আসসালামু আলাইকুম।
আমাদের সামনে এসে গেছে অতি ফজিলতের একটি মাস মাহে শা’বান। প্রিয় নবীজী(সাঃ) এমাসেও দু’আ করতেন যেভাবে রজব মাসেও দু’আ করতেনঃ “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রজব ওয়া শা’বান ওয়া বাল্লিগনা রামাযান।” অর্থঃ “হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শা’বান মাসকে বরকতময় করে দিন এবং আমাদেরকে রমজান মাস পর্যন্ত পৌছেঁ দিন। আমীন।” শা’বান মাসে তিনি অকনকগুলো নফল রোজা রাখতেন।
আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ “আমি প্রিয় নবী (সাঃ) কে রমজান ছাড়া আর কোন পূর্ণ মাসের রোজা রাখতে দেখিনি। আর শা’বান মাস ছাড়া আর কোন মাসে এত অধিক পরিমাণ নফল রোজা রাখতে দেখিনি।” (বোখারি ও মুসলিম)।
গাহাবী উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) বর্ণন করেনঃ আমি প্রিয় নবীজী (সাঃ) কে বললামঃ “ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাঃ)! শা’বান মাসে আপনি যত নফল রোজা রাখেন অন্য কোন মাসে আপনাকে এত নফল রোযা রাখতে দেখিনা।” প্রিয় নবী (সাঃ) এরশাদ করলেনঃ “রজব ও রমজান – এ দুটো মাসের মঝখানের এ মাসটি সম্পর্কে অনেকেই আসলে গাফেল হয়ে থাকে। এ মাসে মানুষের আমল (-এর বার্ষিক রিপোর্ট) আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি চাই আমার আমল যখন পেশ করা হয়, আমি যেন তখন রোযা অবস্থায় থকি।” (আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে খোযাইমা)।
তবে শা’বান মাসের ১৫ তারিখে শুধু একটি রোযা রাখার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদিস পাওয়া যায় না। আর আমাদের সামনে আসছে মধ্য শা’বানের রাতটি যা অনেক দেশে শবে বরাত নামে পরিচিত। এ রাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে অন্যান্য বৎসরের মত এবারও আপনাদের খেদমতে কিছু বিস্তারিত আলোচনা পেশ করতে চাই। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দিন। আমীন।
প্রত্যেক মুসলমানই অবগত আছেন, ইসলামী শরীয়তের মূল উৎস দু’টি – কুরআন ও হাদিস। কুরআন ও হাদিসে যে ইবাদতের যতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তার চেয়ে একটু বেশী বা কম গুরুত্ব দেয়ার অধিকার কেন মুসলিমের নেই। শবে বরাত নামক বিষয়টি কুরআন-হাদিসে আদৌ উল্লেখ করা হয়নি। এটাই হচ্ছে উম্মতের মুহাক্বিক আলিম ও ইমামদের মতামত।
কেউ কেউ দাবী করে থাকেন সুরা আদ-দুখানে “লাইলাতুম মুবারাকাহ” অর্থাৎ বরকতময় রাত বলতে শবে বরাতকেই বোঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারে তাফসীরে ইবনে কাসীর, কুরতুবী, ইত্যাদি রেফারেন্স দেয়া হয়। আসুন আমরা চেক করে দেখি নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থসমূহে এ ব্যাপারে কি বলা হয়েছে। লিখার কলেবর যাতে বৃদ্ধি না হয়ে যায়, সেজন্য যথাসম্ভব তাফসীরের সার-সংক্ষেপ পেশ করা হচ্ছে।
