পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নবাদের পরিকল্পনা হয় ভারতে। এ ব্যাপারে শুধু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’এর কর্মকর্তারারই শুধু মুখ খুলেনি,মুখ খুলেছে বাংলাদেশের বহুনেতাও। যেমন এক কালের নেতা ও পরবর্তীতে জাতীয় লীগ নেতা জনাব অলি আহাদ বলেন, “১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানকালে ময়মনসিংহ নিবাসী রাজবন্দীদ্বয় আব্দুর রহমান সিদ্দিকী ও আবু সৈয়দের নিকট হইতে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষয়াদী অবগত হই। ভারতে মুদ্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ময়মনসিংহ ও বিভিন্ন জেলায় বিতরণকালেই তাহারা গ্রেফতার হইয়াছিলেন।”-(অলি আহাদ)। ইতিহাসের নামে যে মিথ্যাচারটি দেশ জুড়ে ছড়ানো হয়েছে তা হলো,পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের সৃষ্টি মূলত মুক্তিবাহিনীর অবদান। ভারতের নাম তারা সহজে মুখে আনতে চায় না। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশটি সৃষ্টির মূল কাজটি যে নেহায়েতই ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাজ -সে কথাটি ভারতীয় কতৃপক্ষও খুব একটা জোরে শোরে প্রচার করে না। তারা জানে সেটি প্রকাশ পেলে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মাঝেই শুধু নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ভারত ভিলেন রূপে চিত্রিত হবে। এজন্যই বাংলাদেশ সৃষ্ঠিকে তারা বাংলাদেশেীদের কাজ বলে চালিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সেটি তারা লুকাতে পারেনি। পাকিস্তান বাহিনী ও বিপুল সংখ্যক রাজাকারদের কারণে সে পরিকল্পনা সফল হতে পারেনি। মুক্তিবাহিনীর কাঁধে বন্দুক রেখে পাকিস্তান বাহিনী বা রাজাকারদের পরাজয় করা সম্ভব হয়নি। একাত্তরের শেষদিকে তাই স্বয়ং ভারতীয় বাহিনীকেই যুদ্ধে নামতে হয়েছে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালী ও পাকিস্তানীদের লড়াই না হয়ে পাকিস্তান ও ভারতের সরাসরি লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এ লড়ায়ে পাকিস্তানের পরাজয়ে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ। সেটি আরো পরিস্কার হয়, রেসকোর্সের ময়দানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল অরোরা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বভাগের কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীর মধ্যকার চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে।পাকবাহিনী এ চুক্তির মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
রেসকোর্সে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ওসমানীর উপস্থিতি ভারতীয় বাহিনীর কাছে যে কতটা অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক ছিল সেটির মোক্ষম দলিল হলো ১৬ই ডিসেম্বরের এ চুক্তি। ভারত তাই তার আগ্রাসী কদর্য চরিত্রটি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে লুকাতে চেয়েছিল সেটি সম্ভব হয়নি। মুসলিম বিশ্বের প্রায় কোন দেশই তাই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের কাছে বাংলাদেশ ছিল ভারতের অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তান।ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ এবং ভুট্টৌ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পরই তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে এগিয়ে আসে। তবে ১৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী যে সত্যটিকে লুকাতে পারিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে সেটিই সুপরিকল্পিত ভাবে লুকানো হচ্ছে। পাঠ্য পুস্তকে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারগণ কে কোথায় লড়াই করেছেন সে বিবরণ থাকলেও ভারতীয় বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য ও তার কমান্ডারগণ কে কোথায় কি ভাবে যুদ্ধ করলো তার সামান্য বিবরণও নেই। বিবরণ নেই ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর ভূমিকার। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে কোন উল্লেখ নেই সে যুদ্ধে কতজন ভারতীয় সৈন্য কোন কোন স্থানে প্রাণ দিয়েছে। তাই ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের যদি এতটা উৎসব করার কিছু থেকেই থাকে তবে তার জন্য কি জেনারেল অরোরাসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উচিত নয়? তারা না হলে কোন বাঙালী বীরের পক্ষে সম্ভব হত পাকিস্তানী সেনা বাহিনীকে পরাজিত করা?
