‘গরুর কোন দুঃখ নাই, কোন একঘেয়েমী নাই, কারণ গরুর কোন স্মরণশক্তি নাই। গরুর যেহেতু কোন অতীত নাই, তাই সে সুখি’। গরুর স্মরণশক্তির র সাথে গরুর সুখ দুঃখের সম্পর্ক নিয়া এই কথা বলেছেন জার্মান দার্শনিক মহাত্মা ফ্রেডরিক নিৎসে তার দ্বিতীয় ‘আনটাইমলি মেডিটেশন’এ। তবে যেই বিষয়টা আমাদের বুঝা দরকার তা হইলো যে গরুর সুখ দুঃখ নিয়া আদতে নিৎসের কোন মাথা ব্যাথা ছিলনা, গরুর স্মরণশক্তির স্বিমাবদ্ধতা নিয়াও তিনি খুশি বা চিন্তিত ছিলেন না। দার্শনিক নিৎসের তাবৎ চিন্তার বিষয় ছিল মানুষ, আর মানুষের জীবনে স্মরণশক্তি এবং অতীত বিশেষ করে মানুষের সমাজে অথবা আরো ভালো কইরা বলতে গেলে মানুষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির ইতিহাস স্মরণ রাখার সাথে সেইসব জাতিগোষ্ঠির সুখ দুঃখ ও সম্ভাবনা নিয়া আসলে নিৎসে আলাপ করতে চাইছেন। ব্যাক্তি মানুষ ও জনগোষ্ঠির নিজেদের অতীত ইতিহাস স্মরণ রাখা অথবা ভুইলা যাওয়ার উপরে সেই ব্যক্তি অথবা জনগোষ্ঠির সুখ দুঃখ সম্ভাবনা ইত্যাদির সম্পর্ক আছে বইলা মনে করতেন নিৎসে। তার মতে, যেই জনগোষ্ঠির নিজেদের অতীত নিয়া কোন স্মৃতি নাই, সেই জনগোষ্ঠি স্বশাসনে অপারগ, তার স্বাধিকার নাই, আইনের শাসন সে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনা নিজের এবং সমাজের জন্যে। ঐতিহ্যহীন সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী জীবনাচারএর সাথে সম্পর্কহীনতা, সর্বোপরি অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে অসচেতনতা একটা জনগোষ্ঠিরে বানায় অক্ষম। ইতিহাস ভুইলা গেলে গরুর মতো সুখি হওয়া যায় বটে, ভোগ এবং ভোগের জাবর কাটায় সময় যায় বটে, কিন্তু স্বাধীন, নৈতিক, সামাজিক সর্বোপরি মানুষই হওয়া যায়কিনা সেইটা সন্দেহের বিষয়। তবে অতীতকে বেশি আকড়ায়া ধরার সমস্যা নিয়াও নিৎসে ভাবিত ছিলেন, তিনি মনে করতেন যে এতে সৃষ্ঠিশিলতা আর সমাজ বিকাশের ব্যাঘাত ঘটে।
অতীত ইতিহাস স্মরণ রাখা এবং অতি অতীতমুখি না হওয়া এই দুইই ব্যক্তি মানুষ এবং জনগোষ্ঠির জন্যে অত্যন্ত জরুরি মনে করেন নিৎসে। কিন্তু যেই সময় তিনি দ্বিতীয় আনটাইমলি মেডিটেশন লিখেন সেই সময়টা জার্মান আধিপত্ববাদী ও সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদের বিকাশের সময়। জার্মানরা তখন নিজেদের অতীত ইতিহাস আর মিথলজিরে একাকার কইরা ক্রমেই বর্ণবাদী এবং জার্মান জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। নিৎসে এর প্রবল সমালোচনা করেন তার লেখায়, আর তাই অতীত প্রবলভাবে আকড়ায়া ধরার সমালোচনাটাই তার লেখায় ছিল তাই মূখ্য। কিন্তু আমাদের আজকের এই আলাপের উদ্দেশ্য অবশ্য ভিন্ন, বরং নিৎসের উদ্দেশ্যের বিপরীত বলা যায়।
View this link
