চলুন একই জিনিস ভিন্ন চোখে দেখি...... জলিল কে নিয়ে যা হচ্ছে তা যেমন দুঃখজনক তেমনি আমাদের জন্য অসম্মানয়েরও। জলিল সব চেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে, ইউ পম গানা, ইউর মা...আম...আম...মাদার পম রাশিয়া...ইউ ইটিং ফুড ইন বাংলাদেশ......এই কথাগুলর জন্য। কিন্তু আমাদের ও একবার ভেবে দেখতে হবে, যে লোকটা কখনো শিক্ষার আলো পায় নাই তার কাছে আমাদের প্রত্যাশার ব্যাপ্তিটা লাগামহীন হওয়া কি যুক্তিসঙ্গত?
জলিল সাহেব, সংস্কৃতিমনা তাতে কারো বিন্দু মাত্র সন্দেহ থাকা উচিৎ না। বাংলাদেশের সিনেমা যখন জিরো ফিগারের মত জিরো বাজেটের দিকে চলে যাচ্ছিল, কিমবা শাকিব খান নির্ভর সিনেমা গুলোতে শাকিব খান কে ৪০ লাখ টাকা দেবার পর কোটি টাকার বাকী অংশ দিয়ে সিনেমা শেষ করতে যেয়ে পরিচালকেরা হাপিত্যেশ করছিলেন, ঠিক তখনি জলিল সাহেব কোটি কোটি টাকা লগ্নি করেছেন একটা সিনেমার পিছনে। হলিউডের ইউনিভার্সাল স্টুডিয়ো থেকে সিনেমার এডিটিং করেছেন। সিনেমা কে আন্তর্জাতিক মানের করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শিল্পী কলাকৌশলী দের অন্তর্ভুক্তি করেছেন তার প্রতিটা সিনেমার সাথে। নিজের টাকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকরা সিনেমা হল ভাড়া নিয়ে তাতে তার সিনেমা মুক্তি দিয়েছেন, লাভ লসের দিকে খেয়াল করেননি। প্রবাসে থাকা লাখো বাঙ্গালী বড় পর্দায় বাংলা ভাষাভাষী এই সিনেমাগুলো দেখে যৎসামান্য হলেও বিনোদিত হয়েছে।
সেই রহমান-রাজ্জাকের জুগ থেকে শাকিব খান, প্রতিটা সিনেমার অ্যাকশান দৃশ্য গুলোতে "ওয়ালি ঢিশুমা" শব্দে সিনেমার পর্দা কেপে কেপে উঠত। জলিল সাহেব তাতে এনেছেন আমূল পরিবর্তন। অ্যাকশান দৃশ্যগুলো হলিউডি কায়দায় প্রকাশ করছেন, যা বর্তমানে বাংলাদেশ বাদে পৃথিবীর সব দেশের সিনেমার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জলিল সাহেব ই প্রথম বাংলা সিনেমাতে ভিজুয়াল ইফেক্ট সফটওয়্যার ব্যাবহার করেছেন। তার মোশন কন্ট্রোল সফটওয়্যার বাংলা সিনেমার তথাকথিত হাফ লেডিস - স্লো মোশন এ এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
লাখো বাঙ্গালীর হৃদয় কাড়া গোলাপি সিরিজের ( যার সর্বশেষ পার্ট এ মিঠুন চক্রবর্তী অভিনয় করেছেন) স্রষ্টা আমজাদ হোসেনের মত পরিচালক যখন কর্ম শূন্য হয়ে চির চেনা এফডিসি থেকে দূরে সরে গিয়ে সস্তা টিভি নাটক কিম্বা বিজ্ঞাপনের মডেল হিসাবে কাজ করছিলেন, জলিল সাহেব তাকে লাল গালিচায় আলিঙ্গন করে ঘরে( এফডিসিতে) ফেরালেন। দিলেন আনলিমিটেড বাজেট, আমজাদ সাহেব সিনেমা বানালেন। নিয়ে আসলেন সেই মাসুদ রানা খ্যাত সোহেল রানা সহ আরও জাঁদরেল জাঁদরেল অভিনেতাদের যারা হালের মিশা শউদাগর কিম্বা কাবিলাদের দাপটে ভুলেও এফ ডিসির দিকে পা বাড়াতেন না।
