প্রবাস জীবনের স্মৃতিগুলো বেশ অম্লমধুর। সব সময় এটা বলা হয়ে থাকে মানুষ উন্নত জীবনের আশায় প্রবাস গমন করে। আজ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু আলোকপাত করছি।
এই অভিজ্ঞতাটি একজন আফ্রিকান আমেরিকান পরিবার নিয়ে। পরিবারটি এসেছিল ঘানা থেকে। গৃহকর্তার বয়স ৪৫ বছর, চারটি বাচ্চা এবং মমতাময়ী একজন স্ত্রী। গল্পের খাতিরে ধরে নেই তার নাম স্যাম। পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। যখন সে আমেরিকায় এসেছিল তার আগে এসে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একটা মাইনিং কোম্পানিতে কাজ করছিল। সে সে দেশের অর্থনৈতিক বিবেচনায় বেশ মোটা অংকের চাকরি করতো, তথাপি উন্নত জীবনের আশায় সে আমেরিকায় পাড়ি জমায়। এখানে এসে সে বেশ কিছুদিন গ্যাস স্টেশন, মুদিখানা এইসব জায়গায় কাজ করে। কিন্তু সে পড়াশোনাটা চালিয়ে যায় এবং আমেরিকাতে এসে সে তার মাস্টার্স ও এমবিএ সম্পন্ন করে। অবশেষে সে এক কর্পোরেট কোম্পানিতে বেশ বড় পদে আসীন হয় আর তখনই তার সাথে আমার পরিচয়। প্রফেশনাল সম্পর্ক ছাড়াও তার সাথে একটা অন্যরকম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার জীবনের অনেক গল্পও আমাকে শোনায়। কিভাবে সে বেড়ে ওঠে দরিদ্র পরিবারে। বাবা ছিলেন দিনমজুর আর মা দশটি সন্তানের লালন পালন নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সেখান থেকে সে বেড়ে ওঠে আর দেশের অন্যতম স্বনামধন্য এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করে।
যাহোক আমেরিকায় এসে সে অনেক সফল হয়, কিন্তু তার পরিবারকে সময় না দেয়ার কারণে তার পরিবার ভেঙে টুকরো হয়ে যায়। স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায় অন্য আরেকজনের সাথে আর ছেলে মেয়েরা যে যার মত প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সে জীবনে অনেক সফল কিন্তু তার ভেতরের অব্যক্ত কষ্টগুলো কাউকে সে দেখাতে পারেনা। এই কষ্ট, ব্যথা আর যন্ত্রনা নিয়েই সে দিনগুলো অতিবাহিত করছে। নতুন করে কোনরকম কমিটমেন্ট বা রিলেশনে যেতে চায় না। যন্ত্রের মত সে শুধু কাজ করে যায় আর দিন শেষে বাড়ি ফিরে একরাশ হতাশা নিয়ে।
তো তার এই হতাশা পূর্ণ জীবন থেকে উত্তরণের জন্য আমি তাকে কিছু কমিউনিটি কার্যকলাপে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করি। কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতা থাকার কারণে সে আফ্রিকান আমেরিকান কমিউনিটিতে বিশেষ করে করে ধর্মীয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবা মূলককাজকর্ম শুরু করে আর জীবনের এসব অপ্রাপ্তি থেকে কিছুটা হলেও বের হয়ে আসতে পারে। আমি মনে করি মানুষ হিসেবে এটাই আমাদের সার্থকতা যখন আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই ভালো কোন কিছুর জন্য উদ্যোগ নেই। সর্বশেষ তার সাথে আমার বছর খানেক আগে কথা হয়েছিল। সে এখন ব্যস্ত আছে কিভাবে আফ্রিকান শিশু-কিশোরদেরকে অপরাধ জগত থেকে বের করে আনা যায়।
এবার বলব এক বাংলাদেশী দম্পতির কথা। গৃহকর্তার বয়স ৫০, নাম ময়েজ। নিউইয়র্কে জ্যাকসন হাইটসে থাকেন। পরিচিত হয়েছিলাম এক আত্মীয়ের মাধ্যমে। দেশে কনট্রাক্টর হিসেবে কাজ করতেন আর স্ত্রী ছিলেন গৃহিণী। আমেরিকায় আসার পরে জীবনের বাস্তবতায় অনেক ধরনের কাজই তাকে করতে হয়েছে। দম্পতির একমাত্র সন্তান সে হাইস্কুলে পড়াশোনা করতো। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রেমে পড়ে তার চেয়ে ২০ বছর বয়সে বড় এক মহিলার। পড়াশোনার ইতি টেনে সে চলে যায় তার নিজস্ব গন্তব্যে! একদিন গল্পচ্ছলে ভদ্রলোক খুব আফসোস করে বলতে থাকেন আমেরিকা তাকে অনেক কিছু দিয়েছে আবার অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। আমি কিছুটা অনুসন্ধান করলাম তার পরিবার সম্পর্কে। জানতে পারলাম ভদ্রলোক নিজেও তার স্ত্রীকে অন্য আরেকজনের কাছ থেকে সরিয়ে এনেছেন। আর বর্তমানে এই স্ত্রীও তাকে ছেড়ে অন্য কারো প্রতি মনোনিবেশ করছেন। এইসব থেকে মুক্তি পেতে তিনি এখন ধর্ম কর্মে নিয়োজিত করেছেন নিজেকে।
বিচিত্র মানুষ বিচিত্র তাদের চরিত্র। উপরোক্ত দুটি ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের পরিবারের উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় নিজেকে এতটাই ব্যস্ত করেছিলেন যে পরিবারের সদস্যদের কথাগুলো শোনার তাদের ফুসরত হয় নাই। এজন্য পরিবারকে উপযুক্ত সময় দেওয়াটা আমাদের প্রত্যেকের জন্যই শিক্ষনীয় বিষয়।
এই সিরিজটা শুরু করলাম, ইচ্ছে আছে নিজের আরও কিছু অভিজ্ঞতা বিনিময় করব ব্লগারদের সাথে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ২:০৫