কি অদ্ভুত! এত বিশাল আকার প্লেন এতগুলো যাত্রী নিয়ে মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো! কিভাবে গেলো এই নিয়ে সাধারণ মানুষের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। প্লেন আবিষ্কার হয়েছে অনেক আগে কিন্তু এখনো আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার হিসেবেই পরিচিত।
প্লেন আবিষ্কারের কথা বললেই যাদের কথা প্রথমেই বলতে হয় তাঁরা হলেন, রাইট ভ্রাতৃদ্বয়(অরভিল এবং উইল্বার)। তাঁরা ১৯০৫ সালে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আঁকা ছবির পরিপ্রেক্ষিতে আকাশে ওড়ার জন্য সর্বপ্রথম প্লেন তৈরি করেন [১]। আমরা সবাই জানি প্লেন আকাশে অর্থাৎ বাতাসে উড়ে। আর এই বাতাস হলো বিজ্ঞানের ভাষায় ফ্লুইড (Fluid)। পানি যেমন ফ্লুইড ঠিক তেমনি বাতাস ও ফ্লুইড। সুতরাং একটি পাখির কিনবা একটি বিমানের আকাশে উড়ার কৌশল অনেকটা একটি মাছের পানিতে সাঁতার কাটার মতই। আর এ কারণেই প্রকোশলীরা বিমানের বিভিন্ন টেস্ট ক্ষেত্রবিশেষে আকাশে না করে প্রথমে পানির নিচে করে থাকে।
চিত্র ১ঃ প্লেনের কার্যকরী বলসমূহ
একটা প্লেন যখন আকাশে উড়ে তখন সেটি ৪টি এরোডাইনামিক্স বল অনুভব করে [১,২]।
১। অভিকর্ষ বলঃ
প্লেনের মোট ওজন যা নিচের দিকে ক্রিয়া করে (চিত্রঃ ১)তাই অভিকর্ষ বল।
ব্যাখ্যাঃ পৃথিবী তার কেন্দ্রাভিমুখে উপরসস্থ সকল বস্তুকে যে বলে আকর্ষণ করে অর্থাৎ পৃথিবী ও অন্য বস্তুর মধ্যকার আকর্ষণ বলকে অভিকর্ষ বলে। এক্ষেত্রে প্লেনকে পৃথিবী যে বলে তার কেন্দ্রের দিকে টানছে তাই অভিকর্ষ বল।
২। লিফট বা উর্ধ্বমুখী বলঃ
যে বল উড়োজাহাজকে তার ওজন বা অভিকর্ষবলের বিরুদ্ধে উড্ডয়ন করতে সাহায্য করে। স্বাভাবিকভাবেই এটি একটি উর্ধ্বমুখী বল।
ব্যাখ্যাঃ আমরা জানি যে, কোন বস্তুর চারদিকে বাতাসের চাপ সবসময় সমান। কিন্তু তাকে শুন্যে ছেড়ে দিলে তা মাটিতে পড়ে যায় বস্তুর ওজন ও অভিকর্ষ বলের কারনে। সুতরাং, এমন একটা শক্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বস্তুর ওজন এবং অভিকর্ষন/মধ্যাকর্ষন শক্তি মোকাবেলা করে বাতাসে ভেসে থাকা যায়।
যেহেতু, চারিদিকে বাতাসের চাপ সমান তাই ওজন এবং মধ্যাকর্ষন শক্তি’র বিপরীত দিকে বাতাসের চাপ কমালেই নীচ থেকে বাতাসে চাপ ঐ বস্তুকে ভেসে থাকতে সাহায্য করবে। এই শক্তির নামই লিফট।
৩। ড্র্যাগ(Drag) বলঃ
প্লেন যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বাতাস প্লেনকে বাঁধা দেয়। প্লেনের বিপরীত দিকে বাতাসের বাধাজনিত এই বলই ড্র্যাগ(Drag) বল [৩]।
ব্যাখ্যাঃ একটি লাঠিকে যদি বাতাসে বা পানিতে এদিক-ওদিক নাড়ানো হয়, তবে যে বল বাঁধাদেয়ার চেষ্টা করে সেটাই ড্র্যাগ। অর্থাৎ বাতাসের বাঁধাজনিত বল।
৪। থার্স্ট (Thrust) বলঃ
প্লেনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে বলের প্রয়োজন তাকেই থার্স্ট বল বলে ।
প্লেন আকাশে উঠলে বাতাস একে পিছনের দিকে বল প্রয়োগ করে নামিয়ে দিতে চাইবে। কাজেই এই বলকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে থার্স্ট বলের প্রয়োজন। এ বল নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করা হয়।
ব্যাখ্যাঃ
একথা আমরা সবাই জানি, প্লেনের ইঞ্জিন থেকে তার পাখায়। আর এই ইঞ্জিনে রয়েছে কম্প্রেসর, যা ঘুরলেই বাইরের বায়ু প্রচুর পরিমাণে ইঞ্জিনের ভিতরে প্রবেশ করে। সাধারনত জেট ইঞ্জিনে দুইটি চেম্বার বা প্রকোষ্ট থাকে। একটি কম্বাশন বা জ্বালানী চেম্বার, অন্যটি বায়ু বা এয়ার চেম্বার। এই দুই চেম্বার থেকে ব্যবহত গ্যাস প্রচন্ড বেগে নির্গত হয় যা এক্সহস্ট গ্যাস হিসেবে পরিচিত। এই গ্যাস ইঞ্জিনের পিছনের বায়ুতে আঘাত করে, ফলে নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে পিছনের বায়ু থার্স্ট প্রয়োগ করে প্লেনকে সামনের দিকে চলতে সাহায্য করে।
এখানে লক্ষ্যণীয়ঃ ১ ও ৩ নং বল অর্থাৎ অভিকর্ষ ও ড্র্যাগ বল হচ্ছে প্রাকৃতিক এবং ২(লিফট বল) ও ৪(থার্স্ট বল)নংবল হচ্ছে কৃত্রিম, যা এদের বিপরীতে ক্রিয়া করে। এবং যা প্লেনকে ফুয়েল খরচ করে পেতে হয় ওজন এবং পশ্চাতমুখী টান (Drag) এরবিপরীতে ভেসে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
এবার আসা যাক কিভাবে প্লেন এই ২ ও ৪ নং বল সৃষ্টি করে।
কিভাবে প্লেনের পাখা উড়তে সাহায্য করে?
