মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। গতকাল পঞ্চম সাক্ষী মাহতাব উদ্দিন হাওলাদার সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। আগের সাক্ষীদের মতো এই লোকের বিরুদ্ধেও চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই ছ্যারাব্যারা অবস্থার কথা জাতি কেবল জানতে পারছে দৈনিক নয়া দিগন্ত, আমার দেশ আর জামাতের পত্রিকা সংগ্রামসহ হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকার মাধ্যমে।
দৈনিক প্রথম আলোসহ প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী পত্রিকাগুলো এইসব সাক্ষীদের জেরা ছাপাচ্ছে না। এর কারণ কী? জাতিকে সত্য থেকে অজ্ঞ রাখা?
বিবেকবান মানুষ মাত্রই এসব জেরা পড়লে বুঝতে পারতেন যে, মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো কতটা ঠুনকো আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
সাক্ষীরা যে শিখিয়ে দেয়া বুলি বলছে, তাও স্পষ্ট হয় এসব পড়লে।
অতীতের কোনো কিছুই মনে থাকে না এসব সাক্ষীর। তারা কেবল সাঈদীর অপরাধটুকুই ভালো করে জানে!
গতকালের জেরার দিকে লক্ষ্য করুন:
আইনজীবী : পিরোজপুর মহকুমায় সর্বপ্রথম রাজাকার বাহিনী কবে গঠন হয় বলতে পারবেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : আপনার এলাকা টেংরাটিলাতে কবে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় জানা আছে?
সাক্ষী : টেংরাটিলায় কোনো রাজাকার বাহিনী ছিল না।
আইনজীবী : টেংরাটিলায় কোনো রাজাকার ছিল?
সাক্ষী : একজন ছিল।
আইনজীবী : বরিশাল রাজাকার অ্যাডজুন্যান্ট কে ছিলেন বলতে পারবেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : পিরোজপুর মহকুমায় রাজাকার বাহিনীর প্রধানের নাম বলতে পারবেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : পূর্ব পাকিস্তান পিস কমিটি কবে গঠিত হয় বলতে পারবেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : কোথায় গঠিত হয় তাও জানা নেই?
সাক্ষী : না, জানা নেই।
আইনজীবী : শান্তি কমিটির প্রধান কে ছিল তাও জানা নেই?
সাক্ষী : জানা নেই।
আইনজীবী : বরিশালে কবে কোথায় বসে শান্তি কমিটি গঠিত হয়?
সাক্ষী : জানা নেই।
আইনজীবী : এই কমিটির সভাপতি সেক্রেটারি কারা ছিলেন জানা আছে?
এ পর্যায়ে আদালত মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীকে বলেন, এত কিছুর কি দরকার আছে। তখন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, সাক্ষীর কোনোটাই জানা নেই। কিন্তু ৪০ বছর আগে কবে পাক হানাদারবাহিনী পারেরহাটে আসছে, কবে, কোথায়, কার নেতৃত্বে হামলা হয়েছে, তা সব নির্দিষ্ট করে বলে দিতে পারছে। তখন আদালত বলেন, ঠিক আছে জিজ্ঞেস করেন।
আইনজীবী : বরিশাল জেলার উল্লেখযোগ্য কোনো শান্তি কমিটির নেতার নাম মনে আছে?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : বরিশালের এ কে ফয়জুল হকের নাম শুনেছেন?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তার অবস'ান কী ছিল বলতে পারবেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : পিরোজপুর মহকুমায় কবে, কোথায় শান্তি কমিটি গঠিত হয় বলতে পারবেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : সভাপতির নাম বলতে পারবেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : ১৯৭১ সালের ৪ঠা মে পাক আর্মি সর্বপ্রথম পিরোজপুর আসে?
সাক্ষী : ৪ঠা মে নয় ৩রা মে।
আইনজীবী : পারেরহাট আসে ৮ মে?
সাক্ষী : ৭ মে।
আইনজীবী : টেংরাটিলার শাহাদাত হোসেনকে চেনেন?
