সুস্মিতার সাথে সম্পর্কটা ভেঙ্গেই দিলাম। আর কোন উপায় ছিল না। হয়তো কাজটা অনেক নিষ্ঠুর মনে হতে পারে, কিন্তু আমি আর কি-ই বা করতে পারতাম? ওকে আমার আর সহ্য হয় না। ঘরের ভিতর যখন এরকম অসহ্যকর একটা মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা দেখতে আমার আর ভালো লাগছে না। আমি বরং এর থেকে মুক্তি পেতে চাই, মুক্তি পেতে চাই এ যন্ত্রণা থেকে। কথাটা ওকে বলেও দিয়ছি, কোন রাখডাক না করেই। আমি বলে দিয়েছি,
- তোমাকে আমার আর ভালো লাগে না। তোমাকে দেখে কোন ফিলিংসও হয় না। তুমি চলে গেলেই বরং আমি খুশি।
আমার এ কথা শুনে ও খুব একটা উচ্চবাচ্য করেনি। ও জানে আমি এরকম-ই। কোন জবাব দিয়ে লাভ হবে না। কথা বলা বৃথা। শুধু চুপচাপ নিরালায় বসে চোখের জল ফেলল। এই সামান্য অশ্রু মুছে দেবার জন্য একসময় আমি জীবনও দিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু এখন আর এসবে কিছু যায় আসে না আমার। ও যত খুশি চোখের জল ফেলুক। মেয়ে মানুষ তো কাদবেই, এটা তো অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার না। যেদিন ও চিরকালের জন্য চলে যায় সেদিনও ও কেদেছে। আমি তার দিকে আর দৃষ্টি দি-ই নি। কাদবেই তো, যেই বাড়িতে এতগুলো দিন আমার সাথে কাটিয়ে দিল, সেই বাড়ির মায়া কি এত সহজে কাটানো যায়? যাবার আগে ঘরের প্রতিটি আসবাব বার বার ছুয়ে দেখে। একদিন এসব ওর ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। এই বোধটুকু কষ্টকর বৈ কি? কিন্তু একটিবারও আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে না। কারণ ও জানে আমি এমন-ই, কথা বলে কোন লাভ হবে না।
আমার বন্ধুমহলে এটা নিয়ে প্রায়-ই আলোচনা হয়। তারা কিছু জানতে চাইলে আমি এটা ওটা বলে এড়িয়ে যাই। ওরা জানে চাইলেও আমার মুখ থেকে কোন গোপন কথা বের করতে পারবে না যদি না আমি আগ বাড়িয়ে বলি। শুধু আড়ালে কানাঘুষা করে বেড়ায়। এটাও খুব স্বাভাবিক। আমাদের এতদিনের প্রেম, ভালো লাগা, দুইজন দুইজনকে ছাড়া আর সবকিছু ভুলে থাকা, এত মিল, এত স্বপ্ন দেখা....এসবের সাথে এই ঘটনাটা তারা ঠিক মেলাতে পারে না।
আজ সুমন বলছিল, - কিরে তুই তো দেখি পুরা ভুতের মত হয়ে গেছস। চেহারার অবস্থা কি একবার দেখছস আয়নায়?
আমি শুধু একটু হাসি দেই।
- খাওয়া-দাওয়া ঠিক মত কাস না? ভাবি না থাকলে তো এমন হবেই। কেন এই কাজটা করতে গেলি বলত?
