আমার জীবনটাও যেন হুবহু বাংলাদেশ রেডিও। দিনভর আমিও প্রোগ্রাম করে চলছি। বিভিন্ন লোকের মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রাম । রেডিওর মত আমার সে সব প্রোগ্রামের কোন মাথা মুন্ডু নাই । শুধু লোকদের খুশি করার জন্য প্রোগ্রাম করছি । কখোনো হাসির, কখোনো কান্নার, কখোনো মিলনের আবার কখোনো বিচ্ছেদের । একের পর এক অনুষ্ঠান, হররোজ অনুষ্ঠান. হর হামেশা অনুষ্ঠান। তবে একঘেয়েমি অনুষ্ঠান নয়। সে সব অনুষ্ঠানে বৈচিত্র আছে। কিছু অনুষ্ঠান বাংলাদেশ রেডিওর মত নিত্তনৈমিত্তিক কিছুবা ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে সাজানো।
রেডিও বাংলাদেশের মত আমিও ঘুম থেকে জেগেই আসসালামু আলাইকুম বলে অনুষ্ঠান শুরু করি । তবে পার্থক্য এইযে ওদের ঘোষক ও শিল্পিরা আলাদা আলাদা, কিন্তু আমি একাধারে ঘোষক ও শিল্পি দুইই । শুধু কি তাই ? মাঝে মাঝে পরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয় । যদিও প্রোযোজক হিসাবে কখনো নয় ।
প্রাত:কালীন কার্যাদি সম্পন্ন করে আল্লাহ-রসুলের নাম নিতে কেবলমাত্র শুরু করেছি , অমনি গিন্নির গায়ে সূচ ফুটতে আরম্ভ করলো। নেপথ্য কন্ঠে ভেসে এল বিদ্রুপ-বানী, ভক্ত হইছে রাধার মায়.. .. . ইত্যাদি ইত্যাদি। তার গায়ে জ্বালা ধরার কারন তার ঘুমে ব্যাঘাত হচ্ছে । ছেলে মেয়ে গুলো ততক্ষনে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে । ওদের না সামলালে সে যে ঘুমাতে পারছে না । কাজেই তার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য আল্লাহ রসুলের নাম বন্ধ করে ছেলে মেয়ে আগলাতে বসলাম । সে আগলানোও কি চাট্টিখানি কথা! এক একটা এক এক স্বভাবের ।
আমাকে উঠতে দেখেই হৈ হুল্লোর করে এক দঙ্গল ছেলে মেয়ে এগিয়ে এল ক্ষুধা লেগেছে , খেতে দাও। হাতের কাছে যা আছে তাই খেতে দিলাম, সেখানেও বিপত্তি। একটা খাবে রুটি তো অন্যটায় পাউরুটি। একটার জন্য মুড়ি তো অন্যটার জন্য মোয়া। সবার পছন্দ আলাদা । কারো সাথে কারো মিল নেই। আর সে গুলো সামাল দিতে আমি খাচ্ছি হিমশিম । কিন্তু আমার দুরাবস্থা ওদের কৃপাদৃষ্টি আকর্ষনে ব্যর্থ। ওদের এক কথা পিতা হয়ে পিতার দায়িত্ব পালন করতে হবে। আপনারা বলুনতো ছেড়ে দাও বললেই কি আর ছেড়ে দেয়া যায়? ওদের পছন্দমাফিক খাবার দিতে পারিনি বলে ওরা ততোক্ষনে মহা হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। তাতে গিন্নির ঘুমে ব্যঘাত, অগত্যা ফুসতে ফুসতে বিছানা থেকে উঠলেন। বয়লারের জমাকৃত বাস্প ঢাকনা খুলে একসঙ্গে বেরোতে শুরু করল, আর তার সামনে পরে আমার অবস্থা তখন চুপসে যাওয়া বেলুনের মত । খালি কলসি ডুবানের শব্দ শুনেছেন কখোনো? সে রকম ফট ফট করতে করতে পায়ের চটির শব্দ তুলে তষনকার মত তিনি প্রস্থান করলেন , আমিও হাফ ছেড়ে বাচলাম।
