এক যুগ আগের প্রজন্ম যেখানে মাঠে খেলাধুলা করে সময় কাটিয়েছিল, সেখানে এখনকার প্রজন্ম কাটাচ্ছে ফেইসবুক কিংবা ইন্টারনেটে! এ নিয়ে বর্তমান মা-বাবার মধ্যে উৎকণ্ঠার শেষ নেই। আপনি সম্ভবত খুব একটা অবাক হবেন না যখন শুনবেন আপনার ছেলে-মেয়ে টিভি, ভিডিও, ভিডিও গেম, গান শোনা কিংবা ফেইসবুকে অনেক সময় ব্যয় করছে, কিন্তু কতটা সময় ব্যয় করছে সেটা শুনলে আপনি মর্মাহত হতে পারেন! একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে এই প্রজন্মের টিনএজ (তের থেকে উনিশ বছরের) ছেলে মেয়েরা ফেইসবুক কিংবা ইন্টারনেটে দৈনিক নয় ঘন্টা সময় ব্যয় করে। এবং ৯২ ভাগ টিনএজ ছেলে-মেয়েরা প্রতিদিনেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আর এই ইন্টারনেট ব্যবহারের ৭১ ভাগই শুধু ফেইসবুক ব্যবহার করে! আমেরিকার কমনসেন্সে মিডিয়া নামের এক প্রতিষ্টান এক জরিপে বলেছে যে, ছেলে-মেয়েরা দিনে কমপক্ষে ১০০ বার ফেইসবুকে লগইন করে! চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে, নয় ঘন্টা সময় যা ওদের ঘুমানোর সময়ের চেয়ে বেশি কিংবা মা-বাবা ও শিক্ষকদের সাথে কাটানোর সময়ের চেয়ে বেশি! এই পরিসংখ্যান আসলেই উদ্বেগজনক!
কেন ছেলে-মেয়েরা ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে?
অনলাইন অ্যাক্সেস আধুনিক বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং আমাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। উপরন্তু, এটি একটি অত্যন্ত বিনোদনমূলক ও তথ্যপূর্ণ মাধ্যম। যাইহোক, এইসব গুণাবলী ছাড়াও এটি অনেক টিনএজ ছেলে-মেয়েদের কাছে আনন্দদায়ক মাধ্যম হিসেবে উপলব্ধ হচ্ছে কারন তারা ইচ্ছে করলেই একটি অনলাইন চ্যাট রুমে গিয়ে চ্যাট করতে পারে কিংবা নিজ ঘরে বসে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের অন্যান্য খেলোয়াড়দের সাথে রোমাঞ্চকর এবং চ্যালেঞ্জিং গেম খেলতে পারে। মাদকাসক্তির মতই, ইন্টারনেটও এদের কাছে বেদনাদায়ক অনুভূতি বা সমস্যাগ্রস্থ পরিস্থিতিতে অব্যাহতি একটি উপায় হিসেবে উপলব্ধ হয়। একটি মাউস ক্লিক করে তারা একটি ভিন্ন জগতে প্রবেশ করতে পারে যেখানে তাদের বাস্তব জীবনের সমস্যা নেই এবং তাদের ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষাগুলো নিমিষেই বাস্তবায়ন করেতে পারছে।
এজন্যই তারা কিছুক্ষেত্রে তাদের ঘুমের সময়টুকুও ব্যয় করছে এই ইন্টারনেটের পেছনে। উপরন্তু মা-বাবা কিংবা বন্ধু বান্ধবের চেয়ে ইন্টারনেট বা ফেইসবুকে সময় কাটনোতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, যেসব ছেলেমেয়েরা মা-বাবার কাছ থেকে কম সময় কিংবা সমাদর পায়, অথবা যারা দরিদ্র সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে বড় হয়ে উঠে অথবা যারা অন্যদের সাথে সহজে মিশতে পারে না, তারাই ইন্টারনেট কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে বেশী ঝুঁকে পরছে।
এই ইন্টারনেট আসক্তি তাদের দলবদ্ধভাবে কাজ করার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এখনকার ছাত্রছাত্রীরা দলবদ্ধভাবে কোনো কাজ করার চেয়ে কম্পিউটারে এককভাবে কোনো কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে! আবার ক্লাসের ফাঁকে অবসর সময়ে পরস্পরের সাথে কথা বলার চেয়ে মোবাইল নিয়ে সময় কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
বস্তুত এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা ইন্টারনেট আমাদের ছেলে মেয়েদের কাল্পনিকভাবে সামাজিক করার নামে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
মা-বাবা কি করতে পারেন?