এই ভিন্নতার কারন নেহায়েত বাস্তবতা। ইতিহাস স্মরন রাখা অথবা অতীতমুখি না হওয়া এই দুইই জরুরি, এইটা সত্য। কিন্তু নিৎসে এবং আমাদের সময় ও স্থানের বাস্তবতা আলাদা। এমন একটা সময়ে আমরা আজকে এই আলাপটা করছি, যখন পশ্চিমা আধিপত্ত্ববাদী সংস্কৃতি এবং ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে। জার্মানিতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ হইছিল ইউরোপিয় জাতিগুলার মধ্যে ঔপনিবেশিকতায় শ্রেষ্ঠত্বের বাসনা নিয়া, এর চরিত্র আধিপত্ত্ববাদী ও শোষনমূলক। অন্যদিকে বাঙলায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়া, ক্রম বি-উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়ায়, এর চরিত্র সংগ্রামী ও বিপ্লবী। ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটারে স্থানকাল নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করাটা একটা পশ্চিমা প্রভাবদুষ্ট ঔপনিবেশিক ফ্যালাসি মাত্র। তার উপর আমাদের অবস্থা এখন হইছে নিৎসের ‘গরু’র মতন, যেই গরুর কোন স্মরণশক্তি নাই, ভোগ আর ভোগের জাবর কাটা যার একমাত্র নির্বান।
আমাদের এই গরু-অবস্থার পেছনের কারন আর আর তার সাথে আমাদের সুখ দুঃখের সম্ভাবনা বুঝনের জন্যে আরো একজন মহাত্মার নাম স্মরণ না কইরা উপায় নাই। তিনি মহাত্মা এডওয়ার্ড সাইদ। বাঙলার মানুষ দুইশ বছরের ইউরোপিয় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ছিল। এডওয়ার্ড সাইদ দেখাইছেন ঠিক কিরুপে পশ্চিমা শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আমাদের মতো রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠিরে অতীত ঐতিহ্য, জীবনাচার, সর্বোপরি ইতিহাস থেইকা বিচ্ছিন্ন করে। তিনি দেখাইছেন দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন ঠিক কিরুপে একটা জনগোষ্ঠিরে শেখায় ‘তোমার ইতিহাস নাই’, এবং সেই জনগোষ্ঠিও একসময় জিকির করে, ‘আমার ইতিহাস নাই’। এরপরে ইতিহাস তৈরির চেষ্টা চলে, কিন্তু তাও জনগোষ্ঠির ইতিহাস হয়না, হয় গোষ্ঠি, সম্প্রদায় অথবা পার্টির ইতিহাস। বাঙলার জনগোষ্ঠির ইতিহাসও তাই পার্টিস্বার্থে ৫ বছর পরে পরে পরিবর্তন হয়। সেই ইতিহাসের শুরুও বেশিদিন আগে থেইকা না। কেউ শুরু করে ১৯৭১ থেইকা, কেউ কেউ তো আবার দাবি করে ১৯৭৫এর আগে নাকি বাঙলাদেশেরর জনগণের প্রকৃতঅর্থে ইতিহাসই নাই। এর চেয়েও পেছনে গেলে ব্রিটিশ বাঙলা, যেনো ফিরিঙ্গী আলোয় আলোকিত হওয়ার আগে এই ভুখন্ডে মানবকূলের জন্মই হয়নাই, হইলেও তারা ছিল জংলি, বর্বর, ইতিহাস ঐতিহ্যহীন। মিলস সাহেব বলছিলেন আমাদের কোন ইতিহাস নাই, সুতরাং নাই। যা আছইসেইটা সাম্প্রদায়িক হিন্দু আর মুসলিমের ইতিহাস, ব্রিটিশ আলোয় আলোকিত বাঙালি রেনেসার ইতিহাস, আওয়ামীলীগ আর বিএনপির ইতিহাস, তার আগে কিছুনাই, তার বাদে কিছুনাই। সুতরাং, পশ্চিম থেইকা যা কিছু পাও, হাত পেতে নাও এবং গরুর মতো সুখে থাকো।
আমাদের তাবৎ আলাপের মূখ্য উদ্দেশ্য অবশ্য আগত ১৪ ফেব্রুয়ারি, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস। গরুসুলভ সুখের আতিস্বজ্যে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটার সাথে ‘স্বৈরাচার’, ‘প্রতিরোধ’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার কারো কারো মনে অস্বস্তির জন্ম দিতে পারে। সেই অস্বস্তি অবশ্য ১৪ ফেব্রুয়ারি, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসএর গুরুত্ব কমায়না, বাড়ায়ওনা। তবে নিৎসের ‘গরুর যেহেতু কোন অতীত নাই, তাই সে সুখি’ এই বাক্যের ব্যাবহারিক তাৎপর্য প্রমান করে। সামনে আগানের আগে তারচেয়ে আসেন আমরা সুখ অথবা স্বাধীকার, গুরুত্ব অথবা মনুষ্যত্ব এই দুইয়ের একটা নির্বাচন কইরা নেই।
