somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জ্বালানি সম্পদের রাজনীতিঃ পক্ষ, বিপক্ষ, লক্ষ্য। পর্ব-১

২০ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ১০:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্তমান দুনিয়ায় জ্বালানি সম্পদের রাজনীতি একেবারেই নতুন কিছু না। গত শতকের শেষ পঞ্চাশ বছরের নয়া ঔপনিবেশিক পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির মূল লক্ষ্যবস্তুই ‘জ্বালানি সম্পদ’। আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতা জ্বালানি নির্ভর সভ্যতা, তেল-গ্যাস-কয়লা ছাড়া এখন পর্যন্ত এই সভ্যতা টিকে থাকার রাস্তা তৈরি করতে পারেনাই। এই সভ্যতার কেন্দ্রভূমি ইউরোপ আমেরিকার বিলাসবহুল ভোগবাদী জীবনাচার নির্ভর করে তাবৎ দুনিয়ার জ্বালানি সম্পদের উপর কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার উপর। জ্বালানি সম্পদের উপর কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলা মানে এই সভ্যতার দৈনন্দিন জীবনযাপনই হুমকির মুখে পরে যাওয়া। জ্বালানি সম্পদের রাজনীতি তাই এই মুহুর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে জরুরি রাজনীতি। গত শতাব্দির একেবারে শুরুর দিকেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপূল পরিমাণ তেল এবং অন্যান্য জ্বালানি সম্পদের খোজ পাওয়ার সময় থেকেই অধিকাংশ জ্বালানি সম্পদের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দোসরদের কর্পোরেট এবং রাজনৈতিক আধিপত্ব ও কর্তৃত্ব বহাল আছে, বহাল আছে মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন জ্বালানি সম্পদের ক্ষেত্রগুলোর উপরও। কিন্তু তাতেই পশ্চিমা সভ্যতার কর্পোরেট লোভ আর ভোগবাদের তাবৎ চাহিদা পুরণ হয় কি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিগত শতকের একেবারে শেষের বছরে সেই ১৯৯৯ সালে তৎকালিন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি’র একখানা বক্তব্য তুলে ধরতে চাই। সেই বছর আয়োজিত ইনস্টিটিউট অফ পেট্রোলিয়ামের এক ভোজসভায় চেনি বক্তব্য রাখেন যে -
“বিভিন্ন হিসাবে জানা গেছে যে সারা বিশ্বে তেলের চাহিদা আগত বছর গুলোতে প্রতি বছর শতকরা দুই শতাংশ করে বারবে এবং এর বিপরীতে তেলের রিজার্ভগুলো থেকে উৎপাদন কমতে থাকবে প্রতিবছর শতকরা ৩ শতাংশ হারে। অর্থাৎ, আগামী ২০১০ সালে আমাদের দরকার হবে বর্তমানের চেয়ে ৫০ মিলিয়ন বেরেল বেশি তেল, প্রতিদিন। এই তেল কোথা থেকে আসবে?......দুনিয়ার অনেক জায়গাতেই তেল আছে বটে, তারপরও পৃথিবীর দুই তৃতিয়াংশ তেলের মজুদ এবং সবচেয়ে কমদামি তেলের উৎস মধ্যপ্রাচ্যই এই মুহুর্তে সবচেয়ে আরাধ্য। যদিও তেল কোম্পানিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে আরো বেশি অংশিদারিত্ব চাচ্ছে, কিন্তু অগ্রগতি অত্যন্ত ধির”।
উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর জ্বালানি কর্পোরেশন হালিবার্টনের সিইও। ডিক চেনি এরপরে তেল কর্পোরেশনগুলোকে আরো বেশি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ দেন। সেই উৎসাহের ফলাফল কি হয়েছে তা ইতিহাসই বলে দেয়। বিগত দশকের পুরো সময় জুরেই ইরাক এবং আফগানিস্তানে মার্কিন এবং সহচর রাষ্ট্রসমূহের রাজনৈতিক আগ্রাসনের পেছনে সন্ত্রাসের জুজু যতই দেখাক না কেনো পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা মেশিন, মূল লক্ষ্য যে ছিল এইসব রাষ্ট্রের জ্বালানি সম্পদের উপর পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সেইটা এখন কম বেশি সবার কাছেই পরিস্কার। লিবিয়ার জ্বালানি সম্পদএর ভাগ্যেও হয়তো একি পরিণতি অপেক্ষা করছে।