এবার আমরা আসি বৈশ্বিক তারকাদের কয়েকটা উদাহরন নিয়ে যারা জলিল সাহেবের মত অবস্থান থেকে সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে চলেছেন। প্রথমেই আসি পাসের দেশ ভারতীয়দের দেবদা রজনিকান্ত এর ব্যাপারে। আমরা হয়ত সবাই জানি তবু আর একবার স্মরন করি, রজনিকান্ত ছিলেন লোকাল বাসের কনডাক্টর। ওই সময়ে তুমুল জনপ্রিয় কমল হাসানের জনপ্রিয়তাকে ধিরে ধিরে গুড়িয়ে দিয়ে দেবতার আসনটা নিজের করে নেন রজনিকান্ত। আমরা কি জানি, রজনিকান্তের প্রথম কয়েকটি সিনেমাই বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল? আর ওই সময়ের একজন বাসের কনডাক্টর কে হালের টিভি চ্যানেলের টক শোতে সরাসরি কথা বলতে দিলে,আমার বিশ্বাস জলিলের চেয়েও খারাপ ভাবেই বিদেশী একটা ভাষায় কথা বলতেন।
ভুবন বিখ্যাত পরিচালক জেমস ক্যামেরুন ছিলেন একজন ট্রাক ড্রাইভার। একজন ট্রাক ড্রাইভারের জন্য বিদেশী একটা ভাষা রপ্ত করাটা যথেষ্টই কঠিন নয় কি ? হ্যা, ক্যামেরুন সাহেব যেহেতু কানাডিয়ান সেহেতু উনি হয়ত এই অবস্থায়, ভালোয় ইংলিশ চালিয়ে যেতেন।
আমরা কি জানি, জ্যাকি চান একজন রাজমিস্ত্রি ছিলেন? একজন রাজ মিস্ত্রী এর পক্ষে কি আধুনিক কালের টক শোতে ইংলিশে কথা বলা সম্ভব? আমি বাজী ধরতে পারি, জ্যাকি চান একজন চায়নিজ হিসাবে ইংলিশে এর চেয়েও খারাপ ভাবেই বলতেন। জ্যাকি চান কি পারেন নি তার ছাপ রেখে দিতে?
এমন উদাহরন দিলে লাখো বার দেয়া যাবে। তা আর প্রয়োজন বোধ করছিনা। এতক্ষণে হয়ত আপনার মেজাজ পুয়ায় খারাপ হয়েগেছে, কোথায় লিয়াকত আলী আর কোথায় জুতার কালি? আমি মোটেও তুলনায় যাচ্ছি না, আর তুলনায় যাওয়ার মত ধৃষ্টতা দেখালে আমিও যে ইউএসএ ইউনিভার্সিটি কিমবা জলিল সাহেবের মত হাসির উপকরন হয়ে যাব তাতে লেশ মাত্র সন্দেহ নাই।
আপনি চোখ বন্ধ করে বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, রজনীকান্তের অভিনয় আপনার হাসির খোরাক যোগায় না? রজনিকান্ত কে তামিল নাড়ু অধ্যাসিত এলাকার মানুষ পুজা করে তার চ্যারিটি কাজের জন্য, তার অভিনয়ের জন্য নয়। তারা রজনীকান্তের সিনেমা স্পরিবারে দেখে এইভেবে যে, এই সিনেমা থেকে অর্জিত টাকার একটা বিরাট অংশ যাবে রজনীকান্ত চ্যারিটি ফান্ডে, যা হয়ত দেবতাকে পুজা দেবার মতই পুন্যের কাজ।
আপনার মাথায় নিশ্চয় এতক্ষণ একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, ওঁরা তো কেও ছিল বাসের কনডাক্টর, ট্রাক ড্রাইভার, রাজমিস্ত্রি। জলিল সাহেব কি ছিলেন? আর এত টাকা উনি কোথা থেকে পাচ্ছেন?
