গত এক বছর ধরে নানাবিধ আলোচনার মধ্য দিয়ে পুরান ঢাকার কয়েকজন বন্ধু বান্দরবানের গহীনে যাওয়ার মহাপরিকল্পনা করে। যাওয়ার আগে হিমালয় বিজয়ী মুসা ইব্রাহীমের যোগ্য শিষ্য সুহৃদ মেহেদী হাসান তালাতের নেতৃত্বে ট্র্র্যাকিং এর বিশেষ প্রস্ততি হিসাবে সবাই তিন মাস ধূপখোলার মাঠে ব্যায়াম করে এবং তারই নেতৃত্বে গত ২৪ শে জানুয়ারী রাতে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে সবাই যাত্রা করে। প্রকৃতির পাহাড়-ঝরনা-ছড়া-মেঘ-কুয়াশা-নদী-ক্ষূদ্র নৃগোষ্ঠী আর রহস্যময় পাহাড় ঘেরা দীঘির অপার সৌন্দর্য হল বান্দরবান। গহীন পাহাড় ঘেরা অরণ্যের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য নানা উপকরণ নিয়ে পাঁচ সদস্যের সুহৃদ, ২৫ তারিখ সকালে বন্ধু হোসেন এর বাসায় প্রাতঃক্রিয়া শেষ করে হাফেজ ঘোনায় রোমা বাস স্ট্যান্ডে চলে আসে।
তারপর লোকার গাড়িতে চড়ে রোমা বাজারের পথে নতুন ব্রীজের কাছে ব্রীকফিল্টে নেমে আবার চান্দের গাড়ীতে চড়ে ধূলো-বালি মেখে মুরংগো বাজার হয়ে মুরং, খুরমী উপজাতিদের বসতি আর দু’পাশে পাহাড় আর গিরিখাদ দেখতে দেখতে আঁকা-বাঁকা-উঁচু-নিচু পিচ ঢালা ১০-১২ ফুটের প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে মাঝে-মধ্যে গাড়ি কাত হয়ে পড়ি পড়ি অবস্থায় আজরাইলের সাথে যুদ্ধ করে গাড়ি চলছে। মনে করেছিলাম, বাস রোমা বাজারে এসে থামবে। লোকাল চান্দের গাড়িতে উঠে সবাই ভীত ও বিরক্ত ছিল। গত বছর কেওকাড়াডং বিজয়ে কৈক্ষংছড়ি নেমে সাঙ্গু নদী দিয়ে রোমা বাজারে এসেছিলাম এবং সেটাই ভালো ছিল। তবে এবার সাঙ্গু নদীতে পানি খুবই কম। ছোট ছোট বাচ্চারা হাঁটু জলে নেমে বালু জমিয়ে টিলার মত স্তম্ব বানাচ্ছে। এটা দেখে আমার ছোট বেলার নদীর তীরে জল-বালু খেলার স্মৃতি মনে পড়ল। লম্বা লম্বা নৌকা, বাঁশ এর বড় বড় ভেলা উপজাতি পুরুষরা কোথা যেন টেনে নিয়ে চলেছে। জলের নিচে পাথর এর সাথে বাঁধা পেয়ে জলে ভাসমান ভেলা, নৌকা থেমে থেমে চলছে।
সাঙ্গু নদীর জল চিরকাল একদিকে স্রোতমান , ময়লা জমে না। কোন কিছু পঁচে না। তাই সবাই এ জল দিয়ে জীবনের ধারা রচনা করে চলেছে। অবশ্য যেখানে ঝরণা আছে, সেখানকার বাসিন্দারা ঝরণার জল সব কাজে ব্যবহার করে। বাঙ্গালী ও উপজাতি সবাই হাঁটু জলডুবা জলে নৌকা, বাঁশ, স্নান নিয়ে যেন গদ্য কবিতা রচনা করে চলেছে। পাহাড় চেয়ে চেয়ে সব দেখছে। পাহাড়ের উপরে, সাঙ্গুর তীর ঘেঁষে ছোট ছোট টং ঘর দেখা যায়। কোনটা স্থায়ী বসতি কোনটা জুম ফসল তদারকীর জন্য গড়ে উঠেছে। আমাদের অবাক লাগে ঐ জুম টং ঘরে শুধু একটা মানুষ ছয় মাস বা এক বছর পর্যন্ত একাকী বাস করে। পাহাড়, নদী, মানুষ, কুয়াশা ঘেরা প্রকৃতি এত সুন্দর! মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা কি পথ হারিয়ে স্বর্গে চলে এসেছি। ১১টায় রোমা বাজারে এসে সবাই নামলাম। যাই হোক, বরাবরের মত এখানে আসার পরই মনে হয়, এটা আমার দেশ নয়। কারণ দুপুরের খাবার পরই বিজিবি’র কাছে অনুমতির যেতে হয়। আনুসাঙ্গিক নিয়ম মেনে হোসেনের ঠিক করা গাইডকে নিয়ে বগালেক এর পথে যাত্রা শুরু করলাম।