সাম্প্রতিক কালে জ্বালানি সম্পদের রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে বিপূল পরিমান গ্যাস, কয়লা এবং সম্ভাব্য তেলের মজুদের কারণেই বেশ কিছুদিন ধরেই জ্বালানি সম্পদ নিয়া পশ্চিমা বহুজাতিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। আর এই পশ্চিমা আগ্রসনের দালালি করছে পূজিবাদী উপনিবেশের তল্পিবাহক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শ্রেনীগুলো। ধিরে ধিরে হলেও এই আগ্রাসনের বিষয়ে সচেতন হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ। দেশের জ্বালানি সম্পদ পশ্চিমা প্রভুদের উপহার দিতে সদা ব্যতিব্যস্ত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শ্রেনীগুলোর একেবারে বিপরীত অবস্থান দিনে দিনে পরিস্কার হচ্ছে দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ জনগন এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্ব তরুন সমাজের মাঝে। জাতীয় সম্পদ রক্ষার স্বার্থে তৈরি হচ্ছে নানান ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম। সরকারী গোপনিয়তা, মিথ্যাচার, মূলধারার গণমাধ্যমের শত্রুসূলভ আচরণ ইত্যাদির পরেও ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে বাংলাদেশের জ্বালানি সম্পদের উপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। রূখে দেয়া গেছে বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস পাচার, ফুলবাড়ির কয়লা লুট। ফুলবাড়িতে খেটে খাওয়া গনমানুষ জীবন দিয়েছে, নেত্রকোনার গামছা বিক্রেতা বলছেন, ‘সরকাররে ভোট দিছি, দেশ দেই নাই’, সুনামগঞ্জের কৃষক হাতের কাস্তে বাগিয়ে হুংকার দিচ্ছেন, ‘গ্যাস নিতে কে আইবো? হাসিনা খালেদা বুঝিনা, যেই আইবো কল্লা নামায়া ফালামু’। ব্লগ, ফেসবুক নানান সোস্যাল মিডিয়ায় ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠা বিকল্প মিডিয়া জগতে তরুনরা স্লোগান দিচ্ছে ‘আমার মাটি আমার মা, নাইজেরিয়া হবেনা’, রাজপথে স্লোগান উঠছে, ‘রক্ত দেবো, জীবন দেবো, তেল গ্যাস দেবোনা’। জ্বালানি সম্পদের উপর পশ্চিমা আধিপত্ববাদী রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের এই ক্রমেই জেগে ওঠা আশা জাগানিয়া বটে, তবে এই রাজনীতির চরিত্র, এই রাজনৈতিক লড়াইয়ে আমাদের পক্ষ, বিপক্ষ এবং লক্ষ্য বুঝে নেয়া দরকার আছে। ডিক চেনিরা নিজেদের পক্ষ, বিপক্ষ এবং লক্ষ্য বিষয়ে শতভাগ সচেতন আছে। আমরা আছি কি?
আমাদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দল মত নির্বিশেষে কেনো পশ্চিমা কর্পোরেট আগ্রাসনের দালালি করতে নামছে, দেশের আপামর জনসাধারণের স্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছে, কেনোই বা দেশের জাতীয় সম্পদ রক্ষায় মূল ধারার বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান জনস্বার্থ বিরোধী তার পরিস্কার এবং চুলচেরা বিশ্লেষন করা দরকার। তা না করা গেলে বর্তমান নয়া ঔপনিবেশিক ক্ষমতাকাঠামোয় বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রের জনগণ আর এই রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীর চরিত্রগত পার্থক্য বুঝা আর সেইসাথে শত্রু মিত্র নির্নয় করা, এবং সবশেষে জনস্বার্থের পক্ষ নির্ধারণ করা সম্ভব হবেনা, সফল হবেনা জনস্বার্থের এই রাজনৈতিক লড়াইও।