প্রকৃত সত্য হলো, মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৯ মাসে পুরা বাংলাদেশ দূরে থাক একটি জেলা বা একটি মহকুমাও মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কোন জেলা শহরেই মুক্তিবাহিনীর কোন সদস্য প্রকাশ্যে দিবালোকে অস্ত্র হাতে ঘুরতে পারিনি। একাত্তরের মূল লড়াইটি লড়েছে ভারতীয় সেনা বাহিনী। তবে ভারত শুরু থেকেই একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার অপরাধ নিজ কাঁধে নিতে চায়নি। কারণ এটি আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ। একটি দেশের ভূগোলে কিভাবে পরিবর্তন আনতে হবে জাতিসংঘের বিধানে তার একটি বিধিবদ্ধ আইন আছে। সেটি কখনই কোন বিদেশী শক্তির আগ্রাসনের মাধ্যমে নয়। কিন্তু ভারত সে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। এজন্য যুদ্ধ চলা কালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের অধিকাংশ সদস্য পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার প্রতিসমর্থন জানিয়েছে। ভারতের পক্ষে থেকেছে রাশিয়া ও তার মিত্ররা।
ইতিহাসে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এ ভয়েই ভারত নিজেদের অর্থ,অস্ত্র ও লোকবল দ্বারা পাকিস্তান ভাঙ্গার এ যুদ্ধকে বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। লুকানোটি জরুরী ভেবেছে এ জন্য যে, পাকিস্তানের উপর ভারতের এমন আগ্রাসন অন্যদেরও বৈধতা দিবে ভারত-ভাঙ্গার কাজে অংশ নেয়ার। এজন্যই রেসকোর্সের ময়দানে জেনারেল ওসমানীকে শামিল করাটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলগণ অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক ভাবলেও ভারতীয় কূনীতিক বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে তা ছিল বড় রকমের ভুল। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কাঁধে বন্দুক রাখার ন্যায় তাঁর উপস্থিতিরও লোকদেখানো রাজনৈতিক প্রয়োজন ছিল। প্রখ্যাত ভারতীয় কূটনীতিবিদ এবং ভারতীয় ইনটেলিজেন্স এর সাবেক প্রধান Mr.J.N. Dixit তার রচিত “Liberation and Beyond” বইতে জেনারেল ওসমানীকে রেসকোর্সে শামিল না করাকে “major political mistake” বলে অভিহিত করেছেন। অতি সতর্কতার সাথে খুন করার পরও প্রায় সব খুনিই খুনের আলামত যেমন ঘটনা স্থলে রেখে যায়,তেমনি নিজ ঘর পর্যন্ত টেনে নেয়। তাই অপরাধ বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস,আন্তুরিক ভাবে সচেষ্ট হলে কোন খুনিই গ্রেফতার এবং সে সাথে খুনের বিচার থেকে রেহাই পেতে পারে না। রেসকোর্সের ময়দানে ভারত তার অপরাধ লুকাতে পারেনি। ভারতীয় আগ্রাসনের সে জঘন্য অপরাধ ভারতপন্থি বাংলাদেশেীরা যতই লুকানোর চেষ্ঠা করুক, হাজার হাজার বছর ধরে ভারত যে শুধু বাংলাদেশী মুসলমানদের কাছেই নয়,বিশ্বের মুসলমানদের চোখেও শত্রু রূপে চিহ্নিত হতে থাকবে তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে?
বাংলাদেশের সৃষ্টিতে “র”এর কর্মকর্তাগণ কি ভাবেন সেটি দেখা দরকার। ভারতীর গুপ্তচর সংস্থা “র”এর সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মিস্টার বি. রমন লিখেছেনঃ “The R&AW’s success in East Pakistan, which led to the birth of Bangladesh, would not have been possible without the leadership of Kao and the ideas of Nair,”-(B.Ramon, 2007)। মিস্টার বি. রমন যা লিখেছেন তা থেকে একথা সুস্পষ্ট, “র”এর দক্ষতা ও সফলতাই জন্ম দেয় বাংলাদেশের। এবং সেটি সম্ভব হয়েছে তৎকালীন “র”এর দায়িত্বশীল মি. কাউ ও মি নায়ারের ফলপ্রসু নেতৃত্ব ও পরিকল্পণার কারণে। বাংলাদেশের সেক্যিউলার পক্ষটি “র”এর ভূমিকার কথা মুখে আনে না। কারণ তারা নিজেরাও জানে এ সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেলে আজ হোক কাল মুসলিম ইতিহাসে তারা কুলাঙ্গার রূপে চিত্রিত হবেই। কারণ ভারতের ন্যায় একটি শত্রুদেশের গুপ্তচর সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টতা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্যই সুনাম বয়ে আনে না। যেসব ভারতীয়রা আজ কাশ্মীরে মুসলমাদের গণহত্যার নায়ক, তারাই একাত্তরে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে পাকিস্তানের লড়াই লড়েছিল। সে ভারতীয়রাই একাত্তরে আওয়ামী লীগের পক্ষে লড়াই লড়েছিল। অথচ সে ভারতীয়দের কথা আওয়ামী ঘরানার নেতা-কর্মীরা পারতো পক্ষে আজ মুখেই আনে না। বরং এটিকে একমাত্র নিজেদের অর্জন বলে অহংকার দেখায়। অথচ ভারতের ভুমিকাই ছিল চূড়ান্ত। এ ব্যাপারে মিস্টার বি. রমন তার বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’–তে লিখেছেনঃ “The IB (Intellegence Bureau) before 1968 & the R&AW thereafter had built up a network of relationship with many political leaders and government officials of East Pakistan. The networking enabled the R&AW and the leaders and officials of East Pakistan to quickly put in position the required infrastructure for a liberation struggle consisting of a parallel government with its own fighters trained by the Indian security forces and its own bureaucracy. .. The only sections of the local population, who were hostile to India and its agencies, were the Muslim migrants from Bihar.” -(B.Ramon, 2007)
