somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তুমি না আপনি

০১ লা নভেম্বর, ২০০৬ রাত ১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমরা যারা সমবয়সী তারা একে অন্যকে তুমি বলে সম্বোধন করে থাকি । আমাদের সহপাঠিকেও তুমি বলি । আর তুমি বলি তাদেরকে যারা শিক্ষাদিক্ষায় আমার চেয়ে ছোট। সামাজিক পদমযর্াদা আমার সমান নয় কিংবা চাকুরী ক্ষেত্রে আমার চেয়ে নীচু পদে অধিষ্ঠিত । হ্যাঁ , পথ চলতে চলতে যাদেরকে দেখি , মনে মনে তাদের সম্মন্ধে একটা ধারনা নিয়ে তুমি বলে থাকি ।

আর আপনি বলে সম্বোধন করি কাদের? যারা আমার চেয়ে বয়সে বড়, শিক্ষাগত যোগ্যতা আমার চেয়ে বেশী, সামাজিক পদমযর্াদায় আমার চেয়ে উচু আসনের দাবীদার কিংবা কর্মক্ষেত্রে আমার চেয়ে অধিক সফলকাম। তাদেরকেও আপনি বলে সম্বোধন করি যাদের প্রচুর ধন-দৌলত আছে ।

যাদের শ্রদ্ধা করি, সমীহ করি , ভয় করি বা সংকোচ করি তাদেরকেও আমরা হর-রোজ আপনি বলি । কিন্তু তাদের মধ্যে যারা আমার একান্ত আপন তাদেরকে আবার তুমিও বলি । এই ধরুন বাবা মাকে আমরা তুমি বলি । তুমি বললাম বলে কি তাদের অশ্রদ্ধা/ অসম্মান করা হল ? কিংবা সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির কাছে হেয় প্রতিপন্ন করলাম ? না নিশ্চয়ই নয় , বরং আদর-সোহাগের নিদর্শনই প্রকাশ করা হল । প্রকাশ করা হল নৈকট্য ।

তবুও এই তুমি আর আপনি নিয়েই আমার যত ঝামেলা । কাকে তুমি বলব আর কাকে আপনি বলতে হবে অনেক সময় ঠিক করতে পারিনা । আর সে কারনে আমাকে বহুবার হোচট খেতে হয়েছে । এবং এ রকম যতবার ঘটেছে ততবারই তওবা করেছি ভবিষ্যতে সাবধান হবো, এমন নাজেহাল আর যাতে না হতে হয় । কিন্তু ধুত্তুরী, এখন পথে বেড়োনোই দায়।

করি মাষ্টারী । কত ছেলেকেইত পড়িয়েছি । ছাত্রদের অনেকে জীবনে সু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । কেউ জজ-ম্যাজিষ্ট্রেট হয়েছে। কেউবা হয়েছে অফিসের বড় সাহেব আবার কেউ হয়েছে রাজনৈতিক নেতা। মুস্কিল কি আমার শুধু অচেনা লোককে নিয়ে? না! এসব কৃতি ছাত্রদের নিয়েও আমার দুশ্চিন্তা কম নয়।

1972 সনের একদিন ফুড অফিসে গিয়েছিলাম একখানা চিনির পারমিটের জন্য। নিয়ন্ত্রকের রুমে ঢুকে দেখলাম এককালে সে আমার ছাত্র ছিল । কতদিন তাকে পড়িয়েছি। আদর করে অনেক সময় তুই ও বলে ফেলেছি। তাই আজ তাকে তুমি বলে সম্বোধন করলাম । সাহেব একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করলেন, আর তাকালেননা । কিন্তু আমার তো চিনি না হলেই নয়, চিনি নিয়ে বাসায় ফিরলে ছোট বাচ্চাটা দুধ খাবে । রূগ্না স্ত্রী খাবে পথ্য । মরিয়া হয়ে আবার বললাম বাবা, তুমি বোধহয় আমাকে চিনতে পারনি, আমি তোমার কলেজ জীবনের সেই এহসান স্যার । চিনির পারমিটের জন্য তোমার কাছে এসেছি। ভদ্রলোক আর একবার চোখ তুলে চাইলেন এবং ছোট্ট করে বললেন -আপনার বোধহয় ভূল হচ্ছে, আপনি মাষ্টার মানুষ , ছাত্রদেরকে এত শেখান আর একটা অফিসে এসে সেখানকার বড় সাহেবকে কি বলে সম্বোধন করতে হয়, কিভাবে সম্মান দিতে হয় তা'ত শেখেননি। কি বলব বলুন - আমার ছাত্রটির গোস্বা দেখে ভড়কিয়ে গিয়ে ফিরে এলাম, চিনির পারমিট আর হলনা ।