জ্বালানি সম্পদের পশ্চিমা রাজনীতির ঔপনিবেশিক চরিত্রঃ
বাঙলায় ঔপনিবেশিক শাসনের শুরুর ভাগে দেশীয় শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে নানান বানিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করতো পশ্চিমা ঔপনিবেশিক কোম্পানিগুলো। কোন কোন নওয়াব এমনকি তোষামদিতে খুশি হয়ে বিনা করে বানিজ্য করারও সুযোগ করে দেন পশ্চিমা বেনিয়াদের। আর এইসব অন্যায় সুযোগ সুবিধা পেয়ে একদিকে যেমন বানিজ্যের নামে তারা চালিয়েছে লুটপাট অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দেশীয় বনিকশ্রেণী এবং জাতীয় অর্থনীতি। দেশীয় যেই শাসকরা এধরণের অন্যায় সুযোগ সুবিধা দিতে রাজি হন নাই এবং বাঙলার ব্যাবসা ক্ষেত্রে তাদের অবৈধ কর্তৃত্ব মেনে নেন নাই তাদের সাথেই লড়াই হয়েছে পশ্চিমা বেনিয়াদের। সিরাজ উদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মরণপন যুদ্ধ এই ধরণের বানিজ্য কর্তৃত্ব কেন্দ্র করেই। পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর মিরজাফরের কাছ থেকে যাবতিয় বানিজ্যিক সুযোগ সুবিধা এবং বিপূল পরিমান টাকা উপহার এবং কোলকাতা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসাবে বাগিয়ে নেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোলকাতা যুদ্ধের ক্ষতিপুরণের পরিমান জানা যায় ১৭ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। এতসব অন্যায় বানিজ্য সুবিধা নিয়ে বাঙলার শাসন ক্ষমতা দখল করতে সময় লাগেনাই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির, ১৭৬৪তে পেয়ে যায় বাঙলার দেওয়ানী। কর দেওয়া না, বরং এবার তাদের কর তুলে নেয়ার পালা। ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্রই লুটেরা, কম সময়ে অধিক লাভ তুলে নেয়ার ব্যাবসাই এই শাসনের আসল লক্ষ্য। প্রায় ৫ গুন কর বারিয়ে আর ধানের জমিতে জোর করে কৃষকদের দিয়ে আফিম চাষ করিয়ে ৭৬এর মন্বন্তর তৈরি করেছিল আধুনিক পশ্চিমের প্রতিনিধী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বাঙলার ১ কোটি জনগণ সেই দুর্ভিক্ষে না খেতে পেরে মৃত্যুবরণ করেছিল, যা ছিল পুরো বাঙলার মোট জনসংখ্যার ৩ ভাগের ১ ভাগ।
প্রায় আড়াইশ বছর আগের ঔপনিবেশিক লুটপাটের এই কাহিনী স্মরণ করলাম সাম্প্রতিক কিছু খবরাখবরকে মাথায় রেখেই। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আমাদের এখন বিহবল হয়ে দেখতে হচ্ছে পশ্চিমা বহুজাতিক জ্বালানি কর্পোরেট সংস্থাগুলো স্বাধীন বাংলাদেশে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে। মার্কিন কোম্পানি শেভরন এমনকি আগ্রিম আয়কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে, গাড়ি ছাড়া অন্য কোন কিছু আমদানির জন্যে ৩ শতাংশ হারে কোন অগ্রিম আয়কর দিতে হচ্ছেনা তাদের। শুধু শেভরনই না, কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে কম বেশি সবগুলো জ্বালানি কর্পোরেট সংস্থাই, পাচ্ছেনা শুধু নিজের দেশের কোম্পানি বাপেক্স। এদের হয়ে কর পরিশোধ করছে খোদ পেট্রোবাংলা। ২০০৯ সালে শেভরণের পক্ষ হয়ে ২০০ কোটি টাকার বেশি কর পরিশোধ করেছে পেট্রোবাংলা। কর অবকাশ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবছর ৩০০ কোটি টাকারও বেশি পেট্রোবাংলার কাছ থেকে তুলে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। আর এই সবই সম্ভব হচ্ছে সাম্প্রতিক পিএসসি চুক্তিগুলোর মাধ্যমে। অংশিদারিত্ব চুক্তি না বলে এইসব চুক্তিকে ঔপনিবেশিক গোলামি চুক্তি বললে খুব বেশি ভুল হবে কি?

হিসাব, পরিসংখ্যান ইত্যাদি দিতে গেলে অনেককিছুই দেয়া যায়। এও বলা যায় যে, যেখানে বাপেক্স গ্যাস তুলে পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রি করছে ২৫টাকা দরে সেখানে বিদেশী কোম্পানি গুলো গ্যাস তুলে বিক্রি করছে ২১০টাকা দরে। এ হিসাব মতে বিগত ৭ বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা শ্রেফ পাচার হয়ে গেছে দেশের বাইরে। তারপরেও বাংলাদেশের শাসক শ্রেনীর কাছে বিদেশী কর্পোরেট কোম্পানিগুলোই বেশি প্রিয়। কেনো?