- বাদ দে তো এইসব, অন্যকিছু বল। আর তোর ভাবি যখন ছিল না তখন কি আমি ছিলাম না? বাইচাই তো ছিলাম, মইরা তো যাই নাই।
সুমন শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, - হো, তা ঠিক।
আমার কি যেন মনে হয়েছে এভাবে জিজ্ঞেস করি, - আচ্ছা রবিন কই রে? ওরে তো অনেক দিন দেখি না।
- আমিও দেখি না। শালার ফোনও বন্ধ। কই যে হারাইয়া গেল, আল্লাহ মালুম।
আমার প্রতিদিনকার জীবনে হঠাৎ অনিয়ম দেখা দেয়। এতদিনের অভ্যাসে ছেদ পরে। আমার বন্ধু-বন্ধব, আত্মীয়-স্বজন কারো সাথেই আগের মত যোগাযোগ হয় না। ওদের বরং এড়িয়েই চলি, কারণ দেখা হলেই নানান কথা উঠে আসে। আমি বুঝতে পারি একটা অবিন্যস্ততা, একটা শূণ্যতা ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করে চলেছে। আমি আতংকের সাথে অনুভব করি আমি সুস্মিতাকে মিস করছি। এমন তো হবার কথা ছিল না! আমি কেন ওর কথা ভেবে কষ্ট পাব? বল সুস্মিতা, কেনই বা আমি অনুতপ্ত হব?
যখন একা একা পথ হাটি তখন প্রতিটি অলিগলি আমার কাছে স্মৃতি-বিজরিত হয়ে ধরা দেয়। সবখানেই ও আমার কাছে কষ্ট হয়ে ধরা দেয়। আমি হাটতে হাটতে সেই ফুচকার দোকানে চলে যাই যেখানে ওর সাথে আমার প্রথম দেখা। তারপর হঠাৎ ঘোর কাটলে ভাবি হায় আমি এ কি করছি? তারপর আবার পিছু হটি। প্রতিজ্ঞা করি আমি আর ঐ পথ মারাবো না কনদিন, যত প্রয়োজন-ই পরুক না কেন। একদিন মোবাইল গাটতে গিয়ে ওর একটা ছবি পেয়ে যাই। কতদিন পর ওর মুখ দেখা হল ভাবতে লাগলাম। কিন্তু তারপর সেটা ডিলিট করে দিলাম। না সুস্মিতা, আমি তোমার কোন ছবিও রাখব না। আমি অট্টহাসিতে ফেটে পরি। কিন্তু হায়, আমার চোখ নিজের অজানতেই ভিজে উঠে। আমার তখন বড় রাগ হয়। আমি মোবাইলটা ছুড়ে ফেলে দেই দূরে। যেই রেস্টুরেন্টে ওর সাথে বসতাম এক সময়, সেখানে এখন একা একা বসে কাচের জানালায় বৃষ্টি দেখি। সুস্মিতা বৃষ্টি বড় ভালোবাসত। সুস্মিতা, আর কোনদিন তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভেজা হবে না।
এমনি যখন চলতে থাকে, আমি বুঝতে পারি আমার পালাতে হবে। এইসব স্মৃতি, পিছুটান, শূণ্যতা এসব কাটিয়ে চলে যেতে হবে অনেক দূর। আমি ঠিক করি আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব। হ্যা সুস্মিতা, যেখানে তুমি আছো সেখানে আমার আর থাকা সম্ভব না। আমার জীবনটা দুরুহ হয়ে উঠে, এই পীড়া আমি আর সহ্য করতে পারি না। আমার পিছুটান নেই, আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক খারাপের পথে। তাই তারা কিছু মনে করবে না। আমার বন্ধুদের ব্যাপারটা জানালে ওরা আমাকে ফেরাবার চেষ্টা করেনি। শুধু জানতে চেয়েছে,
- কোথায় যাবি কিছু কি ভেবেছিস?
হ্যা, ভেবেছি। আমার পাসপোর্ট, ভিসা সব করা আছে। খুব শীঘ্রি আমি তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাব সুস্মিতা, চিরতরে চলে যাব। এ দেশে আমি আর ফিরব না।
সুস্মিতার স্মৃতিগুলো আমাকে কেবলি তাড়িয়ে বেড়ায়। আমি ওকে ভুলে যেতে ক্লাবে গিয়ে মাতাল হই বন্ধুদের নিয়ে। আমার মাতাল পশুর মত আচরণ দেখে ওরা হতবিহ্বলের মত চেয়ে থাকে। আমি তাদের চাহনিতে কিছু মনে করি না। শুধু জানতে চাই,
- রবিন শালাটা কই রে? ওরে যে দেখি না?
