স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম প্রাণ পুরুষ তাজউদ্দিন আহমেদ,মহান এই নেতার আজ ৮৫ তম জন্ম বার্ষিকী, শুরুতে তার আত্নার মাগফেরাত কামনা করছি। স্বাধিনতার আগেও পরে দেশে গঠনে তার অবদানের কথা মোটামুটি সবারই জানা থাকার কথা।কিন্তু তার অবদানকে স্মরন করে কোন অনুষ্ঠান চোখে পরছে না তাই একটু হতাশই হলাম।
সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছুটা পড়াশুনা করার চেষ্টা করছি,না জানা অনেক কিছুই জানতে পারছি।যতই পড়ছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি।কে নায়ক হবে আর কাকে ভিলেন বানানো হবে তার হিসাব নিকাশ যে খুব সুক্ষভাবেই করা হয়েছে ঐপার থেকে তা জেনে আশ্চর্যই হচ্ছি।তাজউদ্দিন আহমেদ এমনি এক নির্মম বাস্তবতার স্বীকার।তাই সমসাময়িক অনেক নেতাকে নিয়ে হইহোল্লর হলেও তাকে নিয়ে চেচামেচি কমই দেখা যায়।
স্বাধীনটার যুদ্ধের প্রস্তুতি যে একদিনে বা শুধু ৭ই মার্চ থেকেই শুরু হয়নি তা পরিষ্কার।মজার ব্যাপার হল, পরাধীন বা পাকি নির্যাতনের স্বীকার ছিলাম আমরা অথচ স্বাধীনতার মুল হিসাব নিকাশ হলো ওপারে এটা জানতেই আমার দৃষ্টি ছিল ওদের কি স্বার্থ ছিল তা জানার দিকে।আমরা স্বাধীন ভূখন্ড পেয়েছি তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু কতটা স্বাধীন হয়েছি তাই হিসাব নিকাশের পালা আজ।
যাই হউক, ওপারের স্বার্থ খুজে পাওয়া যাবে তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকার কতৃক ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত ৭ দফা গোপন চুক্তির মাধ্যমে;
(১) বাংলাদেশে ভারত তার ইচ্ছামত, তার পছন্দসই লোক দিয় পছন্দসই নেতৃত্ব পাঠিয়ে একটি সামিরক বাহিনী গঠন করবে,যারা আন্তর্জতিক ভাবে আধা-সামারিক বলে পিরিচিত হবে,কিন্তু এদেরকে গুরুত্বের দিক থেকে ও সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের মুল সামরিক বাহিনী থেকে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ রাখা হবে। (ধারণা করা হচ্ছে,এই বাহিনীই হচ্ছে রক্ষীবাহিনী।
ভারতীয় সৈন্যের পোষাক, ভারতীয় সেনানী মন্ডলীর নেতৃত্ব ও ভারতের অভিরুচি অনুযায়ী বিশেষ শ্রেণীর লোককে শতকরা ৮০ জন এবং ‘বিশেষ বাদ’-এর সমর্থক ২০ জন করে নিয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে। অস্র,গাড়ী,পোষাক,সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে এই বাহিনীটি মূল বাহিনীকে ছাড়িয়ে গেছে। এ বাহিনীটি ব্যাবহার করা হইবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে!! ভারত বিরোধী কোন সরকার ঢাকায় ক্ষমতায় বসলেও এ
বাহিনী দিয়ে তাকে উৎখাত করা হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত বিরোধী রাজনীতির সমর্থকদের এই বাহিনী দিয়েই দমন করা হবে। এই বাহিনীর মধ্যে ভারত প্রেমিক বিশেষ শ্রেণীর লোকের সংখ্যাগরিষ্ট হওয়ায় কোন দিন এদেরকে ভারেতর বিরুদ্ধে লাগানো যাবেনা। এদেশের জনগণ কোন দিন বিপ্লবে অবতীর্ণ হলে, রক্ষী বাহিনীর পোষাকে গুণে ভারতীয় সৈন্যরা লাখে লাখে রক্ষী বাহিনী সেজে এদেশের অভ্যন্তরে জনগণকে দমন করেত পারবে।)
(২)বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে যে সামরিক সাহায্য নিয়েছে তা পরিশোধ করতে হবে বিভিন্নভাবেঃ (ক)ভারত ছাড়া অন্য কোন দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশ অস্র কিনতে পারবে না।মাঝে মাঝে ঘোষণা করতে হবে ভারত থেকে এত কোটি টাকার অস্র কেনা হলো, এর দাম ভারতই ঠিক করে দেবে।সরবরাহ দেওয়া হবে অর্ধেক অস্র!সরবরাহকৃত অস্রও ভারত ইচ্ছামত নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবে। (অর্থাৎ,একই অস্র বারবার দেখিয়ে ১৯৭১ এর পাওনা এবং ভারতের সম্পূর্ণ যুদ্ধ খরচ আদায় করা হবে।অভ্যন্তরীণ গোলযোগ দমনের জন্য অস্র ছাড়া কোন ভারী অস্র,সাজোয়া গাড়ী বা ট্যাংক বাংলাদেশকে দেয়া হবে না)