মিস্টার বি. রমনের কথায় এটি সুস্পষ্ট,একাত্তরে যা ঘটেছে তার পরিকল্পনা একাত্তরে হয়নি। হয়েছে অনেক আগে। পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা আই,বি এবং ১৯৬৮এর পর “র” ষাটের দশকের শুরু থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিচ্ছিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাঙালী রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মচারিদের দিয়ে তারা বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং অবকাঠামো গড়ে তোলে। এমনকি ট্রেনিং দেয়ার কাজও শুরু করে। একাত্তরে নয়,বরং তার আগে ১৯৬২ সালেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা Director of Intelelligence Bureau (DIB) জানতে পারে যে কোলকাতার ভবানীপুর এলাকার একটি বাড়ীতে - যা ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অপারেশনাল সদর দফতর,সেখানে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি সংগঠন কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা। -(মাসুদুল হক)।
মিস্টার বি. রমনের লেখা থেকে প্রমাণিত হয়,পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের রিপোর্ট আদৌ মিথ্যা ছিল না। এ গোপন পরিকল্পনা মোতাবেক মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী রূপে দেখা ভারতের কাম্য ছিল না। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের পিছনে তারা যে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা, শেখ মুজিবকে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা নয়। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হলে মিস্টার বি. রমনের কথা মত র’ যেভাবে পূর্বপাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা এঁটেছিল তা কি সফল হত? তখন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার পক্ষ থেকে মুজিব ময়দানে একা খেলছিলেন না,খেলছিল আরো অনেকেই। ছাত্রলীগের নেতৃপর্যায়ে এদের পাল্লাই ছিল ভারি। তাদের দায়িত্ব ছিল শেখ মুজিবকে নিয়ন্ত্রণ করা,যাতে তিনি “র”এর সে পরিকল্পনা থেকে যেন একটুও বিচ্যুত না হন। বস্তুত শেখ মুজিব তখন নিজেই এক পরাধীন ব্যক্তি, ভারতীয় “র” এবং ছাত্রলীগ নেতাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। তখন তার পক্ষে “র”এর কাছে কৃত ওয়াদা থেকে পিছুটান দেয়ার সামান্যতম সুযোগও ছিল না। বহু আগেই ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল। মুজিবের কাজ ছিল বিনা প্রতিবাদে তাদের অনুসরণ করা। মুজিব সেটি করেছিলেনও। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আপোষে শেখ মুজিবের আদৌ কোন আগ্রহ ছিল না। কারণ এতে আগ্রহ ছিল না ভারতের। আর ভারতের যাতে আগ্রহ নেই তাতে মুজিবেরই বা আগ্রহ সৃষ্টি হয় কি করে? ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সাথে মুজিবের আলোচনা এজন্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। এমন আলোচনাকে তারা স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী মনে করে। এনিয়ে আওয়ামী-বাকশালী শিবিরে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু এ বিষয়ে অতিশয় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্গতি হলো তাদের যারা মনে করে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে স্বৈরাচারি ইয়াহিয়ার ভূলের কারণে। যেন মুজিব ও তার আওয়ামী-বাকশালী চক্র পাকিস্তান রক্ষার জন্য দুইপায়ে খাড়া ছিল! ভারত যে পাকিস্তান ভাঙ্গার ব্যাপারে কতটা আপোষহীন ছিল সেটি পরবর্তীতে আরো পরিস্কার হয়ে উঠে। এক সময় ইয়াহিয়া খান একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আন্তরিক ভাবেই চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভারত সেটি হতে দেয়নি। এমন কি যে সব উদ্বাস্তু ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের ফেরতও আসতে দেয়নি। এব্যাপারে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সেক্রেটারি হেনরি কিসিন্জার লিখেছেন, “Despite Yahya’s proclamation of an amnesty India made the return of refugees to East Pakistan depend on a political settlement there. But India reserved the right to define what constituted an acceptable political settlement on the sovereign territory of its neighbor.” –(The White House Years, page 858).