ওরা কোন জবাব দেয় না। হঠাৎ রাতুল আমাকে হাতে ধরে নিয়ে যায় একপাশে নিবৃতে যেখানে মানুষ বেশ কম। তারপর অন্যদের মত করেই বলে,
- তোর চেহারা কেমন হয়েছে শালা দেখেছিস? আচ্ছা তুই এমন কেন? কিসের এত কষ্ট তোর? ভাবি তো আর নিজে নিজে যায়নি, তুই-ই তো ভাগিয়ে দিয়েছিস।
আমি দাত বের করে হাসি যা দেখে রাতুলের পিত্তি জ্বলে যায়। ও তখন রাগত স্বরেই কথাটা জানায়।
- সুস্মিতার যে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এটা জানিস?
না আমি জানি না। সত্যি আমার বিস্ময়ের সীমা থাকে না।
- ছেলে নাকি ওদের আত্মীয়। শুধু যৌতুকের লোভেই ওকে বিয়ে করছে। আচ্ছা তুই এটা কি করলি? তুই তো আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছিলি, সবদিক থেকেই। কেন তুই এই মেয়েটার জীবন এভাবে নষ্ট কএর দিলি?
আমি কিছু বলতে পারি না। আমার কেমন সবকিছু ঘুলিয়ে উঠে। কেন? কেন? হে খোদা, হে সুস্মিতা....শুধু এটুকু ওকে জিজ্ঞেস করতে পারি,
- রবিন কোথায় জানিস? বল না প্লিজ!! প্লিজ বল, একটাবার বল!! তুই আবার কোথাও লুকিয়ে রাখিস নাই তো??
রাতুল খুব হতাশ হয়, একটা করুণার দৃষ্টি দিয়ে তারপর ঘুরে হাটা দেয়।
আমার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে। অনেক ভেবেছি, নিজেকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি আমি আসলে কি চাই। কেউ কেউ বুঝানোর চেষ্টাও করেছে নিজের মত করে। আমার সিদ্ধান্তের তবু পরিবর্তন হয়নি। আমি যাবই। কিন্তু যাবার আগে আমার একটা কাজ শেষ করে যেতে হবে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। যদি সেটা শেষ না করি, তবে আবার আসতে হবে আমার।
আমি শেষবারের মত চট্টগ্রাম শহরে এসেছি একা একা। এ শহরটা আমার বড় ভালো লাগে। এদিক-ওদিক ছন্নছাড়ার মত ঘুরে বেড়াই। নিজেকে ভবঘুরে ভাবতে ভালো লাগে। সুস্মিতাকে ছেড়ে দিয়ে ভালোই হয়েছে, এখন আমি যেখানে খুশি যেতে পারি। কেউ বাঁধা দিবে না।
আর এভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমি এক সন্ধ্যায় তাকে পেয়ে যাই। একটা রেস্টুরেন্টে বসে হালকা নাস্তা করছিলাম। এমন সময় রবিনকে চোখে পরে এক কোণে। মানুষ যেই জিনিসটার কথা খুব ভাবে, কোন না কোন ভাবে একদিন তার দেখা পেয়েই যায়, এটা আবার প্রমাণ হল। রবিন মনে হয় আমাকে তখন দেখেনি। আমি চুপি চুপি ওর পাশে গিয়ে বসে পরলাম। ও আমাকে দেখে যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠে। পরে সামলে নেয়। আমি শুধু একটা হাসি দেই।
- কিরে রবিন, ছিলি কই? আমি তোকে সেই কবে থেকে খুজতেছি!
রবিন কেবল একটা কষ্টকৃত হাসি দেয়। বলে, - কিছুদিনের জন্য আসছি। ঢাকায় তো কোন কাজ নেই এখন, তাই....
আমি বলি, - তো কারো সাথে যোগাযোগও রাখবি না? তোকে তন্ন তন্ন করে খুজেছি এতদিন। আমি তো আর কিছুদিন পর চলে যাচ্ছি বিদেশে।
- চলে যাবি মানে? কোথায়?