কোরবানীর ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি । আমাদের গ্রামে সপ্তাহে দুদিন হাট বসে । হাটে গিয়েছি একদিন, দেখা হল রতনের সাথে । জিজ্ঞেস করলাম - কেমন আছ? উত্তর দিলনা । আমার হাত ধরে একপাশে নিয়ে গিয়ে দাড়াল । আমার মুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকল পরে বলল আমাকে কেন তুমি বলে সম্বোধন করছ? আমি তো তোমার চেয়ে বয়সে বড়, তোমার মত আমিও এম,এ পাশ করেছি, চাকরীও একটা ভালই করছি । তবুও আমাকে কেন তুমি বলছ? আমার বাবা তোমার বাবার কর্মচারী ছিল সে জন্যই কি ? তা সে সম্পর্ক তো চুকে গেছে, তবে? জিজ্ঞেস করলাম তবে কি? সে বলল আপনি বলে কি সম্বোধন করতে পারনা? যদি না পার তবে আমার সাথে কথা বলবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম বয়সে সামান্য বড় হলেও আমরা একই গ্রামে ছোটবেলা থেকে বসবাস করছি, একই স্কুলে পড়াশোনা করেছি, পূর্ব থেকে একে অন্যকে তুমি বলেছি। তাই আজও তুমি বলেছিলাম, যাহোক তোমার আপত্তি থাকলে নিশ্চয়ই বলবনা। আমারতো এমন কিছু লোকসান হবেনা 'আপনি' বলতে। তবুও যেন তার রাগ কমলনা, যেতে যেতে বলে গেল - দিনকাল পাল্টেছে , খেয়াল রাখলে খুশি হব।

রতন চলে গেল, কিন্তু আমাকে ভাবিয়ে রেখে গেল। ভাবলাম সে ত ঠিক কথাই বলেছে, দিন কালের পরিবর্তন হয়েছে। মানীর মান কমেছে। কমেছে বাবার কাশ্মীরী শালের দাম।

ভেবে ভেবে স্থির করলাম - কে কোথায় গোস্বা হবে, কে কি ভাববে বা বলে ফেলবে, কাজেই সময় থাকতে সাবধান। রতন লেখাপড়া শিখেছে, ভদ্রতা করে খারাপ ব্যবহার করেনি। শুধুমাত্র ওর আপত্তিটা জানিয়ে গেছে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে আর কেউ শুধু আপত্তিই করবে না, উল্টো লোকজনের সামনে অপমান করবে। তারচেয়ে আজ থেকে সবাইকে আপনি বলব - তাই ভাল। সবাই খুশি হবে। আমার এমন কিছু লোকসান হবেনা। এবং সেই দিন থেকে সবাইকে আপনি বলা শুরু করলাম। বয়সে ছোট বড় সকলকে(শুধু মাত্র বালক বালিকাদের বাদ দিয়ে) মাছওয়ালা, দুধ ওয়ালা, রিক্সাওয়ালা - সবাইকে । কিন্তু তখন কি জানতাম যে এই আপনি সম্বোধনও একদিন আমাকে বেকায়দায় ফেলে নাস্তা-নাবুদ করবে?

অন্য একদিন আমাদের গ্রামের বাড়ীতে এসেছে গ্রামেরই লোক হাতেম। বাড়ীতে গিয়েছি শুনে দেখা করতে এসেছে। এককালে আমাদের প্রজা ছিল। জিজ্ঞেস করলাম - হাতেম ভাই কেমন আছেন? আপনার বাড়ীর সকলে ভালতো? সে কোন উত্তর দিলনা। আবার জিজ্ঞেস করলাম - কি ভাই কথা বলছেননা কেন? এবার সে মুখ খুলল, বলল - সাহেব লেখাপড়া শিখে আপনাদের মত বড় হতে পারিনি, আপনাদের মত চাকুরী করিনা বা পোষাক পরতে পারিনা বলে কি আপনারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলবেন? বললাম, আপনি বলে কথা বললে বুঝি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়? আপনিত আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, আপনিই তো বলা উচিৎ। এতে দোষ কোথায় ? সে আমার মুখেরপানে একদৃষ্টে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে চলে গেল এই বলে যে - এমন অপমান করবেন জানলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসতাম না সাহেব।

হাতেম চলে গেল আমাকে হতভম্ব করে । আমি ভেবে পাইনা রতনকে তুমি বললে রাগ করবে আর হাতেম রাগ করবে আপনি বললে! তাইত আমার ভাবনা - কাকে তুমি বলব,কাকে আপনি । এটাই আমার সামপ্রতিক কালের সবচেয়ে বড় ভাবনা। এ ভাবনার যেন শেষ নেই । তাইত আজ আমি পরিচিত অপরিচিত কারো সাথেই স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারিনা-পাছে কে অসন্তুষ্ট হয় এই ভেবে ।

লেখাটি সাকিব আল মাহমুদের "আপনি বলতেই ভালো লাগে" থেকে অনুপ্রানিত
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৪৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×