স্বৈরাচারি ব্যক্তির ক্ষমতায় আসা বা গণতন্ত্র-দুষমন দুর্বৃত্তদের রাজনীতির কর্ণধার হওয়া কোন দেশেই অসম্ভব নয়। বিশ্বের বহু দেশেই সেটি হয়। একাত্তরের পর বাংলাদেশেও সেটি বার বার হয়েছে। কিন্তু সে জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ সে দেশের মানচিত্র ভাঙ্গায় হাত দেয় না। এমন কাজ একমাত্র বিদেশী দুষমনদের হাতেই হতে পারে। পাকিস্তানে গণতন্ত্র-বিরোধী ষড়যন্ত্র শুরু হয় দেশটির প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই। দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এরপরও ধৈর্যের সাথে দেশ গড়ার চেষ্ঠা করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে জনাব নাজিমুদ্দিন, জনাব মোহম্মদ আলী বগুড়া ও জনাব সোহরাওয়ার্দী অপসারিত হয়েছেন, সামরিক আইন জারি হয়েছে এবং দেশের শাসনতন্ত্রও রহিত হয়েছে। কিন্তু সেজন্য নাজিমুদ্দিন,মোহাম্মদ আলী বগুড়া,সোহরাওয়ার্দি বা অন্য কোন নেতাই পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে নামেননি। এমনকি চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ও নয়। কিন্তু একাত্তরে দেশের রাজনীতি আর দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের হাতে থাকেনি। সেটি দখলে চলে যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এবং “র” প্রতিপালিত এজেন্টদের হাতে। বি. রমনের বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’ বা অশোক রায়না রচিত Inside R&AW সে কিচ্ছাতেই ভরপুর। ভারতের স্ট্রাটেজিক লক্ষ্য হলো, বিশ্বের দরবারে বৃহৎ শক্তির মর্যাদা লাভ। সে কথার স্বীকারোক্তি এসেছে মি. রমনের বইতে। তিনি এক্ষেত্রে “র” এর ভূমিকার কথাও তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেনঃ An emerging power such as India, which is aspiring to take its place by 2020 among the leading powers of the world, has to have an external intelligence agency which has the ability to see, hear, smell and feel far and near. -(B. Ramon, 2007).
১৯৬২ সালে চীনের হাতে অপমানজনক পরাজয়ের পর সে স্বপ্নে ভাটা পড়ে। এরপর ১৯৬৫এ পাকিস্তান পরাজিত করতে না পারায় সে পুরোন অপমান থেকেও পরিত্রাণ মেলেনি। এরপর মনযোগী হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে। শেখ মুজিব মূলত ব্যবহৃত হয়েছে সে লক্ষ্য পূরণে। তবে ভারতের লক্ষ্য নিছক পাকিস্তানের শক্তিহানী নয়,সেটি ছিল উপমহাদেশে মুসলমানদের শক্তিহানী। সে সাথে প্রতিবেশী নেপাল, ভূটান ও শ্রীলংকার শক্তিহানী। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাকে দুর্বল করার লক্ষ্যেই একাত্তরে পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বাংলাদেশের আর্মির হাতে পোঁছতে দেয়নি। বাংলাদেশ সরকার আজও কি সে পরিমাণ অস্ত্র কিনতে পেরেছে? সব কিছু কুড়িয়ে তারা নিজ দেশে নিয়ে যায়। তাদের ভয়,পাকিস্তানের ন্যায় বাংলাদেশেরও যদি সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায় তবে সে খড়গ তাদের ঘাড়ে পড়বে। তারা জানে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে কোন গুলী ছুড়লে সেটি ভারতে ভূমিতে যাওয়া ছাড়া আর কোন যাওয়ার জায়গা নেই। তাই বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই ভারত অতি সতর্ক। ভারত চায় নিঃশর্ত আনুগত্য। তাই ভারতীয় আগ্রাসী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি হওয়াটাই অপরাধ। মুজিব এবং তার আওয়ামী লীগ সেটি ভাল করেই বোঝে। একারণেই, আওয়ামী লীগ ভারতে মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করে না। তারা নিশ্চুপ কাশ্মীরে ভারতীয় অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ অধিকৃত কাশ্মীরকে বিতর্কিত এলাকা বললে কি হবে, আওয়ামী-বাকশালী মহলো সেখানে ভারতীয় আধিপত্যবাদকেই জায়েজ বলে মেনে নেয়। ১৯৬২এর ১৩ অক্টোবর চীন ভারতকে কাশ্মীরের লাদাখ সীমান্ত থেকে তার সৈন্য অপসারণের দাবী করে। ভারত সে দাবী মেনে না নেয়ায় ১৯৬২ এর ২০ই অক্টোবরে হামলা করে। ২০শে নবেম্বরের মধ্যে লাদাখ এলাকার দুই হাজার বর্গমাইল এবং তিব্বত সীমান্তের NEFA এলাকার প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইল এলাকা দখল করে নেয়। ২৮ শে অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি আইউব খানকে ভারতের সাহায্যে এগিয়ে আসতে বলে। কিন্তু তিনি তা করেননি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে,চীন তখনও মার্কিন বিরোধীতার কারণে জাতিসংঘের সদস্য হতে পারেনি। পাকিস্তান সদস্য পদ লাভে চীনকে জোড়ালো সমর্থন করে। পেশোয়ারের কাছে ছিল সিআইয়ের গোপন ঘাটি,সেখান থেকে CIA U-2 গোয়েন্দা বিমান পাঠাতো রাশিয়ার অভ্যন্তরে। পাকিস্তান সে ঘাঁটিও বন্ধ করে দেয়। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড ক্রোধ চাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। অপর দিকে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্তে যুদ্ধে চীনের হাতে পরাজয়ের পর ভারতও প্রতিশোধের পরিকল্পনা নেয়। এবং সেটি যতটা না চীনের বিরুদ্ধে তার চেয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। পরিকল্পনা নেয় পাকিস্তানের অঙ্গহানির। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা নেয় আইয়ুব খানের অপসারণের ও পাকিস্তানকে দুর্বল করার।-(মাসুদুল হক)। প্রখ্যাত গবেষক ও পররাষ্ট্র বিজ্ঞানী এবং পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী জনাব জি. ডি চৌধুরী তার বই “Last Days of United Pakistan” বইতে দেখিয়েছেন, একাত্তরে পাকিস্তানের কপালে একাত্তরে যা কিছু ঘটেছে সেটি নিছক একটি নির্বাচনের ফল ছিল না। ছিল তৎকালীন আন্ত্রর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধের ফলাফল। এতে যুক্ত ছিল নিছক ভারত নয়, সংযুক্ত ছিল রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।
তখন র`এবং সিআইএ -উভয়েরই প্রয়োজন পড়ে রাজনীতির ময়দানে খেলোয়াড়ের। আর সে শূন্যতা পূরণ করে শেখ মুজিব। তখন ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই পাকিস্তানের রাজনীতির ময়দানে তাঁকে খেলোয়াড় রূপে বেছে নেয়। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ই ফেব্রেয়ারিতে লাহোরে আইয়ুব বিরোধী দলসমুহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে জনাব নুরুল আমীনের নেতৃত্বাধীন এনডিএফ,কাউন্সিল মুসলিম লীগ,জামায়াতে ইসলামি, নেজামে ইসলামি এবং আওয়ামী লীগ সে সম্মেলনে যোগ দেয়। তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন পাঞ্জাবের নবাবজাদা জনাব নাসরুল্লাহ খান। এ সভায় শেখ মুজিব হঠাৎ করেই ৬ দফা পেশ করেন। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছেও বিষয়টি বিস্ময়ের জন্ম দেয়। সাংবাদিক মাসুদুল হকের কাছে এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরি বলেন,“লাহোর যাত্রার প্রাক্কালে এমনকি লাহোরে গিয়েও এ সম্পর্কে মুজিব আমাদের সঙ্গে আলাপ করেননি। আমরা জানতাম না মুজিব এ ধরনের প্রস্তাব তুলবে।” -(মাসুদুল হক)
এর পর আওয়ামী লীগ ৬ দফাপন্থি এবং ৬ দফা বিরোধী দুই খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৭ জেলার মধ্যে ১৪ জেলা সভাপতি ৬ দফার বিরোধীতা করে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে। কিন্তু কে এবং কিভাবে ৬ দফা রচনা সে রহস্যের আজও সমাধা হয়নি। পাকিস্তানের গোয়ান্দা বিভাগ ডিআইবি এটিকে সিআইয়ের চাল হিসাবে মনে করে। ভাষানীপন্থি ন্যাপও সেটিই মনে করে। সে সময় ঢাকায় মার্কিন কনস্যাল জেনারেল ছিলেন মিস্টার ব্রাউন। তিনি একই সাথে সিআইয়েরস্টেশন চীফেরও দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার সাথে শেখ মুজিব ও ছাত্রলীগের একাংশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সময় মার্কিন কনসালে আরেক কর্মকর্তা ছিলেন কর্নেল চিশহোস। চিশহোসের বাসায় মাঝে মাঝে পার্টি দেয়া হত। এসব পার্টিতে বাছাই করা রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতা ও পদস্থ বাঙালী কর্মকর্তাদেও দাওয়াত দেয়া হত। এভাবে একদিনে ভারতীয় র`এর তৎপরতা যেমন চরম আকার ধারণা করেছিল তেমনি তৎপরতা বেড়েছিল মার্কিন সিআইয়ের। পরে পাকিস্তান সরকার কর্নেল চিশহোসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এবং দেশ থেকে বহিষ্কার করে দেয়। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা এ,টি,এস,সফদর জানান,শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন তেজগাঁও বিমান বন্দরে লাহোরগামী বিমানে উঠার আগে ৬ দফা প্রস্তাবের একটি টাইপ করা কপি রুহুল কুদ্দুস নামে একজন সিএসপি অফিসার তার হাতে তুলে দেন। উল্লেখ্য যে রুহুল কুদ্দুস ছিলেন আগরতলা মামলার একজন আসামী এবং শেখ মুজিবের ইনার সার্কেলের লোক।-(মাসুদুল হক)।