কিন্তু সে আর কতক্ষন। পরবতী প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেল । হেঁসেলে ঢুকেই তিনি মানে আমার গিন্নি বেরিয়ে এলেন, বোমার মত ফেটে পড়লেন । থুরি থুরি বোমার মত নয় , বর্তমানে যে রকম বাদ্যযন্ত্রের ( অনেকগুলি একসাথে) কনসার্ট শোনা যায় অনেকটা সেই রকম। তারা বাজির মত তার মুখ থেকে অঝোর বর্ষন শুরু হল । ঘি নেই , ময়দা প্রায় শেষ । ছেলে মেয়ে দের পরোটা হবে কিসে ? তবু সাহস সঞ্চয় করে বললাম আজ একদিন আটার রুটি হোক । ব্যাস! স্তুপীকৃত বারুদে যেন দেশলাই কাঠি ছোয়ানো হল, এবারে গগন বিদারী শব্দে ফেটে পড়লেন , সার সংক্ষেপে- বিয়ে করেছি , বাপ হয়েছি , জায়া পুত্র কন্যার প্রতি কর্তব্য পালন আমাকে করতেই হবে। সে যে ভাবেই হোক । মিনমিনে গলায় অনুরোধ করলাম, আমার আয় রোজগারের গন্ডির মধ্যে বাস করতে , তা শুনতে রাজি নন । তাদের চাহিদা পূরন করতেই হবে, প্রয়োজনে চুরি করে হলেও । গিন্নি তার রায় জানিয়ে চলে গেলেন , ভাবলাম বাঁচা গেল । না বাঁচব কেমনে! প্রথম অধিবেশনের অনেক প্রোগ্রাম যে তখনও বাকি । ঘি ময়দা যতটুকু ছিল তা থেকে নাস্তা তৈরী করে ছেলে মেয়েদের দেয়া হল । গিন্নির তৈরী করতে করতে খেয়েছেন কিনা জানিনা , তবে আমার ভাগ্যে উচ্ছিষ্টও জুটলনা । পরবতী অনুষ্ঠানের কথা ভাবছি। গিন্নি স্বমুর্তিতে সামনে দাড়িয়ে বাজারের থলেটা ছুড়ে দিয়ে বললেন তাড়াতাড়ি বাজারটা সেরে আসতে , মহিলা ক্লাবে অনুষ্ঠান আছে । তাকে সেখানে যেতে হবে। বাজারের একখানা ফর্দও তুলে দিলেন । দেখেতো আমার চক্ষু স্থির। তিন রকমের মাছ , গোস্ত , শবজী ,ডিম ,ঘি , ময়দা অনেককিছু। যেন পুরো বাজারটাই কিনে আনতে হবে। কিন্তু আমার সঙ্গতি কোথায় ? মাসে সবমিলিয়ে দশ হাজার সাত শত টাকা আয় , পূষ্যি গন্ডা দুয়েক , কুলাবে কেন? এতগুলো জিনিস কিনবার পয়সা কোথায়। কিন্তু সে কথা পুষ্যিদের বলা যাবেনা , বলতে গেলে বিড়ম্বনা বাড়বে বই কমবে না। তাই কিছু না বলে পা বাড়ালাম, সাধ্যমত জিনিস কিনলাম কিন্তু গিন্নির দেয়া ফর্দের অনেক কিছুই হলনা । বাসায় ফিরে , গিন্নি থলের মুখ খুলবার আগেই ব্যস্ততার ভাব দেখিয়ে , মাথায় দু মগ পানি ঢেলে , জামা কাপড় পরে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
অফিসে পৌছে শুরু হল আর এক অনুষ্ঠান । পৌছানোর সাথে সাথে তলব এল বড় সাহেবের । দুরু দুরু বুকে সাহেবের কামরায় পৌছে আক্কেল গুড়ুম, সাহেব কড়া মেজাজে চিবিয়ে চিবিয়ে যা বললেন তার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি, শুধু এইটুকু বুঝতে পারলাম আমার নামে কেউ কিছু লাগিয়েছে। কি হতে পারে- ঠিক অনুমান করতে না পারলেও বুঝতে বাকি রইলোনা যে ইহা পরশ্রীকাতরতা। বড় সাহেব আমাকে ভালবাসেন , আমার কাজের তারিফ করেন । বিভিন্ন কাজে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমার সাথে আলাপ করেন । অনেক কাজের দায়িত্ব দেন।এসব সহকর্মীদের অনেকের পছন্দ নয় ।