সমস্যা নিয়ে সরাসরি কথা বলাঃ
সন্তানের উপর রাগ দেখিয়ে কিংবা ভয় দেখিয়ে আপনি কখনই সন্তানদের বুঝাতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে মা-বাবা উভয়ের উপস্থিতে আন্তরিকভাবে সমস্যার কথা তুলে ধরা উচিত। এতে করে সন্তান বুঝতে পারবে তার মা-বাবা বিষয়টি কত গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করছে এবং মা-বাবা দুজনকেই কিছু একই সাধারন উপসংহারে সম্মত হতে হবে। কাঙ্খিত লক্ষ্য পৌঁছাতে গেলে অনেক সময় সন্তান আপনার মতামতের সাথে এক না হয়ে উল্টো আপনাকে দোষারোপ করতে পারে, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনা করে মা-বাবার কিছু ছাড় দেয়া মানসিকতাও থাকতে হবে। অনেকসময় আবেগদিয়ে কিছু কথা বললে সন্তানরা সেটা গ্রহন করে, এইধরনের কিছু পরিস্থিতিতে আপনার সন্তানের অনুভূতি বুঝে পরিকল্পিত আবেগপূর্ণ কথা বললে ওদের সাড়া পাওয়া যায়।
সন্তানের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনঃ
সমস্যা আলোচনা করার পূর্বে যদি আপনি সন্তানের প্রতি ভালোবাসা কিংবা যত্ন প্রকাশ করেন তা সন্তানের মনোযোগ আকর্ষণ করতে অনেকাংশে সহায়তা করবে। আপনি যে তার সুখ এবং মঙ্গল কামনাকারী, তাকে তা বুঝাতে হবে। সন্তানরা প্রায়ই তাদের খারাপ আচরনের জন্য দায়ী এবং সমালোচিত হয়। যার জন্য তাদের মধ্যে বিরুপ ধারণা কাজ করে। কিন্তু আপনাকে এটাই আশ্বস্ত করতে হবে যে আপনি আপনার সন্তানের আচরন নিয়ে কোন দোষারোপ বা নিন্দা করছেন না। বরং, বলুন আপনারা তার আচরনের কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন এবং ঐসব পরিবর্তনগুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেতে হবে। সেইসাথে সেই পরিবর্তনগুলো কেন আপনাদের দৃষ্টিতে খারাপ, তার বিরুপ প্রতিক্রিয়া কি ইত্যাদি সুনিদিষ্টভাবে আলোচনা করতে হবে। তাদের ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। বলতে হবে নিদিষ্ট সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু কি পরিমান সময় ব্যয় করছে এবং কি কাজে সে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে তা জানাতে হবে। তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিন যে, টেলিভিশন দেখলে আপনি যেমন তাদের দেখার অভ্যাস সহজে নজর রাখতে পারেন, ঠিক তেমনি ইন্টারনেট ব্যবহারেও তাদের আপনার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদেরকে এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মধ্যে রেখে দুই সপ্তাহ আপনার নজরদারিতে রাখলে দুই সম্পর্কের মাঝে বিশ্বাস গড়ে উঠবে। যদি তারা আপনার এই প্রস্তাবে সাড়া না দেয় কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে আপনার সাথে মিথ্যা কথা বলে তবে বুঝতে হবে আপনার সন্তান ইন্টারনেট আসক্তির কথা অস্বীকার করছে।
কম্পিউটারে নিজে আরো দক্ষ হোন:
