অাশ্বীকান্দার আত্মাগুলো
লেখক: Srabon Ahmed (অদৃশ্য ছায়া)
.
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। রোকসানা আপু বারবার বললেন, রাতটা থেকে যা। সকাল হলে তারপর তোরা যাস। কিন্তু ফয়সাল ভাই নাছোড়বান্দা। তিনি আবার এক কথার মানুষ। কোনমতেই তিনি রাতটা থাকতে রাজি হলেন না। তার নাকি আবার আগামীকাল সকাল ১০ টার বাসে ঢাকা যেতে হবে। যদি মিস হয়ে যায়, সেই ভয়ে তিনি এই সন্ধ্যাবেলায় আমাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। তিনি অবশ্য আমাকে বলেছিলেন, "নিরব, তুই থাকতে চাইলে থাকতে পারিস।"
কিন্তু আমারও একা একা থাকতে মনটা সায় দিচ্ছিলো না। তাই আমিও ভাইয়ার সাথে রওনা দিলাম।
মাস ছয়েক পরে আপুর বাড়িতে আমরা দুই ভাই বেড়াতে এসেছিলাম। কিন্তু বেড়াতে এসে আমি চারিদিকটা ঠিকমতো ঘুরেও দেখতে পারলাম না। এসবের জন্য অবশ্য দায়ী ফয়সাল ভাই। কি কারণে যে তার সাথে বেড়াতে আসলাম! সকালে এসেছিলাম, আর এই সন্ধ্যাবেলায় চলে যাচ্ছি। মনে রাগ হলেও বড় ভাই বলে তাকে কিছু বললাম না।
আপুর বাড়ি থেকে বের হয়ে মিনিট দশেক হেঁটেছি মাত্র, অমনি কোথা থেকে একজন মুরুব্বি গোছের লোক এসে বললেন, বাবারা আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবে? প্রথমত লোকটির কথায় আমি কোন ভ্রুক্ষেপ করছিলাম না। তিনি বারবার আমাদের অনুরোধ করলেন। তিনি বললেন, বাবারা সামনের ঐ রাস্তার ওপারে আমার কিছু মালামাল পড়ে আছে। কিন্তু আমার একার পক্ষে সেগুলো বহন করা সম্ভব না। যদি তোমরা একটু সাহায্য করতে, তবে বড় উপকৃত হতাম।
লোকটি কথাগুলো বলছেন, আর আমি মুগ্ধ নয়নে তার দিকে চেয়ে আছি। অবশ্য চেয়ে থাকারও যথেস্ট কারণ আছে। লোকটির বয়স কম করে হলেও ৫০ পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তিনি এতো সুন্দর করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছেন, যেন তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বারবার অনুরোধ করাতে ফয়সাল ভাই ভদ্র লোকটিকে বললেন, চলুন।
রাস্তার ওপারে যেতে যেতে লোকটি নিজেই আমাদেরকে তার পরিচয় দিলেন। তিনি এই অাশ্বীকান্দা গ্রামেরই ছেলে। আমরা বর্তমানে যেই রাস্তাটার দিকে যাচ্ছি, সেটা ভাঙাচুড়া পিচঢালা রাস্তা। রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখানেই তার বাড়ি। লোকটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। প্রায় বছর দশেক পর তিনি গ্রামে এলেন।
পরিচয় দেওয়ার সময় তিনি আরও বললেন, তার দুইটা মেয়ে ছিলো। উনি এই কথাটা বলার পরপরই ফয়সাল ভাই বললেন, ছিলো মানে? এখন তারা কোথায়?
লোকটি খানিক চুপ থেকে বললেন, চলো আমার সাথে। তোমরা নিজেরাই দেখতে পারবে।
.