(৩) বাংলাদেশের বর্হিবানিজ্য ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।ভারতের অনুমতি ছাড়া কোন পন্য বিদেশে রফতানী করা যাবেনা।কোন পন্য কত দরে বাইরে রফতানী করতে হবে ভারত সেই দর বেঁধে দেবে।এই সব পন্য ভারত কিনতে চাইলে বাংলাদেশ আর কারো সাথে সে পন্য বিক্রির কথা আলোচনা করতে পারবেনা।বাংলাদেশের আমদানী তালিকা ভারতের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।
(বাংলাদেশে বিদেশী পণ্য আমদানীর ব্যাপারে ভারত উদার থাকবে,যে সব পণ্য ভারতকে আমদানী করতে হয়-সেগুলি আমদানী করানো হবে বাংলাদেশকে দিয়ে।বাংলাদেশ তার বৈদিশিক মুদ্রার তহবিল ভেঙ্গে বিদেশ থেকে যে সব সামগ্রী আমদানী করবে সেগুলি ভারত নিজে আমদানী করবে না।চোরাচালানের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ থেকে সেই মালগুলি ভারতীয় টাকায় যোগাড় করবে।)
(৪)বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পণ্ঞ বার্ষিক
পরিকল্পনাগুলি ভারতকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।(বাংলাদেশ যেন স্বাবলম্বী হতে না পারে সেভাবে পরিকল্পনাগুলি কেটে ছিড়ে ঠিক করবে।যার ফলে বর্তমানেও দেখা যায় দেশের উৎপাদনশীল খাতের চেয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ বেশী দাতাদের এবং ঐসব খাতে ব্যায় করা হচ্ছে সরকারী অর্থ!)
(৫)বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অনুবর্তী রাখতে হবে।অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে।
(৬)বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার চুক্তিগুলি বাংলাদেশ একতরফাভাবে অস্বীকার করতে পারবে না!তবে ভারত এ চুক্তিগুলির কার্যকারিতা অস্বীকার না করলে বৎসর বৎসরান্তে এ চুক্তিমালা বলৎ থাকবে।
(৭)ডিসেম্বর যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তিটিতে বলা হয়েছিল যে, ভারতীয় সৈন্যরা যে কোন সংখ্যায়,যে কোন সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং বাঁধা প্রদানকারী কোন মহলকে নিশ্চিহ্ণ করে দিতে পারবে।ভারতীয় বাহিনীর এ ধরণের অভিযানের প্রতি বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি দিচ্ছে।ভারত চুক্তিটি নাকচ না করলে বৎসর বৎসরান্তে এ চুক্তি কার্যকারী থাকবে।
সংগ্রিহীতঃ বাংলাদেশঃ মারাত্বক অপপ্রচারণা, ষড়যন্ত্র ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের শিকার, পৃষ্ঠা ১২৪-১২৬
এই চুক্তিটি দেখে মনে হতে পারে তাজউদ্দিন নেতৃত্ব কি দেশ প্রেমিক ছিলেন? নাকি বোকা ছিলেন?! এক অত্যাচারিতের হাত থেকে বাচাঁর জন্য দেশবাসী মরণপন লড়াই করছে অথচ গোপনে আমাদের হাত বদল হয়ে যাচ্ছে আরেক সাম্প্রদায়ীক সম্প্রসারন বাদীদের হাতে! আব্দুর রাজ্জাকের মতে তাজউদ্দিন ক্ষমতা লোভী ছিলেন?! আমার দৃষ্টিভজ্ঞি একটু ভিন্ন, আমার মতে তাজউদ্দিন হয়ত চেয়েছিলেন যে করেই হউক দেশটা স্বাধীন হয়ে যাক তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে যার কারনে তিনি আমাদের তথাকথিত বন্ধুদের কলের কাঠি হিসেবে নড়েছেন।মনে মনে হয়তো তার দেশ প্রেম ঠিকই ছিল কিন্তু ব্রাক্ষনবাদীদের ষড়যন্ত্র যে কত গভীরে ছিল তা তিনি আজ বেচে থাকলে হারে হারে টের পেতেন এবং অনুতপ্ত ও অনুশুচনা করতেন।
এই চুক্তির মাধ্যমে অর্জিত স্বদেশকে আবার স্বাধীন করার জন্য দেশ প্রেমিক সেনা বাহীনিকে অস্র তুলে নিতে হয়েছিল ১৫ ই আগষ্ট।যার ফলে বাংলাদেশ নামক দেশটি পৃথিবীর বুকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য মাথা উচুঁ করে দাড়িয়েছিল। তাই আমি নির্ধীদায় বলতে পারি ১৫ই আগষ্ট শোক দিবস কারো কারো জন্য হতে পারে কিন্তু আধুনিক বাংলাদেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ঐ দিন হচ্ছে সত্যিকারের স্বাধীনতা দিবস!
ক্ষমতার জোরে হয়ত কিছু দিন এই সত্য অস্বীকার করা যাবে কিন্তু সত্য সমাগত মিথ্যা অপসারিত, এই সত্য একদিন প্রকাশ পাবেই।