কিভাবে হিস্ট্রি (ইতিহাস) ফোল্ডার পর্যবেক্ষণ করতে হয় তা জানুন এবং শিখুন সফটওয়্যার পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে। কিভাবে বিভিন্ন ইন্টারনেট কনটেন্ট ফিল্টার (অনাকাঙ্ক্ষিত সাইট ব্লক) করতে হয় তা জানুন। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে মা-বাবারা কম্পিউটার ও অনলাইন সম্পর্কে এতটুকু জ্ঞান রাখবেন যাতে আপনার সন্তানরা অনলাইনে কি করছে তা সহজেই বুঝতে পারেন। হয়তবা আপনার এসব প্রযুক্তিতে তেমন আগ্রহ নেই কিন্তু সন্তানের স্বার্থে আপনাকে আপডেট থাকা জরুরি।
যুক্তিসঙ্গত নিয়ম সেট:
অনেক মা-বাবাই তাদের সন্তানের ইন্টারনেট আসক্তি লক্ষণ দেখে সহজেই রেগে যান এবং শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে কম্পিউটার থেকে দূরে রাখেন। আবার অনেকেই সন্তানদের মারধোর করেন এবং বিশ্বাস করেন যে সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার এগুলোই একমাত্র উপায়। বাস্তবিকে উভয় পন্থাই আপনার সন্তানের জন্য বিপত্তি ডেকে আনে। যেমন, তারা উপলব্ধি করে যে তারা খারাপ কোনো কাজ করেছে, আবার তারা মিত্র এর পরিবর্তে শত্রু হিসাবে আপনাকে গন্য করবে, আবার অনেকেরই পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াস্বরূপ স্নায়বিক দুর্বলতা, রাগ এবং অস্বস্তিবোধ হতে পারে।
এক্ষেত্রে আপনি কি করতে পারেন? আপনি সন্তানের সাথে সহজ সম্পর্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য একটি নিয়ম চালু করতে পারেন। উদাহরনস্বরূপ প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইন্টারনেট বা ফেইসবুক ব্যবহার করতে দিতে পারেন, হতে পারে সেটা রাতের খাওয়ার পর কিংবা তাদের হোম ওয়ার্ক শেষ করার পর। উপরন্তু ছুটির দিনগুলোতে কিছু বাড়তি সময় দিতে পারেন। শুধু নিয়ম করলেই হবে না তা যথাযথভাবে পালন করছে কিনা তারদিকেও নজর রাখতে হবে। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, যাতে সন্তানরা মনে না করে যে আপনারা তাদের উপর জোর করছেন। বরং উপলব্ধি করে, তারা যাতে মানসিকভাবে ইন্টারনেট আসক্ত হয়ে না পড়ে- তাতে আপনারা সহায়তা করছেন। এছাড়া ও মা-বাবারা সন্তানদের বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উৎসাহী করে তুলতে পারেন। যেমন গল্পের বই পড়ার অভ্যাস, বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে দেয়া, নাচ-গান শিখানো ইত্যাদি।
সরকারি উদেগ্যে কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পেইজ বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে ইন্টারনেট আসক্তির অপকারিতা সম্পর্কে উল্লেখ করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকরাও এবিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করে তুলতে পারেন। টিনএইজ ছেলে-মেয়েদের ইন্টারনেট আসক্তি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। তাই বলে বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেট থেকে দূরে থাকাও যুক্তিযুক্ত নয়। এবিষয়ে সবার বিশেষ করে মা-বাবাদের সচেতন থাকা উচিত। সকলের প্রচেষ্টায় ভালো একটা যুবসমাজ গড়তে পারাই আমাদের লক্ষ্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৬ রাত ৯:৪৭