পিএসসি চুক্তিগুলো অনুযায়ী উৎপাদন খরচ তুলে নেয় বিদেশী কোম্পানিগুলো, আর এই উৎপাদন খরচের নাই কোন গাছ পাথর, একের পর এক সংশোধনিতে তা বারতেই থাকে। এমনকি উৎপাদন খরচ তুলতে তুলতে সব গ্যাস খরচ করে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে কেয়ার্ন এনার্জি। মাগুরাছড়ায় অক্সিডেন্টাল ১ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের হিসাব দিয়ে বারবার সংশোধনের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত উৎপাদন খরচ বাবদ আদায় করে নেয় ৪ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ডলার। মাগুরাছড়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটিয়েও এদের কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হয়না, মন্ত্রীকে একটা গাড়ি দিলেই সবকিছু চুকে যায়। এই মন্ত্রীদের কাছে বিদেশী কোম্পানিগুলোই প্রিয়, জনস্বার্থ গোল্লায় যাক। এরা বলে বাংলাদেশের নাকি টাকা নাই, বাপেক্সের নাকি যোগ্যতা নাই। অথচ বাঙ্গুরায় সাব কন্ট্রাক্টর হিসাবে মাত্র ৫৩ লাখ টাকা খরচে কূপ খনন করে দিয়েছে বাপেক্স, আর মূল দায়িত্বে থাকা তাল্লো উৎপাদন খরচের ভেতরে এই খননের জন্যেই খরচ দেখিয়েছে ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। তারপরও আমাদের সরকারগুলোর কাছে বিদেশী কোম্পানিগুলোই অগ্রাধিকার পায়, পাচ্ছে। কেনো?
এইসব কেনোর উত্তর খুজতে হলে আমাদের অবশ্যই জ্বালানী সম্পদের উপর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ঔপনিবেশিক চরিত্র বুঝতে হবে, সেইসাথে বুঝতে হবে বাংলাদেশের শাসক শ্রেনীর নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা চরিত্র।

আজকের ইউরোপিয় সভ্যতা, এর শিল্পন্নত নগর, ভোগবাদী বিলাশবহুল জীবন এইসবই গড়ে উঠেছে উপনিবেশকে কেন্দ্র করে। পূজিবাদ আর উপনিবেশ হাত ধরাধরি করে বড় হয়েছে, বেরে উঠেছে পশ্চিমা সভ্যতা। উপনিবেশ মোটামুটি তিন দিক দিয়ে পশ্চিমা শিল্প বিপ্লবে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেছে –
১। উপনিবেশ থেকে উপনিবেশক পেয়েছে কাঁচামাল।
২। উপনিবেশ থেকে উপনিবেশক পেয়েছে সস্তা শ্রম।
৩। উপনিবেশগুলোতে উপনিবেশক পেয়েছে নিজেদের প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বাজার।

পশ্চিমা প্রথম দুনিয়ার সাথে বাংলাদেশের মতো তথাকথিত তৃতীয় দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখন পর্যন্ত এই কাঠামো ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। এক কালে মশলা আর মসলিন কাপড়ে ধনী বাংলাদেশকে গোলাম বানিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে ব্রিটিশ উপনিবেশ। শুরুতে দেশীয় মশলা শিল্পের উপরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, দেশীয় পোষাক শিল্প ধ্বংস করে দেয়া, তারপরে বিরাট লাভের আফিম ব্যবসার জন্যে জোর করে আমাদের মাটি আর কৃষকের স্বস্তা শ্রম ব্যবহার করা, ইউরোপের শিল্প বিকাশের জন্যে দরকারি কাঁচামাল ‘নীল’ আমাদের মাটিতে আমাদের কৃষকদের দিয়ে চাষ করিয়ে নেয়া এবং সবশেষে নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসাবে আমাদের দেশকেই ব্যবহার করে ব্রিটিশরা দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হতে পেরেছিল। আমাদের রক্ত চুষেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বেরে উঠেছিল, আমাদের রক্ত চুষেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের টিকে থাকতে হবে। আর তাই আমার দেশের খনিজ সম্পদ আমার দেশের শ্রমিকদের দিয়ে স্বস্তায় তুলে নিয়ে বিপূল পরিমান লাভে আবার আমার দেশের বাজারেই তা বিক্রি করছে শেভরন, তাল্লো, অক্সিডেন্টালএর মতো নয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলো। আর সেই কাতারে যুক্ত হয়ে আরো বড় ধরণের লুটপাটের পায়তারা করছে কনকো ফিলিপস, এশিয়া এনার্জির মতো কোম্পানিগুলো। আর এদের যাবতিয় লুটপাটে সামান্য ভাগের বিনিময়ে জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে উঠেপরে লেগেছে আমাদের তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসক শ্রেনী। পশ্চিমা লুটপাটের সহযোগী এই নয়া মিরজাফর শ্রেণীর চরিত্র আমাদের উদঘাটন করতে হবে, বুঝে নিতে হবে নয়া উপনিবেশের সাথে এর খায় খাতিরের পেছনের কাহিনী।

নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গাঃ

বাংলাদেশের যেইসব রাজনীতিবিদ আর আমলা শ্রেণী আজকে জাতীয় স্বার্থের তোয়াক্কা না করে, দেশের সাধারণ জনগণের লাভ লোকসানের হিসাব না করে জাতীয় সম্পদ লুটপাট হতে দিচ্ছেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার হতে দিচ্ছেন, আর যেইসব বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এইসব লুটপাটকে বৈধ করার জন্যে ‘বাংলাদেশের জন্যে নিজে নিজে গ্যাস তোলা লাভজনক না’, ‘সমুদ্রের গ্যাস তোলা আর উড়জাহাজ তৈরি করা একই রকম’ ইত্যাদি ডিসকোর্স তৈরি করার চেষ্টা করছেন, এদেরকে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে খুব বেশি কড়া সমালোচনার মুখোমুখি না হতে হলেও পথে ঘাটে, ব্লগে, ফেসবুকে তরুন প্রজন্ম নানান ব্লগ পোস্ট, স্ট্যাটাস আর পোস্টারে এদের গালি দিচ্ছে ‘দালাল’ , ‘কমিশনভোগী’ ইত্যাদি বলে। এই ‘দালাল’ শব্দটা কি শুধুই গালি? এর কি কোন তাত্ত্বিক অবস্থান নাই? আছে বৈকি। বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহী কেনো মার্কিন মরিয়ার্টির নির্দেশ মোতাবেক কনকো ফিলিপসএর হাতে সমুদ্রের গ্যাস তুলে দেন, ম তামিমএর মতো বুদ্ধিজীবী কেনো কনকো ফিলিপস এর সাথে পিএসসি চুক্তির পক্ষে সাফাই গেয়ে প্রথম আলোয় লেখেন, আর সরকারদলীয় পাতি নেতারাও কেনো “সমুদ্রের গ্যাস ফেলে রেখে লাভ কি? ফেলে রাখলে তো পঁচে নষ্ট হবে” জাতীয় অলিক রূপকথা শোনান সেইটা বুঝার জন্যে এই ‘দালাল’ শব্দের ঐতিহাসিক এবং তাত্ত্বিক গুরুত্ব বুঝতে হবে।
‘নয়া উপনিবেশ’ শব্দটার প্রথম ব্যবহার করেন স্বাধীন ঘানার প্রথম প্রেসিডেন্ট কাওমে নক্রুমা। নক্রুমা তার নিও কলোনিয়ালিজমঃ দা লাস্ট স্টেজ অব ইম্পেরিয়ালিজম (১৯৬৫) পুস্তকে স্বাধীন ঘানার উপর প্রাক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলার ক্ষমতার বলয় এবং কর্তৃত্ব করার প্রক্রিয়াগুলা আলোচনা করেন। তিনি দাবি করেন যে খাতা কলমে স্বাধীনতা অর্জন করার পরও বিভিন্ন আর্থ সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সংস্থার মাধ্যমে প্রাক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলা ঘানার উপর কর্তৃত্ব বহাল রাখতে সচেষ্ট ছিল। নক্রুমা এই পদ্ধতির নাম দেন ‘নয়া উপনিবেশ’। নয়া উপনিবেশের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সত্ত্বেও এর ক্ষমতা সম্বন্ধে নক্রুমার পুরা ধারণা ছিলনা, ছিলনা এর কর্মপদ্ধতি এবং খোদ ঘানার ভেতরেই এর দালাল শ্রেণী এবং দালালির কলকব্জা সম্বন্ধে। ফলস্বরূপ এই পুস্তক প্রকাশিত হওয়ার মাত্র ১ বছর পরই ১৯৬৬ সালে সিআইএর মদদে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত এবং দেশান্তরি হন। ব্রিটিশ উপনিবেশ বিরোধী ঘানার স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা নক্রুমা মৃত্যুবরণ করেন বিদেশের মাটিতে।