সাপ্তাহিক মেঘনার (১৬/১২/৮৫) সাথে এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আব্দুল মালেক উকিল বলেন, ৬ দফা তিনি প্রথম দেখেন একটি টাইপকরা কাগজে শেখ মুজিবের পকেটে ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় কনভেনশনে যাওয়ার পথে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৬ দফা হলো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একাত্তরের ঘটনাবলী, পাকিস্তান ভাঙ্গা ও বাংলাদেশের সৃষ্টি - এসবের শুরু হয় মূলত ৬ দফা থেকে। অথচ এটির প্রণয়নে শেখ মুজিব নিজ দলের নেতাদের সাথেও কোনরূপ পরামর্শ করেননি। এটি প্রণয়নের প্রাক্কালে কোন দলীয় সম্মেলন বা পরামর্শ সভাও হয়নি। অথচ গণতান্ত্রিক রাজনীতির সেটিই প্রথাসিদ্ধ রীতি। কিন্তু সেটি প্রণিত হয় রুহুল কুদ্দুসের ন্যায় একজন সন্দেহভাজন চরিত্রের মানুষের দ্বারা যিনি বিদেশী শক্তির বিশ্বস্থ বন্ধুরূপে বহু পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিলেন।
কোন পরিকল্পনা যখন বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ রূপে আগায় তখন সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমুহ আর প্রকাশ্যে নেয়া হয় না। দেশবাসীকে ও দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সে প্রক্রিয়ায় জড়িত করা হয় না। এবং সেটি ৬ দফা প্রণয়নের সময় যেমন হয়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার সময়ও হয়নি। অথচ পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহিত হয়েছিল প্রকাশ্য জনসভায়। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে এ কথাগুলো নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। কোন প্রশ্নও তোলা হয়নি। অথচ ইতিহাস রচয়িতাদের দায়িত্ব হলো, এসব সিদ্ধান্তসমূহের গুঢ় রহস্যগুলি উদঘাটন করা। কারা ছিল নেপথ্যের নায়ক বা ভিলেন তাদের খুঁজে বের করা এবং সত্য থেকে মিথ্যাগুলোকে অতি সতর্কতার সাথে আলাদা করা। বাংলাদেশের ইতিহাসের লেখকদের দ্বারা একাজটিই হয়নি। তারা অতি পরিচিত মিথ্যাগুলোকেও বিনা প্রতিবাদে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করেছেন। রক্তক্ষয়ী একটি লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে র’এর কি ভূমিকা ছিল সে বিষয়ে আরো কিছু তথ্য দিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক অশোক রায়না তার “Inside RAW” বইতে। সেটি এরকমঃ...কিন্তু ততদিনে ভারতীয় এজেন্টরা পূর্ব পাকিস্তানের মুজিবপন্থী একটি অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আগরতলায় ১৯৬২-৬৩ সালে ভারতীয় এজেন্ট মুজিবপন্থীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পরবর্তী গৃহিত কার্যক্রম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কর্নেল মেনন ( ইনি হলেন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’এর দিল্লিস্থ পাকিস্তান ডেস্কের দায়িত্বশীল। তার আসল নাম কর্নেল শংকর নায়ার। মেনন তার ছদ্দ নাম) যিনি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী ও মুজিবপন্থী অংশের যোগাযোগ রক্ষাকারী ছিলেন। তিনি আগরতলা বৈঠকেরপর ইঙ্গিত পান যে, মুজিবপন্থী গ্রুপ আন্দোলন শুরু করার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব। কর্নেল মেনন তাদের এই বলে সতর্ক করে দেন যে,তার সঠিক ফলদায়ক সিদ্ধান্তে আসার সময় এখনো হয়নি।.. তারা অস্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে এবং ঢাকাস্থ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস অস্ত্রাগারে হামালা চালায়। কিন্তু এই প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আসলে এই পদক্ষেপ একটি ধ্বংসাত্মক ফলাফল ডেকে আনে, ঠিক যেরূপ কর্নেল মেনন ধারণা করেছিলেন। এর কয়েকমাস পর ৬ই জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার চক্রান্ত করার জন্য ২৮ জন পাকিস্তানীর বিচার করা হবে। শেখ মুজিবকেও বারদিন পর একজন দোষী হিসাবে জড়িত করা হয়। এই মামলাই পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে পরিচিত পায়।-(অশোকা রায়না, ১৯৯৬)
২৫শে মার্চের বহু পূর্ব থেকেই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’ মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। তাই যারা মনে করে পাকিস্তান আর্মির মিলিটারি এ্যাকশনের পরই মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় তাদের ধারণা আদৌ সত্য নয়। অশোক রায়না লিখেছেন, “কর্নেল মেননের অবিরাম ভ্রমন ও যোগাযোগের জন্য সীমান্তব্যাপী র’এর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং কর্নেল মেননের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরের প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের নিবিড় যোগাযোগ ঐ সমস্ত তরুণ,অবিশ্রান্ত ও উৎসর্গীকৃত গুপ্ত যোদ্ধাদের মনোবল দারুণ ভাবে বৃদ্ধি করে। ... ইতিমধ্যে যখন বিভিন্ন কেন্দ্র স্থাপন শেষ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের এজেন্টদের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়,তখনই সেই ভয়াবহ ‘কালো রাত্রী’(২৫ শে মার্চ)র পদধ্বনি শোনা যেতে থাকে।- (অশোক রায়না, ১৯৯৬)