বড় সাহেবকে চটানো যায়না । তার দেয়া দায়িত্ব পালন করতে হয় । অন্যদিকে সহকর্মীদের সাথেও সৌহার্দ বজায় রাখতে হয় একই সময়ে দুদিক সামলে চলা, উভয়কেই সন্তুষ্ট রাখা যে কি ঝামেলা তা ভূক্তভুগিরাই ভাল বুঝবেন, অন্য কেউ নয় । ভাল কাজ করলে সহকর্মীদের অসুবিধা , কাজে ফাঁকি দিলে বড় সাহেবের ধমকানি , চাকুরী খোয়াবার ভয় । এসব ঝামেলা আমাকে হররোজ পোহাতে হয় । আপনারা কে কি করেন জানিনা।
কাজের ফাকে ফাকে মনে হয় পেটটা চোঁ চোঁ করছে । দানা পানি চাই । কিন্তু সঙ্গতি কই ? বারবার গেলাস ভর্তি পানি খেয়ে ঠেকা দেই । অগত্যা যে দিন আর না পারা যায় তখন একখানা টোষ্ট আর এক সিঙ্গেল চা ক্ষুধা নামক দানবটাকে ঘুষ দিয়ে রেহাই পাবার চেষ্টা করি।
কখনো বড় সাহেবের ধমকানি, কখোনো সহকর্মীদের সহানুভুতি কখোনো বা বাইরের লোকের তাড়া খেয়ে অফিসের সময়টা শেষ হয়ে যায়। তখন আবার বাসায় ফেরা ।
বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই ছেলে মেয়েদের বায়না, হাজার রকমের আবদার , গিন্নির গোমরা মুখ আমায় ভাবিয়ে তোলে। গিন্নিকে মাঝে মধ্যে বোঝাতে পারলেও ছেলে মেয়েদের বায়নার যেন আর শেষ নেই। একটার জামা নেই , অন্যটার প্যান্ট নেই বড় মেয়েটার শাড়ী চাই তো বড় ছেলের চাই .... শুধু নাই আর নাইয়ের তান্ডব নৃত্য।
হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার জন্য অপো করতে করতে যখন ঝিমুনী আসছে তখন হয়ত কোনদিন কিছু নাস্তা এলো , কোনদিন বা কিছুই না । কিন্তু যে দিন গুলোতে এল তাও সারাদিন পথ হেঁটে আমার পেটের দরজায় ঢুকবার আগেই হয়ত বাচ্চাদের কেউ এগিয়ে এল , বুঝতেই পারছেন পিতৃদেব হয়ে তখন আমার কর্তব্য পালন করা ছাড়া আর গত্যান্তর থাকে না ।
যা হোক শেষ পর্যন্ত রাতের খাবারটা কোনরকমে গলঃধকরন করে যে যার মত বিছানায় শুতে যায় । তখন নিরিবিলি গিন্নির সঙ্গে এক- আধটু আলাপ সেরে আমারও শোবার ব্যবস্থা । অর্থাৎ শেষ অধিবেশনে খেয়াল অথবা রাগপ্রধান গান গেয়ে সেদিনকারমত অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষনা করা হয়।
পৃথিবীর রং বদলায় , বদলায় বাংলাদেশেরও । ছয় ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখি বাংলাকে । গ্রীষ্মের পরে আসে বর্ষা , বষর্ার শেষে শরত। শরতের পর হেমন্ত তারপরে শীত ও যথাক্রমে বসন্ত। আর এই এক এক ঋতুতে বাংলার এক এক রূপ । কিন্তু আমার জীবনের রং বদলের , পট পরিবর্তনের কোন নিয়ম নেই । ঠিক যেন বাংলাদেশ রেডিওর প্রোগ্রামের মত । নানা জনের অনুরোধে নানা সুর বাজিয়ে চলছি ।
একই ঔষধ বিভিন্ন কোম্পানী ভিন্ন ভিন্ন নামে বিক্রি করে । রং আলাদা , চেহারা আলাদা । কিন্তু দোষ গুন একই । কাজেই আশা করছি আমার সারাদিনের প্রোগ্রাম শুনে নিশ্চই আপনারা বিরক্ত হননি । কেননা আপনাকেও অনেকের মনোরঞ্জনের জন্য প্রোগ্রাম করতে হচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০০৮ সকাল ১১:৪৪