তবে নক্রুমারই সমসাময়িক, ফরাসি উপনিবেশ মার্টিনিকে জন্ম নেয়া এবং আলজেরিয়ার ফরাসি উপনিবেশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামের বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ফ্রাঞ্জ ফানো নয়া উপনিবেশ এবং এর দেশীয় দালাল শ্রেণীর চরিত্র উদঘাটন করেন খোলামেলা ভাবে, সেইসাথে উপনিবেশ থেকে খাতা কলমে স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ভবিষ্যত সম্বন্ধে কিছু ভবিষ্যতবানী করেন। বাংলাদেশের বর্তমান সময়কার ‘দালাল’ শ্রেণীর চরিত্র ভালোভাবে বুঝতে গেলে এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দুরবস্থা বুঝতে গেলে ফ্রাঞ্জ ফানোর এইসব বিশ্লেষন আর ভবিষ্যতবানীর কোন বিকল্প নাই। বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, আমলা শ্রেণী এবং তাদের দোসর বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কাজ কারবারগুলা ঠিক সেইরকমই, যেইরকম ভবিষ্যতবানী করে গেছেন ফানো তার ‘রেচেড অফ দা আর্থ’ পুস্তকে, আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে। এই পুস্তকটির ‘জগতের লাঞ্চিত-ভাগ্যাহত’ নামের একটি পুরনো এবং ‘জগতের লাঞ্চিত’ নামের একটি নতুন বাংলা সংস্করণ পাওয়া যায়, সবাইকে পড়ে দেখার আনুরোধ রইল।

ফানো তার রেচেড অফ দি আর্থ পুস্তকে উপনিবেশ থেকে খাতা কলমে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণীকে অভিহিত করেন ‘জাতীয় বুর্জোয়া’ নামে। ফানো’র এই জাতীয় বুর্জোয়া আর মার্ক্সিয় পাঠের জাতীয় বুর্জয়ায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। মার্ক্সিয় তত্ত্বে আলোচিত জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী মূলত জাতীয় পূজি, জাতীয় শিল্পায়ন এবং জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে নেতৃত্ব প্রদানকারী শ্রেণী। পূজিবাদী দুনিয়ায় এরাই রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়ক কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ভিলেন। কিন্তু মার্ক্সিয় পাঠে উপনিবেশক রাষ্ট্রের জাতীয় বুর্জোয়া এবং উপনিবেশিত রাষ্ট্রের জাতীয় বুর্জোয়ার কোন পার্থক্য নির্নয় করা হয় নাই। এই পার্থক্যটা করেছেন ফ্রাঞ্জ ফানো। উপনিবেশিত রাষ্ট্র এবং উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়া নয়া উপনিবেশের কর্তৃত্বের মুঠোয় থাকা রাষ্ট্রগুলোর নেতৃস্থানীয় জাতীয় বুর্জোয়াদের চরিত্র উপনিবেশক রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় বুর্জোয়ার চেয়ে বহু দিক থেকেই ভিন্ন, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরাপুরি বিপরীত। অবশ্য এই ভিন্নতা এবং বৈপরিত্ব এই দুই জাতীয় বুর্জোয়ার মধ্যকার নয়া ঔপনিবেশিক ক্ষমতাকাঠামোর অন্তর্গত সম্পর্কের কারনেই, এই সম্পর্ক পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের, সমস্বার্থের।
ফানো দাবি করেন যে, পশ্চিমা উপনিবেশক রাষ্ট্রের জাতীয় বুর্জোয়াদের মতো উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্ত এইসব রাষ্ট্রের জাতীয় বুর্জোয়ারা উৎপাদনশীল অর্থনীতির নেতৃত্ব দেয় না। জাতীয় শিল্পায়নের বদলে এদের মূল ব্যাবসা হলো ঠিকাদারি, কমিশন এজেন্সি, মধ্যসত্বভোগী এক কথায় দালালী। দ্রুত মুনাফা তুলে সম্পদের পাহার গড়া আর যতটুকু সম্ভব পশ্চিমা ভোগবাদী জীবন যাপনের চেষ্টা করাই এদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে কোন মানসম্পন্ন উৎপাদনমুখি ব্যবসা বা পেশায় এদের আগ্রহ নাই। বরং নানান উপায়ে নিজের দেশকে পশ্চিমা অর্থনীতির বাজারে পরিণত করাই এদের যাবতিয় কাজ কামের মধ্যে প্রধান। আর এই প্রক্রিয়ায় পশ্চিমের দালালি করে কমিশন কামিয়ে দ্রুত বড়লোক হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা এদের মজ্জাগত। এই দালাল শ্রেণীর রাজনৈতিক শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে এই পুস্তকের ‘দি পিটফল অব ন্যাশনাল কনশাসনেস’ অধ্যায়ে ফানো বলেন-