Written by ফিরোজ মাহবুব কামাল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নবাদের পরিকল্পনা হয় ভারতে। এ ব্যাপারে শুধু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’এর কর্মকর্তারারই শুধু মুখ খুলেনি,মুখ খুলেছে বাংলাদেশের বহুনেতাও। যেমন এক কালের নেতা ও পরবর্তীতে জাতীয় লীগ নেতা জনাব অলি আহাদ বলেন, “১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানকালে ময়মনসিংহ নিবাসী রাজবন্দীদ্বয় আব্দুর রহমান সিদ্দিকী ও আবু সৈয়দের নিকট হইতে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষয়াদী অবগত হই। ভারতে মুদ্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ময়মনসিংহ ও বিভিন্ন জেলায় বিতরণকালেই তাহারা গ্রেফতার হইয়াছিলেন।”-(অলি আহাদ)। ইতিহাসের নামে যে মিথ্যাচারটি দেশ জুড়ে ছড়ানো হয়েছে তা হলো,পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের সৃষ্টি মূলত মুক্তিবাহিনীর অবদান। ভারতের নাম তারা সহজে মুখে আনতে চায় না। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশটি সৃষ্টির মূল কাজটি যে নেহায়েতই ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাজ -সে কথাটি ভারতীয় কতৃপক্ষও খুব একটা জোরে শোরে প্রচার করে না। তারা জানে সেটি প্রকাশ পেলে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মাঝেই শুধু নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ভারত ভিলেন রূপে চিত্রিত হবে। এজন্যই বাংলাদেশ সৃষ্ঠিকে তারা বাংলাদেশেীদের কাজ বলে চালিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সেটি তারা লুকাতে পারেনি। পাকিস্তান বাহিনী ও বিপুল সংখ্যক রাজাকারদের কারণে সে পরিকল্পনা সফল হতে পারেনি। মুক্তিবাহিনীর কাঁধে বন্দুক রেখে পাকিস্তান বাহিনী বা রাজাকারদের পরাজয় করা সম্ভব হয়নি। একাত্তরের শেষদিকে তাই স্বয়ং ভারতীয় বাহিনীকেই যুদ্ধে নামতে হয়েছে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালী ও পাকিস্তানীদের লড়াই না হয়ে পাকিস্তান ও ভারতের সরাসরি লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এ লড়ায়ে পাকিস্তানের পরাজয়ে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ। সেটি আরো পরিস্কার হয়, রেসকোর্সের ময়দানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল অরোরা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বভাগের কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীর মধ্যকার চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে।পাকবাহিনী এ চুক্তির মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
রেসকোর্সে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ওসমানীর উপস্থিতি ভারতীয় বাহিনীর কাছে যে কতটা অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক ছিল সেটির মোক্ষম দলিল হলো ১৬ই ডিসেম্বরের এ চুক্তি। ভারত তাই তার আগ্রাসী কদর্য চরিত্রটি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে লুকাতে চেয়েছিল সেটি সম্ভব হয়নি। মুসলিম বিশ্বের প্রায় কোন দেশই তাই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের কাছে বাংলাদেশ ছিল ভারতের অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তান।ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ এবং ভুট্টৌ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পরই তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে এগিয়ে আসে। তবে ১৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী যে সত্যটিকে লুকাতে পারিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে সেটিই সুপরিকল্পিত ভাবে লুকানো হচ্ছে। পাঠ্য পুস্তকে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারগণ কে কোথায় লড়াই করেছেন সে বিবরণ থাকলেও ভারতীয় বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য ও তার কমান্ডারগণ কে কোথায় কি ভাবে যুদ্ধ করলো তার সামান্য বিবরণও নেই। বিবরণ নেই ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর ভূমিকার। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে কোন উল্লেখ নেই সে যুদ্ধে কতজন ভারতীয় সৈন্য কোন কোন স্থানে প্রাণ দিয়েছে। তাই ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের যদি এতটা উৎসব করার কিছু থেকেই থাকে তবে তার জন্য কি জেনারেল অরোরাসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উচিত নয়? তারা না হলে কোন বাঙালী বীরের পক্ষে সম্ভব হত পাকিস্তানী সেনা বাহিনীকে পরাজিত করা?
