বাড়ী থেকে বের হয়ে আপন মনে হাঁটছে অয়ন । গলির মাথায় ছাই রঙা দোতলা বাড়ীটার সামনে এলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও দৃষ্টি বার বার সেদিকে চলে যায় তাঁর । অয়ন জানে সমাজে এই সম্পর্কের কোন মুল্য নেই । এই সম্পর্কটিকে সামাজিক করার মত সাহস তার ও মালবিকা কারোরই নেই। তাকিয়েই থাকে সেদিকে। শত মণ পাথর বুকে চেপে আছে যেন তাঁর। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে নিয়ে দ্রুত বাড়ীটিকে পাশ কাটাতে চায় সে।
দুপুর বেলাতে পাড়াটা বেশ নির্জন। ঘর থেকে বের হয়ে আসে মালবিকা। পিঠের উপর শাড়ীর আঁচল ভাল করে টেনে দেয়। তবে থুতনির নিচে কালচে দাগ আড়াল করতে পারছেনা। মুখ কিছুটা নামিয়ে গুটিগুটি পায়ে গলির মুখে যেতেই চোখা চোখি হয় অয়নের সাথে। চোখ ফিরিয়ে পাশ কাটায় । ভাড়া ঠিক না করেই দ্রুত রিকশাতে উঠে পড়ে।
কিছুদুর যাওয়ার পর আরেকটি রিকশা এসে মালবিকার রিকশার সামনে পথ রোধ করে দাঁড়ায়। সামনের রিকশা থেকে নেমে মালবিকার রিকশায় উঠে হুড তুলে দিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চায় অয়ন---
"এখানে কালশিটে দাগ কেন পড়েছে। জানোয়ারটা গায়ে হাত তুলেছে আবার"? বলেই হাত বাড়িয়ে জায়গাটা ছুঁতে চায়।
ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয় মালবিকা, শুকনো মুখে বলে--- "কিছু হয়নি আমি ঠিক আছি"।
"না তুমি ঠিক নেই" -- পিঠে হাত রাখে অয়ন।
আঁচল সরে গিয়ে কালসিটে দাগ দেখে আঁতকে উঠে সে।
সদাহাস্যময়ী, প্রাণচঞ্চল মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে মালবিকা। বুকের গভীরে অয়নের জন্য ডানা ঝাপ্টালেও রায়হানের পরিবারে মানিয়ে চলার পরীক্ষাতে সে ভালোভাবেই উতরে যায়। মালবিকার শরীর নিয়ে মেতে উঠতে তাঁর স্বামী যতটা স্বচ্ছন্দ, তাঁর হৃদয়ের কথা জানতে ততোটাই অনাগ্রহী।
গভীর রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আলো ঝলমলে অচেনা শহরটার দিকে চেয়ে থাকে সে। এই শহর, পরিবার, কাজের জায়গা কোনোকিছুই মালবিকার আপন মনে হয় না। কখনও সে জোরে শাওয়ার ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদে। খুব কাঁদে।
খুব সুখী হতে ইচ্ছে করে তার। প্রতিদিন হতাশায় ছেয়ে থাকা এই জীবনটা বোঝা মনে হয়। বুকে চাপ চাপ জমা কান্না , কষ্টে কণ্ঠ ভারী, পৃথিবীতে নিজেকে খুব উদ্বাস্তু মনে হয় মালবিকার।
কাছের আপনজনেরা অনেকটা জোর করেই যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়েছে তাকে। মনে হয় কোথাও কেউ নেই এখন আর। বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা তাঁর কই? সংসার টিকিয়ে রাখতে মুখ বুজে মেনে নেয় সব কিছু। মেনে নেওয়াটাই সংসার জীবনের সাফল্যের মূলকথা হয়ে দাঁড়ায় যেন।
ততক্ষণে রিকশা এসে দাঁড়ায় বাচ্চাদের স্কুলের সামনে। এক গাল হাসি নিয়ে পাঁচ বছরের মৃদুল তাঁকে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটিকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে, বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পায়। অয়নের দিকে চেয়ে ম্লান হাসি দিয়ে মৃদুলের হাত ধরে বাড়ীর পথ ধরে মালবিকা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ৭:০৯