‘এইসব দরিদ্র অনুন্নত দেশে সম্পদের পাহাড়ের পাশেই থাকে চরম দারিদ্রও...পুলিশ এবং সেনাবাহিনী সেখানে শাসকশ্রেণীর খুঁটি...বাৎসরিক ঋণ প্রদানের মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয় বিদেশীরা...মন্ত্রীরা দিনদিন ধনী হয়, তাদের বউয়েরা হয়ে ওঠে এক একজন ফুলবিবি। সংসদ সদস্যরা তাদের বাড়িগুলোকে প্রাসাদ বানিয়ে ফেলে। সাধারণ সেপাই থেকে শুরু করে কাস্টম কর্মকর্তা পর্যন্ত এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি দুর্নীতির বিশাল মিছিলে শরীক নন’।

এই জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী, এই দালাল শ্রেণী নিজে থেকে কিছু তৈরি করেনা, করতে পারেনা। দেশ শাসন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, আইন, গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, উন্নয়ন সবকিছুতেই এরা শ্রেফ অনুকরণ করে যায় প্রাক্তন উপনিবেশক প্রভুদের। এরা নিজেদেরকে পশ্চিমা বুর্জোয়াদের পরিচয়েই পরিচিত করতে চায়, আর তাই উপনিবেশক বুর্জোয়াদের দেখানো পথেই এরা হাটে। ফলস্বরূপ টিকে থাকে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা, আইন, শাসন পদ্ধতি ইত্যাদি, টিকে থাকে খোদ উপনিবেশ। এই দালালদের চরিত্র বুঝার জন্যে ‘পিটফল অব ন্যাশনাল কনশাসনেস’ অধ্যায়ের আরো কিছু লাইন তুলে ধরছি-

‘জাতীয় আয়ের সাথে তুলনায় যে বিশাল মুনফা এরা হাতিয়ে নেয়, সেই মুনাফা এরা পুনর্বিনিয়োগ করেনা...মাঝে মাঝে, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরপরই এরা নিজেদের দেশের মাটি থেকে কামিয়ে নেয়া টাকা বিদেশী ব্যাংকএ বিনিয়োগ করার নামে পাচার করে। এর বাইরে বিপূল পরিমান টাকা এরা খরচ করে গাড়ি, বাংলো থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশের বুর্জোয়া হিসাবে নিজেকে জাহির করার জন্যে যা যা লাগে সেইসবের পেছনে’। (চলবে)

