখতে। আসলে মানুষ নিজের আবেগ আর অনুভব অপর থেকে আড়াল করে সুচতুরভাবে। আমিও তাই করছি এখন।
"গরম কফি খাবে? তোমার ভালো লাগবে"
হঠাত তাঁর বলা কথায় আমি জানাল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অনির দিকে তাকাই।
কী যেন একটা মায়া ধরে রেখেছে আমার জন্য তার কন্ঠে। আমি সহসা চোখ ফেরাতে পারিনা। আমার দুচোখ ছল ছল করে উঠে। আমি ঘাড় কাত করে বলি "হ্যা" ।
কফি মেকার নিয়ে ব্যস্ত অনি বলে উঠে "কত দিন পর তোমার মুখোমুখি ! ঠিকানা কেমন করে জোগাড় করলে"?
ততক্ষণে কফি মেকারে কফি উপচে উঠেছে । টগবগে ফুটন্ত কফির দিকে চেয়ে আমি বলি "ক্যালেন্ডারের পাতা হিসেব করলে ছ'বছর। ঠিকানা যোগাড় করতে একটু কষ্ট হয়েছে"।
আমার দিকে কফির মগ বাড়িয়ে ধরে নিজে ধূমায়িত তেতো কফির মগে চুমুক দিতে দিতে একটা ক্রিম রোল হাতে তুলে নিলো! রোলের প্যকেট আমার দিকে বাড়িয়ে হাসলো। প্রাণবন্ত উচ্ছ্বল বিশ্বস্ত সেই পুরনো হাসি!
তাঁর হাসিতে আমি কেমন এক ঘোরলাগায় ডুবে যাই। অপলক তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার দৃষ্টিতে অনির্বাণ ছটটফট করে উঠে। আলতো করে হাত ছোঁয়ায় ইজি চেয়ারের কাঠের হাতলে।
তাঁর অস্থিরতা দেখে আমি দেওয়ালে লাগানো বুক শেল্ফে সাজানো বইয়ের দিকে মনযোগী হওয়ার চেষ্টা করলাম। এভাবে কিছু সময় কেটে যায়। ঘরের বাতাস ভারি হয়। অস্বস্তি বাড়ে। কী বলতে পারি আমি এসময়! কেমন এক শূন্যতার প্লাবনে ডুবে যাই।
" রাত হচ্ছে তুমি বাড়ি ফিরবে কিভাবে”?
দ্রুতলয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে আই প্যাডে অস্থির আঙ্গুল চালাতে লাগলো অনির্বাণ।
"তোমার ঠিকানা পেয়ে বের হলাম। রাতে কোথায় থাকবো সে ব্যবস্থা করে আসিনি। তবে রাতে মোটেলে ৫০ ডলার দিয়ে এক রুম ভাড়া নিয়ে নেবো। সকালে বাসে চলে যাবো"।
"কোথায় থাকবে আজ রাতে? মোটেলে "? আহত গলায় বলে উঠে অনি ।
তাঁর দৃষ্টি নিষ্প্রাণ। সে দৃষ্টিতে শুধুই শুন্যতা অনুভব করতে লাগলাম।
যে ছিল আমার হ্যালুসিনেশান। আমার উপচে পড়া প্রেম। পরিপাটি করে সাজানো আমার ঘরের কোণ। সেই তাঁর ভেতর আমার জন্য এতোটা শূন্যতা অনুভব করে আমি দিশেহারা হয়ে যাই।
এসময় এক আশ্চর্য বোধের বিশালত্বে আমি প্রবেশ করি! তাঁর ছলছল দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি ভালোবাসাগুলো ঠিক আগের মতই জ্বল জ্বল করছে।
অনির্বাণ কাউচ থেকে উঠে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বলতে লাগলো "জানতাম তুমি আসবে। আর কোনো বাধা নেই, এখন থেকে তুমি শুধুই আমার"।
তুমুল প্রেমে আমার দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসে। অবিচল ভালবাসাগুলো শেষ বারের মতো আমাকে প্রশান্তি এনে দেয় তাঁর উষ্ণ বাহু ডোরে।
আমার সেই পঁচিশ বছরের যৌবনকে আমি তাঁর বাহু ডোরে অনুভব করতে থাকি। বুঝতে পারি জীবন আসলে কিছু অনুভব আর আবেগের মিশেল।
বাহিরে রাত গাঢ় হয়ে খুব বৃষ্টিপাত শুরু হোল।
(সবাইকে ইংরেজী নতুন বছরের শুভেচ্ছা )
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২১ ভোর ৫:৪৩