চিত্র ২: প্লেনের পাখার গতি
ফ্লুইড মেকানিক্সের বিখ্যাত বার্ণোলীর ইক্যুয়েশানের অনুসারে যেকোন প্রবাহিত স্রোতের (পানি/ফ্লুইড/বাতাস) কোন জায়গায় গতি বেশি হলে সেখানে (বাতাসের) চাপ কমে যায়। এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় কিভাবে প্লেনের পাখা প্লেনকে উপরে উঠতে সাহায্য করে।
প্লেনের পাখা, উইং (Wing) কিংবা এয়ার ফয়েল (Air Foil) নামেও পরিচিত। প্লেনের পাখা আকার সামনের দিকে মোটা আর পিছনের দিকে সরু থেকে(চিত্র ২)। প্লেন যখন সামনের দিকে চলতে শুরু করে তখনএর পাখা বায়ুকে দু’টি স্তরে (চিত্র ২) বিভক্ত করে ফেলে- একটি ডানার উপরের স্তর, অন্যটি নিচের। এখন পাখার উপরের অংশ অর্ধবৃত্তাকার বা অধিবৃত্তাকার আকৃতির কারনে এর উপর দিয়ে যে বায়ু স্তর অতিক্রম করে তা বাঁধা পায় । আর নিচের অংশ তুলনামুলকভাবে সমতল বলে বাধার সম্মুখীন হয় না। ফলে উপরিউক্ত বার্ণোলী নীতি অনুসারে এই বায়ু স্তরের গতি বৃদ্ধি পায় কিন্তু চাপ হ্রাস পায়(চিত্র ২)। পক্ষান্তরে ডানার নিচের বায়ুস্তরের গতি বা চাপ পরিবর্তন হয় না কিংবা কম হয়।
এমতাবস্থায়, প্লেনের পাখার নিচেরস্তরের বায়ুচাপ উপরেরস্তরের চেয়ে বেশী, এবং স্বাভাবিকভাবেই প্লেনটি বায়ুর চাপে ওজনের বিপরীতে উপরের দিকে উঠবে [৪]। উপরের দিকে উঠাকে লিফট বলে- যা পূর্বে লিফট বা উর্ধ্বমুখী বল হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
প্লেন যখন ভুমি থেকে উপরের দিকে(টেক অফ) উঠতে শুরু করে তখন অনেক বেশি লিফটের প্রয়োজন হয়। সেজন্য প্লেনকে উঠার সময় একটি নিদিষ্ট কোণে (প্লেনের উড্ডয়ন কোণ)উঠতে হয়। কারণ প্লেনের পাখাকে যত তির্যকভাবে উঠানো সম্ভব হবে প্লেনের উপরের আর নিচের স্তরের বায়ুচাপের ব্যবধান তত বেশি হবে, অর্থাৎ লিফট তত বেশি হবে এবং প্লেন সহজেই উপরের দিকে উঠে যাবেএ
আমরা সকলেই লক্ষ্য করেছি, প্লেন উঠার আগে রানওয়েতে কিছুক্ষন একটি নিদিষ্ট বেগে চলতে থকে। তার কারণ হল প্লেন ধীরে ধীরে তার গতি বৃদ্ধি করতে থাকে আর সেই সাথে লিফট বলো বাড়তে থাকে। আর যখনই লিফট বল তার ওজনের চেয়ে বেশি হবে তখনই প্লেন উড়াল দেয়।
অনুসন্ধানঃ
১। Theodore A. Talay, Introduction To The Aerodynamics Of Flight.
২। Click This Link
৩। Click This Link
৪। Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৯