View this link
এইবার আমরা যারা সুখের বদলে স্বাধীকার আর গরুত্বের বদলে মনুষ্যত্বকে নির্বাচন করছি তাদের জন্যে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারীর ইতিহাস স্মরণ করা অত্যন্ত জরুরি। ১৯৭৫ পরবর্তি বাঙলাদেশে গনতন্ত্রের হত্যা এবং সামরিকশাসনের উত্থান এই দুইই বাঙলার জনগণের সূদির্ঘ মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে মারাত্মক আঘাত। জিয়াউর রহমানএর হাত ধরে বাঙলাদেশে সামরিকশাসনের সূচনা হইলেও তার পরিপূর্ণ বিকাশ হয়েছিল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদএর হাতে। দীর্ঘ সময় বাঙলার ক্ষমতার মসনদ কুক্ষিগত করে রাখা এই স্বৈরাচারকে বিশ্ব বেহায়া
টাইটেল দেয়া হইছিল। ইতিহাস ভুলে যাওয়া গরুদের সামনে এই বেহায়া এখন গনতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত হয়ে সংসদে যান, এই বেহাযার বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রামী দুই রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে তাকে বগলদাবা করতে ব্যস্ত থাকেন, এবং মঝে মাঝে কাউকে কাউকে বলতেও শোনা যায়যে এরশাদের স্বৈরশাসনেই আমাদের আবার ফিরে যাওয়ার দরকার।
বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম, এই ভুখন্ন্ডের আপামর জনতার মুক্তি সংগ্রামের ধারাবাহিকতা, এই রাষ্ট্রেরর সংস্কৃতি ও দর্শনের বিপরীতে সামরিক শাসন এক নিদারুন কলঙ্ক। পাকিস্তানি স্বৈর শাসকদের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জন্ম বাংলাদেশের। ঔপনিবেশিক প্রকৌশলে জন্ম নেয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানে ছিল না ভাষা জাতিগুলোর, সর্বোপরি আপামর জনতার রাজনৈতিক অধিকার। শুধুমাত্র ঊর্দুভাষী নতুন জন্ম নেয়া এলিট জাতীয় বুর্জোয়াদের লুটপাট আর কামড়াকামড়ির রাজনীতি, যাতে শুধুমাত্র এই শ্রেণীর রাজনৈতিক ও সামজিক স্বার্থ রক্ষিত ছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে এই শ্রেণীর বন্ধুত্ব দেশের জনগণের প্রতি দায়িত্বের চেয়ে অধিক দরকারি ছিল। আর এই শ্রেণীর অতি লুটপাট ও কামড়িকামড়িতে খুব বেশি অস্থিরতা তৈরী হইলেই অথবা এদের বিরুদ্ধে জনতার সংগ্রাম দানা বাধলেই সরাসরি সাম্রাজ্বাদী পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক শাসন, দমন নিপীড়ন। তারপর আবারো কোনদিন জনগণের শক্তি কাজে লাগিয়ে লুটেরাবুর্জোয়া গনতন্ত্রের পূনরুউত্থান। এই হইলো পাকি্সতানের ইতিহাস, তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভগ প্রাক্তন উপনিবেশেরর চালচিত্র। আর এর বিরুদ্ধেই বাঙালি তার মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করেছে। ভাষা জাতির সাংস্কৃতিক