নানা গাছ-গাছালী, বিশেষ করে লম্বা লম্বা ঘাস জাতীয় গাছের ফাঁকে ফাঁকে সরু ঢেউ খেলানো বন্ধুর পথে পিঠে মালসমেত দশ কেজির ব্যাগ নিয়ে বগালেকের পাহাড়ে উঠছি। বন্য কাশফুলের দুই সারি পথে চলতে মনে হল, দু’পাশে ফুল নিয়ে মানুষ যেন দাঁড়িয়ে আমাকে ফুলেল শুভেচ্ছা দিচ্ছে, আমি যেন হোমড়া-চোমড়া কিছু একটা। এক ঘন্টা ধরে একা একা হাঁটছি। খুব ক্লান্ত, পা আর চলতে চায় না। সবার আগে আমি, অথচ সবার আগে থাকার কথা গাইড আর মেহেদীর । আমাদের ব্ল্যাক বেল্টধারী শওকতের অবস্থা খারাপ। তাই ওকে সাহায্য করার জন্য দু’জনেই পিছনে। আমার ডান পাশে গিড়িখাত, অনেক ঢালু আর নিচু, মাঝে মাঝে বাঁশঝাড়। শীতের প্রকৃতি বলে পাতা শূণ্য অনেক গাছপালা দেখা যায়। কুয়াশা ঘেরা দূরের পাহাড় আর টিলা। ঢেউ খেলানো পাহাড় আর টিলা যেন আকাশে হেলান দিয়ে আছে। যেন, কোন ছবিকরের আঁকা পাহাড়ী চিত্র । নিজের অজান্তে রবীন্দ্র সংগীত বেজে উঠল মনে, গাইতে শুরু করলাম, আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় পাহাড় ঘুমায় ঐ...। কিভাবে এ পাহাড়গুলো সৃষ্টি হল, খুব জানতে ইচ্ছা হয়। শওকত আর পুলিশ সাজেন্ট এক বাক্যে বলে দেয়, আল্লা বানাইছে, কিন্তু ওদের কথায় আমি স্বস্তি পাই না। আমি প্রাগঐতিহাসিক কাহিনী আর ভূতত্ত্ব জানতে চাই। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে কাঁটা গাছের গোড়া, পাহাড় কাঁটার চিহৃ--এবারের ভ্রমনে নির্বিচারে পাহাড় আর গাছ কাঁটার দৃশ্য দেখেছি। আগামী বছর যদি এবারের তোলা ছবির সাথে মিলিয়ে দেখি, হয়তো অবাক হতে হবে। এক বগালেক ও আশেপাশে যেভাবে পাহাড়, গাছ কেঁটে তথা প্রকৃতি ধ্বংশ করে বসতি আর জুম চাষ করা হচেছ তাতে আগামী দশ বছরে বগালেকের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
২৭০০ ফুট উপরে উঠে দীঘিতে গোসল সেরে বিকাল-গোধূলী-সন্ধ্যা-পূর্ণিমার রাত এ পাহাড় ঘেরা লেকের রূপ উপভোগ করে সিয়াম দিদির বিখ্যাত হোটেলে ডিম ঝোল,আলু ভর্তা, ডাল, পাহাড়ী শিম বিচির তরকারী দিয়ে জুম চালের আঠালো ভাত খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। গত বছর উত্তরের কটেজে রাত্রি যাপন করেছিলাম। এবারও সেই বাঁশ, বাঁশের তৈরী বেঁড়া, দরজা, ছাদ, পাটাতন আর বেত এর দড়ি দিয়ে নিপূণ উপজাতীয় প্রাকৃতিক অতিথি নিবাস এ মহাক্লান্তির ঘুম এর রাজ্যে হারিয়ে গেলাম বিছানা যাবার দশ পনের মিনিটের মধ্যেই।
২৬ তারিখ সকালে কেওক্রাড়াডং এর পথে ঝিরি পথ দিয়ে শুরু হল পদ যাত্রা। চিংড়ি ঝরণা থেকে পানি নিয়ে চলতে চলতে দার্জিলিং পাড়ার মাইদুং দিদির দোকানে চা পান করে দুপুর দেড়টায় কেওকারাডং এ পোঁছলাম। এই পাহাড়ের মালিক লালা মামার নতুন করে গড়া ঘরের দোতলার বারান্দায় গত বছরের টাঙ্গিয়ে রাখা ‘ কেওকাড়াডং-এ আমরা সুহৃদ’-- ব্যানার দেখে আমরা বিস্মিত!