খানিক বাদেই আমরা রাস্তার ওপারে পৌঁছালাম। এদিকটা একেবারে নির্জন। সন্ধ্যা হলেও কিছুটা আলো রয়েই গিয়েছে এ ধরনীর বুকে। সেই আলোতে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলাম, এই রাস্তাতে সচরাচর কারো পা পড়ে না। অর্থ্যাৎ কেউ সচরাচর এই রাস্তাতে আসে না অতি প্রয়োজন ছাড়া।
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম, চাচা আপনার মালামাল কই? আমার কথাতে লোকটি মুচকি হাসলেন। হাসির কারণটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েই চোখ পড়লো লোকটির সামনে থাকা কয়েকটা ব্যাগের দিকে। অদ্ভুত ব্যাপার, এই ব্যাগগুলো কোথা থেকে এলো? মাত্রই তো দেখলাম কোন মালমাল, ব্যাগ পত্র, কিছুই নেই এখানে। তবে হঠাৎই এগুলো এলো কোথা থেকে? আমি ফয়সাল ভাইয়কে বিষয়টা বলতে গিয়ে দেখলাম তিনি আমার থেকে পাঁচ হাত দূরে থাকা একটা বস্তা কাঁধে করলেন।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকালাম। তিনি আমার তাকানো দেখে বললেন, বাবা তুমি এই ব্যাগগুলো নাও।
ধীর পায়ে ব্যাগের কাছে এগিয়ে যেতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো। ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। লোকটা গেলো কোথায়! ঘুরে রাস্তার দিকে তাকালাম। দেখলাম, ফয়সাল ভাই আর ঐ লোকটি রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করেছেন।
আমি একটু দ্রুত হেঁটে তাদের সাথ ধরলাম।
এখন সন্ধ্যার মৃদু মৃদু আলোটাও নেই। পুরো অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছে চারপাশ। ফয়সাল ভাই আর লোকটি, দুজন পাশাপাশি সামনে হাঁটছেন। আর আমি তাদের পিছু পিছু। তারা কী যেন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। পেছন দিক থেকে বাতাস আসার কারণে ঠিক ভাবে শুনতে পারছি না। রাস্তাটাও ব্যাপক ভাঙাচুড়া। কোন একটা গর্তে পা পড়লেই মচকে যাবে। সাবধানতা অবলম্বন করাটাই শ্রেয়। তাই আর তাদের কথার দিকে কান না দিয়ে পথ দেখে দেখে হাঁটতে থাকলাম। হাঁটার সুবিধার্থে মোবাইলের আলোটা জ্বালিয়ে নিলাম। আলো জ্বালাতেই লোকটি বলে উঠলেন, আলো নিভাও আলো নিভাও। লোকটির কন্ঠস্বর শুনে ভয়ে ভয়ে আমি আলোটা নিভিয়ে দিতেই ফয়সাল ভাই বললেন, নিরব আলোটা জ্বালা। নয়তো পথ চলতে অসুবিধা হচ্ছে। ভাইয়ের কথার বিপরীতে লোকটি আগের কন্ঠস্বর বজায় রেখে বললেন, না আলো জ্বালাবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? তিনি খানিকটা সময় নিয়ে গুছিয়ে গাছিয়ে বললেন, "এই রাস্তাতে বন্য পশুদের উপদ্রব রয়েছে। আলো দেখলে তারা ছুটে চলে আসবে এদিকে। একবার একটা ছেলেকে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো এই রাস্তায়। ভোর বেলা যখন সাহেদ ছেলেটিকে দেখেছিলো, ঠিক তখনই সে আমাকে খবর দেয় এবং বলে, স্যার চলুন আমার সাথে। লোহার রাস্তাটার শুরুর কাছে একটা ছেলেকে পাওয়া গিয়েছে। পরে আমি সাহেদের সাথে সেখানে গিয়ে দেখি সত্যিই তো একজন রক্ত মাখা শরীর নিয়ে শুয়ে আছে! পরক্ষণেই আমি খেয়াল করে দেখলাম, ছেলেটির হাতে একটা মোবাইল ফোন। আর সেটাতে আলো জ্বালানো।"
লোকটির কথা শুনে আমি পায়ের নিচের রাস্তাটার দিকে তাকালাম। দেখলাম আসলেই তো এটা একটা লোহার রাস্তা। আমি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এই সাহেদ টা কে? তিনি মুখে এক চিলতে হাসির রেখা টেনে বললেন, সে আমার বাগানের মালী। আমাদের কথা বলার মাঝে হঠাৎই ফয়সাল ভাই চিৎকার দিয়ে উঠলেন। আমি তাড়াতাড়ি করে কোন নিষেধের তোয়াক্কা না করে মোবাইলের আলোটা জ্বালালাম। দেখলাম ফয়সাল ভাই রাম্তার উপরে বসে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ভাইয়া? তিনি বললেন, তেমন কিছু না। গর্তে পা পরেছিলো। কিন্তু....
ফয়সাল ভাই কিন্তু বলে চুপ হয়ে গেলেন। আমি বললাম, কিন্তু কী ভাইয়া? ঠিক তখন পাশে থাকা মুরুব্বি লোকটি বললেন, কিন্তু সে গর্তে পা পড়ার পরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো, হঠাৎই কে যেন তাকে ধরে ফেলে এবং সুন্দর করে ওখানে বসিয়ে দেয়।
লোকটির কথা শুনে আমি ভাইয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। আমার চোখের দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন ছিলো যে, ভাইয়া লোকটি যা বলেছে তা কী সঠিক?