অধিকার, জনতার রাজনৈতিক অধিকার এর জন্যে শান্তিপূর্ণ, গনতান্ত্রিক, সামরিক এবং বিপ্লবী সংগ্রাম করেছে বাঙলার মানুষ। ৭৫ পরবর্তি সামরিক শাসন তাই বাঙলার বুকে কলঙ্ককসামীল, একধরণের জাতীয় মৃত্যু। ৯০এর যেই গন-অভ্যুত্থানে বাঙলার এই কলঙ্ক মোচন হয়, সেই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব লুটেরা বুর্জোয়া পার্টিগুলোর হাতে থাকলেও তার শক্তি ছিল দেশের আপামর সংগ্রামি জনতা। ছাত্র, শিক্ষক এবং পেশাজীবী জনতার গড়ে ওঠা সংগ্রামের পুজিতে এইসব পার্টি সামরিক শাসনের পতন ঘটাইতে সক্ষম হয়।
এরশাদ যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেন তখন দীর্ঘ সময় বৃহত দুই রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধে কোন সৎ এবং সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনাই, বরং তাদের ভুমিকা ছিল কাপুরুষচিত ও সুবিধাবাদী। তাই এরশাদের অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিছিলেন দেশের ছাত্র সমাজ।
১৯৮৩ সালে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়া শুরু হয় এই প্রতিরোধের। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী মজিদ খানের শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দী মুক্তি ও জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে ছাত্র সমাবেশের ডাক দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই ছাত্র সমাবেশ পরে পরিবর্তিত হয় বিরাট জনতার প্রতিরোধে। স্বৈরাচার বনাম জনতার সংগ্রামে পুলিশের গুলিতে সেইদিন শহীদ হন জাফর, জয়নাল, কাকন, দিপালীসহ আরো ১০জন। সেই ১৪ ফেব্রুয়ারীর চেতনায় শুরু হয় স্বৈরাচার প্রতিরোধের সংগ্রাম, গলে সামরিক বুট আর বুলেটের আতংকের বরফ, আর সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়ই ৯০এর গণঅভ্যুত্থান। ১৪ ফেব্রুয়ারী এরপর থেকেই পালিত হয়ে আসছে স্বৈরাচার প্রওতিরোধ দিবস হিসাবে।
কিন্তু গরুর কোন দুঃখ নাই, কারন তার স্মরণশক্তি নাই। গরুর একমাত্র নির্বান ভোগ এবং ভোগের জাবর কাটায়। আর তাই ১৪ ফেব্রুারী হঠাৎ করেই আমাদের কাছে এখন ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’। হিরোশিমা দিবস চাপা পইরা যায় বন্ধু দিবসের চাপে, গরুর মস্তক হিরোশিমার ইতিহাস আর চেতনা বিবর্জিত। স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস চাপা পইরা যায় ভালোবাসা দিবসের চাপে, গরুর মস্তক স্বৈরাচার প্রতিরোধের চেতনা বিবর্জিত।
কিন্তু এতে চেতনার কোন ক্ষতি নাই। ক্ষতি অন্য এক জায়গায়। নিৎসে যে বলেছেন, নিজের ইতিহস ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কহীন জনগোষ্ঠির স্বশাসন এবং স্বাধীকারের ক্ষমতা নাই তা সত্য বলেছেন। গরু না হইলে বাঙলাদেশের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকাইলেই এইটা বুঝতে পারার কথা। হুদাই কি আর যার যখন মনে চায় আইসা যেমন খুশি তেমন থাবরা দিয়া, চুমা দিয়া কাপড় খুইলা নিয়া যায়?
ছবিঃ http://www.droho.net/?p=3981&fb_source=message