লালা মামার এখানে খেয়ে দায়িত্বশীল গাইড নুরুল ইসলাম এর সাথে আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দূর্গম তাজিংডং এর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বারবার পরিবারের কথা মনে হয়েছে। সবাই বিধাতাকে স্মরণ করে গাইড নুরু ভাইয়ের পিছে পিছে ছয় থেকে দশ কেজির ব্যাগ পিঠে নিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে এক থেকে দেড় হাত ঝরা পাতা বিছানো পথে, কখনো বিস্ময়কর গিড়িখাদ, কখনো উঁচু ঢালু পথ পাড়ি দিয়ে কোন মতে প্রাণটাকে হাতে নিয়ে পাঁচটা তিরিশে বম উপজাতি পাড়া, বাকত্লাই এসে দেখি, সবাই সন্ধ্যা বেলা রাতের খাবার খাচ্ছে। নুরু ভাই মুন লাল বম এর বাসায় আমাদের রাতে থাকার ব্যবস্থা করলেন এবং ওদের ঘরের ভিতরে রাখা চুলায় রান্না শুরু করে দিলেন। পাড়া থেকে খানিকটা দূরের এক ছড়ায় হাত মুখ ধূতে গিয়ে পিছলা পথে মেহেদী পড়ে গিয়ে বাম হাতের কব্জিতে বেশ আঘাত পেল। বম পাড়ার সবাই ব্যাপ্টিস্ট খ্রীস্টান মতবালম্বী। গীর্জায় গিয়ে মেহেদী আর আমি তাদের ফাদারের কথা শুনছি। কিন্তু ওদের কথা আর ইংরেজী অক্ষরে লেখা ওদের ভাষার বই দেখে কিছুই বুঝলাম না। চলে এলাম ঘরে। আট ঘন্টা হাঁটার ক্লান্তি শেষে গভীর ঘুম। তারপর সকালের অভিজ্ঞতা-যা জীবনে কোনদিন ভুলব না। শুরুতে আমিই টয়লেটে গেলাম। গৃহপালিত শূকর আর মোরগ-মুরগী-ছানারা আমার সাথে হাঁটা শুরু করল। উপজাতিদের বাথরুমের সামনে কোন পর্দা থাকে না। এর চেয়ে আমাদের গ্রামের খাল পাড়ও ভাল। শুকরদের যন্ত্রণায় একবার বাথরুমে যাই, আরেকবার নামি। শেষ পর্যন্ত বাথরুমে ইয়ে শুরু করতেই শুকররা চেটেপুটে সব খেয়ে ফেলল। প্রকৃতির এই বাথরুমে এখানে এটাই স্বাভাবিক।
যাই হোক, ২৭ তারিখে শুরু হল ২য় দিনের পদ যাত্রা। আবার সেই ভয়ঙ্কর পথ চলা। দুই পাশের পাহাড়ি ঘাসের ঢেউ খেলানো সরু পথে শুধুই নামছি। শেষ আর হতে চায় না। হঠাৎ কোনো লোকালয় দেখতে পেলে ক্লান্তি কমে আসে। নিজেদের কাছে বাঁশের লাঠি থাকা সত্বেও বাঁশ, দড়ি, পাহাড়ি লতা, গাছের শিকড়--যা পেয়েছি তাই ধরে নানা চড়াই-উৎরাই পার হযেছি। শওকত আর জাহাঙ্গিরের জন্য বারবার থামতে হয়েছে। বাকত্লাই পাড়া থেকেই জাহাঙ্গিরের জ্বর, সেই জ্বর নিয়ে মনের জোরে প্রকৃতির টানে অতি কষ্টে শওকতের সঙ্গী হয়েই তাকে পেছনে থাকতে হয়েছে। পুলিশ সার্জেন্ট জামান এ গ্রেডের সার্ভিস দিয়ে মেহেদীর সাথে সবার আগে আগে চলেছে । আর আমি মাঝে এতিমের মত শূন্য পাহাড়ী পথে একাকী চলেছি। গাইড প্রায় সব সময় দুর্বলের সঙ্গী হয়েই পিছনে থেকেছে।