১৯৬১ সালে ঠিক আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে প্রকাশিত এই পুস্তকের বর্ননা বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতির সাথে এমন খাপে খাপ মিলে যাওয়া কোন অলৌকিক ঘটনা না। উপনিবেশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামি ফ্রাঞ্জ ফানো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন যে উপনিবেশ বিরোধী সাধীনতা সংগ্রাম বিফল হতে যাচ্ছে, বেহাত হতে যাচ্ছে জাতীয় বিপ্লব। শুধু বিদেশী লর্ড, ভাইসরয় আর সেনাবাহিনী বিদায় নিলেই উপনিবেশ বিদায় হয়না, শত শত বৎসরের ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের মনজগতে জায়গা করে নেয়া উপনিবেশের উৎখাত করতে হয়, উপনিবেশের আধুনিকায়ন থেকে তৈরি হওয়া শোষনকে মোকাবেলা করতে হয় নিজ সংস্কৃতি থেকে মাল মশলা দিয়ে। আর তা না করা হলে প্রাক উপনিবেশিক প্রতিটা রাষ্ট্রে যে নয়া উপনিবেশিক বাস্তবতা তৈরি হয় তাতে নাইজেরিয়া, ঘানা, বাংলাদেশ, মার্টিনিক অথবা আলজেরিয়ার মতো আলাদা আলাদা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বড় ধরণের কোন ভিন্নতা দেখা যায়না। ফানো এই কারনে ঘোষনা করেন যে শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক শাসককে দেশ ছাড়া করলেই হবেনা, সেইসাথে উপরে ফেলতে হবে নিজের মন মগজ থেকে ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারনা, উচ্ছেদ করতে হবে ঔপনিবেশিক শিক্ষা, প্রশাসন ও আইন ব্যবস্থা। সর্বোপরি ঔপনিবেশিক জ্ঞান তত্ত্বের যে ধারাবাহিকতা তাকেই সমূলে ধ্বংস করতে হবে। এই ঔপনিবেশিক জ্ঞান তত্ত্বই আমাদের সেখায় যে সাদা ইউরোপিয়রা জ্ঞান, গরিমা, যোগ্যতা সবকিছুতেই আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই জ্ঞানতত্ত্ব এককালে আমাদের শিখিয়েছে আমরা ছোটলোক, নিজেরা নিজেদের শাসন করতে পারিনা, সাদা প্রভুদের শাসনে বেঁচে থাকা ছাড়া আমাদের গতি নাই। এই জ্ঞানতত্ত্বই আজকে আমাদের শেক্ষাচ্ছে যে আমরা ছোটলক, নিজেদের খনিজ সম্পদ নিজেরা তুলতে পারিনা, সাদা প্রভুদের হাতে এই খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা ছাড়া আমাদের আর কোন গতি নাই।
কিন্তু আসল সমস্যা হলো উপনিবেশকে উৎখাত তথা বিউপনেবিশায়নের প্রক্রিয়া নিয়া। ঔপনিবেশিক প্রভুকে আমাদের ভুমি থেকে আমরা উৎখাত করেছি, তাও টিকে আছে উপনিবেশ। এখন এর দালাল শ্রেণীকে উচ্ছেদ করলেই কি উপনিবেশ উৎখাত হয়ে যাবে? এই দালাল শ্রেণীর ব্যপ্তি কতটুকু? এই দালাল শ্রেণীর বাইরে গণমানুষই কারা? এই দালাল শ্রেণীকে উচ্ছেদ করলেই যে নতুন দালাল শ্রেণী গজিয়ে উঠবেনা সেটাই বা নিশ্চিত করা যায় কোন প্রক্রিয়ায়? এই দালাল শ্রেণী কি নিজেই নয়া উপনিবেশের প্রক্রিয়াকে টিকিয়ে রাখে নাকি এরা নিজেরাই নয়া উপনিবেশের প্রক্রিয়ার ফশল? এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়াই সম্ভবত বাংলাদেশী উত্তর ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক ফয়েজ আলম আমাদের সামনে হাজির করেছেন ‘নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা’ নামক শব্দগুচ্ছ। ফয়েজ আলম তার ‘ভাষা ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে’ নামক পুস্তকের ‘নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা’ নামক প্রবন্ধে দালাল অথবা জাতীয় বুর্জোয়া শব্দ দিয়া নয়া উপনিবেশের তল্পিবাহক দেশীয় শ্রেণীকে চিহ্নিত করার সাথে সাথে ব্যবহার করেছেন ‘নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা’ নামক শব্দগুচ্ছ। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বাড়ি তৈরির সময় আগে সেই বাড়ির একটা কাঠামো তৈরি করা হয় কাঠ দিয়ে, এই কাঠের কাঠামোর উপরেই পরে গড়ে উঠে বাড়ি। এই কাঠামোকেই বলা হয় কড়ি-বর্গা। ‘নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা’ বলতে তাই বুঝায় নয়া উপনিবেশের প্রাসাদের মূল কাঠামোটুকু। লুটেরা জাতীয় বুর্জোয়াদের একটা শ্রেণীর বদলে কাঠামো হিসাবে ধরে নিলে আমাদের বাড়তি কোন সুবিধা হয় কি? হয় বৈকি। এই লুটেরা বুর্জোয়ারা পুরোপুরিভাবে কোন একটা শ্রেণীর অংশ না, যদিও ঠিক ঔপনিবেশিক প্রভুর শ্রেণীতে উত্তোরণের সাধ আহ্লাদ এদের কম বেশি সবারই আছে। এরা একক কোন শ্রেণী না, বরং এমন একটা কাঠামো যেই কাঠামো ঔপনিবেশিক শিক্ষা, আইন, প্রশাসন ইত্যাদি টিকিয়ে রেখে খোদ নয়া উপনিবেশকেই টিকিয়ে রাখে। আর ঔপনিবেশিক শিক্ষা, আইন, প্রশাসন ইত্যাদির মাধ্যমে এই কাঠামো টিকিয়ে রাখার নতুন সৈনিকরা তৈড়ি হয়। আলাদা ভাবে কোন শ্রেণীকে উচ্ছেদ করলেই যে তাই উপনিবেশের উচ্ছেদ হবে এমনটা আশা করার উপায় নাই, পুরনো শোষকের জায়গা এসে দখল করবে নতুন শোষক, যেমনটা আগেও হয়েছে। ‘নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা’ নামক এই কাঠামোকেই তাই আমাদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে, আর তা করতে হলে ঔপনিবেশিক শিক্ষা, আইন প্রশাসন সর্বোপরি আমাদের চিন্তা জগৎ থেকে ঔপনিবেশিক জ্ঞান ভাষ্যকেই উৎখাত করতে হবে। তা না হলে আজকের দেশপ্রেমিক নেতাই আগামি দিনে আবির্ভুত হবেন শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধি হয়ে। তবে এই কাঠামোকে ধ্বংস করতে হলে আগে বুঝতে হবে এই কাঠামোর ঐতিহাসিক বিকাশ প্রক্রিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১২ রাত ১:০৮
১৯টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×