জলিল ছিলেন একটা গার্মেন্টস এর আয়রন ম্যান। নিছক কাপড় আয়রন করা ছিল যার কাজ। ঢাকার অদূরে সাভারের আগে, পলো কিমবা ডেকো গার্মেন্টস এ গেলেই তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
যে মানুষটা একজন আয়রন ম্যান থেকে, দুইটা গার্মেন্টস এর ই মালিক হতে পারেন তাও মানুষের মন জয় করে বৈধ উপায়ে, সে আর যায় হউক কোন সাধারন মানুষ নন।
বাংলাদেশে তো শিল্পপতির অভাব নাই, কয় জন এসেছেন, ভংগুর এই সিনেমা জগতটাকে পুনরুদ্ধার করতে? নাজিমুদ্দিন চেয়ারম্যান, আজিজ মোহাম্মাদ ভাই কিমবা মনোয়ার হসেন ডিপজলের মত গডফাদাররা যখন ময়ূরী, পলি, নদি, মুনমুন, আরও নাম না জানা দেহ সর্বস্ব স্তুলাকার নায়িকা দের দিয়ে সংস্কৃতির কথা ঘুনাক্ষরেও চিন্তা না করে মুনাফা লুটেছে, তখন টু শব্দটা পর্যন্ত করি নি আমরা। আজ আমরা বড় সচেতন জলিলের ইংলিশ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে। সাইবার জগতে ঝড় তুলছি বিভিন্ন রঙ্গ রসের মাদ্ধমে।
জলিল সাহেবের পলো গার্মেন্টস এর ম্যানেজার সুমন সাহেবের সাথে আমার ব্যাক্তিগত ভাবে কথা হয়েছিল কিছুদিন আগে, জলিল সাহেব নাকি কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের বড় বড় শহর গুলোতে সিনেপ্লেক্স বানানোর প্রোজেক্ট হাতে নিচ্ছেন, আমাকে উনি জানালেন। এই কাজটা কে রজনীকান্তের চ্যারিটি ওয়ার্কস এর সাথে তুলনা করলে কি খুব অন্যায় হবে? অন্যায় হলে আগেভাগে ক্ষমা চাইছি।
শেখ মুজিবর রহমানের আমলে যেহেতু সিনেমা জগতকে শিল্প হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, তাই এই সরকার কে মাঝে মাঝে উচ্চ বাচ্চ করতে শোনা যায়। জাতির পিতার স্বপ্ন বলে কথা ! ওত টুকুই। এর বেশি কিছু নয়। এই অর্থ বছরে পুরা সিনেমা জগতের উন্নয়নের জন্য ৬০-৭০ কোটি টাকা বরাদ্ধ করা হয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের পকেট ভারি করে তার কত টুকুই এফডিসির উন্নয়নে খরচ হবে তা আমরা ঢের বুঝতে পারি। আপনি কি জানেন, আন্তর্জাতিক মানের কিছু শুটিং ইন্সট্রুমেন্ট কিনতে গেলে এই টাকা দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় সিকিভাগও কেনা যাবে না?
মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত আবার একের পর এক হিন্দি সিনেমা আনা হচ্ছে যা বাংলা সিনেমার জন্য অশনি সংকেত ।
জলিলের মত শতকারা দুই ভাগ শিল্পপতিও যদি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সিনেমার পিছনে লগ্নি করার সাহস দেখাত, তাহলে কে বলতে পারে আগামি দিনে আমাদের সিনেমাও আন্তর্জাতিক বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করবে না? দরকার শুধু পৃষ্ঠপোষকতার ।এখান থেকে পাওয়া