ভাইয়া আমার দৃষ্টিভঙ্গির দিকে খেয়াল না করে লোকটিকে প্রশ্ন করলেন, আপনি জানলেন কী করে? লোকটি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, আমি সব জানি।
লোকটির কথা শুনে এবার অবাক না হয়ে পারলাম না, তিনি সব জানেন মানে? তিনি কী বোঝাতে চাইছেন! লোকটি তার কোর্টের পকেট থেকে কিছু একটা বের করলেন, অন্ধকার থাকার কারণে ঠিক বুঝতে পারলাম না কী বের করলেন। আমি কিছু বলতে যাবো তাকে, তার আগে তিনি আমার হাতে কিছু একটা গুঁজে দিলেন। আমি হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম না, এটা চকলেট। কিন্তু এই লোকের কাছে চকলেট থাকবে কেন? তিনি তো আর বাচ্চা নন। লোকটি আমাকে চকলেকটি খেতে বললেন। আমিও সাতপাঁচ না ভেবে খেতে শুরু করলাম।
চারিদিকে যে বিদঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছিলো, কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে আলোর দেখা মিললো। এখন আমরা সেই আলোকিত পথে ধরে সামনের দিকে হেঁটে চলেছি।
.
কিছুদুর হাঁটার পর আমার মনে হতে লাগলো, আমাদের পেছন পেছন আরো চারটি পা হেঁটে চলেছে। অর্থ্যাৎ দুটো মানুষ। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে দেখলাম কিছুই নেই। লোহার রাস্তাটা শেষ হতেই একটা মেঠোপথ পেলাম। মেঠোপথে পা রাখতেই পকেটে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠলো। হঠাৎ করে এমন কেঁপে ওঠায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। ফোন বের করে দেখি আরিকা ফোন দিয়েছে। কল ধরতেই সে বলে উঠলো, নিরব তুমি আর সামনে যেও না। তার কন্ঠটা ভয় মিশ্রিত এবং অস্থির কিসিমের ছিলো। আমি তাকে কিছু বলার আগেই সে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো। তার অমনভাবে এই অদ্ভুত কথাটা শোনার পর নিজের মধ্যে ভয় কাজ করতে লাগলো। পুরো শরীর ক্রমেই ভারি হয়ে আসছে। আমি কাঁপছি। কাঁপা কাঁপা হাতে আরিকাকে কল ব্যাক করলাম, কিন্তু নম্বর বন্ধ দেখায়। কোন কিছু না ভেবে ফয়সাল ভাইকে ডাক দিয়ে বললাম, ভাইয়া আর এক পাও সামনে এগোবেন না। কথা বলতে দেরি শুধু, ভাইয়ার থামতে দেরি হলো না। তিনি বললেন, কেন কী হয়েছে?
আমি বললাম, কী হয়েছে সেটা পরে শুনলেও চলবে। আমাদের আর সামনে যাওয়া ঠিক হবে না। পাশ থেকে মুরুব্বি লোকটি করুণ সুরে বললেন, কেন বাবা? সামনে গেলে কী হবে? ঐ যে দেখো আমার বাড়ি দেখা যাচ্ছে। এইটুকু পথ এগিয়ে দিলে বড় উপকার হতো। লোকটির কথা শুনে আমি সামনে তাকিয়ে দেখি সত্যিই তো এখান থেকে কিছুটা দূরে একটা বড় বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই বাড়িটা তো একটু আগে কোথাও দেখলাম না।! নিশ্চয়ই কোন গন্ডগোল আছে। এই লোকটিকে মোটেও বিশ্বাস করা যাবে না। এই লোকের সাথে যখন থেকে আছি ঠিক তখন থেকে অদ্ভুত লাগছে চারিদিকের কার্যক্রম এবং এই লোকের কার্যপ্রণালী। নিজের কাছে কোনকিছু স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফয়সাল ভাই বললেন, চল এগিয়ে দিয়ে আসি। এইতো আরেকটু পথ বাকি আছে। পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবো। ভাইয়ার মুখে এমন কথা শুনে লোকটি মিটিমিট হাসলেন, যা আমার চক্ষু এড়ালো না। তার এই হাসির মধ্যে চতুরতার গন্ধ পাচ্ছি আমি। নিশ্চয়ই কোন গন্ডগোল আছে এর মধ্যে। আমাদের সামনে আগানো টা মোটেও ঠিক হবে না বলে আমি মনে করলাম। তবুও ভাইয়ার কথা শুনে এগাতে থাকলাম। এক পা এক পা করে সামনে এগোচ্ছি আর মনে হচ্ছে পেছন থেকে আরিকা আমাকে ডেকে বলছে, নিরব তুমি আর এক পাও সামনে যেও না। হঠাৎই মনে প্রশ্ন জাগলো আরিকা আমাকে এসব কথা বলবে কেন? তাহলে কী সে আমাকে অনুসরন করছে?