সাক্ষী : চিনতাম। তিনি মারা গেছেন।
চুরির অভিযোগ
আইনজীবী : আপনি এবং আপনার ভাইয়েরা মিলে শাহাদাত হোসেনের বাড়ি থেকে কাঠ চুরি করেন। পরে পুলিশের সহায়তায় আপনাদের বাড়ি ঘেরাও করে সে কাঠ উদ্ধার করে ।
সাক্ষী : সত্য নয়
আইনজীবী : ওই চোরাই মাল উদ্ধার করে পরে তা এই মামলার বাদি এবং এক নম্বর সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদারের জিম্মায় রাখা হয় কাঠের মালিক নির্ধারণের আগ পর্যন্ত ।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী : মালামাল পরে শাহাদাত হোসেনকে ফেরত দেয়া হয়।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আগের সাক্ষীরা তাদের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ স্বীকার করেছে। এই সাক্ষীর চুরির অভিযোগের ব্যাপারেও সাঈদীর আইনজীবীরা আগামীতে প্রমাণ উপস্থাপন করবেন বলে জানিয়েছেন।
আইনজীবী : আপনার পিতার চার স্ত্রী।
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : আপনি দু’টি বিয়ে করেছেন?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : আপনি পারেরহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : আপনার ছেলে জিয়ানগর ছাত্রলীগের সভাপতি।
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : স্বাধীনতা যুদ্ধকালে আপনি স্কুলের ছাত্র ছিলেন?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : কোন স্কুলের?
সাক্ষী : পারেরহাট রাজলক্ষ্মী মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
আইনজীবী : বালিপাড়া ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় আপনার বাড়ি থেকে ১২-১৩ মাইল দক্ষিণে।
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : আপনি ওই স্কুলের নিয়মিত ছাত্র ছিলেন না।
সাক্ষী : সত্য।
আইনজীবী : ১৯৭৪-৭৫ সালে এই স্কুলের একজন নিয়মিত ছাত্র না হওয়া সত্ত্বেও আপনি নবম শ্রেণীতে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করেন এসএসসি পরীক্ষার জন্য?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : ওই নিবন্ধে আপনার জন্মতারিখ লেখা আছে ৬ জুন ১৯৫৯ সাল।
সাক্ষী : হেডমাস্টার কী লিখেছিল তা আমার মনে নেই।
আইনজীবী : জন্মনিবন্ধন ফরমে আপনার জন্মতারিখ লেখা আছে ১৫/৯/১৯৬৩ ।
সাক্ষী : স্মরণ নেই। (আমি ১৯৭৪-৭৫ সালে রেজিস্ট্রেশন করলেও এসএসসি পাস করি ১৯৭৯ সালে। সে অনুযায়ী জন্মনিবন্ধন ফরমে জন্মতারিখ লেখা হয়। আমি যখন এসএসসি পাস করি তখন আমার ছেলে ফাইভে পড়ে।)
আইনজীবী : এই আদালতে জবানবন্দী দেয়ার আগে অন্য কোথাও জবানবন্দী দিয়েছেন?
সাক্ষী : হ্যাঁ। ২০০৮ সালে পিরোজপুর জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেটের কাছে।
আইনজীবী : কত তারিখে বা কোন মাসে স্মরণ আছে?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : ২০০৮ সালে জবানবন্দীর আগে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অন্য কোথাও কোনো অভিযোগ করেছেন?
সাক্ষী : না।
মারাত্মক গলদ
আইনজীবী : এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতে কি সই করেছিলেন?
সাক্ষী : না।
যেসব বিষয় তিনি খুব ভালো জানেন
আইনজীবী : আপনি আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে দেলোয়ার হোসেন শিকদার বর্তমানে সাঈদী বললেন। ১৯৭১ সালে মাওলানা সাঈদীর নাম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছিল, শিকদার ছিল না ।
সাক্ষী : সত্য নয়। দেলোয়ার হোসেন শিকদার ছিল।
আইনজীবী : ওনার নাম সব সময়ই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছিল।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী : ‘বর্তমানে সাঈদী’ কথাটি আপনি আগে কোথাও বলেননি। শিকদার কথাটিও বলেননি।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী : মাওলানা সাঈদী সাহেবকে কত দিন ধরে চেনেন?
সাক্ষী : ১৯৭০ সাল থেকে।
আইনজীবী : কিভাবে চেনেন?
সাক্ষী : পারেরহাট বাজারের ফুটপাথে বসে তেল নুন বিক্রি করত সে কারণে চিনি।
আইনজীবী : দানেশ আলী মোল্লা চেয়ারম্যান ছিলেন
সাক্ষী : হ্যাঁ, পরে শান্তি কমিটির সাথেও জড়িত হয়।
আইনজীবী : সেকেন্দার শিকদার কী করত?