- আছে, আর কোনদিন ফিরব না।
এই কথায় ওকে যেন একটু আশস্ত হল বলে মনে হল। একটু যেন খুশি মনে হয়। আমি ওকে এই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকতে দেই না। আমার কাজটা শেষ করতেই হবে যার জন্য এই শহরে এসেছি। আমি আমার অস্ত্রগুলো বের করতে শুরু করি।
- সুস্মিতার যে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এটা জানিস?
রবিন যেন একটু বিষম খেল। চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে সেটা আবার নামিয়ে রাখে। শুধু মিন মিন করে বলে, - তোর কষ্ট লাগেনি শুনে?
আমি বলি, - তা তো খানিকটা লাগেই। কিন্তু তোর লাগে না?
এ কথায় রবিনের মুখ সাদা হয়ে যায়। চায়ের চুমুক নাক-মুখ দিয়ে উঠে। মিন মিন করে বলে, - এটা কেমন প্রশ্ন করলি তুই?
এবার মোক্ষম অস্ত্রটা বের করি। ওকে বলি, - কেন, তোরা যে প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতি তা কি আমি জানি না ভেবেছিস?
রবিন আমতা আমতা করতে শুরু করে।
আমি কথা চালিয়ে যেতে থাকি, - আমি আমার ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম অনেকদিন। ঘরে খুব একটা সময় দিতে পারিনি। কিন্তু তার মানে এই না যে সেই সুযোগে তোরা কি করে বেড়িয়েছিস তা আমি জানতাম না। আমার কাছে সব খবরই আসত। তুই জানতি আমি যে আমি সব জেনে গেছি, তাই সুযোগ বুঝে পালিয়েছিস। কি, ঠিক বলেছি?
হ্যা রবিন জানত, তাই ও এখন আর প্রতিবাদ করে না। বরং চিন্তিতভাবে চুলে হাত বুলায়।
আমি চালিয়ে যাই, - তোকে তো এত খারাপ বলে মনে হত না যে শেষমেশ বন্ধুর বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে এমন করবি। আর মেয়েটাও কেমন দেখ, আমার কোন জিনিসটার অভাব ছিল? টাকা-পয়সার কি কোন কমতি ছিল? আর এটা করে লাভ কি হল? আমরা দুই কূলই হারালাম। তুই পালিয়ে রইলি। এটাকে কি জীবন বলে?
রবিন আর শুনতে পারে না। ও তাড়াতাড়ি উঠে চলে যায়। আমিও ওর পিছু পিছু যেতে থাকি। রবিন দ্রুত হাটে, মাঝে মাঝে পিছে তাকিয়ে দেখে নেয় আমি আসছি কিনা। ওর ভয়ার্ত মুখ দেখে আমার হাসি পায়, বন্য হাসি। যেতে যেতে আমরা একটা এদো-গলিতে এসে পৌছাই। এদিকে জন-মানুষ নেই কন। এটাই সুযোগ। আমি ওর পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পরি। রবিন উপুড় হয়ে পরেছে, আমি ওর পিঠের উপর চেপে ধরে রেখেছি যেন নড়তে না পারে।
তারপর পেন্টের চোরা পকেট থেকে ধারালো ড্যাগারটা বের করে নিয়ে আসি। জানো কি সুস্মিতা, তুমি চলে যাবার পর থেকে একমুহুর্তের জন্যও এটা হাতছাড়া করিনি। কিন্তু আজকের পর এটা আর কন কাজে লাগবে না। আমি ড্যাগারটা রবিনের গলায় বসিয়ে দেই। রক্ত ছলকে পরে রাস্তার উপর, রবিন জবাই করা মুরগীর মত তড়পাতে থাকে। কিন্তু আমার তা দেখে একটুও করুণা হয় না, বরং হাসি পায়। দেখ সুস্মিতা, যার জন্য আমি তোমাকে এত কষ্ট দিলাম, সেই রবিনকে আমি হত্যা করেছি।
আমাকে এই অবস্থায় যেই কেউ দেখে ফেলতে পারে, আমাকে পুলিশে দিতে পারে। কিন্তু তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমার যে কাজটা বাকি ছিল, তা করা হয়ে গেছে। এখন জেল অথবা বিদেশ সব আমার কাছে একই রকম।