প্রকৃত সত্য হলো, মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৯ মাসে পুরা বাংলাদেশ দূরে থাক একটি জেলা বা একটি মহকুমাও মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কোন জেলা শহরেই মুক্তিবাহিনীর কোন সদস্য প্রকাশ্যে দিবালোকে অস্ত্র হাতে ঘুরতে পারিনি। একাত্তরের মূল লড়াইটি লড়েছে ভারতীয় সেনা বাহিনী। তবে ভারত শুরু থেকেই একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার অপরাধ নিজ কাঁধে নিতে চায়নি। কারণ এটি আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ। একটি দেশের ভূগোলে কিভাবে পরিবর্তন আনতে হবে জাতিসংঘের বিধানে তার একটি বিধিবদ্ধ আইন আছে। সেটি কখনই কোন বিদেশী শক্তির আগ্রাসনের মাধ্যমে নয়। কিন্তু ভারত সে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। এজন্য যুদ্ধ চলা কালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের অধিকাংশ সদস্য পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার প্রতিসমর্থন জানিয়েছে। ভারতের পক্ষে থেকেছে রাশিয়া ও তার মিত্ররা।
ইতিহাসে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এ ভয়েই ভারত নিজেদের অর্থ,অস্ত্র ও লোকবল দ্বারা পাকিস্তান ভাঙ্গার এ যুদ্ধকে বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। লুকানোটি জরুরী ভেবেছে এ জন্য যে, পাকিস্তানের উপর ভারতের এমন আগ্রাসন অন্যদেরও বৈধতা দিবে ভারত-ভাঙ্গার কাজে অংশ নেয়ার। এজন্যই রেসকোর্সের ময়দানে জেনারেল ওসমানীকে শামিল করাটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলগণ অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক ভাবলেও ভারতীয় কূনীতিক বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে তা ছিল বড় রকমের ভুল। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কাঁধে বন্দুক রাখার ন্যায় তাঁর উপস্থিতিরও লোকদেখানো রাজনৈতিক প্রয়োজন ছিল। প্রখ্যাত ভারতীয় কূটনীতিবিদ এবং ভারতীয় ইনটেলিজেন্স এর সাবেক প্রধান Mr.J.N. Dixit তার রচিত “Liberation and Beyond” বইতে জেনারেল ওসমানীকে রেসকোর্সে শামিল না করাকে “major political mistake” বলে অভিহিত করেছেন। অতি সতর্কতার সাথে খুন করার পরও প্রায় সব খুনিই খুনের আলামত যেমন ঘটনা স্থলে রেখে যায়,তেমনি নিজ ঘর পর্যন্ত টেনে নেয়। তাই অপরাধ বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস,আন্তুরিক ভাবে সচেষ্ট হলে কোন খুনিই গ্রেফতার এবং সে সাথে খুনের বিচার থেকে রেহাই পেতে পারে না। রেসকোর্সের ময়দানে ভারত তার অপরাধ লুকাতে পারেনি। ভারতীয় আগ্রাসনের সে জঘন্য অপরাধ ভারতপন্থি বাংলাদেশেীরা যতই লুকানোর চেষ্ঠা করুক, হাজার হাজার বছর ধরে ভারত যে শুধু বাংলাদেশী মুসলমানদের কাছেই নয়,বিশ্বের মুসলমানদের চোখেও শত্রু রূপে চিহ্নিত হতে থাকবে তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে?
বাংলাদেশের সৃষ্টিতে “র”এর কর্মকর্তাগণ কি ভাবেন সেটি দেখা দরকার। ভারতীর গুপ্তচর সংস্থা “র”এর সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মিস্টার বি. রমন লিখেছেনঃ “The R&AW’s success in East Pakistan, which led to the birth of Bangladesh, would not have been possible without the leadership of Kao and the ideas of Nair,”-(B.Ramon, 2007)। মিস্টার বি. রমন যা লিখেছেন তা থেকে একথা সুস্পষ্ট, “র”এর দক্ষতা ও সফলতাই জন্ম দেয় বাংলাদেশের। এবং সেটি সম্ভব হয়েছে তৎকালীন “র”এর দায়িত্বশীল মি. কাউ ও মি নায়ারের ফলপ্রসু নেতৃত্ব ও পরিকল্পণার কারণে। বাংলাদেশের সেক্যিউলার পক্ষটি “র”এর ভূমিকার কথা মুখে আনে না। কারণ তারা নিজেরাও জানে এ সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেলে আজ হোক কাল মুসলিম ইতিহাসে তারা কুলাঙ্গার রূপে চিত্রিত হবেই। কারণ ভারতের ন্যায় একটি শত্রুদেশের গুপ্তচর সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টতা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্যই সুনাম বয়ে আনে না। যেসব ভারতীয়রা আজ কাশ্মীরে মুসলমাদের গণহত্যার নায়ক, তারাই একাত্তরে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে পাকিস্তানের লড়াই লড়েছিল। সে ভারতীয়রাই একাত্তরে আওয়ামী লীগের পক্ষে লড়াই লড়েছিল। অথচ সে ভারতীয়দের কথা আওয়ামী ঘরানার নেতা-কর্মীরা পারতো পক্ষে আজ মুখেই আনে না। বরং এটিকে একমাত্র নিজেদের অর্জন বলে অহংকার দেখায়। অথচ ভারতের ভুমিকাই ছিল চূড়ান্ত। এ ব্যাপারে মিস্টার বি. রমন তার বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’–তে লিখেছেনঃ “The IB (Intellegence Bureau) before 1968 & the R&AW thereafter had built up a network of relationship with many political leaders and government officials of East Pakistan. The networking enabled the R&AW and the leaders and officials of East Pakistan to quickly put in position the required infrastructure for a liberation struggle consisting of a parallel government with its own fighters trained by the Indian security forces and its own bureaucracy. .. The only sections of the local population, who were hostile to India and its agencies, were the Muslim migrants from Bihar.” -(B.Ramon,
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১১ দুপুর ১:১২