ভদ্রলোক চড় কষিয়েই ক্ষান্ত থাকলেন না। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে শুরু করলেন। তার মুখে উচ্চারিত শব্দগুলোর সাথে তার চেহারা ও পোষাকের সাথে মিল ছিলনা। অমন ভাষায় গালাগালি সাধারনতঃ আমরা শুনে থাকি অশিতি কুলি মজুরদের মুখে। তাই উপস্থিত সকলে না হলেও বেশ কিছু সংখ্যক অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
ঐ ভদ্রলোক গিয়েছিলেন শহর থেকে কিছু দুরে। বন্ধু বান্ধব ও পরিচিত কিছু লোক নিয়ে গাড়ি সাজিয়ে দিনভর আনন্দ ফুর্তি করার জন্য। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে আমোদ- প্রমোদে যদি বাঁধা আসে তবে কে না রাগ করে? কার না মেজাজ খারাপ হয়, বলুন তো?
শহুরে লোকগুলো যখন গাড়ি হাকিয়ে, ঢাক ঢোল বাজিয়ে আমোদ ফুর্তি করার কারনে স্বল্পক্ষন হাজির হয় তখন তাদের দেখতে গ্রামের সাধারন মানুষগুলোর দৃষ্টি কাড়াই তো স্বাভাবিক। তাদের হৈ -হুল্লোর, খানাপিনার তেজী ঘ্রান ঐ অনাহার কিষ্ট, পান্ডুর চেহারার লোকগুলোকে ত আকৃষ্ট করারই কথা। ওরা অংশগ্রহনের জন্য নয়, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার কারনেও নয়, নিছক কৌতুহল বশত: এবং কিয়দাংশ হয়তবা আহারের সুঘ্রানে নিজের রসনাকে তৃপ্ত করতে সেখানে এসে ভীড় করে। কেউ দাড়িয়ে থেকে তামাশা দেখে। বেলেল্লাপনায় আহত হয়ে কিম্বা অধিক্ষন দেখে দেখে কান্ত হয়ে এক সময় ফিরে যায় বেশীরভাগ দর্শক। আর অনাহার যাদের নিত্য সাথী সেই সব পরিবারের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা খাবারের মৌ মৌ গন্ধে যেন জায়গা ছেড়ে যেতে পারেনা। ওদের রসনা সজীব হয়ে ওঠে। আমাদের পরিচিত জীব বিশেষের মত কুঁই কুঁই করে ওরই আশে পাশে রসনা তৃপ্তির আশায় ঘুর ঘুর করতে শুরু করে। তাদের এ বেহায়াপনা বিরক্তির উদ্রেক করে ঐ সব শহুরে লোকদের - ক্রোধান্বিত করে। কোন কোন সময়বা হিংস্র হয়ে উঠতে বাধ্য করে।
এমন এক ঘটনাই ঘটেছিল সেদিন ঐ ভদ্রলোককে ঘিরে। রোজকার মত শহরের বাসার ছিমছাম পরিবেশে টেবিলে সাজানো পঞ্চব্যাঞ্জনে রসনা তৃপ্ত না করে শহরতলীতে গিয়েছিলেন ছায়াঘেরা, পাখির কল-কাকলীতে মুখর কোন জায়গায় কিছুনের জন্য ব্যতিক্রম খুঁজতে। অনেকগুলি মুরগী ও খাসীর জীবনাবসান ঘটিয়ে নামকরা বাবুর্চি সাথে নিয়ে ঐ ভদ্রলোক গিয়েছিলেন পিকনিক খেতে।
মাইকে গানের আওয়াজ আর তাদের হৈ-হুল্লোরে পাখিরা ভয়ে উড়ে পালালেও একদল লোক এসে উপস্থিত হয়েছিল তাদের রং তামাশা দেখতে এক সময় ভীড় পাতলাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছু সংখ্যক দর্শককে আকৃষ্ট করে ধরে রেখেছিল খাবারের মৌ মৌ গন্ধ।
পড়ন্ত বেলায় খাবার পরিবেশন হচ্ছে। দলের সবাই নিজ নিজ প্লেটে সুগন্ধি খাবার নিয়ে গ্রাস তুলেছে আর ঐ হাভাতেরা দূরে দাড়িয়ে থেকে ঘ্রান শুকছে আর দেখছে। অদৃশ্য আকর্ষনে পা পা করে খাবার পরিবেশনের জায়গায় এসে দাড়িয়েছে বেশ কয়েকজন। ব্যাস শুরু হল ধমকানি, গালাগালি, দু একজন তেঁেড়ও এলেন। ওরা দূরে সরে গেল। পরক্ষনেই আবার কি এক দুর্বার আকর্ষনে কাছাকাছি এগিয়ে গেল।
ওরা জানে এসব খাবার ওদের জন্য নয়। শবে বরাতের রাতে ওদের ভাগ্যে পান্তা ভাত আর মরিচ পোড়াই বরাদ্দ হয়েছে, তাই আফসোস থাকলেও কেড়ে খাবার ইচ্ছে নেই। তাই বলে ভদ্রলোকদের মাটিতে ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট হাড্ডি গুলো একটু চেখে দেখতে দোষ কোথায়?
আপত্তি নেই ভেবেই ছোট ছেলেটি ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্টে হাত লাগিয়েছিল। কিন্তু ভদ্রলোকের যে খাওয়া শেষ হয়নি তখনও। প্লেটের পাশে অমন নোংরা চেহারা আর জামা-কাপড় পরা ছেলেটির হাত পরবে ভাবা অসহ্য। তাইত ভদ্রলোক চড় কষিয়েছিলেন।
ছেলেটিরই বা দোষ কি বলুন? ভদ্রলোকেরা ত মাংস খেয়ে হাড্ডি ফেলে দিচ্ছেন। সেগুলি তুলে নিলে তাদের আপত্তি কোথায় - ছেলেটির মনে সেই প্রশ্ন। যাহোক হাড্ডি খেতে গিয়ে উপরি হিসেবে থাপ্পড়ও খেল। মন্দ কি?
সুধী পাঠক এমনটা হয় কেন বলতে পারবেন?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০