.
অবশেষে আমরা তিনজন বাড়িটির সামনে উপনীত হলাম। চিরিদিক নিরবতা। কোন টু শব্দও নেই। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এটা যেন একটা প্রাণশূন্য জায়গা। ফয়সাল ভাই বস্তা গুলো নামিয়ে বললেন, আংকেল এবার আমরা আসি।
তিনি বললেন, সে কী কথা! তোমরা আমার উপকার করলে, আমাকে জিনিসগুলো বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে সাহায্য করলে, তবে কী তোমাদের এমনি এমনি যেতে দিবো আমি? অন্তত দুজনে দু কাপ চা তো খেয়ে যাবে। ভদ্রতার খাতিরে ভাইয়া বললেন, আচ্ছা চলুন।
সদর দরজার বেল চাপতেই দরজাটা খুলে গেলো। ভাইয়া আর লোকটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। সাথে আমিও ঢুকলাম। কিন্তু আমার মাথায় একটা জিনিস কাজ করছে না। বেল চাপতেই দরজাটা খুললো কিভাবে? দরজা থেকে খানিকটা দূরে যেতেই দরজাটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেলো। বিশাল বাড়ি, বাড়ির প্রতিটি স্থানে কোন না কোন জিনিস পড়ে আছে। পড়ে আছে বলতে বাড়ির প্রতিটি স্থানই কোন না কোন জিনিস দিয়ে সাজানো।
আমি বাড়িটার চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখছি। হঠাৎই মাথায় প্রশ্ন জাগলো, এতো বড় বাড়িতে কি তিনি একা থাকতেন? আর যদি একাই থেকে থাকেন। তবে টানা দশ বছর পর বাড়িটির এই চাক্যচিক্যতা থাকার কথা না। কেননা, তিনি তো ঢাকায় থাকেন। যেখানে মানুষের বসবাস নেই, সেখানটা মাকড়সার জালে ভরে যায়। এতো চাকচিক্য থাকে না তাতে।
কৌতুহলবশত আমি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, আংকেল এই বাড়িতে কী কেউ নেই? তিনি বললেন, আছে তো। আমার দুইটা মেয়ে আছে। আমার কথোপকথনটি ফয়সাল ভাইও লক্ষ্য করছিলেন। তিনি বললেন, দুইটা মেয়ে মানে?
লোকটি ঐ আগের মেই মুচকি হাসিটা মুখের কোণে রেখে বললেন, হ্যাঁ দুইটা মেয়ে। অবাকে আপ্লুত আমি। মনে প্রশ্ন জাগলো, যদি তার দুইটা মেয়ে এখানে থেকে থাকে, তবে তাদের ভরণপোষণ কে করান? নিয়মমাফিক ধরলাম, এই লোকটিই মেয়ে দুইটার ভরণপোষণের টাকা দেন। কিন্তু এই বাড়ির আশেপাশে তো কোন হাঁট বাজার নেই। তবে তারা কিভাবে খেয়ে পড়ে এখানে থাকে।
ভাবনার অন্তে মোবাইলটা আবার কেঁপে উঠলো, বের করে দেখি এলার্ম বাজছে। কী ব্যাপার! তাহলে কী রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গিয়েছে? ঘড়ির সময়টা দেখে আমি চমকে গেলাম, ভোর চারটা বাজে। আধা ঘন্টা পর ফজরের আজান দেবে। আমি অবাক নয়নেই ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাইয়া সময়টা দেখে নিন। তিনি মোবাইল বের করে সময়টা দেখেই আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বললেন, এটা কী করে সম্ভব!
.
লোকটি সাথে গেস্টরুমে বসে আছি। খানিক বাদেই দুইটা মেয়ে চা নিয়ে এলো আমাদের জন্য। মেয়ে দুইটার মাথায় ঘোমটা দেওয়া। চা টা হাতে নিয়ে খেতে যাবো, ঠিক তখনই চায়ের জায়গাতে কাঁচা রক্তের গন্ধ পেলাম। মুখের কাছ থেকে কাপটা সরিয়ে কাপের দিকে তাকিয়ে দেখি চায়ের বদলে সেখানে রক্তরস। রক্ত দেখামাত্র হাত থেকে কাঁপটা পড়ে গেলো। পাশে তাকিয়ে দেখি ফয়সাল ভাই এখনও চায়ের কাপটা হাতে করেন নি। তিনি মেয়ে দুইটার সাথে গল্পে মেতে আছেন। আমি এবার মেয়েগুলোর দিকে তাকাতেই থমকে গেলাম। আরিকা এখানে! আর ঐ পাশের মেয়েটা কে? আরে ওটাতো সুমাইয়া!