ইমাম ইবনে কাসীর (রাহঃ)বলেনঃ বরকতময় রাত বলতে সুরা আদ-দুখানে শবে ক্বদর-কে বোঝানো হয়েছে। কারণ, এখানে কুরআন নাযিলের কথা বলা হয়েছে। আর সেটাতো সূরা ক্বদর-এ স্পস্ট করেই বলা আছে। আর কুরআন যে রমজান মাসেই নাযিল হয়েছে সেটাও সুস্পস্ট করে বলা হয়েছে সূরা বাক্বারায়।
তিনি আরও বলেনঃ কেউ যদি বলে যে বরকতময় রাত বলতে মধ্য শা’বানের রাত-কে বোঝানে হয়েছে – যেমনটি ইকরামা কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে – তাহলে সে প্রকৃত সত্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করল।
শবে বরাতে মনুষের হায়াত, মউত ও রিযকের বার্ষিক ফয়সালা হওয়া সংক্রান্ত যে হাদিসটি উসমান বিন মোহাম্মদ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি বলেছেন, হাদিসটি মুরসাল। অর্থাৎ, হাদিসের প্রথম বর্ণনাকারী হিসাবে যে সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে হাদিসটি শুনেছেন, তার কোন উল্লেখ নেই। ফলে এমন দূর্বল হাদিস দিয়ে কুরআন ও সহীহ হাদিসের অকাট্য বক্তব্যকে খণ্ডন করা যায়না। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ তাফসীর ইবনে কাসীর, খণ্ডঃ ৭, পৃষ্ঠা ৩১৬১)।
ইমাম কুরতুবী বলেনঃ “বরকতময় রাত্রি বলতে ক্বুদরতের রাতকে বোঝানো হয়েছে, যদিও কেউবা বলেছেন সেটা মধ্য শা’বানের রাত। ইকরামাও বলেছেন সেটি হচ্ছে মধ্য শা’বানের রাত। তবে প্রথম মতটি অধিকতর শুদ্ধ। কেননা আল্লাহ বলেছেনঃ ‘আমি এই কুরআনকে লাইলাতুল ক্বদর-এ নাযিল করেছি।’” এ প্রসঙ্গে মানুষের হায়াত, মউত, রিযক, ইত্যাদির ফয়সালা শবে বরাতে সম্পন্ন হয় বলে যে রেওয়ায়েত এসেছে, সেটাকে তিনি অগ্রহণযোগ্য বলে বর্ণনা করেন। তিনি পূণরায় উল্লেখ করেনঃ “সহীহ-শুদ্ধ কথা হচ্ছে, এ রাতটি লাইলাতুল ক্বদর।”
অতঃপর তিনি প্রখ্যাত ফকীহ কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবীর উদ্ধৃতি পেশ করেনঃ জমহুর আলীমদের মতামত হচ্ছে, এ রাতটি লাইলাতুল ক্বদর। কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন এটা মধ্য শা’বানের রাত। এ কথাটি একেবারেই বাতিল। কারণ, আল্লাহ স্বয়ং তাঁর অকাট্য বাণী কুরআনে বলেছেনঃ “রমজান হচ্ছে ঐ মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে।” এখানে তিনি মাস উল্লেখ করে দিয়েছেন। আর বরকতময় রাত বলে লাইলাতুল ক্বদরকে উল্লেখ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ মাসটিকে রমজান থেকে সরিয়ে অন্য মাসে নিয়ে যায়, সে মূলতঃ আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে বসে। মধ্য শা’বানের রাতটির ফজিলত এবং এ রাতে হায়াত-মউতের ফয়সালা সংক্রান্ত কোন একটি হাদিসও সহীহ এবং নির্ভরযোগ্য নয়। কাজেই কেউ যেন সেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত না করে। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ তাফসীরে কুরতুবী, খণ্ডঃ ১৬, পৃষ্ঠাঃ ১২৬-১২৮)।
