((১))
হ্যালো, কেমন আছিস বইন?
-
আমিও ভালা, তোর ছুট মাইয়াডা কি বিয়া দিছস?
-
আমার কাছে একটা ভালা পোলা আছে, মাইয়া দিবিনি?
-
হ, পোলা ভাল। শিক্ষিত, দেখতে শুনতে ভাল, ভাল চাকুরি করে।
-
হ, ফ্যামিলিও ভালা।
-
আইচ্ছা, আমুনে। তোর মাইয়া এখন কিসে পড়ে?
-
ভাল, ভাল। তোর সাহেবের সাথে কথা কইস, এরপরে আমারে জানাইস, পোলার মায়েরে লইয়া আমুনে।
-
না। তোর ভাই সাহেবের শরীর’টা ভাল না।
-
হরে বইন, এর লাইগাই তোঁ কোথাও যাইতে পারি না। আইজ কি রান্না করছ? (এরপর ব্লা ব্লা..................... ব্লা ব্লা..................... ব্লা ব্লা..................... ব্লা ব্লা..................... ২০ মিনিট শেষ)
((২))
হ্যালো? করিমন? কি করস? আমি মাজেদা।
-
হু, ভালা আছি। তোরা কেমন আসছ? ভালানি?
-
হু, সবই ভালা। ঐ শোন, আমাগো স্বর্নার পোলা অহন বড় হইছে, বিয়া দিব। তোর মাইয়া কি বিয়া দিছস?
-
হ, হ, আমি অহন স্বর্নার বাসায়, হ ওরা ভাল আছে। তোর মাইয়া কতদুর পড়ছে?
-
ভাল করছস বইন, পড়াশুনা না করলে এখন কেউ দাম দেয় না। হুন, স্বর্নার পোলাও ভাল পড়াশুনা করছে। ল’পাশ দিছে, তয় উকলাতি করে না, প্রাইভেট কম্পানিতে চাকুরি করে।
-
হ, পোলা দেখতে শুনতে ভাল, উচা লম্বা।
-
আইচ্ছা পোলার মায়েরে লইয়া আমুনে।
-
আরে পোলা আইত না, পরে আইব, আগে আমরা দেইখা শুইনা লই। রাইতে ভাত খাইছস? কি দিয়া খাইছস? কেমনে খাইছস? ব্লা ব্লা..................... ব্লা ব্লা..................... ব্লা ব্লা..................... ব্লা ব্লা.................... ৩০ মিনিট শেষ )
((৩))
হ্যালো, সেলিনা? ও, সেলিনা কই? দে তোর মায়েরে মোবাইল’ডা দে, কবি মাজেদা খালা মুবাইল দিছে।
হ্যালো, সেলিনা, কেমন আছস? তোর পোলাপাইন সবাই ভাল?
-
হ, আমরাও ভাল আছি। তোর বড় মাইয়া কি বিয়া দিছস?
-
ও, ছোট’টা কি সে পড়ে এখন?
-
ও ভাল,ভাল। শোন, আমার কাছে একটা পোলা আছে, মাইয়া বিয়া দিবিনি?
-
পোলা, চাকুরি, করে ব্যাবসা করে। শিক্ষিত, দেখতে শুনতেও ভাল।
-
আমার বইনের পোলা।
-
না, ঢাকায় নিজের বাড়ি নাই।
-
না, সরকারি চাকুরে করে না। প্রাইভেটে চাকুরি করে।
-
তাতে কি? শিক্ষিত পোলা, বাড়ি গাড়ি করতে সময় লাগে নাকি?
-
এইডা কি কস? মাইনষে ভাল পোলা খুজে আর তোরা বাড়ি গাড়ি খুজস!!
-
আইচ্ছা হেইডা তগো ইচ্ছা, তয় আমি আপন মনে করে কইছিলাম। এইরকম ভালা পোলা আর হয় না।
-
আইচ্ছা, আমুনে একদিন। (ব্লা ব্লা............ব্লা ব্লা.........ব্লা ব্লা ৩০ মিনিট শেষ)
মাজেদা খালা মোবাইল’টা সোফার পাশে রাখলেন। উনাকে কিছুটা মনখুন্ন মনে হল। না, আর সুযোগ দেয়া যায় না। আমি আস্তে করে আমার মোবাইলটা হস্তগত করলাম, যেন প্রান ফিরে পেলাম। ব্যালেন্স চেক করতে গিয়ে আমি পুরাই টাস্কি খাইলাম, বিদেশে কল করব বলে বেশ কিছু টাকা রিচার্জ করে ছিলাম, পুর টাকাটাই “জলে”গেল।
“জুনি, যা তুই হাত মুখ ধুয়ে আয়, তোর সাথে কথা আছে” বলে উনি আম্মুর সাথে খোশ গল্প শুরু করলেন।
মাজেদা খালা। আমাদের মাজেদা খালা। উনি এক আজব চরিত্র। পৃথিবীর সব মানুষই উনার আপন, সব মানুষই উনার কাছে সমান, সে সিএনজির ড্রাইভার হোক আর প্লেনের পাইলটই হোক, উনি পার্থক্য খুজে পান না।
মাজেদা খালা আমার আপন খালা নন, এমনকি দূর সম্পর্কেরও কোনো আত্মীয় না। আমাকে জন্ম দিতে যখন আমার আম্মু হলিফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন মাজেদা খালাও উনার সন্তান জন্ম দিতে একই ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। সেখান থেকেই এই দুই “মায়ের” পরিচয় হয় ও পরবর্তিতে উনারা দুইজন বান্ধবী পাতান।