এরা এখানে এলো কী করে? আরিকার চোখে চোখ পড়তেই সে আমাকে বললো, কী হলো নিরব? চা টা ফেলে দিলে কেন?
আমার পুরো শরীর তখন আবারও ভারি হয়ে এলো। ঘামছি প্রচুর পরিমাণে। কথা বলার শক্তিটুকুও নেই। আরিকা আর সুমাইয়া মেয়েটা ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। তাদের চেহারার আকৃতি ততক্ষণে বিভৎস রুপ ধারণ করেছে। পাশ থেকে সেই মুরুব্বি লোকটির অট্টহাসি শুনতে পেলাম। যেই হাসিতে পুরো বাড়ি মুখরিত হচ্ছে। তিনি বলছেন, দিনের আলো ফোটার আগে তাজা চোখ গুলো তুলে ফেল তোরা। দ্রুত কর। আমি পেছনে আগাতে আগাতে সোফায় বেধে মেঝেতে পড়ে গেলাম। অন্যদিকে ফয়সাল ভাই দেয়ালে বেঁধে গিয়ে আর পেছনে যেতে পারছেন না। ক্রমেই আরিকা আর সুমাইয়ার শরীর মিলিয়ে যেতে থাকলো, শুধু হাত দুটো ছাড়া। বড় বড় নোখওয়ালা হাত। হাত দুটো ঠিক যখন আমার চোখের সামনে চলে এসেছে, ঠিক তখনই দূরের মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে এলো। সাথে সাথে সেই হাত দুটোও সামনে থেকে মিলিয়ে গেলো। তারপর কী হয়েছিল সেটা মনে করতে পারছি না।
যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন নিজেকে একটা পোড়া বাড়িতে আবিষ্কার করলাম। চারিদিকে মাকড়সার জাল দিয়ে ভর্তি। বন্য লতাপাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারপাশটা জুড়ে। পাশে তাকিয়ে দেখি ফয়সাল ভাই মাকড়সার জালের মধ্যে শুয়ে আছেন। আমি উঠে গিয়ে তাকে ডাক দিতেই তিনি ধচমচিয়ে উঠে পড়লেন। পুরো শরীর জুড়ে গোবরের গন্ধ তার। কারণ তিনি গোবের উপরেই শুয়ে ছিলেন।
.
পোড়া বাড়ি থেকে যখন বের হলাম, তখন দেখলাম চারিদিকে শুধু মাঠ আর মাঠ। আশেপাশে কোথাও কোন বাড়ি ঘর নেই। দূর দূরান্তে চেয়েও কোন জনমানবের হদিশ পেলাম না। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখি সকাল ৭টা বেজে ৯মিনিট। লোকেশান অন করে বাড়ি যাওয়ার পথ খুঁজে পেলাম দুজনে। দুজনে বাড়ির পথে হাঁটছি। হঠাৎই কী মনে করে যেন দুজনই হেসে উঠলাম। আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি হাসলেন কেন? তিনিও আমার দিকে চেয়ে আমাকেও একই প্রশ্ন করলেন।
আমার ফোনে চার্জও নেই তেমন। ভাইয়াকে বললাম, আপনার ফোনটা দেন। তিনি ফোনটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি আমার ফোন থেকে আরিকার নাম্বারটা নিতে গিয়ে তার নাম্বারটা খুঁজে পেলাম না। নোট প্যাডে তার নাম্বারটা সেভ ছিলো, সেখানেও পেলাম না।
তাহলে কী আরিকা নামের কেউ ছিলোই না কখনও? আমি কী তাহলে এতো দিন ধরে এই অাশ্বীকান্দার আরিকা নামের আত্মাটার সাথে প্রেম করেছি? আর ঐ সুমাইয়া! সে তো আরিকার বান্ধবী ছিলো। তাহলে কী দুজনই এই পোড়া বাড়ির মেয়ে? এখন আমার ঐ মুরুব্বি লোকটির একটা কথা মনে পড়ছে। তিনি আমাদের তার নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় বলেছিলেন, তার দুইটা মেয়ে ছিলো। এখানে ছিলো বলতে কী এই আত্মাগুলো ছিলো?