ইমাম তাবারী তাফসীরে তাবারীতে বরকতময় রাতের ব্যাখায় উল্লেখ করেনঃ কাতাদাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত এ রাতাট লাইলাতুল ক্বদর-এর রাত। প্রতি বৎসরের যাবতীয় কিছুর ফায়সালা এ রাতেই সম্পন্ন করা হয়। অতঃপর ইকরামা কর্তৃক বর্ণিত মধ্য শা’বানের মতামতটিও উল্লেখ করেন। পরিশেষে তিনি মন্তব্য করেনঃ লাইলাতুল ক্বদর-এর মতটাই সহীহ। কারণ, এখানে কুরআন নাযিলের কথা বলা হয়েছে।(বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ তাফসীরে তাবারী, খণ্ডঃ ১১, পৃষ্ঠা ২১২-২২৩)।
আল্লামা মুহাম্মদ আল আমীন আশ-শিনকীতী (রাহঃ) সূরা আদ-দুখানের বরকতময় রাতের তাফসীরে বলেনঃ এটি হচ্ছে রমজান মাসের ক্বদরের রাত। মধ্য শা’বানের রাত হিসাবে সেটিকে বুঝানো হয়েছে মনে করা – যেমনটি ইকরামা কর্তৃক বর্ণিত রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে – মিথ্যা দাবী ছাড়া আর কিছু নয়। এ দাবীটি কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী । নিঃসন্দেহে হকের বিপরীত যে কোন কথাই বাতিল।
কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী যে হাদিসগুলো কেউ কেউ বর্ণনা করে থাকেন, যাতে বলা হয় এ রাতটি হচ্ছে মধ্য শা’বানের রাত, সেই হাদিসগুলোর কোন ভিত্তি নেই। সেগুলোর কোনটার সনদই সহীহ নয়। ইবনুল আরাবী সহ মুহাক্বীক আ’ইম্মায়ে কেরাম এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বলেছেন, বরই আফসোস ঐসব মুসলমানদের জন্য যারা কুরআনের সুস্পষ্ট বিরোধিতা করে কুরআন ও সহীহ হাদিসের দলীল ছাড়াই।(বিস্তারিত দেখুনঃ আদওয়াউল বায়ান, খণ্ডঃ ৭, পৃষ্ঠাঃ ৩১৯)।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মুফতী শফী (রাহঃ) এ বিষয়ে মা’আরেফুল কুরআনে বলেনঃ বরকতময় রাত বলতে অধিকাংশ তাফসীরবিদের মতে এখানে শবে ক্বদর বুঝানো হয়েছে যা রমজান মাসের শেষ দশকে হয়। কেউ কেউ আলোচ্য আয়াতে বরকতের রাত্রির অর্থ নিয়েছেন শবে বরাত। কিন্তু এটা শুদ্ধ নয়। কেননা, এখানে সর্বাগ্রে কুরআন অবতরনের কথা বলা হয়েছে। আর কুরআন যে রমজান মাসে নাযিল হয়েছে, তা কুরআন দ্বারাই প্রমাণিত। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ মা’আরেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা ১২৩৫)।
প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করুন, প্রতিটি তাফসীরেই ইকরামা কর্তৃক বর্ণিত শবে বরাতের বর্ণনাটিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আর কুরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, এটি হচ্ছে লাইলাতুল ক্বদর। কুরআন দিয়েই কুরআনের তাফসীর গ্রহণ করার সুযোগ থাকলে সেটাই গ্রহণ করতে হবে। এটাই উলামায়ে উম্মতের ইজমাহ। তারপর কি আর এ বিষয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ থাকে?
কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই, এ বক্তব্যটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এবার আমরা দেখি হাদিস শরীফে কী আছে।
শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো দু প্রকারঃ
প্রথমত, শবে বরাতে কতো রাকাত নামায পড়তে হবে, সূরা ইখলাস, আয়াতুল কুরসী প্রতি রাকাতে কতবার করে পড়তে হবে, ইত্যাদি এবং সে আমলগুলোর বিস্তারিত সওয়াবের ফিরিস্তি সংক্রান্ত হাদিসগুলো একেবারেই জাল এবং বানোয়াট।
আর দ্বিতীয় প্রকার হাদিসগুলো, এ রাতের ফযীলত, ইবাদতের গুরুত্ব, ইত্যাদি বিষয়ক। এ সব হাদিসের কোনটাই সহীহ হিসাবে প্রমাণিত হয়নি। বরং সবগুলোই যইফ (দুর্বল)। তবে, মউজু (জাল বা বানোয়াট)নয়। এখানে একটি বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার। সিহাহ সিত্তার (ছয়টি গ্রন্থের)সবগুলো হাদিসই কি সহীহ? হাদিস বিশারদগণ প্রায় একমত যে, বুখারী ও মসলিম – এ দুটো গ্রন্হের সবগুলো হাদিসই সহীহ পর্যায়ের। কোন যইফ (দুর্বল) হাদিসের অবকাশ নেই এ দুটো গ্রন্থে।
আর বাকী ৪টি গ্রন্থের অধিকাংশ হাদিস সহীহ। তবে, বেশ কিছু সংখ্যক যইফ (দুর্বল) হাদিসও রয়েছে সেগুলোর মধ্যে। শবে বরাত সংক্রান্ত কোন একটি হাদিসও বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে আসেনি। আর বাকি ৪টি গ্রন্থে বা অন্যান্য আরও কিছু গ্রন্থে এ সংক্রান্ত যে হাদিসগুলো এসেছে, তার একটিও সহীহ হাদিসের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। শবে বরাত সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস, হাদিস বিশারদগণের মন্তব্য সহকারে উল্লেখ করা হলঃ
১. আলী (রাঃ)-এর বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ “১৫ শা’বানের রাতে তোমরা বেশী বেশী করে ইবাদত কর, এবং দিনের বেলায় রোযা রাখ। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা সূর্যাস্তের সাথে সাথেই দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেনঃ ‘কে আছ আমার কাছে গুনাহ মাফ চাইতে? আমি তাকে মাফ করতে প্রস্তুত। কে আছ রিযক চাইতে? আমি তাকে রিযক দিতে প্রস্তুত। কে আছ বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে বিপদমুক্ত করতে প্রস্তুত। কে আছ …’ এভাবে (বিভিন্ন প্রয়োজনের নাম নিয়ে) ডাকা হতে থাকে সুবহে সাদেক পর্যন্ত”। (ইবনে মাজাহ কর্তৃক হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে)।
এ হাদিসটি যে আদৌ সহীহ নয়, সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমাম হাফেজ শিহাব উদ্দিন তাঁর যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, হাদিসটির সনদ যইফ (দুর্বল), কারণ হাদিসটির সনদের মাঝখানে আবু বকর বিন আবু সাবরা নামে একজন রাবী (বর্ণনাকারী) অনির্ভরযোগ্য। এমনকি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এবং প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইবনু মাইন তার ব্যাপারে মন্তব্য করেছেনঃ “লোকটি মিথ্যা হাদিস রচনা করে থাকে।” (দেখুনঃ সুনান ইবনে মাজাহ, মন্তব্য ও সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ ফুয়াদ আব্দুল বারী, পৃষ্ঠা ৪৪৪)।