হুররে! তাজিংডং পাহাড়ে চলে এসেছি। কিন্তু উপরে উঠব কিভাবে? এখানে কেওকাড়াডং এর মত সিঁড়ি নেই। আমিই শুরুতে উঠতে শুরু করলাম। অতি কষ্টে সবাই উঠে চিৎকার শুরু করলাম। এখানে সামান্য কিছু জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে। চারদিকে গভীর জঙ্গল। কেওকাড়াডং পাহাড়ের এর মত এখানে কোন নেম প্লেট নেই। এখান থেকে শাখা হাফং পাহাড়, দূরের উপজাতি গ্রাম দেখা যায়। বর্ষায় এলে মেঘ ছোঁয়া যেত। ব্যানার নিয়ে ছবি তুলে নামতে গিয়ে কেউ এগোচ্ছে না। অগত্যা মেহেদীর কাছে রাখা দড়ি বেয়ে নামলাম। আবার শেরখর পাড়া অভিমুখে যাত্রা। এ পথ আগের পথের চেয়ে আরো খারাপ। মাঝে মাঝে ছড়া পেলে হাত মুখ ধুই, বোতলে পানি ভরি। মাঝে মাঝে গরু,গয়াল, শুকরের চিহৃ দেখা যায়। ভাবি, কিভাবে এই সব চতুষ্পদ প্রাণিগুলো এ খাড়াই-উৎরাই পথ পাড়ি দেয়? সন্ধ্যা বেলা শেরখর পাড়া এসে পৌঁছলাম। এটাও বম পাড়া। এ পাড়ার এক দাদুর বাসায় রাত যাপন করে পরদিন ২৮ তারিখ থানচির উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম। মুরংদের নোংরা বডিং বা রইসপাড়া পার হয়ে কাচ বাদামের বাগান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা ঝিরি পথ পেলাম। যেখানে বসতি তার আশেপাশে পানির ব্যবস্থা থাকবেই। কুলিরা এই গিড়িখাত পেরিয়ে কতটা রিক্স নিয়ে, কিভাবে গাছের গুড়ি কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যায়, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। নেতার নির্দেশ ছিল যে, পলিথিন জাতীয় জিনিস ডাস্টবিন ছাড়া কোথাও ফেলা যাবে না। একটা তিরিশে থানছি পৌঁছে ডাস্টবিনে ময়লা ফেললাম। শওকত, জাহাঙ্গীর আর আমার খুব খারাপ লাগছে। ছয় দিনের ট্র্যাকিং এর এখানেই সমাপ্তি টানতে চাইলাম। নেতা মেহেদী আর জামানের কারণে ইতি টানা গেল না। নতুন গাইড নিয়ে থানচি থেকে রেমাক্রি বাজার হয়ে নাফাকুম দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। শওকত স্বার্থপরের মত অনেকটা পালিয়ে বান্দরবান চলে গেল।
চার জনের টিম, ট্রলার নিয়ে স্রোতের বিপরীতে তিন্দু বাজার, রাজার পাথর হয়ে চার ঘন্টায় রেমাক্রি বাজারে এলাম। গেস্ট হাউজে রাত কাটিয়ে ২৯ তারিখে সকালে নাফাকুম যাত্রা। এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। স্থানীয় মারমা উপজাতির অংশু গাইডের সাথে স্রোতের মধ্য দিয়ে পাথর বিছানো পথে সাঙ্গু নদীর বাঁক কয়েক বার পাড় হয়ে প্রায় তিন ঘন্টায় নাফাকুম-এ এলাম। নাফাকুম ফলস্ দেখে গত পাঁচ দিনের ক্লান্তি যেন, শেষ হয়ে গেল। সাঙ্গু নদীর বুকে এত সুন্দর ঝরণা! ছবি তুলতে তুলতে সবাই ক্লান্ত হয়ে গেলাম। গেস্ট হাউজে ফিরে ফ্রেশ হয়ে মারমা উপজাতির হোটেলে খেয়ে থানচির পথে স্রোতের অনুকুলে তিন ঘন্টায় ফিরে এলাম। ৩০ তারিখ রাতে রেস্ট হাউজে একরাত কাটিয়ে থানচির গাইড মামুন তথা থানচির টুরিস্ট ব্যবসার তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে পরদিন ৩১ তারিখে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে লম্বা ট্র্যাকিং এর সমাপ্তি টানলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:৫৮