আগের দিনে মোবাইল/ইন্টারনেট না থাকলেও “আত্ত্বার টান” ছিল, তাই দুই পরিবারের মাঝে খুব সহজেই একটি সেতু বন্ধন হয়। সপ্তাহে না হোক, অন্তত মাসে একবার উনাদের বাসায় যেতাম বা উনারা আমাদের বাসায় আসত। আম্মু ফার্মেসির দোকান থেকে নিয়মিত পয়সা খরচ করে মাজেদা খালাকে ফোন দিত, উনিও প্রায়ই আমাদের বাড়িওলার নম্বরে ফোন দিত। এখন আমরা আধুনিক, সবার কাছেই মোবাইল নামের আধুনিক যন্ত্র আছে, কিন্তু আম্মুকে সেই আগের মত কাউকে আর ফোন দিতে দেখি না। হয়ত উনিও আমাদের মত আধুনিক হয়ে গেছেন তাই আগের মত আর আত্ত্বার টান অনুভব করেন না।
মাজেদা খালার সাথে আমার দেখা হয় না প্রায় ৬ থেকে ৭বছর হবে। লাস্ট উনাদের বাসায় গিয়েছিলাম এক কোরবানির ঈদে, খালু সাহেব আমাকে ১০০টাকা সালামি দিয়েছিলেন, কিন্তু উনি যখন শুনলেন আমি ভার্সিটিতে পড়ি ও বেকার, তখন উনি আমাকে ৫০০ টাকা সালামি দিলেন। সেটিই ছিল আমার জীবনে পাওয়া বড় অংকের সালামি।
আজ বাসায় এসে দেখি মাজেদা খাল ড্রইং রুমে বসে আম্মুর সাথে কথা বলছেন। অনেক দিন পরে দুই বান্ধবির দেখা তাই উনারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। এক ফাকে আম্মু আমার মোবাইলে ব্যালেন্স আছে নাকি জিজ্ঞাসা করে আমার মোবাইল নিয়ে গেলেন, তারপর থেকেই মাজেদা খালা আমার মোবাইলের ১২টা বাজাচ্ছেন।
-জুনি, তোর সাথে আলাপ আছে ( কোনো এক অজানা কারনে খালা আমার জনি নাম উচ্চারন করতে পারেন না,তাই উনি আমাকে জুনি নামেই ডাকেন)
- কি আলাপ খালা? আসেন বসেন (খালা আমার রুমে এসে খাটে বসল)
-তোর কি কোনো পছন্দের মাইয়া আছে?
-না খালা, থাকলে তোঁ অনেক আগেই বিয়া করতাম
-তোর পছন্দ কেমন?
-হে হে এই ধরেন যে মেয়ে বাসায় হবে মায়েদের মত পরিপাটি, গোছানো, সাংসারিক দ্বায়িত্ববান, বাহিরে হবে বন্ধুর মত, আর বেড রুমে হবে গার্লফ্রেন্ডের মত।(আমি আমার স্বভাব মত হেসে উত্তর দেই)
(খালা কি বুঝল বলতে পারি না) উনি আবারো প্রশ্ন করল
- মানে? কেমন মাইয়া চাস তুই? আমরা সেই রকম খুইজা দেখুম।
-আমি আর কেমন মাইয়া চাইব? আপনেরা দেখেন, আপনারা মুরব্বিরা যেটা ভাল মনে করবেন সেটাই হবে, আমার কোনো পছন্দ বা আপত্তি নাই। (এবার সিরিয়াস মুডে উত্তর দিলাম)
-ভালা, সেটাই ভালা।
(খালা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার কথা শুরু করলেন)
-বাবারে, কোনো বাপ মায়ে কি চায় পোলার জন্যে খারাপ মাইয়া আনতে? আমার পোলা দুইটা বুঝল না, ওরা নিজেদের মত বিয়া করল। (মাজেদা খালার দুই চোখ ভিজে উঠল), কত আশা ছিল পোলাগো নিজ হাতে বিয়া দিমু, নিজে পছন্দ করে মেয়ে আনুম, ১০ গ্রামের লোক আমার বউ দেখতে আইব, মাইনষে সুনাম কইব। কত আশা ছিল একটা ভাল মেয়ের হাতে সংসারের দায়িত্ব তুইলা দিয়া আমি নিশ্চিন্তে আল্লাহ আল্লাহ করুম।
(মাজেদা খালা কান্না করছেন ও উনার দুই চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে) উনি আপন মনে কথা বলেই চলছেন। মাইয়া দেখুম, মাইয়ার বাপ মা দেখুম, বেয়াই বেয়ানের সাথে গল্প করুম, বেড়াইতে যামু। কত আশা ছিল, কিছুই হইল না। পোলারা বুঝল না ওগো বাপ মা হিসেবে আমাগো কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে, পোলাগো উপর বাপ মায়ের হক থাকে।
মাজেদা খালা দির্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। উনি আরো কি কি যেন বলছেন। আমি এই সব শুনছি না। আমাকে কক্সবাজার যেতে হবে, ব্যাগ গুছাচ্ছি, নিচে গাড়ি অপেক্ষা করছে। আমরা ইয়াং স্মার্ট, ডিজুইস পোলাপাইন। মুরব্বিদের এই সব কথা আমাদের শুনতে হয় না, আমরা নিজেরাই সব কিছু জানি।