সাক্ষী : জমিজমা ছিল। তা দেখাশোনা করত। পারেরহাট বাজারে একটি দোকান ছিল তা দেখাশোনা করত। আর সকাল-বিকাল পারেরহাট বাজারে ঘোরাঘুরি করত।
আইনজীবী : সেকেন্দার শিকদার খুব প্রভাবশালী ছিলেন?
সাক্ষী : জমিজমা তেমন না। তবে তিনি খুব সম্মানিত লোক ছিলেন।
আইনজীবী : মোসলেম মাওলানা কী করত?
সাক্ষী : জমিজমা দেখাশোনা করত। গণ্ডগোলের সময় পারেরহাট বিপদ সাহার বাড়িতে থাকত।
আইনজীবী : বিপদ সাহার মেয়েকে বিয়ে করে জামাই হিসেবে থাকত?
সাক্ষী : বিয়ে করেছিল কি না জানি না। তবে ভানু সাহাকে নিয়ে থাকতেন।
আইনজীবী : স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পিরোজপুরে পাকবাহিনী আসার খবর পেয়ে অধিকাংশ হিন্দু ভারতে চলে যায়?
সাক্ষী : সত্য।
আইনজীবী : মোসলেম মাওলানা পিরোজপুর বা জিয়ানগর ওলামা লীগের সভাপতি।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী : তিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী : পিরোজপুর শত্রুমুক্ত হওয়ার সময় পিরোজপুর সদর থানা কে সর্বপ্রথম দখল করেন?
সাক্ষী : মেজর জিয়াউদ্দিন।
আইনজীবী : পারেরহাট যখন রুহুল আমিন নবিনের নেতৃত্বে ছিল তখন কোনো রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির লোকজন মারা যায়নি?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : ওই সময় রাজাকার, আলবদর বা শান্তি কমিটির কাউকে ধরে সুন্দরবন কিলিংস্কোয়াডে পাঠানো হয়নি হত্যার জন্য।
সাক্ষী : পাঠানো হয়নি।
আইনজীবী : আপনি মাওলানা সাঈদী, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার শিকদার, দানেশ আলী মোল্লাসহ অন্যদের নিয়ে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে রাজাকারবাহিনী গঠন এবং তার দু-তিন দিন পর রাজাকারবাহিনী গঠনের যে কথা আদালতের কাছে জবানবন্দীতে বলেছেন তা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীতে বলেননি।
সাক্ষী : খেয়াল নেই।
আইনজীবী : এ কথা পিরোজপুর মেজিস্ট্রেটের কাছেও বলেননি।
সাক্ষী : জানা নেই।
আইনজীবী : আপনি ১৯৭১ সালের ২ জুন পারেরহাট অবস্থানের যে কথা বলেছেন তাও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেননি।
সাক্ষী : আমি বলেছি। তবে কী লিখেছে তা জানা নেই।
আইনজীবী : হরেন্দ্রনাথ, সতিশ বালা, চিত্ত তালুকদার, রবি তালুকদারের ঘরে লুটপাট, আগুন দেয়ার কথাও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেননি।
সাক্ষী : বলেছি কি না খেয়াল নেই।
আইনজীবী : ২ জুন মাওলানা সাঈদী সাহেবসহ অন্যদের উমেদপুর গ্রামের দিকে যাওয়ার যে কথা আদালতে বলেছেন তাও আগে বলেননি তদন্ত কর্মকতার কাছে।
সাক্ষী : খেয়াল নেই।
আইনজীবী : লুটপাটের পর মালামাল ভাগাভাগি এবং ২০-২২টি ঘরে আগুন দেয়ার কথাও বলেননি আগে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীতে।
সাক্ষী : স্মরণ নেই।
আইনজীবী : বিশাবালীকে গুলি মারতে দেখার কথাও বলেননি।
সাক্ষী : বলেছি।
আইনজীবী : মাহবুবুল আলমের ঘরে লুটপাটের কথাও মেজিস্ট্রেটের কাছে বলেননি।
সাক্ষী : আমি দেখি নাই, শুনেছি। শোনা কথাও বলেছি কি না স্মরণ নেই।
আইনজীবী : মদন সাহার ঘর ভেঙে নিয়ে যাওয়ার কথা তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেননি।
সাক্ষী : বলেছি।
আইনজীবী : মেজিস্ট্রেটের কাছে মদন সাহার নামও উল্লেখ করেননি।
সাক্ষী : খেয়াল নেই।
আইনজীবী : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আপনি মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি।
সাক্ষী : না।
আগের পোস্ট :: লো কোয়ালিটির প্রসিকিউটর দিয়া যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল 'আন্তর্জাতিক' হইব??