আপনি কি জানেন গতবছর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি এসিড সন্ত্রাসের শিকারে শীর্ষে রয়েছে আমাদের সিরাজগঞ্জে জেলা। সিরাজগঞ্জের তাঁতীরা তাঁতের সরঞ্জাম বাবদ অন্যান্য দব্যেরে মত এসিড কিনে কাপঁড়ে দিতে গিয়ে অনেকটাই অবৈধ উপায়ে বিক্রি করে দেয় তরুণ যুবকদের কাছে। এর ফলে তরুণ সমাজের একটা অংশ মেয়েদের উপর বিভিন্ন সময়ে নিক্ষেপ করে এসিড । যার ফলে...। এর ফলে কি হয়! এরপর কি হতে পারে! কি হতে একটি মেয়ের জীবনে। এর পর কি হয় সেই যুবকটি'র! এরপর । এপরপর ...?
কয়েকটি মেয়ের বাস্তবিক কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।
সতীনের বাবা-ভাইয়ের ছোঁড়া এসিডে কোহিনূর বেগমের (৩৫) সম্পূর্ণ মুখ, দুহাত, গলা, বুক ঝলসে যায়। বছর দুয়েক আগে সিরাজগঞ্জ জেলার শলঙ্গা থানার মধ্যপাড়া, ধরমনি গ্রামের গৃহিণী কোহিনূর বেগম ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য সতীনের বাপ ও ভাইকে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা দেয়। কথা ছিল ৬ মাসের মধ্যে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করবে। দুবছর ধরে টালবাহানা শুরু করলে কোহিনূর বেগম টাকা ফেরত চায়। এ নিয়ে শুরু হয় ঝগড়াঝাটি মনোমালিন্য।
কোহিনূর বেগমের মতে, টাকাও ফেরত দেয় না, ছেলেকেও বিদেশ পাঠায় না। ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য চাপ দিলেই তারা অনেকবার বিদেশে পাঠানোর তারিখ দিয়েও পাল্টায়। বারবার তারিখ পাল্টানোর জের ধরে পাল্টাপাল্টি ঝগড়া হয়। তিন মাস আগে তার তাকে মারধর করে। এতে তিনি নির্যাতনের মামলা করেন। মামলার জের ধরে পাল্টাপাল্টি ঝগড়া হয়। তিন মাস আগে তারা তাকে মারধর করে। এতে তিনি নির্যাতনের মামলা করেন। মামলার জের ধরেই টাকা দেয়ার মিথ্যা আশ্বাসে ২৪ মার্চ ২০০৭ তারিখে সকাল ১১ টায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে কোহিনূরকে রাস্তায় ডেকে নিয়ে আজগর শেখ (৬৫), মোজাম্মেল (৩৫) এবং মহব্বত (৩০) এই তিন জনে সামনাসামনি এসিড ছুঁড়ে পালিয়ে যায়।
শলঙ্গা থানার উপপরিদর্শক রেজাউস সাদিক (এস আই) এ মামলা সম্পর্কে জানান, ২ এপ্রিল ২০০৭ তারিখে বাদী আবদুল আলী এসিড অপরাধ দমন আইনের ৫ (১)/৭ এর ধারায় মামলাটি করেন। ১৭ মে ২০০৭ তারিখে মামলা তদন্তের চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়।
এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশনের ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সালের মার্চ পর্যন্তএক পরিসংখ্যানে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ জেলায় এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছে ১১১ জন। এদের মধ্যে ৪২ জন নারী, ৫৪ জন পুরুষ, ১২ জন মেয়েশিশু এবং ৩ জন ছেলেশিশু। ২০০৩ সালে ২১ জন এবং ২০০৫ সালে ২১ জন এসিডে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে ২০০৩ সালে ১০ জন নারী, ৮ জন পুরম্নষ এবং ৩ জন মেয়েশিশু আবার ২০০৫ সালে ৫ জন নারী, ১২ জন পুরম্নষ, ৩ জন মেয়েশিশু এবং ১ জন ছেলেশিশু এসিডে আক্রান্ত হয়।
১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে ২০০৭ সালের ৬ জুন পর্যন্ত আরেকটি তথ্যে জানা যায় সিরাজগঞ্জে ১১৪ জন এসিড আক্রান্তের শিকার হয়েছে। এসিড সহিংসতায় শীর্ষ জেলা হিসেবে সিরাজগঞ্জের অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
জানুয়ারি থেকে জুন ২০০৬-এর এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশনের এসিড মামলায় জেলায় ৬৩টি দায়েরকৃত মামলায় ৩টির শাস্তির রায় প্রদান হয়েছে। খালাস হয়েছে ২৩টি, অব্যাহতি হয়েছে ২২টি, ১৫টি বিচারাধীন। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহাজাদপুর থানার শাহজাদপুর থানার শাহাজাদপুর তালতলা গ্রামের জবা টেক্সটাইলের রঙের ডাই মাষ্টার মুহম্মদ ওসিল উদ্দিন পরামাণিক ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, সাদা রঙের কাপড় লাল, খয়েরি, কমলা ইত্যাদি রঙ করতে এসিড ও নাইট্রিক ব্যবহার করা হয়। এই এসিড নারায়ণগঞ্জ জেলার নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থেকে ২৫ কেজির জার হিসাবে কারখানায় কিনে আনা হয়। তবে শাহাজাদপুর বাজারের ১০-১২টি দোকানে খোলা এসিড বিক্রি হয়। ছোটছোট তাঁত শিল্পে কম পরিমাণ এসিড লাগে। এসব দোকান থেকে তাঁতীরা ১০ থেকে ২০ তোলা এসিড কিনে তাদের কাজ সারে। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর ইয়ং মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল হাকিমের মতে, সিরাজগঞ্জ তাঁত অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় তাঁতি সম্প্রদায় তার কাজের প্রয়োজনে এসিড ব্যবহার করে। সুতা বা কাপড় রঙ করার জন্য নানারকম মেডিসিন ব্যবহার করার পরও এসিড না মিশালে এর রঙ পাকা হবে না। যারা কাজের প্রয়োজনে এসিড ব্যবহার করছেন তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। এসিড ব্যবহারে সরকারি বিধিমালা সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কে এসিড বৈধভাবে ব্যবহার করছে, কে অবৈধভাবে ব্যবহার করছে? তখনই এর সঠিক প্রয়োগ বেরিয়ে আসবে। সরকারি বিধিমালার সুষ্ঠু প্রয়োগ না হওয়ায় ভিন্নমাত্রা থেকে এসিড সংগ্রহ করে এসিড সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটছে। যারা এসিড বিক্রি বা বহন করছে তাদের লাইসেন্স না থাকলে চিহ্নিত করা যাবে এটি অবৈধভাবে ব্যবহার হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে যারা কিনছে তারও অবৈধভাবে কিনছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সঠিক সরকারি ব্যবহার নিয়মনীতি। এটি করলে এসিড সহিংসতা বন্ধ হবে। তিনি বলেন, তাঁত ব্যবসায়ীরা যাতে লাইসেন্সের মাধ্যমে বৈধভাবে এসিড ব্যবহার করে এ বিষয়ে তাদের অবগত করতে হবে।
এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২-এর কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে। ছোট তাঁত ব্যবসায়ী, বড় তাঁত ব্যবসায়ী, স্বর্ণ ব্যবসায়ী। এরা তাদের কাজে এসিড ব্যবহার করে। কাজের প্রয়োজনে এদের অনেকে বেশি এবং অনেকে কম এসিড ব্যবহার করে। ব্যবহার পরিমাণের ওপর না করে আইনে সবার জন্য এসিডের লাইসেন্স ফি সমান ধার্য করা হয়েছে। একজন ছোট তাঁত ব্যবসায়ী, যিনি কম পরিমাণ এসিড কিনছে তার জন্য এটা ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যায়। ব্যবহার বিধি অনুযায়ী লাইসেন্স ফি ধার্য করা দরকার। এই বিষয়গুলোর আইনে সংশোধন করার প্রয়োজন রয়েছে।
এ এলাকায় আমরা এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২ প্রণয়নের কার্যকারিতার সঙ্গে এসিড ব্যবহারের বিধিনিষেধের বিষয়গুল জনসমক্ষে তুলে ধরছি। এসিড সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য মতবিনিময় সভা করছি। তাঁত অঞ্চলে যারা কাজের প্রয়োজনে এসিড কিনছে তাদের এর সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ, এসিড সহিংসতা কিভাবে প্রতিরোধ করা যাবে জনগণের মধ্যে এর প্রচার করে জনসচেতনতা গড়ে তুলছি।
উত্তরণ মহিলা সংস্থার (সামস) নির্বাহী পরিচালক সাফিনা লোহানীর মতে, এ জেলার রায়গঞ্জ, শাহজাদপুর, বেলকুচি এই তিন এলাকায় এসিড সহিংসতা বেশি হচ্ছে। এসিড সহিংসতা দমনে সরকারি প্রশাসন এবং সুশীল সমাজের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। কমিউনিটিতে বেইজ অর্গানাইজেশনে তৃণমূল পর্যায়ে যেসব কর্মী কাজ করছে তারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় এসিড সহিংসতা প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। এসিড সহিংসতার ওপর যে ভিডিও ফিল্মগুলো রয়েছে তা মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে এসিড নিক্ষেপের ক্ষতিকর দিক, চিকিসা এবং আইনে এসিড নিক্ষেপকারী ব্যক্তির শাস্তির চিত্র দেখানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে এসিড সহিংসতা প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে। এ ও দেখা যাচ্ছে অনেক ভিকটিম গ্রামের প্রভাবশালী মহলের চাপে ন্যায্য বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ তারা অর্থের বিনিময়ে সালিশ ডেকে মামলা আপস করে দেয়।
তথ্যসূত্রঃ ইত্তেফাক