২. আয়েশা (রাঃ)-এর বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ “আমি এক রাতে দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার পাশে নেই। আমি উনার সন্ধানে বের হলাম। দেখি যে তিনি জান্নাতুল বাকী (কবর স্থানে)অবস্থান করছেন। ঊর্ধ্বাকাশপানে তাঁর মস্তক ফেরানো। আমাকে দেখে বললেন, ‘আয়েশা, তুমি কি আশঙ্কা করেছিলে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) তোমার প্রতি অবিচার করেছেন?’ আমি বললাম, ‘এমন ধারণা করিনি, তবে মনে করেছিলাম, আপনার অন্য কোন বিবির সান্নিধ্যে গিয়েছেন কিনা।’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘আল্লাহ তা’আলা ১৫ই শা’বানের রাতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং কালব গোত্রের সমুদয় বকরীর সকল পশমের পরিমাণ মানুষকে মাফ করে দেন।’” (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)। ইমাম তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করে নিজেই মন্তব্য করেছেনঃ আয়েশা (রাঃ)-এর বরাত দিয়ে বর্ণিত এই হাদিসটি হাজ্জাজ বিন আয়তাআহ্ ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করেছেন বলে জানা নেই।
ইমাম বোখারী বলেছেনঃ এ হাদিসটি যইফ (দুর্বল)। হাজ্জাজ বিন আয়তাআহ্ বর্ণনা করেছেন ইয়াহ্ইয়া বিন আবি কাসির থেকে। অথচ হাজ্জাজ ইয়াহ্তইয়া থেকে আদৌ কোন হাদিস শুনেননি। ইমাম বোখারী আরও বলেছেনঃ এমনকি ইয়াহ্ইয়া বিন আবি কাসিরও রাবী ওরওয়া থেকে আদৌ কোন হাদিস শুনেননি। (দেখুনঃ জামে’ তিরমিজী, সাওম অধ্যায়, মধ্য শা’বানের রাত, পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৮)।
৩. আবু মুসা আশ’আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ)বলেছেন, “১৫-ই শা’বানের রাতে আল্লাহ তা’আলা নিচে নেমে আসেন এবং সকল মানুষকেই মাফ করে দেন। তবে মুশরিককে এবং মানুষের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টিকারীকে মাফ করেন না” (ইবনে মাজাহ)। এ হাদিসটির ব্যাপারে হাফেজ শিহাব উদ্দিন তাঁর যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেনঃ এর সনদ যইফ (দুর্বল)। একজন রাবী (বর্ণনাকারী) আব্দুল্লাহ বিন লাহইয়াহ্ নির্ভরযোগ্য নন। আরেকজন রাবী ওয়ালিদ বিন মুসলিম তাফলীসকারী (সনদের মাধ্যে হেরফের করেতে অভ্যস্ত) হিসেবে পরিচিত।
প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আসসিন্দী বলেছেনঃ আরেকজন রাবী আদদাহহাক কখনও আবু মুসা থেকে হাদিস শুনেননি। শবে বরাত সংক্রান্ত বর্ণিত সবগুলো হাদিসের সনদের মধ্যেই এ জাতীয় দুর্বলতা বিদ্যমান থাকার কারণে একটি হাদিসও সহীহ’র মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
লিখার কলেবর বৃদ্ধি হওয়ার আশংকায় আমরা বাকী হাদিসগুলো বা তদসংক্রান্ত মন্তব্য উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি। এবার প্রশ্ন আসে যইফ (দুর্বল) হাদিসের ভিত্তিতে কোন আমল করা যায় কি-না।
অধিকাংশ মুহাদ্দেসীনের মতে যইফ হাদিসের উপর কোন আমল করা শরীয়তে জায়েয নেই।
অধিকাংশ ফুকাহা আইম্মায়ে কেরাম যইফ (দুর্বল) হাদিস দ্বারা শর্ত সাপেক্ষে আমল করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন। শর্তগুলো নিম্নরূপঃ
• ১।খুব বেশী যইফ (দুর্বল) পর্যায়ের না হওয়া।
•২। শুধুমাত্র ফাযায়েল অধ্যায়ের হওয়া। অর্থাৎ ফাজায়েল অধ্যায় ব্যতীত অন্য কোন অধ্যায়ের যইফ হাদিসের ভিত্তিতে কোন প্রকার আমল করা যাবে না।
•৩। আমল করার সময় সহীহভাবে প্রমাণীত হওয়ার ধারনা না রাখা। অর্থাৎ, এ ধারণা রাখতে হবে যে হাদিসটি সহীহভাবে প্রমাণীত নয়।
• ৪। কুরআন ও সহীহ হাদিসের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া। অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট যইফ হাদিসটি কুরআন বা সহীহ হাদিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
উক্ত মূলনীতিগুলোর আলোকে শবে বরাতের আমল করা যেতে পারে বলে অনেক ওলামায়ে কেরাম মতামত দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন আসে আমল করতে হলে কিভাবে করা যাবে।
প্রথমতঃ ব্যক্তিগতভাবে বিছু ইবাদত বন্দেগী করা যেতে পারে। সে জন্যে মসজিদে সমবেত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করার জন্য ওয়াজ নসীহত, যিকির ইত্যাদির আয়োজন করা যাবেনা। (দেখুনঃ ফাতাওয়া শামীয়া, ইমাম বিন আবেদীন, পৃষ্ঠা ৬৪২)। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং সাহাবায়ে কিরামগণ এমনটি করেননি। তাই সে ত্বরিকার বাইরে ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতা আবিষ্কার করলে সেটা হয়ে যাবে বিদ’আত।
দ্বিতীয়তঃ হায়াত, মউত, রিযক ইত্যাদির ফয়সালা এ রাতে হয়, এটা বিশ্বাস করা যাবে না। কারণ, এসব ফয়সালা যে লাইলাতুল ক্বদরে হয়, তা সুস্পষ্টভাবে কুরআন ও সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণীত।
তৃতীয়তঃ আমাদের দেশে (বাংলাদেশে) আলোকসজ্জা ও আতশবজির যে তামাশা করা হয়, তা প্রকাশ্যে বিদ’আত। সে ধারণা থেকে কোন এলাকায় এ রাতের নাম হচ্ছে বাতির রাত। এ সব ধারণা ইসলামী শরীয়তে হিন্দুদের দিওয়ালী অনুষ্ঠান থেকে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রাহঃ)। হালুয়া-রুটি বিলি-বণ্টনের কার্যক্রমও বিদ’আত। (দেখুনঃ ফাতাওয়া শামীয়া, ইমাম বিন আবেদীন, পৃষ্ঠা ৬৪২)। ইবাদতের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এসব অনেক আমল শিয়াদের কাছ থেকে উপ-মহাদেশের মুসলমানরা গ্রহণ করেছেন বলে মুফতী রশীদ আহমদ লুদিয়ানী উল্লেখ করেছেন। (দেখুনঃ সাত মাসায়েলঃ শবে বরাতে শিয়াদের ভ্রষ্টতা, পৃষ্ঠা ৩৯-৪২)।
চতুর্থতঃ নফল ইবাদতের জন্য সারা রাত মসজিদে এসে জেগে থাকা রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নত বিরোধী। তিনি নফল ইবাদত ঘরে করতে এবং ফরয ইবাদত জামা’আতের সাথে মসজিদে আদায় করতে তাগিদ করেছেন। আর সারা রাত জেগে থেকে ইবাদত করাটাও সুন্নত বিরোধী। প্রিয় নবীজী (সাঃ) সব রাতেরই কিছু অংশ ইবাদত করতেন, আর কিছু অংশ ঘুমাতেন। উনার জীবনে এমন কোন রাতের খবর পাওয়া যায়না, যাতে তিনি একদম না ঘুমিয়ে সারা রাত জেগে ইবাদত করেছেন।
পঞ্চমতঃ শবে বরাতের দিনের বেলায় রোযা রাখার হাদিস একেবারেই দুর্বল। এর ভিত্তিতে আমল করা যায়না বলে পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম ও ফকীহ মুফতী মাওলানা তাকী উসমানী সাহেবের সুস্টষ্ট ফাতাওয়া রয়েছে। শবে বরাত, কবর যিয়ারত, ইত্যাদি অনেক আমলেরই কোন সহীহ দলিল না থাকার কারণে উপমহাদেশর প্রখ্যাত আলেম ও ফকীহ মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়নবী, হাক্বীকুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রাহঃ)-এর সাথে বহু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রাহঃ) শেষের দিকে কিছু কিছু বিষয় অবশ্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
ষষ্ঠতঃ শবে বরাতের রোযার পক্ষে যেহেতু কোন মজবুত দলিল নেই, তাই যারা নফল রোযা রাখতে চান, তারা আইয়ামে বীজের তিনটি রোযা – ১৩, ১৪, ১৫ – রাখতে পারেন। এর পক্ষে সহীহ হাদিসের দলিল রয়েছে। শুধু একটি না রেখে এ তিনটি বা তার চেয়েও বেশী রোযা রাখতে পারলে আরও ভাল। কারণ, শা’বান মাসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবচেয়ে বেশী পরিমাণ নফল রোযা রেখেছেন।
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদিসের উপর আমল করার তাওফীক দান করুণ। আমীন।
নোট: লেখাটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদ, ইষ্ট লন্ডন মসজিদের সম্মানিত খতিব, মাওলানা আব্দুল কাইউম লিখেছিলেন ২০০৮ সালে।